রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন

#রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

অগ্রহায়নের শেষের দিক। বাতাসে পৌষের ঠান্ডা স্পর্শ। স্পৃহাদের গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দেবকাঞ্চন গাছের মাথা ভর্তি লাল রঙা ফুল। সামনের রাস্তার উপর ঝুঁকে পড়া ডালটা যেন বিনয়ে নত হওয়া আস্ত এক রূপকথা। বাড়ির ফটকের সরু পাকা রাস্তাটায় বিছানো দেবকাঞ্চন ফুলের রঙিন বিছানা। জুতোগুলো হাতে নিয়ে দেবকাঞ্চন ফুলের ওপর আলতো পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম আমি। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঝরে পড়া ফুলের ডগায় ডগায় স্নিগ্ধ শিশিরের ভীড় জমেছে। শিশির ভেজা নরম ফুলে খালি পা জুড়া রাখতেই অদ্ভূত ভালো লাগায় শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্পৃহা তাদের দোতালা বাড়িটার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো। একহাতে আমার ব্যাগ আর অন্যহাতে মুঠোফোনে প্রেমিকার কানে মিষ্টিবুলির ঝড় উঠাচ্ছিল।

‘ আজ কিন্তু তুই থেকে গেলেই পারতি রোদু। থেকে যা না প্লিজ।’

স্পৃহার কন্ঠে ফিরে তাকালাম আমি। ততক্ষণে মুঠোফোনটা কান থেকে নামিয়ে বারান্দা থেকে সরু রাস্তায় নেমে এসেছে স্পৃহা। আমি হালকা হেসে হাওয়ায় লাফিয়ে উঠে ঝুঁকে পড়া দেবকাঞ্চনের ডালটা ধরার চেষ্টা করলাম। দু’একটা ফুল মুঠোবদ্ধ করে নিয়ে কানের পাশে গুঁজলাম। খানিকটা রাজকীয় ভাব নিয়ে বললাম,

‘ হেই বিউটিফুল লেডি! বলো তো আমায় কেমন লাগছে?’

স্পৃহা নিরস গলায় বলল,

‘ একদম ভূতের মতো।’

আমি মুখ ভেঙিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। স্পৃহা আমার পাশে বসতে বসতে বলল,

‘ থেকে যা না প্লিজ। আজ বাবা বাড়ি নেই, রাতে অনেক মজা হবে। তাছাড়া, পড়াগুলোও কমপ্লিট করে ফেলব দু’জনে মিলে। প্লিজ প্লিজ।’

আমি সরু চোখে তাকিয়ে জারি দিয়ে বললাম,

‘ একটু আগে অপমান করে এখন থাকতে বলছিস? থাকব না আমি।’

স্পৃহা হেসে ফেলে বলল,

‘ যা! অপমান তুলে নিলাম। তোকে একদম অচীনপুরের রাজকন্যার মতো লাগছে। এই রূপের বাণে রাজকুমারের মৃত্যু আজ নিশ্চিত। ‘

আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,

‘ একদম মজা করবি না আমার সাথে। এই ভাইয়াটা যে কেন এখনও আসছে না। একমাত্র ওর জন্য এই ম্যানহলের গার্লফ্রেন্ডের সাথে বসে পকপক করতে হচ্ছে।’

‘ এহ্ আমার বয়ফ্রেন্ড ম্যানহল হলে তোর জামাই হবে বুড়িগঙ্গা নদী। ইয়াক! এখনই গন্ধ আসছে নাকে।’

স্পৃহার উত্তরের প্রেক্ষিতে কিছু বলব তার আগেই চোখ কুঁচকাল স্পৃহা। গেইটের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,

‘ রোদু? ওইটা শুভ্র ভাই না?’

স্পৃহার কথায় উঠে দাঁড়ালাম আমি। রাস্তার ওপাশে উঁকি দিয়ে কপাল কুঁচকালাম। স্পৃহা জামা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,

‘ তোকেই নিতে এসেছে বোধহয়।’

আমি অবিশ্বাস্যের স্বরে বললাম,

‘ ধুর! আমাকে কেন নিতে আসবে? ভাইয়ার আসার কথা ছিলো তো। আর উনি…’

আমার কথার মাঝেই ফোন বাজল। বহু কসরতে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কানে নিতেই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলেন আম্মু,

‘ তুই নিচে নাম রোদু। শুভ্র স্পৃহাদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। জলদি নিচে নাম।’

আমি কপাল কুঁচকে বললাম,

‘ আশ্চর্য! তোমার ভাইয়ের ছেলে স্পৃহার বাসার সামনে কি করে? তোমার নিজের ছেলে নাই? মেয়েকে নিতে অন্যের ছেলে ধার করে আনা কেন, শুনি?’

