রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-১৭

0
580

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[১৭]

সন্ধ্যা সাতটা তখন। মাথায় প্যাঁচানো ওড়নাটা আর ও ভালোভাবে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ছাদ থেকে নামল আনহা। জায়িদের মুখোমুখি ঠিক তখনি। জায়িদ হাতের ঘড়িতে টাইম দেখতে দেখতে বলল,
‘ তুমি ছাদে কি করছিলে? ফোনে কার সাথে কথা বলছ?
আনহা থতমত খেয়ে বলল,
‘ ছাদে সাগর আন্কেল ছিল। ওনার সাথে কথা বলছিলাম। ফোনে নয়।
জায়িদ আনহার কথা পুরোপুরি না শুনে বলল,
‘ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তোমার কেসটা নিয়ে নিয়েছে গতকাল। তোমাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে সকালে৷
আনহার ভীষণ রাগ লাগল।
‘ আমাকে তাড়াতে পারলেই তো আপনি খুশি। চলে যাব নিজ ইচ্ছায়।
আনহা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
জায়িদের কথায় থেমে গেল।
‘ তোমার ইচ্ছায় যেতে পারবেনা। কারণ তুমি এতদিনে আমার হেফাজতে ছিলে৷ কোন ঝামেলায় আমাকে ফাসানোর জন্য বসে আছ তুমি? আমি বুঝতে পারছিনা।
আনহা চলে গেল। জাহেদাকে ডাক দিয়ে বলল,
‘ আন্টি আমি একটু জিনিয়ার কাছে যাব। যাই?
জাহেদা হাঁক ছাড়ল।
‘ যেতে হবেনা তোর। চুপচাপ ঘরে থাক। এত লাফালে পা কেটে বসিয়ে রাখতে বলব জায়িদকে। আমার ছেলেটাকে আর জ্বালাস না। সব তো চুকে গিয়েছে এবার অন্তত আর ঝামেলা বাড়াস না।
জাহেদার কথা শুনতে শুনতে আনহা গিয়ে দাঁড়ায় রান্নাঘরে। নরম কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে আমি চলে যাই আন্টি। আমাকে যেতে ও দিচ্ছ না আবার কথা ও শোনাচ্ছ।
জাহেদা হাতের খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসেন।
‘ মুখে মুখে কথা বলবি না মেয়ে। তোর কিছু হয়ে গেলে আমার ছেলেটা ফেঁসে যাবে। তারচাইতে তুই একটা কাজ কর। তোর মায়ের ফোন নাম্বার দে৷ আমি ফোন দেই।
‘ মা অসুস্থ আন্টি। ফোনে কথা বলতে পারেনা।
জাহেদা চুপ হয়ে গেলেন। পরক্ষনেই বললেন,
‘ তোর পরিবারে কি আর কেউ নেই?
আনহা মাথা নাড়লেন৷
জাহেদা বলল,
‘ তোর মাকে আমি দেখব। দেখাবি?
সামান্য কথায় আনহা না না আওয়াজ করে।
জাহেদা কপালে ভাঁজ ফেলল৷ বলল,
‘ এইভাবে বললি কেন? তোর মাকে কি আমি দেখতে পারিনা?
আনহা চুপ হয়ে গেল৷ কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বলল,
‘ কেন দেখতে পারোনা? কিন্তু এখন না। মা সুস্থ হোক। তখন।
জাহেদা বলল,
‘ আচ্ছা। তোর যখন ইচ্ছে হবে আরকি। কোথায় থাকিস তোরা? মানে বাসা ভাড়ায় থাকিস?
আনহা ঘনঘন মাথা নাড়াল।
‘ হ্যা। ছোটখাটো একটা চাকরি করতাম। সেই পয়সা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা আর পড়ালেখা চালাতাম।
‘ তাহলে বিয়ে দিচ্ছিল কে?
আনহা থেমে যায়। জাহেদার মনে হলো সে আমতাআমতা করছে। ধমক দিল জাহেদা,
‘ তোতলাচ্ছিস কেন? বল?
আনহা জাহেদার দিকে তাকায়। জাহেদা জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই ট্রেনে করে গ্রামে গিয়ে পড়লি কেমনে?
আনহা বলল,
‘ আমার বন্ধুর যাওয়ার কথা ছিল রূপসা গ্রামে। কিন্তু ওই টিকিটটা ও আমাকে দিয়ে দেয়। আমি গিয়ে পৌঁছি গ্রামে। ওর আসার কথা ছিল। ওর বাবাকে হসপিটালে এডমিট করাতে হয়েছে তাই আসেনি। গ্রামে নাকি ওর কোন একটা আত্মীয় থাকে। সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। ওর আত্মীয় নাকি গার্মেন্টসের ম্যানাজার। আমার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা ও হয়ে যেত ওনার কাছে যেতে পারলে। ওই লোকটা ও গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন কয়দিনের জন্য। কিন্তু হলো না কিছু৷

