রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে’ পর্ব-৪৫

0
814

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৪৬]

জিনিয়া হঠাৎই জ্ঞান হারালো মনে হলো। সাহিল কোলে তুলে নিল তাকে। ডক্টর হোসেনকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথে চলে এলেন তিনি। তিনি যেন নিজের আয়ু গুনছেন। সাহিলের কথামতো স্ট্রেচার নিয়ে হাজির হলেন তালুকদার বাড়িতে। শফিক সাহেব আর জাহেদা আটকাতে চেয়ে ও পারলোনা। সাহিল জিনিয়াকে নিয়ে গেল হসপিটালে। অপারেশন হলো জিনিয়ার। অপারেশন হলো সাহিলের। নিজের দুটো কিডনি সে দিয়ে দিল জিনিয়াকে। জিনিয়াকে সে তার নিজের অংশ দিয়ে বাঁচালো। ২৪ ঘন্টা পার হতেই জ্ঞান ফিরল সাহিলের। ডায়ালোসিস করায় সাহিল উঠে দাঁড়ালো। যেকোনো সময় রক্তনালি বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে সে। যখন কেবিনের বাইরে চলে এল তখন দেখল সবাই। নাহিল দৌড়ে এল। সাহিলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ভাই! ভাই কি হলো এটা ভাই?
সাহিল থেমেথেমে বলল
‘ আমার পাপ আমাকেই শেষ করল নাহিল। যে কিডনি নিয়ে আমি খেলা করতাম রোজ, সে কিডনি আল্লাহ নষ্ট করে দিল জিনির৷ আমাকে শাস্তি দিল আল্লাহ।
সালেহা বেগম জ্ঞান হারান ছেলেকে দেখে।
সাগর সাহেব ভেঙে চুরমার। জাহেদা, শফিক সাহেব, জায়িদ স্তব্ধ। সাহিলের বিরুদ্ধে জোগাড় করা প্রমাণ সে ফেলে দিল৷ ফেলে দিল সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ৷ সেখানে আছে সাহিল কিভাবে নির্মমভাবে রূপসা গ্রামের বড় পুলিশ অফিসারকে হত্যা করেছে। জায়িদ ফেলে দিল।

সাহিল দেখতে গেল জিনিয়াকে। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে অচেতন জিনিয়ার কপালে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল সে। লাল শাড়িটা দিয়ে ঘোমটা পড়িয়ে দিল। মনে হলো চারবছর আগের সেই নতুন বউ। সে ঘুমন্ত মুখ। যে মুখে জিনিয়ার অবচেতনে সে আঁকত ভালোবাসার নকশা। যে মুখের দিকে তাকাতেই কেটে যেত তার সারাদিনের ক্লান্তি।

সাহিল জিনিয়ারদুগাল আঁকড়ে ধরে বলল
জিনি , আমার জীবনের সবচাইতে বড় মিথ্যে আমি তোমাকে ভালোবাসিনি।
সবচাইতে বড় সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদি উপরওয়ালা চায় আমাদের দেখা হবে ওইপাড়ে। কথা দিলাম আর কখনো ঠকাবোনা তোমায়। ভালোবাসার অভিনয় করবনা। তোমার গায়ে একটা আঁচড় ও লাগতে দেবনা। এইপাড়ে আর তোমায় ভালোবাসা হলোনা জিনি। তোমায় আর নতুন করে পাওয়া হলোনা। ওইপাড়ে তুমি যেন আমার হও। আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার। আমাকে তখন নোংরা বলে দূরে সরিয়ে দিওনা। একটু ভালোবাসতে দিও, ঠকবেনা। শুধু একটুখানি।