আম্মু অবাক হয়ে বলল,

‘ অন্যের ছেলে মানে কি? শুভ্র কি আমাদের পর? তোদের কাছে তো পর লাগবেই। ও তো আমার ভাইয়ের ছেলে। তোর ফুপ্পিদের ছেলে হলে না হতো তোদের নিজের মানুষ। আমার বাপের বাড়ির মানুষকে তোর বাবারও সহ্য হবে না, তোদেরও না।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ উফ্ মা! তোমার ভাই, আমার ভাই স্লোগানটা বন্ধ করে আমার ভাইকে পাঠাও। আমি শুভ্র ভাইয়ের সাথে যাব না, ব্যস।’

‘ কেন আসবি না? শুভ্র তোকে করেছেটা কি? সে তোর সাথে কোনোরকম মিসবিহেভ করেছে?’

আমি আগলা গলায় বললাম,

‘ শুভ্র ভাই সারা জীবনই আমার সাথে মিসবিহেভ করে মা। এটা নতুন কিছু না। উনার ধারণা পৃথিবীতে সবচেয়ে ফাজিল আর বেয়াদব মেয়ে হলাম আমি। আমাকে দিনরাত থাপড়াইয়া ঠিক করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে সাগরে ভেসে যাব আমি।’

আম্মু স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘ খারাপ তো কিছু বলে নি। তুই আসলেই বেয়াদব হচ্ছিস দিন দিন। এখন এসব আশেপাশের কথা বন্ধ করে শুভ্র নিচে দাঁড়িয়ে আছে নিচে নাম।’

‘ ভাইয়াকে পাঠালে কি হতো?’

‘ তোর ভাইয়ার মাথা ব্যাথা। টেবলেট খেয়ে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আলিফ বলল শুভ্র সার্কিট হাউজের আশেপাশেই টিউশনি করাতে গিয়েছে। তাই ওকে ফোন দিয়ে আসার সময় তোকে সাথে আনতে বললাম। ছেলেটা কি লক্ষ্মী আর তোরা ওকে পছন্দ করিস না।’

আমি ফোন কাটলাম। আম্মুর পরের লাইনগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে আমার। সেই কথাগুলো এখন শুধু বিরক্ত নয়। বিরক্তর থেকেও অনেক উপরের কিছু বলে বোধ হয়। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে স্পৃহার হাত থেকে ব্যাগটা নিতেই হাসি হাসিমুখে বলে উঠল স্পৃহা,

‘ এত্তো কিউট একটা কাজিনের সাথে যেতে কারো প্রবলেম হতে পারে জানা ছিলো না। যদিও শুভ্র ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও রাস্তার মানুষ তো আর জানে না।’

কথাটা বলে চোখ টিপলো স্পৃহা। আমি সরু চোখে ওর দিকে তাকালাম। মুখ ঝামটি দিয়ে বললাম,

‘ অশ্লীল।’

স্পৃহা হেসে ফেলল। দু’জনেই বারান্দা থেকে নেমে সরু রাস্তা ধরে হাঁটা দিলাম। গেইট পেরিয়ে স্পৃহাকে বিদায় দিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়ার পরও দৃষ্টি ফেরালেন না শুভ্র ভাই। কয়েক সেকেন্ড পর হালকা কেশে অন্যদিকে তাকালেন। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা দিলাম। শুভ্র ভাই আমার পেছন পেছন হাঁটছেন। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রাস্তার পাশের ফার্নিচারের দোকানের গ্লাসে শুভ্র ভাইকে চোখ পড়ল। উনি হাঁটার তালে তালে নিমগ্ন চিত্তে ফোন চাপছেন। ছাই রঙের শার্ট আর অফ হোয়াইট জিন্সে সুন্দর লাগছে উনাকে। ঘড়ি পরা বামহাতটা দিয়ে যখন কপালের চুল সরিয়ে অসচেতন চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন তখন এই সুন্দর লাগাটা যেন বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফার্নিচারের দোকানটা পাশ কাটিয়ে খানিকটা এগুতেই একটা টং দোকান চোখে পড়ল। সেই টং দোকানে কয়েকজন ছেলে দল বেঁধে চা খাচ্ছে। আরেকটু এগুতেই ছেলেদের কয়েকটাকে চিনতে পারলাম আমি। এই ছেলেগুলো হাইস্কুলে থাকতে আমাদের সাথেই ব্যাচে পড়ত। প্রত্যেকটা মেয়েকে ভাবি, বউ হেনতেন নাম দিয়ে প্রাইভেটের পরিবেশের ইন্না-লিল্লাহ করে ছাড়ত। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কোনো একভাবে ছেলেগুলোর চোখে পড়ে গেলাম আমি। সাথে সাথেই নিজেদের মধ্যে ফুসফাস করে হৈহৈ করে উঠল ওরা। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। ফোন স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালেন। চায়ের স্টলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ এই তুই সাকিব না? তোর পাশেরটা কে? জিহাদ, আসাদ?’

