#রেড_রোজ (পর্ব ৮)
১.
আজ ছুটির দিন, সারাদিন কোনো কাজ নেই। ইদানিং ছুটির দিন এলেই রায়ানের হাঁসফাঁস লাগে। ভেবেছিল আজ লিয়ার সাথে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাবে। সেই মতো সব ঠিকঠাকও করা ছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে লিয়া ক্যানসেল করে, ওর বড় চাচা হঠাৎ করেই মারা গেছে কাল রাতে। রায়ান একবার ভেবেছিল আজ একা একাই ঘুরবে। কিন্তু আজ কোথাও যাওয়া হয়নি, সারাদিন ঘুমিয়েছে। ইদানিং রাতে ঘুম হয় না, আসলে আতংকে ঘুমোতে পারে না। ঘুমোতে গেলেই মনে হয় রয়ার অশরীরী আত্মা ওকে গলা চেপে ধরবে।
বিকেলের দিকে রায়ান ছাদে ওঠে। সারাদিন আজ একটা গুমোট আবহাওয়া ছিল, একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস আসছে। রায়ান ছাদের এক কোণে রাখা রকিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে। দুলতে দুলতে একটা কথা ভাবে। আজ ক’দিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে, যতই ভাবছে ততই ব্যাপারটা ওর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। গত এক মাস ধরে ওর সাথে যা হচ্ছে এসবই ওই পুলিশ অফিসারের কারসাজি। রয়ার সিম থেকে ফোন আসাতে একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে এটাও সম্ভব। ইদানীং সিম ক্লোন করে অনেক অপরাধ হচ্ছে। ভাবনাটা ভাবতেই ওর মনের দুর্ভাবনাটা কেটে যায়। একটা স্বস্তি বোধ করে। এই বেটা পুলিশ অফিসার ওর সাথে নার্ভের খেলায় নেমেছে। দেখা যাক, কে জেতে। রয়া ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু ও কিছুতেই ভাঙবে না।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই ফোন আসে। নিশ্চয়ই লিয়ার ফোন। রায়ান দ্রুত ফোন ধরতে যেয়ে হাত থেমে যায়, চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়, রয়ার ফোন। আজ, ইচ্ছামতো কথা শোনাবে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা পরিচিত গান শোনা যায় –
‘Tis the last rose of summer,
Left blooming alone.
All her lovely companions
Are faded and gone’
রায়ানের মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে, ওর পুরো পৃথিবী যেন দুলে ওঠে। ও কী ঠিক শুনছে? এ যে রয়ার গলা! এই গানটা রয়া প্রায়ই খালি গলায় শোনাত। এটা কী করে সম্ভব! বুকের ভেতর কেউ খামচে ধরে। কিছু বলতে যেয়েও পারে না, গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
ফোনটা কেটে যেতেই রায়ানের প্রথম যে কথাটা মনে হয় সেটা হলো রয়া বেঁচে আছে! কিন্তু সেটা কী করে? আচ্ছা, রয়া যেদিন মারা যায় সেদিন সাজিদের ফোন পেয়ে ও হাসপাতালে ছুটে যায়। ওর পৌঁছানোর আগেই রয়া মরে গিয়েছিল। ডাক্তার ওর মুখটা দেখতে দিতে চায়নি, সেটা নাকি দেখার অবস্থায় নেই। রায়ান জোর করেই দেখেছিল, মুখটা চেনা যাচ্ছিল না। আচ্ছা, ওই সাজিদ ওর সাথে কোনো ভয়ংকর খেলা খেলেনি তো? রয়া হয়তো মারা যায়নি। ওই সাজিদই কোথাও ওকে লুকিয়ে রেখেছে। কথাটা ভাবতেই রায়ানের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। তাহলে ওই সাজিদই ওকে ভয় দেখাচ্ছে! রাগে রায়ানের গা কিড়মিড় করে ওঠে। ব্যাপারটা এখনই ফয়সালা করতে হবে। রায়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে।
২.
