রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-২৬

0
529

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[২৬]

মাগরিবের আজান পড়ছে চারপাশে। ওযু করে মাত্রই নামাজ পড়তে যাচ্ছে জিনিয়া। তাননা মুননাকে ডাকতে গিয়ে ও ডাকল না। গলার আওয়াজ অনুসরণ করে দেখল, ভাই বোনকে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দিচ্ছে। বোন ভাইকে টুপি পড়িয়ে দিচ্ছে।
জিনিয়া মৃদু হাসল। জায়নামাজ হাতে নিয়ে বলল,
‘ কি করছেন আপনারা?
তাননা বলে উঠল,
‘ মুননুকে টুপি পলিয়ে দিচি। আমি ওননা পচচি।
জিনিয়া বলল,
‘ কেন পড়ছেন?
তাননা বলল,
‘ আচান দিচে। নামাচ পববো। মুননু ও পববে। নাওলে আল্লাহ মাববে।
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা আমি পড়ে নিই আগে।
তাননা চেঁচিয়ে উঠে।
‘ না না না। আমলা পববো। আম্মার সাথি আমমা না পললে আল্লাহ মাববে।
মুননা বিছানার উপর দাঁড়ায়। কানে নিচে হাত দিয়ে ডাক দেয়,
‘ আল্লাহুআব্বর।
জিনিয়া আর না পারতে হেসে দেয়।
‘ আব্বু তুমি নামাজ পড়ে ফেলছ?
মুননা হাত নামিয়ে জিনিয়ার দিকে তাকায়।
‘ ওফফফ, আমি আচান দিচচি না? জুননুকে আল্লাহ মাববে।
জিনিয়া আবার ও হেসে দেয়। তাননা এসে জিনিয়ার পাশে জায়নামাজে দাঁড়ায়। আর ও একটা জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়। তাননা জিনিয়াকে দেখে দেখে নামাজ পড়ে। সিজদা দিতে গিয়ে ধপ করে পড়ে যায়। আবার উঠে পড়ে। মুননু দুজনকে দেখে নাক ফুলায়।
‘ মুননুকে ছিড়ে নামাচ পললে হুবেনা। নামাচ হুবেনা।
জিনিয়ার নামাজ শেষ হয়। কিন্তু ভাইবোনের নামাজ শেষ হয়নি। জিনিয়া দেখতে থাকে দুজনের কান্ড। মুননা তাননার মতো বুকে হাত দিয়েছে। নাভি বরাবর দেয়নি। হেসে ফেলল জিনিয়া। সিজদাহ দিতে গিয়ে মুননা তাননার মতো দিতে পারেনা। আঙুল গুলো চেপে চেপে বাকা করে তারপর সিজদাহ দেয়। সিজদাহ দেওয়ার সময় জোরে জোরে আল্লাহুআব্বর বলে। জিনিয়া ঠোঁট টিপে হাসে। তার পাগল দুইটা।
নামাজ পড়া শেষ হতেই মুননা ঠাসস ঠাসস চড় বসায় তাননার মাথায়।
‘ তুমি ইতু তালাতালি নামাচ পলো কিনো? আমি পলতে পালিনা। জুননু তুননুল নামাচ হুবেনা।
জিনিয়া হেসে মুননুকে টেনে কোলে নেয়। বলে,
‘ আপনার নামাজ হবেনা। আপনি কি মেয়ে? বুকে হাত দিয়েছেন কেন? আপনার আব্বা কি শিখিয়েছে?
মুননা ঠোঁট ফুলায়। জিনিয়ার কপালে ঠোঁট ঢলে বলে,
‘ আব্বা পুঁতা। নামাচ না পলে কুথায় গিছে ?
জিনিয়া বলল,
‘ কে জানে?
তাননা গাল ধরে বসে থাকল।
‘ আম্মা আমাকে কুলে নাও। আল্লাহ মাববে।
জিনিয়া দুজনকে দুই উরুতে বসায়। দুজনের গালে আদর দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ আমার আদর, আদরিনী।
মুননা তাননা একসাথে বলে উঠল,
‘ আদোল, আদোলিনী।