ছেলেগুলো মুহূর্তেই নীরব হয়ে গেল। সাকিব নামক ছেলেটি মাথা চুলকে বলল,

‘ ভাইয়া, কই গেছিলেন?’

শুভ্র ভাই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ডান চোখের ভ্রু টা উঁচু করে বললেন,

‘ ছোয়াতকে পড়াতে গিয়েছিলাম। তোরা এই সময়ে এখানে কি করছিস? সমস্যা কি?’

তাদের মধ্যে থেকে একজন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,

‘ কোনো সমস্যা নাই ভাই। আসলে পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল তাই মামার দোকানের চা খাইতে আসছি।’

শুভ্র ভাই মাথা দুলিয়ে বললেন,

‘ গুড গুড। এভাবে জ্যাম লাগতে থাকলে এডমিশনও সাকসেসফুলি জ্যাম লাগবে ইনশাআল্লাহ। এই সাকিব? আংকেলকে বলে দিস নেক্সট উইক থেকে তোদের আর পড়াচ্ছি না।’

সাকিব ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

‘ কেন ভাই?’

শুভ্র ভাইয়ের সহজ উত্তর,

‘ পড়াতে ইচ্ছে করছে না তাই।’

‘ ভাই আব্বায় বিশ্বাস করবো না। নির্ঘাত ভাববো কিছু একটা পুন্টামি করছি।’

শুভ্র ভাই আমাকে ইশারা করে বললেন,

‘ রাস্তায় মেয়েদের সাথে ফাজলামো করা কি খুব ভালো কাজ? আংকেলকে বলবি আমায় ফোন দিতে।’

‘ সরি ভাই। রোদরে নিয়ে কিছু বলি নাই, কসম। আমরা তো গল্প করতেছিলাম। আব্বারে কিছু বইলেন না। সরি ভাই। রোদ বইন সরি, হ্যাঁ?’

শুভ্র ভাই একটা রিকশা ডাকলেন। আমি রিকশায় উঠে বসতেই পাশে এসে বসলেন উনি। সাকিব গলা উঁচু করে বলল,

‘ সোমবারে পড়াতে আসবেন না ভাই?’

শুভ্র ভাই পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললেন,

‘ তোদের ব্যাচ ক্যান্সেল। মামা চলো।’

রিকশা ছুটলো। সাকিবের চোখ-মুখের অসহায় ভাব দেখে এতোদিনের জমিয়ে রাখা ক্ষোভে কিছুটা শীতল পরশ খেলে গেলো। তবে, মনের আনন্দটা বেশিক্ষণ টিকলো না। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, চারপাশের মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত চোখে দেখছে আমায়। একটা ছেলে তো রীতিমতো বাইক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। আমার শরীরে রাজ্যের অস্বস্তি ভর করলো। হাত বাড়িয়ে কানের পাশে গুঁজে রাখা ফুলগুলো খুলে আনলাম। তাতেও খুব একটা সুবিধা হলো না। তাকিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কোনো অংশে কমছে না। আমি আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাল। উনি গভীর মনোযোগে ফোন ঘাটছেন। আমি মৃদু গলায় ডাকলাম,

‘শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই ক্ষীণ গলায় জবাব দিলেন,

‘ হু।’

‘আমার দিকে তাকান।’

শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকালেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

‘ কেন? তোর দিকে তাকাতে হবে কেন?’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ তাকাতে বলেছি, তাকাবেন। ব্যস। এতো প্রশ্ন করছেন কেন?’