জাহেদা প্রশ্ন করে,
‘ বিয়ে হচ্ছিল কার সাথে?
আনহা বলল,
‘ বাসার নিচে একটা লোক ছিল। দেখতে ভদ্র মনে হলেও চূড়ান্ত বেয়াদব। মায়ের চিকিৎসা চালাবে বলে জোর করে আমাকে বিয়ে করবে বলেছে। বিয়ের রাতেই আমি পালায়। মা এখন হসপিটালে এডমিট আছে। আমার বন্ধু আছে হসপিটালে। তার নজরদারিতে রেখে এসেছি মাকে। সে মায়ের খেয়াল রাখে।
‘ ওই লোকটা কি তোকে পছন্দ করত?
আনহা মাথা নাড়ায়। জাহেদা বলল,
‘ তো বিয়ে থেকে পালালি কেন? তোকে আর তোর মাকে ভালো রাখত। তোদের একটা অন্তত ঠাঁই হতো।
আনহা চমকে তাকায় জাহেদার দিকে।
‘ নিজেকে বিক্রি করে ঠাঁই খুঁজব আন্টি? লোকটা মদ খায়। লোকটাকে আমার পছন্দ না। মায়ের অসুস্থতাকে ব্যবহার করে লোকটা আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তা কি করে হতে দিতাম। মা লোকটাকে পছন্দ করেনা। সুস্থ হয়ে যদি জানত পারত আমি লোকটার কাছে বিক্রি হয়ে গেছি তাহলে মা আবার ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই আমি পালিয়েছি।
‘ এখন কি করবি?
জাহেদা জানতে চাইল।
আনহা বলল,
‘ ঢাকায় যেহেতু ফিরেছি সমস্যা নেই। আমার বন্ধুর সাহায্য চাকরির খোঁজ করছি। চাকরি পেলেই চলে যাব। মাকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠব। অনেক ধারদেনা ও হয়েছে। ওগুলো শোধ করতে হবে। আমার অনেক কাজ আন্টি।
জাহেদা অবাক না হয়ে পারল না। এটুকুনি একটা মেয়ে এত দায়ভার নিয়ে কত হাসিখুশি থাকে? মেয়েটার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। জিনিয়াকে একটি ছোট্ট চেইন দিয়েছিল সীমান্ত। সেটি তিনি আনহার হাতে তুলে দেন। বলেন,
‘ এটা একটা পাপ মনে হয় আমার। এই পাপের জিনিস অন্তত ভালো কাজে লাগুক। তুই তোর মায়ের চিকিৎসা করা এই চেইন বিক্রি করে। ফেরাস না আমায়। কষ্ট পাব।
আনহা প্রশ্ন করল,
‘ এটা পাপ কেন আন্টি?
জাহেদা বলল,
‘ কিছু কিছু ব্যাপার না জানাই ভালো।
আনহা চোখে জল ভর্তি হলো। সে চেইনটি হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিল। জাহেদাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আন্টি আমি এত ঋণ কিভাবে শোধ করব? কিভাবে?
জাহেদা আনহার পিঠে হাত বুলায়। বলে,
‘ কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে পছন্দ করি আমরা। তুই ও নাহয় আমাকে সেই দলে রাখবি।
আনহা আর ও কাঁদল। দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে৷ দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো কেঁদে কেঁদে মাকে ডাকল। আওড়াল,
‘ আমি চারপাশে অন্ধকার দেখছি মা। সবকিছু কেমন যেন উলটপালট হয়ে গেল।