সাহিল এল তার কিছুক্ষণ পর। তাননা মুননাকে ডাক দিয়ে বলল,
‘ আম্মা কোথায়? আব্বা কোথায়?
ভাইবোন একসাথে চিল্লিয়ে উঠে,
‘ আমলা ইখানে।
‘ কি করে?
‘ আল্লাহ ডাকি।
সাহিল রুমে ডুকে মা ছেলেমেয়েকে দেখে হাসে। তাননা মুননা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।

‘ আব্বা নামাচ না পললে আল্লাহ মাববে।

সাহিল পকেটে থাকা টুপি মাথায় পড়ে নেয়। দেখিয়ে বলে,
‘ এইতো এক্ষুণি মসজিদ থেকে এলাম। পড়ছি তো। পড়ছি।
জিনিয়া হেসে ফেলল। তাননা বলল,
‘ আমাল আব্বা ভালু।
মুননা বলল,
‘ গুড্ডু গুড বয়।
তাননা বলল,
‘ গুড্ডু ডাকলে আল্লাহ মাববে মুননু।
মুননা নাক ফুলিয়ে সাহিলের কাছে চলে যায়।
‘ আল্লাহ মুননুকে মালেনা। আদোল কলে। মিছি বুলো কেন?
তাননা কাঁদাকাঁদো হয়ে বলে,
‘ আমি মিছি বুলিনা। আম্মা তুননু মিছি বুলেনা। আল্লাহ মাববে।
জিনিয়া তাকে কোলে তুলে নেয়।
গালে আদর দিতে দিতে বলে,
‘ আমার আদরিনীকে আল্লাহ মাববে না। আদোল কববে।
মুননাকে সাহিল কোলে নেয়। বলে,
‘ এরা মা মেয়ের আগে আমরা ওখানে যাব। চা খাব। চলো চলো। চাচ্চু তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।
মুননা সাহিলের গালে গাল লাগিয়ে বলে,
‘ চলো চলো গুড্ডু চলো। চা খাববো, চা খাববো।

জিনিয়ার কোল থেকে তাননাকে নিয়ে নেয় নাহিল। তার পাশে সোফায় বসিয়ে বলে,
‘ মাথায় কি পড়েছ আম্মু?
তাননা মাথায় পড়া হিজাব দেখিয়ে বলে,
‘ ওননা পচচি। ওননা পলে নামাচ পচচি।
সাজেদ সাহেব হেসে উঠেন। সাগর সাহেব ও। বলেন,
‘ দাদুমণি আমরা তো নামাজ পড়তে জানিনা। এখন কি হবে?
সাহিলের কোল থেকে নেমে আসে মুননা।
কানের নিচে হাত দিয়ে আবার বুকে হাত দিয়ে বলে,
‘ ইভাবে ইভাবে পববে। আমি নামাচ পততে জানি।
সালেহা বেগম এসে বসেন সোফায়। বলেন,
‘ আমার দাদু ভাইয়ের কাছ থেকে সবাই নামাজ পড়া শেখো।
সবাই হাসে একসাথে। জিনিয়া চা নিয়ে আসে। সবাইকে চা বিতরণ করে তাননা মুননাকে ডাকে। চামচে করে ফু দিয়ে দিয়ে চা খাওয়ায়। মুননা জিনিয়ার হাত থেকে চামচ কেড়ে নেয়। আমি খিতে জানি জুননু।
জিনিয়া হাসে।
‘ খান। যদি জামায় ফেলেন খবর আছে।
মুননা খালি চামচ গালে দিয়ে বলে,
‘ তুমাল খবল আচে।

নাতাশা বেগম নেমে আসেন নিচে। চোখের নিচে অর্ধচন্দ্রাকার কালো দাগ। বিমর্ষ পাংশুটে চেহারা। শুধু নাহিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাহিল কোনোমতে চা খেয়ে তাননাকে কোলে করে বাইরে বেরিয়ে যায়। মুননা মেঝেতে পড়ে মাথা ঠুকায়।
‘ মুন্টু আমাকে ফিলে চলে গিছে কিনো? আল্লাহ এখুন কি হুবে? আমি মুরে যাবো।
জিনিয়া কোলে তুলে নেয়। ইচ্ছেমত জিনিয়াকে মারে মুননা। কেঁদেকেটে সারা হয়। সাজেদ সাহেব আর না পেরে মুননাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান। মুননা সেই খুশি।