এখন শরত কাল। আকাশ মন কেমন করা নীল। সেখানে প্রায়ই সাদা মেঘের ভেলা ভাসে। সাজিদ গুনগুন করে গান গাচ্ছিল –
“আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই– লুকোচুরি খেলা”
গান থামিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। আজ কতগুলো দিন পার হয়ে গেল রয়া নেই। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে। ওর জন্যই যে রয়া এমন বিপদের মুখে পড়ে গেল। ওর উচিত ছিল নিজেই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা। যে সম্পর্কের কোনো গন্তব্য নেই সেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কোনো মানেই যে নেই। মাঝখান দিয়ে রয়া মরে গেল, ওর জন্যই মরে গেল। কথাটা ভাবতেই একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরে ওকে। কিছু যদি করতে পারত, অন্তত রয়ার অদৃশ্য আততায়ী ধরা পড়ত। আচ্ছা, মেসেজগুলো কে দিত? মাঝে মাঝে মনে হয় রায়ান, সেটা ও পুলিশকে বলেছেও। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই। আচ্ছা ওরা কি তদন্তে হাল ছেড়ে দিল? এখন পর্যন্ত তো রায়ানকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি।
কথাটা যখন ভাবছিল ঠিক তখন কলিং বেল বাজে। সাজিদ চমকে ওঠে। এই ভর সন্ধ্যায় কে এল?
সাজিদ উঠে দরজা খুলতেই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, রায়ান! পাগলাটে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পায় সাজিদ, এক পা পিছিয়ে যেয়ে তোতলানো গলায় বলে, ‘তুই এখানে?’
রায়ান হিসহিসিয়ে বলে, ‘রয়া কই, কোথায় ওকে লুকিয়ে রেখেছিস, বল।’
সাজিদ চমকে ওঠে ওর কথা শুনে, হতভম্ব গলায় বলে, ‘এসব তুই কী বলছিস! রয়া তো মারা গেছে।’
রায়ান গর্জে ওঠে, ‘মিথ্যে কথা! ও বেঁচে আছে। বল, ও কোথায়?’
কথাটা বলে রায়ান ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর পুরো ঘর উলটোপালটা করে ফেলে। খাটের নিচে, ফলস ছাদে, সব জায়গায় পাগলের মতো খুঁজে দেখে। সারা গায়ে ধুলো, মাকড়াসার জাল মাখামাখি হয়ে যায়, সেদিকে এক বিন্দু খেয়াল নেই রায়ানের। হঠাৎ হারমোনিয়ামটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ায়, তারপর ছুটে গিয়ে হারমোনিয়ামটা শুন্যে তুলে সশব্দে আছড়ে নিচে ফেলে দেয়। ভেঙে যাওয়া হারমোনিয়ামের উপর সবটুকু জেদ, রাগ নিয়ে পাগলের মতো পা দিয়ে মাড়াতে থাকে।
সাজিদ ভয়ে কুঁকড়ে যায়, আতংকিত হয়ে দেখে ওর প্রিয় হারমোনিয়ামটা খন্ড বিখন্ড হয়ে এলোমেলো পড়ে আছে।
পায়ে পায়ে এবার রায়ান ওর দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এসে কলার চেপে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘রয়াকে তুই কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবি না। আমি তোকে দেখে নেব।’
কথাটা বলে ওকে ধাক্কা মেরে বের হয়ে যায়। সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা যায়। রাগের মাথায় লিফটেও উঠল না।
সাজিদ বিমূঢ় হয়ে ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
৩.