শুভ্র ভাই আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন,

‘ তুই বললেই তাকাতে হবে? আমার চোখকে কি তুই টেক্স দিস, তাকাতে বলবি আর ফট করে তাকিয়ে ফেলব? বাপের মতো সুবিধাভোগী একটা।’

আমি রাগে চোখ-মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম। মাথায় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন ঘুরছে, এই মুহুর্তে এই লোকটাকে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কি সে মারা যাবে? মারা না গেলে ধাক্কা দেওয়া যেতে পারে। আমি শক্ত গলায় বললাম,

‘খবরদার আব্বুকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বলেছেন তো। আর আমি মোটেও আব্বুর মতো হই নি। সবাই বলে, আমি আম্মুর মতো হয়েছি।’

আমার কথায় শুভ্র ভাই হেসে কুটিকুটি। উনার হাসির ধামক দেখে মনে হচ্ছে, হাসতে হাসতে রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়লেও তার বিশেষ একটা আফসোস থাকবে না। শুভ্র ভাই কোনোরকম হাসি থামিয়ে বললেন,

-‘ তুই ফুপ্পির মতো? ভেরি ফানি! শোন, আমার ফুপ্পি হলো আমাদের ময়মনসিংহের রক্ত, খাঁটি সোনা। আমার ফুপ্পির মতো রূপবতী আর গুণবতী হতে চাইলে তোকে আরো দশবার জন্মাতে হবে। তবুও হতে পারবি কিনা সন্দেহ। তোর জন্য তোর বাপই পার্ফেক্ট। দুইটাই সেইম সেইম…. এক নাম্বারের ধান্দাবাজ।’

আমার রাগটা এবার আকাশ ছুঁলো। আমাকে যেনতেন আব্বুকে ধান্দাবাজ বলার অপরাধে এই বিরক্তকর লোকটিকে রিকশা থেকে ফেলা দেওয়া যেতেই পারে। শুধু রিকশা থেকে ফেলা দেওয়া নয় এর থেকেও ভয়ানক কোনো শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি তাকাবেন?’

শুভ্র ভাই হুট করেই তাকালেন। আমার চোখে চোখ রেখে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলেন। রিকশার সরু সিটে পাশাপাশি বসে আছি দুজনে। সন্ধ্যার হলদেটে আলো এসে পড়ছে উনার গালে, ঠোঁটে। রিকশার ঝাঁকিতে উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে ছুটোছুটি করছে। ভারী পাঁপড়িতে ঢাকা চোখদুটোতে কোনো এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য হানা দিয়েছে। আমার চোখে মুগ্ধতা। ঘোর লাগা চোখদুটোতে পলক পড়ার বিরতিটাও যেন সইছে না। শুভ্র ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

‘তাকালাম। তারপর?’

উনার কথায় চোখদুটোতে পলক পড়ল। অদ্ভুত ঘোরটা ভেঙে টুকরো হলো। কন্ঠটা আরো খানিকটা নিচু করে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

‘ এভ্রিথিং ইজ ওকে?’

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ মানে?’

‘ মানে, আমার সব ঠিকঠাক আছে?’

‘ তোর সব ঠিকঠাক আছে, মানে? ঠাডায় একটা চড় লাগাবো বেয়াদব। বাপের মতো ঘুরাই পেঁচাই কথা বলিস কেন? কি বলতে চাস ডিরেক্ট বল। বাপ মেয়ে এক টাইপ, সুযোগ পেলেই আমার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পায়তারা করিস। তোদের তো পৃথিবীতে থাকতে দেওয়াটাই মহাপাপ। তোরা হলি পৃথিবীর বাইরের মানুষ। ঘুরন্তি মানব। তোদের থাকতে হবে পৃথিবীর বাইরে। মহাকাশে ঝুলাঝুলি করাই তোদের কাজ।’

আমি দাঁত কিরমির করে উনার দিকে তাকালাম। চোখে আস্ত একটা আগ্নেয়গিরি পুরে নিয়ে শক্ত গলায় বললাম,

‘ আপনি যে একটা অসহ্য ধরনের মানুষ তা কি আপনি জানেন? কথায় কথায় আমার আব্বুকে না টানলে চলছে না আপনার?’

শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘ আমি কথায় কথায় তোর বাপকে টানি? আমি? তোর বাপ কি দেশের প্রেসিডেন্ট নাকি যে তাকে নিয়ে নাচানাচি, টানাটানি করতে হবে? আমি কথা বলা শুরু করলে তোর ধান্ধাবাজ বাপ অটোমেটিকলি আমার এক্সামপলে চলে আসে। তাকে নিয়ে টানাটানি করার সময় আছে নাকি আমার?’