_________

তখন প্রায় সকাল আটটা হবে। দুইজন ভদ্রলোক এলেন নিচে। একজন সাহিলের সমবয়সী অন্যজন সাগর সাহবের। ইয়াজিদ মজুমদার, আর তার ছেলে ইয়ামিন মজুমদার।
ইয়াজিদ মজুমদার যিনি সাহিলকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়েছিলেন। আর ইয়ামিন সাহিলের দুই বছরের বড় হলেও সমবয়সীর মতো। দুজনকে দেখে জিনিয়া নিচে নেমে এল। সালাম দিয়ে পরিচিত হয়ে নিল। ইয়ামিনের চোখের দৃষ্টি গভীর। সাহিলের ওয়াইফ পরিচয় দিতেই সে যেন শক খেল একপ্রকার। ইয়াজিদ সাহেব হেসে ছেলেকে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ সারপ্রাইজটা কি ভালো হলো? নাকি খারাপ?
ইয়ামিন ঠোঁট বাঁকা করে হাসে।
‘ আমার জন্য খুব শকিং একটা নিউজ বাবা। কিন্তু?
ইয়াজিদ সাহেব থামিয়ে দিল ইয়ামিনকে। ইয়ামিনের কেমন করা দৃষ্টি উপেক্ষা করে উপরে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই সাহিল চলে এল বাড়িতে। না দেখালেও কেমন একটা বিরক্তবোধ করল সাহিল তা চোয়াল দেখেই স্পষ্ট। জিনিয়াকে দেখে এগিয়ে এল সাহিল। শান্ত গলায় বলল,
‘ আমি না বললে কারো সামনে যাবেনা। এখানে আসাটা উচিত হয়নি তোমার জিনি।
জিনিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ এভাবে কেন বলছেন? কারণটা?
সাহিল যেন জিনিয়ার মুখে এমন কিছু শুনতে চায়নি। সে বলল,
‘ তোমার এখন উপরে চলে যাওয়া উচিত জিনি।
জিনিয়া উপরে চলে এল। সাহিলের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝল না।
তার কোর্টে যেতে হবে। সাহিলকে সেটা বলার সুযোগ ও হয়ে উঠল না। রুমে পায়চারি করতে করতে সাহিলের দেখা পেল জিনিয়া। আচমকা দৌড়ে এসে বুকের মধ্যে পিষ্ট করল জিনিয়াকে। কিছু না বুঝে পড়ে রইল জিনিয়া। লম্বাটে মানুষটাকে দেখার জন্য চোখ উপরে তুলতে হলো। সময় নিয়ে বলল,
‘ কি হয়েছে?
হেসে ফেলল সাহিল।
‘ বাচ্চারা কোথায়?
‘ ওদেরকে তো আব্বা এসে নিয়ে গেছে। আমার কোর্টে যেতে হবে তো।
সাহিলের মুখমন্ডল কালো হয়ে গেল। জিনিয়া বুঝে ফেলল। সাহিলের বুকে মাথা রেখে বলল,
‘ আপনি শুধু শুধু ভয় পান আমাকে নিয়ে। কিচ্ছু হবেনা আমার।
‘ লয়ারদের শত্রুর অভাব নেই জিনি। অন্য পেশা কি নেওয়ার ছিল না?
জিনিয়া আরও চেপে যায় সাহিলের বুকে। শ্বাস টেনে বলে,
‘ আপনি আবারও অযথা চিন্তা করছেন। কিচ্ছু হবেনা আমার। আপনি এরকম করলে আমার সেখানে গিয়ে কাজে মন বসেনা।
সাহিল তার হাত রাখল জিনিয়ার মাথায়। চুলের মাঝে হাত চালিয়ে চুমু খেল মাথায়। বলল,
‘ ঠিক আছে। সাবধানে থাকবে।
জিনিয়ার প্রশ্ন করা হলোনা ইয়াজিদ মজুমদার কেন এসেছেন?
কোর্টের উদ্দেশ্যে বের হলো জিনিয়া।
কোর্টে নতুন কেস নিয়েছেন আজিজুর রহমান। মিঃ রহমান জিনিয়াকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠায়। কেস বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। মিঃ রহমান বলতে শুরু করে,