সেদিন রাতে রায়ান বহুদিন পর হুইস্কির বোতল খোলে। কিছুতেই মনের অস্থিরতা কমছে না। তিন পেগ খাওয়ার পরেই নেশা হতে থাকে। আজ যতক্ষণ পারে খাবে, রয়ার ভুতকে ভুলে থাকতে হবে।
ঠিক রাত বারোটার সময় একটা মেসেজ আসে। রায়ান পাগলাটে দৃষ্টিতে তাকায়, নিশ্চয়ই সেই ভুতুড়ে মেসেজ। তাকিয়ে দেখে লিয়ার মেসেজ। খুলতেই দেখে ওকে উইশ করে পাঠিয়েছে ‘হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার’।
রায়ানের হঠাৎই মনে হয় আজ ওর জন্মদিন। ও একদম ভুলেই গিয়েছিল। বাহ, এই মেয়েটা এই ক’দিনেই ওর সবকিছু মুখস্ত করে ফেলেছে। মনটা একটু ভালো হয়ে যায়। ওকে থ্যাংকস জানিয়ে ফিরতি মেসেজ দেয়। বার্থডে সেলিব্রেট করা যাক। এই উপলক্ষে আরও এক পেগ মেরে দেওয়া যাক।
রায়ান ক্রিস্টালের সুদৃশ্য গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ঘোলাটে চোখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে ওখানে ভুতুড়ে কোনো লেখা আছে কি না।
নেশাটা যখন প্রায় ধরে আসে ঠিক তখন ফোনটা আসে। নিশ্চয়ই লিয়ার ফোন, ওকে উইশ করবে হয়ত। খোশমেজাজে ফোন ধরতে যেতেই ওর হাত থেমে যায়। রয়ার ফোন! চোখ পিটপিট করে বার বার বোঝার চেষ্টা করে, ও ঠিক দেখছে নাকি। ভয়ে ভয়ে রায়ান ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে রয়ার রিনরিনে গলা পাওয়া যায়, ‘হ্যাপি বার্থডে রায়ান।’
রায়ান তোতলানো গলায় বলে, ‘ক্কে, কে?’
রয়ার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমাকে ভুলে গেলে রায়ান! আমার যে কবরের ভেতর একা একা খুব ভয় করে। তুমি কবে আসবে?’
রায়ানের নেশা ছুটে যায়, রয়ার গলা! রয়ার অশরীরী আত্মা কথা বলছে? ও ঢোক গিলে বলে, ‘আমি কেন আসব। তুমি মরে গেছ, তুমি থাকবে ওখানে।’
ওপাশে একটা নীরবতা নামে। একটু পর করুণ গলায় বলে, ‘আমাকে তুমি মেরে ফেললে রায়ান? সেদিন ফোনে তোমার গলা আমি চিনে ফেলেছিলাম, তাই তো অমন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। কেন এমন করলে রায়ান?’
রায়ান এবার ক্ষিপ্ত গলায় বলে, ‘খুব ভালো করেছি। হ্যাঁ, আমিই তোমাকে মেসেজ দিতাম, ভয় দেখাতাম। তুমি ওই সাজিদের সাথে প্রেম করবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব?’
রয়া অনুতাপের গলায় বলে, ‘আমার খুব ভুল হয়েছে। তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে।’
রায়ান হিসহিসিয়ে বলে, ‘এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দেব? তোমার শাস্তি তো পেতেই হতো। এখন চুপচাপ কবরে শুয়ে থাকো।’
রয়ার উত্তেজিত গলা পাওয়া যায়, ‘আমি পুলিশকে সব বলে দেব। তুমিই আমাকে ফোনে ভয় দেখাতে। তোমার লুকিয়ে রাখা মোবাইলের কথাও বলে দেব।’
রায়ান থমকে যায়, তারপর হা হা করে হেসে বলে, ‘মৃত মানুষের কথা কেউ বিশ্বাস করে না।’
ওপাশ থেকে রয়ার ফিসফিস শব্দ শোনা যায়, ‘আমি ছাড়ব না তোমাকে।’
ফোনটা কেটে যায়। রায়ান খ্যাপাটে দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আচ্ছা, রয়া অমন ইংরেজিতে কথা বলছিল কেন? অবশ্য রেগে গেলে রয়া ইংরেজিতে কথা বলত। একটা ধন্দে পড়ে যায় রায়ান। সত্যিই কি কোনো ফোন এসেছিল? নাকি নেশাটা বেশি হয়ে গেছে? আরেক পেগ ঢালে, আজ সারারাত খাবে।