______

সকালে খাবার টেবিলে নাহিলকে না দেখে নাহিলের খোঁজ করতেই সাহিল জানল নাহিল তার মায়ের কাছে। তাকে না বলে যাওয়ায় ভীষণ রকম অবাক হলো সাহিল সাহিল ফোন লাগাল নাহিলের ফোনে। ওপাশে নাহিল ফোন তোলার সাথে সাথে বলল,
‘ ভাই তুমি খোঁজ নাও কিনা তা দেখার জন্য ফোন দিইনি৷
‘ হঠাৎ কাকির কাছে? কোনো বিশেষ কিছু?
নাহিল হেসে ফেলল। চৌধুরী বাড়ির ছাদে হাঁটতে হাঁটতে নাহিল মাথা চুলকাল। বলল
‘ ভাই তোমাকে বলা হয়নি। এসেই সব বলব।
সাহিল কিছু একটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। বলল,
‘ আচ্ছা আগে আয়। তারপর কথা হবে।
টেবিলের উপর পানির জগ রেখে চেয়ার টেনে বসল জিনিয়া।
সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেব একত্রে আসলেন৷ তরিনা খাতুন এসেই বলল
‘ গুড্ডু তোর বউ ভার্সিটি যাবে। দিয়ে আসিস। একা ছাড়িস না।
সাহিল তাকাল জিনিয়ার দিকে।
‘ ভার্সিটি যাবে?
জিনিয়া মাথা নাড়াল। বলল,
‘ একটু হসপিটালে ও যাব ভাবছি।
সাহিল খেতে খেতে বলল,
‘ হসপিটালে কি?
জিনিয়া সাগর সাহেবের দিকে তাকালো। সাগর সাহেব খাওয়া থামিয়ে বলল
‘ এত প্রশ্ন করিস কেন? যাবে বলছে, যাক না।
সাহিল খেয়ে উঠে গেল। যেতে যেতে বলল,
‘ যাক।
জিনিয়া পাউরুটি ছিঁড়ে গালে দিল। গাল নাড়াতে নাড়াতে বলল,
‘ বাবা ওনি কম খেয়ে উঠে গেল মনে হয়?
সাগর সাহেব মাথা নাড়ালেন।
‘ তেজ। বুঝোনা?
জিনিয়া কিছুই বুঝলনা। হুটহাট রাগ করে কেন মানুষটা। প্লেটে নাশতা তুলে জিনিয়া বলল,
‘ আমি ওনাকে এসব দিয়ে আসছি।
তরিনা খাতুন বললেন,
‘ যাও।
মাথায় শাড়ির আঁচল আরেকটু টেনে প্লেট হাতে নিতেই তরিনা খাতুন থামিয়ে দিলেন জিনিয়াকে।
‘ শাড়ি পড়ে থাকতে অসুবিধা হলে সেলোয়ার-কামিজ পড়ো। নতুন বউ ছিলে তাই শাড়ি পড়তে বলেছিলাম। এখন সেলোয়ার-কামিজ পড়তে পারবে।
জিনিয়া হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ আচ্ছা দাদু।
জিনিয়া যাওয়ার আগে সাহিল চলে এল। সাগর সাহেবের সামনে টেবিলে কালো একটি ফাইল রেখে বলল,
‘ বাবা এই ফাইলে রিসোর্টের জমিজমার অরিজিনাল কাগজপত্রের ফটোকপি আছে। তুমি দেখে নিও।
সাজেদ সাহেব হাতে নেন ফাইলটি। বলেন,
‘ এগুলো তো দেখা হয়েছে। হসপিটালের পেছনে যে ফার্ম হাউজটা আছে, ওটা কি করবি?
সাহিল ভেবে বলল,
‘ ওই ফার্ম হাউজ হসপিটাল অথরিটি ভাড়া নিয়েছে। ওনার বিশেষ প্রয়োজনে। এমনকি দ্বিগুণ ভাড়া দিবেন বলে ও অফার করেছেন। যেহেতু পড়ে আছে আমি তাই ভাড়া দিয়ে দিয়েছি তিন বছরের জন্য। এগ্রিমেন্ট পেপারের ফটোকপি এই ফাইলে আছে। তোমারা দেখে নিও।
জিনিয়া এসব ব্যক্তিগত কথায় নাক ডুকালো না। সাহিলকে ডেকে বলল,
‘ আপনি এখন বেরোচ্ছেন?
সাহিল তাকালো জিনিয়ার দিকে। বলল,
” হ্যা। কেন?
জিনিয়া তরিনা খাতুনের দিকে তাকাল।
‘ ওকে ভার্সিটিতে কে নিয়ে যাবে গুড্ডু?
সাহিল বলল,
‘ আমার সাথে যেতে হবেনা। আমি সিএনজি ভাড়া করে রেখে যাব। ওটাতে করে চলে যেও।