হসপিটালের পাশের এক দোকানদার নাকি অন্য দোকানদারকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। ফলসরূপ দোকানদারটি সকালেই মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু অভিযুক্ত মতিন মিয়ার বক্তব্য তিনি আসার আগেই মৃত দোকানদার বাবলুর লাশ পড়েছিল। তিনি মারতে এসেছিল ঠিক কিন্তু মারেননি।
জিনিয়া জানতে চাইল,
‘ মারতে চেয়েছিল কেন স্যার?
‘ মারতে চেয়েছিল, কারণ অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসে মতিন মিয়াকে বলল, বাবলু নাকি মতিন মিয়ার দোকানটা কিনে নেবে ওই দোকানের জমির মালিক থেকে। তাও আবার বেশি টাকা দিয়ে। দুজনই ভাড়া নিয়ে চালাত দোকান দুটো । রাগে,ক্রোধে লোহার রড নিয়ে ঠিকই যায় মতিন মিয়া কিন্তু তার আগেই লাশ পড়া ছিল বাবলুর।
জিনিয়া ভাবতে থাকে। বলে,
‘ স্যার আদালত কয়দিন সময় দিয়েছেন?
মিঃ রহমান জানালেন,
‘ কাল থেকেই শুনানি শুরু। আমরা আবার ও ডিফেন্সের পক্ষে ইনশিরাহ। মতিন মিয়াকে আমাদের নির্দোষ প্রমাণ করতেই হবে।
জিনিয়া কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ স্যার মতিন মিয়া যে মিথ্যা বলছেনা তার প্রমাণ কি?
মিঃ রহমান হাসল।
‘ ঠিক প্রশ্ন করেছ ইনশিরাহ। মতিন মিয়ার হাতে যে রডটি ছিল ও-ই রডে বাবলুর রক্ত লাগানো ছিল ঠিক, কিন্তু মতিন মিয়ার আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। মতিন মিয়ার কেন কারোরই পাওয়া যায়নি।
তারমানে বোঝায় যায়, অপরাধী হাতে গ্লাভস পড়ে ছিল। বাবলুকে খুন করে রডটি মতিন মিয়ার দোকানে রেখে এসেছিল। তারপর ওই নাম্বার থেকে মতিন মিয়াকে কল করেছিল।
জিনিয়া মাথা নাড়াল। বলল,
‘ মতিন মিয়ার কাছে যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। নাম্বারটা আমার চাই স্যার। আর এই কেসের সমস্ত ডকুমেন্টস চাই। ইনশাআল্লাহ আজ রাতেই আমি কেসস্টাডি রেডি করে রাখব। আপনি চিন্তা করবেন না।
মিঃ রহমান হাত বুলায় জিনিয়ার মাথায়। বলে,
‘ তোমার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে ইনশিরাহ। এই কেসটি তুমি জিতবেই। এই কেসটা যদি তুমি জিততে পারো তোমার জন্য আমি নিজ হাতে এপ্লিকেশন পাঠাব উচ্চ আদালতে। যাতে তোমাকে অফিসিয়াল লয়ারের অন্তর্ভুক্ত করে। আমার হয়ে আর কাজ করতে হবেনা।
গাল এলিয়ে হেসে দেয় জিনিয়া।
‘ থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ সো মাচ স্যার। আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব সত্যটা খুঁজে বের করার। আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার। আর ভাইয়া তো আছেই। ভাইয়া আমাকে সকল প্রকার হেল্প করবে।