আমি চোখ-মুখ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। কন্ঠে কম্পিত রাগ নিয়ে বললাম,

‘ হাহ্! আরেকবার যদি ‘তোর বাপ’ ‘তোর বাপ’ করে আমার আব্বুকে অপমান করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেব। তারপর নায়ক উমর সানির মতো স্মৃতি হারিয়ে সারাজীবন ‘আমেনার মা’ ‘আমেনার মা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতেই জীবন কেটে যাবে। ল্যাংড়া ট্যাংরাও হয়ে যেতে পারেন। হু নোস?’

শুভ্র ভাই চোখ বড় বড় করে তাকালেন। অত্যন্ত দুঃখী কন্ঠে বললেন,

‘ তুই তো সাংঘাতিক ধরনের ফাজিল মেয়ে। দি শুভ্র অর্থাৎ এত্তো এত্তো মেয়ের ক্রাশকে তুই রিকশা থেকে ফেলে ল্যাংড়া বানিয়ে দিতে চাইছিস? নির্লজ্জর মতো ল্যাংড়ার সাথে আবার ট্যাংরাও লাগিয়ে দিচ্ছিস! কি সাংঘাতিক!’

আমি খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম,

‘ এখানে সাংঘাতিকের কিছু নেই শুভ্র ভাই। আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়াটা কখনোই সাংঘাতিকের পর্যায়ে পৌঁছায় না। আর কি যেন বলছিলেন? ক্রাশ? হাহ্! এটা নির্ঘাত আপনার দিবাস্বপ্ন শুভ্র ভাই। কোনো মেয়ের মাথায় সামান্যতম ঘিলু থাকলেও সে আপনার উপর ক্রাশ খাবে না। তবে পাবনায় এডমিটকৃত মেয়েরা খেতেই পারে। আপনার যা অবস্থা, কিছুই অসম্ভব না।’

শুভ্র ভাই বাঁকা হেসে বললেন,

‘ এইতো আবারও প্রমাণ দিয়ে দিলি তোর বাপের মতো তোর বুদ্ধিও হাঁটুতে। নয়তো এমন উদ্ভট কথা কখনোই বলতি না তুই। আমার আশেপাশের সব মেয়েরা যে আমার ওপর ফ্ল্যাট তা তো দেখেই বুঝা যায়। তবে, হাঁটুতে মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুরা মানুষের পক্ষে তা বোঝা খানিকটা দুষ্কর।’

আমি চোখে- মুখে থমথমে ভাব নিয়ে বসে রইলাম। উনি আবারও আমাকে অপমান করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। চালাচ্ছেন বলে ভুল হবে ইতোমধ্যে অপমান করে ফেলেছেন। আমি কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা ভাবনা করে বললাম,

‘ আপনার ধারণা আপনার আশেপাশের সব মেয়েরা আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?’

শুভ্র ভাই ভারি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,

‘ অবশ্যই।’

‘ কই আপুর মাঝেও তো আপনার উপর হাবুডুবু খাওয়া টাইপ কোনো আচরণ চোখে পড়ল না। তাহলে আপনার প্রেমে আসলে পড়লটা কে? আমি তো দূর-দূরান্তে প্রেমে ডোবা কাউকে দেখছি না শুভ্র ভাই।’

‘ নাউজুবিল্লাহ। রুহি আমার বোন হয়। আমার একমাত্র ফুপ্পির একমাত্র মেয়ে। ও আমার প্রেমে হাবুডুবু কেন খাবে? তোর চিন্তা-ভাবনা যে এতোটা কলুষিত তা আমার ধারণাতেই ছিলো না।’

উনার কথায় মুখটা অটোমেটিক ‘হা’ হয়ে গেলো আমার। চোখ পিটপিট করে তাকালাম। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললাম,

‘ একমাত্র! তো? আমি কে? আমি কি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছি নাকি?’

শুভ্র ভাই স্বাভাবিক মুখভঙ্গি নিয়ে বললেন,

‘ আকাশ থেকে টুপ করে কেন পড়বি? তোকে যে নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছিলো, বলেছিলাম না? আর যায় হোক, কোনো কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে তো আর বোনের পরিচয় দেওয়া যায় না। দুনিয়া উল্টো গেলেও তুই আমার বোনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবি না। নো, নেভার।’

শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝেই কিছু প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষান্ত হলাম আমি। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ছেলে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন তো হাত দিয়ে ইশারাও করছে। ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আগের অস্বস্তিটা যেন আবারও দানা বাঁধলো। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম,

‘ মেয়েদের মতো ঝগড়া না করে আমার সব ঠিক আছে কিনা দেখুন তো।’

শুভ্র ভাই আমার কথাটা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘ কি দেখবো?’