জিনিয়া মাথা নাড়াল। সাহিলের পিছু পিছু বাইরে বের হয়ে গেল। হাতে প্লেট। সাহিল পিছু ফিরল। জিনিয়া বলল,
‘ আপনি কি কোনো কারণে রাগ করেছেন?
সাহিল মৃদু হাসল। বলল,
‘ না।
জিনিয়া বুকে হাত দিয়ে বলল,
‘ উফ বাঁচলাম। আমি ভেবেছিলাম আপনি রেগে আছেন।
সাহিল এগিয়ে এল। জিনিয়ার হাতে থাকা প্লেট থেকে ডিমের পুডিং গালে দিয়ে বলল,
‘ রান্না ভালো হয়েছে ভীষণ।
জিনিয়া হেসে ফেলল।
‘ আমার মন খারাপের কারণ বুঝলেন কি করে?
সাহিল গাল মুছে বলল,
‘ বুঝি আমি। আর ইচ্ছে করেই কম খেয়েছি। দেখতে চেয়েছি তুমি কেমন রিয়েক্ট করো। আর দেখলাম ও।
জিনিয়া প্লেট দেখিয়ে বলল,
‘ এগুলো সব খান। নাহলে কষ্ট পাব। আপনার পছন্দ শুনে নিজ হাতে বানিয়েছি। সাহিল বলল,
‘ আর ও মিষ্টি দরকার। আমি মিষ্টি খাই বেশি। এখানে আর ও চিনির দরকার।
জিনিয়ার গলা জ্বলে উঠল।
‘ এত চিনিতে আমার গলা জ্বলছে। আর আপনি? এত চিনি কি করে খান আপনি? ডায়াবেটিস হয়ে যেতে পারে।
সাহিল ডিমের পুডিং গালে দিতে দিতে বলল,
‘ হোক গে। সেজন্য কি আমি মিষ্টি খাবনা? আর ও বেশি বেশি খাব।
জিনিয়া হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা আচ্ছা খাইয়েন। আমি নেক্সটে এর চাইতে ও দুই ডাবল চিনি দেব। নইলে দুইকেজি কাঁচা মরিচ দেব।
বলেই জিনিয়া হেসে ফেলল। সাহিল জিহবা নাড়িয়ে বলল,
‘ উফফ মরিচের নাম শোনার সাথে সাথে যেন ঝাল লাগল।
জিনিয়া হেসে ফেলল। কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ অস্ট্রেলিয়ায় কি আপনাদের ব্যবসা আছে?
সাহিল মাথা নাড়ল।
‘ কি নিয়ে বিজনেস?
‘ বাবা বলেনি?
জিনিয়া বলল,
‘ না, আমি জিজ্ঞেস করিনি।
সাহিল বলল,
‘ ওখানের বিজনেসটা আমি হ্যান্ডেল করি। ইমপোর্ট, এক্সপোর্টের বিজনেস।
জিনিয়া হাসল মৃদু। বলল,
‘ আপনি আবার কখন অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন?
সাহিল জিনিয়ার গালে হাত রাখল। হেসে বলল,
‘ এখন আপাতত যাচ্ছিনা। ওখানে লোক রেখেছি আমি। আমার বিশ্বস্ত লোক। তাছাড়া সবকিছু তো আমিই হ্যান্ডেল করছি এখান থেকে।
জিনিয়া বলল,
‘ আপনি গেলে আমাকে ও নিয়ে যাবেন। অস্ট্রেলিয়া দেখব।
সাহিল হেসে ফেলল আওয়াজ করে।
‘ আচ্ছা আচ্ছা চেষ্টা করব।
জিনিয়া বলল,
‘ হাসলেন কেন?
গাল ফুলালো জিনিয়া।
সাহিল টোকা দিল জিনিয়ার গালে। বলল,
‘ গাল ফুলালে জঘন্যর চাইতে জঘন্য লাগে তোমাকে। জানোনা মেয়ে?
জিনিয়া চোখ নামিয়ে ফেলল। হাসতে হাসতে গেইট পার হলো। সাহিল অদৃশ্য হতেই জিনিয়া হেসে ফেলল। ঘরে চলে গেল।