মিঃ রহমান হাসেন। বলেন,
‘ অফিসার তোমাকে সাহায্য করলেও আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেনা ইনশিরাহ। আইন কিন্তু অন্ধ। প্রমাণ ছাড়া তারা কিছু বিশ্বাস করবেনা। কেসটা যতটা ইজি মনে হচ্ছে, ততটা ও ইজি না ইনশিরাহ। অপরাধীর নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। মতিন মিয়া আর বাবলুর শত্রুতাকে কেন্দ্র করে সে তার নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে।
জিনিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। মিঃ রহমানকে বলল,
‘ মিথ্যে যতই শক্তিশালী হোক স্যার। সত্যকে কখনো চেপে রাখতে পারবেনা। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে মতিন মিয়াকে আমি নায্য বিচার পাইয়ে দেবই।
মিঃ রহমান হেসে বলেন,
‘ অল দ্য বেস্ট ইনশিরাহ। তোমার বাচ্চারা, হাজবেন্ড,ফ্যামিলির সবাই কেমন আছে?
জিনিয়া হাসল। ডকুমেন্টস গোছাতে গোছাতে বলল,
‘ সবাই ভালো আছে স্যার। বাচ্চাদের কথা আর কি বলব, আমি তার তাদের আব্বা না থাকলে সবার মাথা খায়।
মিঃ রহমান হেসে বলেন,
‘ এখনো ছোট তো তাই। আমি হুট করে একদিন দেখতে যাব তাদের। অনেক গল্প জমে আছে।
জিনিয়া হাসল। সালাম দিয়ে বের হয়ে গেল।

___________

পরেরদিন বাইকে করে জিনিয়াকে কোর্টে এনে দিল সাহিল। মাথার হেলমেট খুলে নিল জিনিয়া। বলল,
‘ শুনানি দেখবেন না?
সাহিল হাসল। বলল,
‘ অন্য একদিন ম্যাডাম। আজ অনেক কাজ।
জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ আচ্ছা।
সাহিলকে হেলমেট পড়িয়ে দিল সে। বলল,
‘ সাবধানে যাবেন। আমি কোর্ট থেকে বের হলে ফোন দেব।
সাহিল হেলমেট ভালো করে পড়তে পড়তে জবাব দিল,
‘ মন দিয়ে কেস লড়ো। জিততে দেখতে চাই।
জিনিয়া হাসল। বলল,
‘ যথাআজ্ঞা মহাশয়।
সাহিল বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়।

কেসের শুনানি শুরু হয়। কোর্টে মিঃ রহমান ও উপস্থিত ছিলেন। দুরুদুরু বুক নিয়ে জিনিয়া দ্বিতীয়বারের মতো কেস লড়ে। প্রসিক্রিউটর হিসেবে দেখা যায় ইয়ামিনকে। জিনিয়া ভীষণ অবাক। ইয়ামিন লয়ার?
জিনিয়াকে দেখেও ভীষণ অবাক হয় ইয়ামিন। হেসে তো বলেই দিল,
‘ মিসেস আহমেদ আপনার বিপক্ষে কেস লড়তে মোটেও ভালো লাগছেনা। কিন্তু কি করব বলুন? অপরাধীকে তো শাস্তি দিতেই হবে। আর সাহিলের কাছে ট্রিট।