সাহিল হাঁটা ধরল তাননা মুননার উদ্দেশ্যে। বারবার ফিরে তাকালো নিজের পরিবার পরিজনদের কাছে।
এবার সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা।
এই জগত সংসার হঠাৎ করে এত সুন্দর মনে হচ্ছে কেন? মন হচ্ছে তুচ্ছ কারণ নিয়ে ও বাঁচা যায় এই সুন্দর পৃথিবীতে। স্ত্রী, সন্তানদের সাথে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিগুলো সবচাইতে দামী মুহূর্ত। আমরা আসলেই বুঝতে পারিনা।
অর্ধাঙ্গিনী শব্দটা আসলেই যথার্থ। নিজের একটা অংশ জুড়ে থাকে স্ত্রী। তবে এরিজমার মতো স্ত্রী শুধু বিজনেস ডিল। দুই স্বামীর হত্যাকারী এরিজমা সাহিলের বিয়ের প্রস্তাব রাখে ইয়াজিদের কাছে। মেয়ের আবদার রাখতে পুরো বিজনেস ইয়াজিদ তুলে দেয় সাহিলের হাতে। সাহিল বিজনেস হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিয়ে করে এরিজমাকে। কিন্তু কখনো ঘনিষ্ঠ হয়নি তারসাথে। বিয়ের রাতেই সাহিল মেরে রক্তাক্ত করে এরিজমাকে। বিজনেস তার হাতের মুঠোয় চলে আসায় সাহিল তালাক দিয়ে দেয় এরিজমাকে৷ ডিভোর্স লেটার ছুঁড়ে মারে। এরিজমা তা মেনে নেয়না। সাহিল ইয়াজিদ আর ইয়ামিনকে হাতে রাখার জন্য এরিজমার সাথে আক্রমণাত্মক ব্যবহার কমিয়ে আনে। নইলে তারা সব বলে দিত সাগর সাহেবকে। জিনিয়াকে বিয়ে করার পর সাহিল আর ও ভয়ে থাকে। এরিজমা সেই সুযোগ হাতিয়ে নিয়ে সাহিলকে কাছে পেতে চায়ত। তবে সাহিল শতশতবার আঘাত করেছে এরিজমাকে। একবার তো জ্বলন্ত সিগারেট লাগিয়ে দিয়ে ঘাড়ের কাছে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ইয়াজিদ তাকে ব্যবহার করে পাপের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। আর সেই পাপের সাম্রাজ্য সাহিল কেড়ে নিল। নিজ হাতেই ধ্বংস করল।
ভীষণ কাঁপল সাহিলের শরীর। অপারেশনের জায়গা এখনো কাঁচা। তালুকদার বাড়িতে আছে আনহা, তাননা, মুননা।

এসে দেখল অন্ধকার পুরো বাড়ি। সাহিল লাইট জ্বালিয়ে দিতেই কেঁদে উঠল তাননা,মুননা,আনহা। সাহিলের কাছে দৌড়ে আসল। আনহা কেঁদে দিয়ে বলল
‘ ভাইয়া দরজা বন্ধ করতে যেতে ভয় লাগছিল। মনে হলো বাইরে কেউ আছে তাই লাইট বন্ধ করে রেখেছি।
সাহিল বলল,
‘ ভয় নেই আমি আছি।
তাননা মুননা দৌড়ে এল। আব্বা আব্বা ডেকে।
সাহিল তাননা মুননাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। থেমেথেমে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল
‘ আব্বা, আম্মা।
মুননা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল।
‘ গুড্ডু কেন কানে?
সাহিল ঠোঁট চেপে ধরল মুননার গালে। তাননার গালে ও আদর করে দিয়ে বলল
‘ আম্মাকে দেখে রেখো আব্বা। ভালো রেখো। ভালো থেকো।
তাননা বলল
‘ আব্বা কুথায় যাবে?
‘ ঘুম যাবো মা। একটু ঘুমাবো। কতদিন ঘুমায় না।
আনহা হাউমাউ করে কেঁদে বলল
‘ না ভাইয়া। নাহ।
সাহিল সিঁড়িতে বসে পড়ল। আনহা এসে ধরলো তাকে। সাহিল বুক চেপে ধরে বলল
‘ বোন আমার। আমার দুই সন্তানকে আগলে রাখিস। তাদের অভিভাবক তোরা।
আনহা বলল
‘ নাহ, নাহ তুমি কোথাও যাবেনা। কোথাও না।
তাননা মুননা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সাহিল আনহার কোলে মাথা রাখল। বলল
‘ আমি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়বো বোন।
তাননা চিল্লিয়ে বলল
‘ আল্লাহ আব্বাকে দিয়ে দাও। আমাল কাছি দিয়ে দাও। আল্লাহ আব্বাকে আল মারুনা। আব্বা বিথা পায়, কষতো পায়।
মুননা গিয়ে সাহিলের বুকে হাত রাখল। সাহিল মুননার হাত চেপে ধরল তার বুকে।তাননাকে ডাকল
‘ মা পানি দেবে একটু?
তাননা পানি আনলো। বেশঅর্ধেক পড়ে গেল। আনহা কাঁদল জোরেজোরে। তাননা পানি খাওয়াতে নিয়ে গেল। কোথাথেকে গুলি এসে পড়ল গ্লাসে। গ্লাস ছিটকে দূরে পড়ে গেল। তাননা চেঁচিয়ে উঠে পড়ে গেল। আনহা মুননা কেঁদে উঠল। ইয়াজিদের মাথায় হ্যাট, হাতে পিস্তল, ঠোঁটে সিগারেট।
মাথার হ্যাট ফেলে দিয়ে গুলি তাক করল সাহিলের দিকে। সাহিল উঠে দাঁড়ালো কাঁপাকাঁপা পায়ে। পিস্তল তাক করল ইয়াজিদের দিকে। সাহিল বলল
‘ তাননা মুননা লুকিয়ে পড়ো। আনহা যাহ।
আনহা যেতে চাইলো না । সাহিল বলল,যাহহ। আমার কছম।
আনহা পিলারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাননা মুননা সোফার নিচে ডুকে বসে থাকলো। সাহিল গুলি তাক করে নরম গলায় বলল
‘ তুই বেঁচেছিলি শুধু। মর এবার। আমার মৃত্যুর ভয় নেই।
ইয়াজিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
‘ তোর পেছনে কে দেখ?
সাহিল আনহা ভেবে ফিরে তাকালো। তার পিঠে গুলি ছুড়ল ইয়াজিদ। গুলি বের হয়ে গেল সামনের বুক দিয়ে। পিলারের সাথে লাগোয়া আনহা চিৎকার করে পিলার ঘেঁষে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে পালালো ইয়াজিদ। ওহ শিট বাচ্চাদুটোকে মারা গেলনা। যাইহোক সাহিলকে মারতে পারলো তাতে যথেষ্ট। তিল তিল করে তার বানানো হাতিয়ার সাহিল। নিজ হাতে গড়লো নিজ হাতে মারলো।
পালালো ইয়াজিদ।