‘ আমার ড্রেসআপ সব ঠিক আছে কিনা সেটা দেখতে বলছি। রাস্তার ছেলেরা কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।’

শুভ্র ভাইয়ের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,

‘ তাকিয়ে আছে নাকি?কই? কে তাকিয়ে আছে?’

‘ উফ! এতো কথা কেন বলেন আপনি? আপনাকে যা বলতে বলেছি তা বলুন। ইজ এভ্রিথিং ওকে?’

শুভ্র ভাই দুই হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমার থেকে খানিকটা দূরে সরে বসলেন। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নিরক্ষণ করে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,

‘ আশ্চর্য! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

শুভ্র ভাই নরম গলায় বললেন,

‘ কিভাবে তাকিয়ে আছি?’

‘ খুবই বাজে ভাবে তাকিয়ে আছেন।’

শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

‘ আমার এই বাজে ভাবে তাকানোই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মেয়েরা। কিন্তু আফসোস! কারো দিকে তাকাতে পারি না।’

উনার কথায় রাগটাকে গিলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘ কেন? আপনার চোখ দুটো কি কেউ বেঁধে রেখেছে? তাকালে তাকাবেন মানা করেছে কে?’

শুভ্র ভাই আফসোসের সুরে বললেন,

‘ মানা করে নি মানে? আরে, পারমিশমই তো দিচ্ছে না। আমার মা আর আমার মন দুজনে মিলে আমার চোখদুটোকে এমনভাবে আটকে দিয়েছে এখন আর একজন ছাড়া অন্য কাউকে চোখে পড়ে না। ইনিয়ে বিনিয়ে মায়ের থেকে পারমিশন পেলেও মিরজাফর মনের থেকে পারমিশন পাওয়া যায় না। এ জীবনে মন সেই পারমিশন দেবে বলেও মনে হচ্ছে না।’

আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ সেই একজনটা যে কি পরিমাণ কিউট জানিস? একদম মাত্রাতিরিক্ত কিউট। তোরা তো ওর আশেপাশেও ঘেঁষতে পারবি না। আমি এই বিষয়ে খুব ভেবেছি বুঝলি? এইযে আমার মনটা তার ওপর ফ্যাভিকলের মত আটকে বসে আছে, এর এক্চুয়াল কারণটা কি? এমনি এমনি তো আর আটকাআটকি বাঁধিয়ে বসে থাকতে পারে না, তাই না? অনেক ভেবে টেভে যা খুঁজে পেলাম তা হলো, ওর বাচ্চাদের মতো মিষ্টি দুটো গাল আর হাসি! উফ! মাস্টারপিস হাসি দেখেছিস কখনো? কতটা সুন্দর হয় জানিস? মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে…’

শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝে রিকশার ব্রেক কষলো। আমি রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘ আপনার ‘তার’ প্রসংশা শেষ হলে এবার আমি আসি শুভ্র ভাই। বাকিটা নাহয় অন্যদিন শুনবো।’

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ তুই শুনতে চাইলেই আমি তোকে শুনাতে যাব কেন? তোরা তো ভালো মানুষ না। পরে দেখা যাবে বাচ্চা মেয়েটার ওপর নজর টজর লাগিয়ে ফেলেছিস। খবরদার ওর দিকে নজর দিবি না। নজর দিবি তো এক চড়। এই মামা চলো তো… আজাইরা।’

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকশাটি নিজের গন্তব্যে ছুটলো। আমি নিজের মনেই হেসে উঠলাম। উৎফুল্ল মনে গেইটের দিকে পা বাড়াতেই ম্যাসেজ টুন বাজলো। শুভ্র ভাইয়ের ম্যাসেজ,

‘ তার চোখদুটো এতোটা সুন্দর না হলেও পারত। প্রথম দৃষ্টিতে মনের এতোবড় সর্বনাশটা সে না করলেও পারতো। চুলে গুঁজা দেবকাঞ্চনে তাকে মায়াদ্বীপের পরীটির মতো না দেখালেও পারত। তার নামটা সর্বনাশী, এই শুভ্র প্রেমিকের সর্বগ্রাসী না হলেও পারত!’

উনার পাঠানো ছোট্ট এই বার্তায় আমার বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ বইতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। চেহারায় একরাশ লাজুকতায় আর মনে ভর করলো অদ্ভুত এক চঞ্চলতা। ইশ, কি লজ্জা!

#রোদবালিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here