জিনিয়া ও হাসল। বলল,
‘ আসলে কি বলুন তো মিঃ মজুমদার। অপরাধী তো শাস্তি পাবেই, তবে নকল অপরাধী নয় আসল অপরাধী। এনিওয়ে অল দ্য বেস্ট।
অধর ছড়িয়ে হাসে ইয়ামিন। বলে,
‘ থ্যাংকস এ লট।
সুনানি শুরু হয়। মতিন মিয়ার কাছ থেকে জবান নেয় জিনিয়া।
বাবলু খুন হয় রাত দশটা পাঁচে। কিন্তু মতিন মিয়ার কাছে ওই নাম্বারটি থেকে ফোন আসে রাত দশটা বারোতে। তারমানে বোঝায় যাচ্ছে মতিন মিয়া পৌঁছানোর আগেই বাবলুকে খুন করা হয়েছে।
কিন্তু জিনিয়াকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে ইয়ামিন জানায় মতিন মিয়ার কাছে কোনো ফোনই আসেনি। এসব মতিন মিয়ার সব মনগড়া গল্প। যদি ফোন এসেই তাকে, তাহলে কে ফোন দিয়েছে, আর নাম্বারটি কেন ট্রাকিং করা সম্ভব হচ্ছেনা তা দয়া করে জানান মিসেস ইনশিরাহ।
জর্জ জিজ্ঞেস করল জিনিয়াকে।
‘ নাম্বারটি কোথাথেকে এসেছে?
জিনিয়া বলল,
‘ পুলিশদের দায়িত্বে ছিল নাম্বারটি ট্র্যাক করা।
জায়িদকে ডাকা হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জায়িদ জানায়,
‘ সরি স্যার নাম্বারটি কোনোভাবেই ট্রাক করা যাচ্ছেনা। কিন্তু আমরা মতিন মিয়া আর ওই অপরিচিত ব্যাক্তির ফোনকল রেকর্ড কালেক্ট করেছি।
জিনিয়া ঠোঁটে হাসি ফুটল।
মতিন মিয়া বলল,
‘ দেখেছেন দেখেছেন সাহেব। আমি ঠিকই বলেছি। আমার কাছে ফোন এসেছিল।
জায়িদ রেকর্ডার জিনিয়াকে দেয়। জিনিয়া হাত বাড়িয়ে নিয়ে হেসে বলে,
‘ থ্যাংকস অফিসার।
জায়িদ একগাল হাসল। বলল,
‘ ওয়েলকাম মিসেস ইনশিরাহ।
জিনিয়া চোখ মারল ভাইকে। জায়িদ হেসে দিল বোনের কান্ড দেখে।
রেকর্ড শুনল জর্জ। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মতিন মিয়া আর অপরিচিত ব্যাক্তির গলার আওয়াজ। ইয়ামিন বলল,
‘ এসব ভুয়া। এসব বানানো।
জায়িদ বলল,
‘ এটাই রিয়েল। পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে এই রেকর্ড কালেক্ট করেছে। আপনি চাইলে আবার ও আপনাকে রেকর্ড কালেক্ট করে দেখাতে পারে।
জর্জ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় এক শুনানিতে খালাস দিল মতিন মিয়াকে। কিন্তু আসল অপরাধীকে শনাক্ত করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে জোরদার করল।