_____________

পালংকে পায়ের উপর পা তুলে বসা নাতাশা বেগম হুংকার ছাড়লেন যেন। নিজের ছেলের মুখে এমন উক্তি শুনে আর চুপ থাকতে পারলেন না। শেষমেশ কিনা একটা গ্রামের মেয়ে? তা ও আবার কালো?
কোনোমতেই তিনি এমন মেয়েকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন না। কখনোই না।
ভেঁজা চুলে চুল ঝাড়া মেয়েটির ছবি দেখেই থিতিয়ে উঠলেন নাতাশা। মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে বললেন,
‘ চেহারার মায়া দিয়ে কি হবে? এই মেয়ের গায়ের রংতো ভালো না। শ্যামলা। একটু উজ্জ্বল শ্যামলা হতো তা ও হতো। জিনিয়ার ছবি দেখেছি আমি, জিনিয়া তো যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু এই মেয়ে?
এই মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধূ হিসেবে লোকজনকে দেখাব কি করে?

চেপে রাখা রাগ এবার মাথায় উঠল নাহিলের। সামনে থাকা সেন্টার টেবিলে জোরে লাতি বসিয়ে উল্টো করে দিল নাহিল। গর্জে বলল,
‘ সোরা কি প্রোডাক্ট মা? লোকজনকে দেখাতে হবে কেন? ওর সাথে সংসার আমি করব, তুমি না। বিয়ে আমি ওকেই করব যদি করতেই হয়। আর নাহলে কখনোই নয়, কাউকেই নয়। এখানে ও আর জীবনে আসব না আমি। ভুলে যাব আমার মা আছে। বাবা থাকুক শুধু।
নাতাশা বেগমের গাল ভিজে উঠল। তুষ্টপুষ্ট গালের দুপাশ রাগে লাল হয়ে এল। ছেলে তাকে এত কথা শোনাল? একটা গ্রামের মেয়ের জন্য। বের হয়ে গেল নাহিল গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে। নাতাশা বেগম ও আটকালেন না। জেদ ছেলের নয়, তার ও আছে। রাজী হবেন না তিনি।
সাজেদ সাহেবের কাছে ফোন দিয়ে একদফা রাগারাগি ও করলেন নাতাশা। সাজেদ সাহেব মৃদুস্বরে বললেন,
‘ নাহিলকে বলেছি সোরাকে ঘরে তুলতে, তোমার পারমিশনের প্রয়োজন নেই। নাহিল বলেছে আমায়, তার নাকি মা নেই।
নাতাশা বেগমের হাত থেকে ফোন খসে পড়ল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাশি উঠল নাতাশার। গাল বেয়ে জল গড়াল। ঔষধ খুঁজতে গিয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিল কয়েকটা। নিজের গর্ভের সন্তান পরের মেয়ের জন্য এমনটা বলতে পারল?

____

সাহিল হেসে পিঠ চাপড়াল নাহিলের। বলল,
‘ তাহলে আবার ও গ্রামে যেতে হবে?
নাহিল লজ্জা পেল ভীষণ। ভাই তাকে এভাবে বলছে লজ্জায় ফেলার জন্য। তরিনা খাতুন ব্যঙ্গ করে বললেন,
‘ মুন্টু শেষমেশ কালোনির প্রেমে পড়লি?
কালোনি কেন বলল? শুধু নাহিল বলবে কালোনি। নাহিল রেগে গেল মুহূর্তেই। ধুপধাপ হেঁটে চলে গেল উত্তর না দিয়ে।
সবাই হেসে ফেলল। তরিনা খাতুন ভেংচি কেটে জিনিয়াকে বলল,
‘ দেখেছ? এখন থেকেই কেউ কিছু বলতে পারছেনা। আল্লাহ! এতো দেখছি গুড্ডুর চাইতে ও বেশি বউপাগলা হবে।