রাত বাড়ে, সেই সাথে নেশার পারদ চড়তে থাকে। ইকবাল রোডের সেই বাসাটায় রায়ানকে একটু পর পর বিড়বিড় করে বলতে শোনা যায়, রয়া, তুমি কবরেই চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমাকে জ্বালাতে এসো না।
পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙে রায়ানের। মাথা ব্যথা করছে, সেই সাথে সারা শরীরে ব্যথা। আজকেও অফিসে যাওয়া হবে না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অফিসে মেসেজ করে দেয়, আজ যাবে না। কি মনে হতে একবার কল লিস্ট দেখে, রয়ার নামটা জ্বলজ্বল করছে। তারমানে রয়ার কল এসেছিল, আর কথাও হয়েছিল! ভেবেছিল কালকের ঘটনা পুরোটাই ওর নেশার ঘোরে উল্টোপাল্টা কল্পনা।
হঠাৎ করেই রায়ানের কেমন শীত লাগতে থাকে। এই অশরীরী আত্মার হাত থেকে ওর মুক্তি নেই। একটা কথা মনে হতেই হঠাৎ ওর ভয় করতে থাকে। আচ্ছা, ওই অশরীরী আত্মা সত্যিই যদি বলে দেয় মোবাইলের কথা? ইশ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। মোবাইলটা কোনো পুকুরে বা নদীতে ফেলে দিলেই হতো। তখন প্রতিশোধের আগুনে ও পুড়ছিল, তাই অমন একটা কান্ড করা। নাহ, মোবাইলটা সরিয়ে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি। যদিও আত্মা কথা বলতে পারে না, কিন্তু নিজেকে এখন কিছুতেই নিরাপদ লাগছে না। মোবাইলটা এবার টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে হবে।
৪.
হাফিজ পুলিশের একটা টিম নিয়ে আজ সকাল থেকে ইকবাল রোডে পাহারা দিচ্ছে। কেউ ভ্যানে সবজি বিক্রি করছে, কেউ ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিকেল হয়ে গেল অথচ এই রায়ান ব্যাটার বাসা থেকে বের হবার কোন খবরই নেই।
হাফিজ সন্ধ্যা নাগাদ বিরক্ত হয়ে রাহাতকে ফোন করে, ‘বস, আমাদের ফাঁদে মনে হয় না রায়ান পা দিয়েছে। আর অপেক্ষার কি দরকার, ও যে রয়াকে ভয় দেখিয়ে ফোন করত তার রেকর্ডিং তো আছেই। আদালতে এর চেয়ে বড় প্রমাণের আর কিছু আছে?’
রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘তা হয়ত নেই। কিন্তু আমি অর্ধেক কাজ করতে পছন্দ করি না। এই কেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হলো মোবাইলটাসহ ওকে হাতেনাতে ধরা। আজ রাত দেখব, তারপর ভাবব কি করা যায়।’
হাফিজ একটু বিরক্ত হয়, কিন্তু জানে স্যার ঠিক কথাই বলেছেন।
রাত বারোটা সময় রায়ানের রেড ওয়াইন কালারের প্রিমিও গাড়িটা বের হতে দেখা যায়, হাফিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দ্রুত রাহাতকে খবরটা জানিয়েই ওরা যে যার মতো দুটো মোটরসাইকেলে চারজন পিছু নেয়। রাহাত ওদের সতর্ক করে দিয়ে বলে, ‘তোমরা খুব সাবধানে পিছু নিও। রায়ান কিন্তু ভীষণ ধূর্ত, কোনোভাবেই যেন বুঝতে না পারে কেউ পিছু নিয়েছে।’
হাফিজ আশ্বস্ত করে বলে, ‘স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা এর মাঝে কয়েকবারই আমাদের বেশভূষা চেঞ্জ করেছি। ও বুঝতেই পারবে না কিছু।’