আদালত থেকে বের হতেই ইয়ামিনের সাথে দেখা জিনিয়ার৷ জিনিয়া হেসে বলল,
‘ কনগ্রেস জানাবেন না?
ইয়ামিন মাথা তুলে হাসল।
‘ ইয়েস। হুয়াই নট। কিন্তু সেইদিনের জন্য বাকি রেখে দিই যেদিন অপরাধীকে ধরতে পারবেন আপনি৷।
জিনিয়া হেসে চলে এল।

জায়িদকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল জিনিয়া। জায়িদ ও জড়িয়ে ধরল। জিনিয়া অনেক্ক্ষণ পর জায়িদকে ছেড়ে বলল,
‘ ট্রিট দাও ভাইয়া। আমি আবার ও কেস জিতেছি।
জায়িদ হাসল।
‘ কেস জিতেছিস সেটা বড় কথা নয় জুননু। আসল অপরাধী খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সবকিছু মিটমাট হবেনা।
জিনিয়া বলল,
‘ ঠিক বলেছ। কিন্তু?
মতিন মিয়াকে দেখে থেমে যায় জিনিয়া। মতিন মিয়ার পেছনে তার যুবতী মেয়ে। মতিন মিয়া কয়েকটা শত টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় জিনিয়ার দিকে। বলে,
‘ এগুলো রাখো মা। বেশি দিতে পারিনি, ব্যবসায় মন্দা চলতেছে তো।
জায়িদ জিনিয়ার দিকে তাকায়। জিনিয়া হাসিমুখে বলল,
‘ টাকা তো আমি পাব। আপনাকে দিতে হবেনা। এগুলো দিয়ে আপনি ঔষধ খান। সুস্থ থাকুন। আপনার মেয়ের জন্য হলেও সুস্থ থাকতে হবে তো।
মতিন মিয়ার দুচোখ ছলছল করে উঠে। জিনিয়া বলল,
‘ আসি। দোয়া করবেন আমার বাচ্চাদের জন্য। সবার জন্য।
মতিন মিয়া হাত বুলিয়ে দেয় জিনিয়াকে। জায়িদের সাথে কথা বলতে বলতে বের হয় জিনিয়া। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ওই দোকানটার সামনে। জিনিয়া বলল,
‘ ভাইয়া আমাকে ডুকার পারমিশন দাও একবার। হয়ত কোনো ক্লু পেতে পারি ওখানে।
জায়িদ বলল,
‘ ঠিক আছে যাহ। কিন্তু তাড়াতাড়ি।
জিনিয়া চাবি নেয় কনস্টেবলের হাত থেকে। ডুকে পড়ে দোকানের ভেতর। চক দিয়ে বাবলুর মৃত দেহের অবয়ব আঁকা। রক্তের ফোঁটা। জিনিয়া বসে মেঝে দেখল ঠাহর করে করে। মোবাইলের লাইট অন করে দেখতে দেখতে একসময় পেল একটি লেন্স। চোখের লেন্স। জিনিয়া হাসিমুখে তুলে নিল সেটি। দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে ডাকল, ভাইয়া?
ততক্ষণে দোকানের কিছুটা দূরে এসে থামে একটি একটি কালো গাড়ি। নেমে আসে একজন মধ্যবয়স্ক লোক৷ জায়িদের চেনা চেনা লাগল। জায়িদকে দেখে হাসল মিঃ চ্যাটার্জি।
‘ চিনতে পেরেছেন আমাকে?
জায়িদ বলল,
‘ জ্বি। আপনাকে তো সিলেটে দেখেছিলাম। হঠাৎ এখানে?
মিঃ চ্যাটার্জি বললেন,
‘ এখানে ভাইয়ের বাসায় এসেছি।
জায়িদ সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘ ওহ আচ্ছা। আপনার মেয়ে এখন কেমন আছে?
মিঃ চ্যাটার্জি হেসে বলল,
‘ ভালো আছে। ওকে ও নিয়ে এসেছি। দোকানদার বাবলু নাকি মারা গিয়েছে? তার আকস্মিক মৃত্যু হলো কেমনে? বেচারা ভালো লোক ছিল। আমি বেশিরভাগ এই দোকানে এসে বসতাম। ওর দোকানের চা ভালো লাগত।
জায়িদ বলল,
‘ জ্বি। ওনার কেস নিয়ে তদন্ত চলছে।
জিনিয়া এগিয়ে আসে। জায়িদকে টেনে নিয়ে যায়। বলে,
‘ ভাইয়া এই দেখো। লেন্স পেয়েছি একটা।
জায়িদ হাতে নিল। বলল,
‘ ছক্কা মেরেছিস জুননু। অনেক কাজে লাগবে।

তারমধ্য চেঁচামেচি কানে আসে জিনিয়া ও জায়িদের। দুজনই তাকায়। টেডিবিয়ার নিয়ে দৌঁড়ানো মেয়েটার পিছু পিছু দৌড়ে যাওয়া ছেলেটি ডাকে,
‘ পূজারিণী দৌড়াস না। পূজারিনী? পড়ে যাবি। এই পূজা?
মিঃ চ্যাটার্জি ব্যস্ত হয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ প্রণয় পূজাকে থামতে বলো। পড়ে যাবে। আহা।
জিনিয়া বলল,
‘ ওনার মেয়ে কি পাগল ভাইয়া?
জায়িদ বলল,
‘ কে জানে? হয়ত। মাথা খারাপ না হলে কেউ এভাবে দৌড়ে নাকি?

পূজা দৌড়াতে গিয়ে থামে আইসক্রিম ওয়ালার কাছে। আইসক্রিম বিক্রেতা পূজাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, কি চাই?
পূজা গালে আঙুল ডুকিয়ে দুলতে থাকে। প্রণয় হাঁপাতে থাকে হাঁটুতে হাত দিয়ে। আইসক্রিম ওয়ালাকে দেখে বলে,
‘ পূজারিণী তুই আইসক্রিম খাবি বলবি না? আশ্চর্য!
আইসক্রিম কিনে নেয় প্রণয়। পূজা আইসক্রিম হাতে নেয়। খেতে খেতে বলে,
‘ এটার নাম কি দাভাই?
প্রণয় খেতে খেতে বলে,
‘ আইসক্রিম গাধী।
পূজা হাসল।
‘ আইসক্রিম। আইসক্রিম। আইসের উপর ক্রিম। আইসক্রিম।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here