জিনিয়া জিভে কামড় বসালো। এদিকে হুট করে সাহিল রেগে গেল। তাকে বউপাগলা বলল কেন?
সে ও ধুপধাপ পা ফেলল। চলে গেল। তরিনা খাতুন সাগর সাহেবকে বলল,
‘ দেখলি সাগর তোর ছেলে ও রেগে গেল। হায়রে এসব কাদের নিয়ে আছি আমি? এরা বউপাগলা কিন্তু এদের বউপাগলা বলতে পারব না।
জিনিয়া হাসতে হাসতে বসে পড়ল চেয়ারে।

সাজেদ সাহেবের কাছে ফোন এল। তিনি তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। সবাই কি হয়েছে জানার চেষ্টা করতেই নাহিল দৌড়ে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাইক নিয়ে ছুঁটল। সাহিল ও ব্যস্ত হয়ে বের হতেই জিনিয়া আটকালো।
‘ কি হয়েছে? এভাবে সবাই কোথায় যাচ্ছেন?
সাহিল পকেটে ফোন গুঁজতে গুঁজতে বলল,
‘ ছোটমা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। আমি হসপিটাল যাচ্ছি।
সাগর সাহেব সোফায় বসে পড়ল। বলল,
‘ শুরু হয়েছে নাতাশার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। কোনোদিন স্বামী কি চায় তা বুঝার চেষ্টা করেনি, আর এখন সন্তান কি চায় তা ও। বুঝে ও বুঝেনা যেন ওই মহিলা। কি হবে খোদা জানে। নাহিলটা ও কি করবে কে জানে?

নাতাশা বেগমের মাথার কাছে হাঁটু মুড়ে বসল নাহিল। চোখদুটো ছলছলে। মায়ের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে চুপ করে বসে থাকল নাহিল।
নাতাশা বেগমের জ্ঞান ফিরল প্রায় মধ্যরাতে। বিষণ্ণ চেহারা। নাহিল তার পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে চেয়ারে বসে। নাতাশা ছেলের চুলে হাত বুলালেন। একটামাত্র ছেলে তার। একটামাত্র কলিজা। মায়ের জন্য সারারাত এভাবে বসেছিল? মা তো নেই তার। তাহলে কেন এভাবে বসে ছিল? কেন?
নাহিল জেগে উঠল নাতাশার কান্নায়। মুখ তুলে মায়ের গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল,
‘ মা তুমি যা বলবে তাই হবে মা। তোমার কথার অবাধ্য হবোনা আমি। কখনো হবোনা। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কিকরে ভাবতে পারো মা? আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, তুমি যা বলবে তাই হবে। সোরাকে চাইব না আমি, চাইব না।
নাতাশা কিছু বলল না। নাহিলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ আমি কে তোর? কেন কাঁদছিস?
নাহিল মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। বলল,
‘ মায়ের চাইতে ও বড় কখনোই অন্য কিছু হতে পারেনা মা। অন্য কেউ হতে পারেনা। আমি তোমার বাধ্য ছেলে হয়ে থাকব মা। সোরার কথা কখনোই বলব না তোমাকে। কখনোই না।
নাতাশা বেগমের মন গলল এবার। কিন্তু ছেলেকে তা দেখালেন না তিনি।