গাড়িটা প্রথমে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। হাফিজ সবাইকে সতর্ক করে, রায়ান ইচ্ছে করেই এমন করছে। নিশ্চিত হয়ে নিতে চায়, কেউ পিছু নিয়েছে কি না। একটা সময় পর গাড়িটা চলতে চলতে শহরের এক কোণে গিয়ে থামে। ওরা অবাক হয়ে খেয়াল করে এটা একটা কবরস্থান, রয়াকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে। হাফিজ চাপা গলায় রাহাতকে ফোনে জানাতেই ওপাশ থেকে রাহাত সতর্ক করে দিয়ে বলে, ‘তোমরা ওর উপর নজর রাখো। মনে হচ্ছে ও রয়ার কবরেই যাবে। হয়ত ওখানেই মোবাইল লুকিয়ে রেখেছে। একদম হাতেনাতে ধরবে। আমি প্রায় চলে এসেছি।’
এলাকাটা নির্জন। রাত অনেক এখন, একটা বেজে গেছে। হাফিজ ওর সহযোগীদের নিয়ে সন্তর্পণে রায়ানের পিছু নেয়। ওরা নিরাপদ দূরত্ব রেখেই অবস্থান নেয়। রায়ানকে দেখা যাচ্ছে, হাতে একটা শাবল। উবু হয়ে কি যেন একটা রাখল। এদিক ওদিক একবার তাকায় রায়ান, তারপর নিচু হয়ে বসে মাটি খুড়তে থাকে। উত্তেজনায় হাফিজের বুক ধুকপুক করতে থাকে। রাহাত স্যার তো ঠিকই বলেছেন। স্যারের মতো ও কোনোদিনই ভাবতে পারে না। মনটা একটু খারাপ হয়।
ঠিক এই সময় হাফিজের ফোনে রাহাত স্যারের ফোন আসতেই হাফিজ তাড়াহুড়ো করে ফোন সাইলেন্ট করে। ইশ, একদম ভুলে গেছে। জোরে ঠোঁট কামড়ে ও ভালো করে রায়ানকে খেয়াল করে, নাহ, বেটা পেছন ফিরে তাকায়নি। হয়ত এত দূর থেকে মোবাইলের শব্দ শুনতে পায়নি। তারপরও নিজের বোকামিতে নিজেরই রাগ হয়, নিজেকে কষে একটা গালি দেয়। তারপর অনেকখানি পিছিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে রাহাতকে ওর অবস্থানটা জানায়।
একটু পরেই রাহাতকে দেখা যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হাফিজ আঙুল তুলে রয়ার কবরটা দেখায়। রাহাত চোখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে, রায়ান কি করছে। নিশ্চয়ই মোবাইলটা বের করছে। লোকটা এত নিষ্ঠুর! রয়াকে যে ফোন দিয়ে ভয় দেখাত সেটা ওর কবরেই লুকিয়ে রেখেছে? এতটা প্রতিশোধপরায়ণ! আজ একে হাতেনাতে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা ও করবেই। রাহাতের মুখের পেশি শক্ত হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও রায়ান যখন উঠে না, তখন সন্দেহ হয়। কি করছে রায়ান এতক্ষণ ধরে? এখন তো মাটিও খুড়ছে না। নাকি ইতোমধ্যে মোবাইলটা বের করে ফেলেছে? হায় হায়, ফোনটা যদি ভেঙে ফেলে? কথাটা মনে হতেই আর দেরি করে না, রাহাত ওদের এগোতে বলে।
রাহাতসহ ওরা পাঁচজন পা টিপে টিপে কাছে আসে, তারপর একসাথে দু’টো জোরালো টর্চের আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু রায়ান একবার ফিরেও তাকায় না ওদের দিকে। ওরা হতভম্ব হয়ে খেয়াল করে রায়ান যত্নের সাথে একটা গোলাপের গাছ লাগাচ্ছে, আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।
রাহাত উবু হয়ে বসে, কাছে গিয়ে কান পেতে শোনে, রায়ান বিড়বিড় করে দ্য লাস্ট রোজ গানটা গাইছে
‘Tis the last rose of summer,
Left blooming alone.
All her lovely companions
Are faded and gone’
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৯/০৩/২০২৩