________

বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। বৃষ্টি নামার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে। আনহা দাঁড়ানো ছাদে। এলোমেলো ভাবনা এসে মাথায় চেপে বসেছে। থানায় সব মিথ্যে মিথ্যে বিবৃতি দিয়েছে আনহা। যেভাবে সিফাত শিখিয়ে দিয়েছিল। ভয় কাজ করছে আনহার। সে ফেঁসে যাবেনা তো?
ফোন কাঁপিয়ে কল এল। কে কল দিল না দেখেই রিসিভ করল আনহা। কানে দিতেই ভেসে এল হুমকি।
‘ তোমার মাকে রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি আমি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরুক তোমার মা।
আনহা না না করে উঠল। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি হো হো করে হেসে উঠল। বলল,
‘ হসপিটালের এত খরচ আমি কেন দেব বলতে পারো? কেন দেব?
আনহার কন্ঠস্বর পাল্টাল।
‘ আমার মা মানে , তোমার ও তো মা সিফাত। তুমি একটা অসুস্থ মানুষের সাথে কি করে অমনটা করতে পারো ? তাহলে আমি কি ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম?
ওপাশের ব্যক্তির এবার চাপাস্বর শোনা যায়।
‘ ভালোবাসার প্রশ্ন তুলবেনা একদম। কাজ করতে পাঠিয়েছি তোমাকে, প্রেম করতে নয়। উল্টাপাল্টা কিছু শুনলে লাশ ফেলব আমি তোমার মনে রেখো।
আনহা ও সমান পরিমাণে গর্জে বলল,
‘ কেমন পাগলের মতো বিহেভ করছ তুমি? আমি কার সাথে প্রেম করেছি? ফালতু কথা বলবেনা। নিজেকে কন্ট্রোল করতে শেখো সিফাত । এতটা ইনসিকিউরিটি ফিল করলে আমাকে এখানে পাঠিয়েছ কেন? আর পুলিশ অফিসার আমার মতো মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্য বসে আছে।
সিংহের মতো করে গর্জন ভেসে এল আনহার কানে।
‘ মাথা খারাপ করবেনা আনহা। তাড়াতাড়ি কাজ সেড়ে এসে তোমার মাকে নিয়ে যাও।
আনহা আবার ও বলল,
‘ তোমার ও মা কিন্তু। এই তুমি কি আমাকে ভালোবাসোনা? তোমার কথার ধরণ দিনদিন এমন হচ্ছে কেন?
‘ আবার ও এই ভালোবাসার প্রশ্ন তুলছ?
আনহা বলল,
‘ একশবার তুলব। হাজারবার তুলব। তুমি আমাকে ভালোবাসলে আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতেনা। মায়ের অপারেশনের টাকা নিতে আমাকে এতবড় রিস্ক নিতে হতোনা। মাকে যদি তুমি নিজের মা ভাবতে তাহলে অপারেশন করানোর টাকা দিয়ে দিতে। মাকে রাস্তায় ফেলে আসবে বলতেনা। বলতেনা।
আমি ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি আমি। যাকে ভালোবাসি আমি, সে আমাকে ভালোবাসেনা, ব্যবহার করে শুধু।
কল ততক্ষণে বিচ্ছিন্ন।
আনহা ছাদের রেলিং ঘেষে বসে। মাথা ঠেকায়।
‘ এই কোথায় ফেঁসে গেল সে? শেষটা কি হবে? মা তার কুকর্মের কথা জানতে পারলে কখনো কি ক্ষমা করবে?
ছাদের লাইট জ্বলল মুহূর্তেই। আনহা তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে নিল। দাঁড়িয়ে পড়ল। গাল মুছে ফোন কানে দিয়ে রাখল। জায়িদ এসে এদিকওদিক তাকাতেই আনহাকে দেখল।
‘ লাইট অফ করে দিয়েছ কেন? অন্ধকারে ভয় করেনা?
আনহা কিছু বলল না। ফোনে কারো সাথে কথা বলার মতো বকবক করল। কিছুক্ষণ পর ফোন নামিয়ে জায়িদের সামনে এসে বলল,
‘ ফোনে কথা বলছি, দেখছেন না? এত বকবক করেন কেন? আজকাল বেশি কথা বলছেন মনে হচ্ছে।
জায়িদের কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘ এই মেয়ে আমাদের ছাদে দাঁড়িয়ে এসব করতে পারবেনা তুমি। নিজের ঘরে গিয়ে ওসব করো।
আনহা বলল,
‘ মানুষ ওসব মানে প্রেমালাপ ছাদে দাঁড়িয়ে করে অফিসার। আপনি তো ওই ওসব কখনো করেননি তাই জানেন না।
জায়িদ বিষম খেল যেন। খুকখুক করে কেশে উঠে বলল,
‘ প্রেম?
আনহা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ হ্যা প্রেম? বুঝেন?
জায়িদ বিদ্রুপ করে বলল,
‘ বুঝব না কেন? প্রেম মানেই ন্যাকামো এটা ভালো করে বুঝি।
আনহা চেতে উঠল।
‘ ন্যাকামো?
জায়িদ বলল,
‘ হ্যা। ন্যাকামো করো তুমি, করতেই থাকো। কে বাঁধা দিচ্ছে? আমি কেন বাঁধা দেব? আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই?
বলেই চলে গেল জায়িদ। পায়ের আওয়াজের সুর ভিন্নরকম।
আনহা হেসে গাইল,
‘ আজি অন্য সুরে কেন বাজে বাঁশি?
আজি বৃষ্টি নামল কেন এত সাজি?

চলবে,
রিচেইক করা হয়নি। সবার মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here