বুকে হাত দিয়ে পড়ে যেতেই তাননা মুননা এসে ধরল সাহিলকে। মুননা কোলে নিল সাহিলের মাথা। তাননা পুরো জগ নিয়ে এসে ছোট্ট হাতটাতে ঢেলে সাহিলের মুখে পানি দিল। পড়ল, লা ইলাহা, লা ইলাহা। আল্লাহ আব্বাকে নিওনা, নিওনা। আব্বা আল্লাহ বুলো। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বুুলো। বুলো।
সাহিল নিভু নিভু চোখে চেয়ে রইল তাননা মুননাকে। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। পাগলের মতো হন্য হয়ে দৌড়ে এল জিনিয়া। তার পিছু পিছু সবাই। সাহিলকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে সবাই আর এগোতে পারলোনা। জিনিয়ার গায়ে সেই লাল শাড়ি। কেবিন,থেকে বের হয়ে মা কিভাবে তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিল কে জানে!
সাহিলকে দেখে শান্ত হয়ে গেল সে। হেসে ফেলল। মুননার কোল থেকে সাহিলের মাথা নিজের কোলে নিয়ে ফেলে বলল
‘ আপনি নাকি আমায় কিডনি দিলেন? আপনার জিনিস আমার মাঝে কেন দিলেন?
সাহিল আঁধার চোখে দেখল প্রিয়তমাকে। জিনিয়া হেসে হেসে বলল
‘ আপনি তো খুব দয়ালু দেখছি। ভালোবাসেননি আমায়, কিন্তু দয়া দেখিয়ে গেলেন।
জিনিয়া বাচ্চাদের হাত সরিয়ে নিজের হাত রাখল সাহিলের বুকে। রক্ত ভেসে গেল তার হাত। জিনিয়া রক্ত দেখে বলল
‘ আপনার কি বেশি লেগেছে?
সাহিল শেষবারের মতো ডাকল
‘ জিনি। একটু ভালোবাসবে?
জিনিয়া মাথা নাড়ালো। সাহিল হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছুঁল তার মুখ। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে বলল
‘ নাহিল, সোরা।
নাহিল আর সোরা দৌড়ে এল।
নাহিল বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠে বলল
‘ ভাই। আমার ভাই। কে করেছে তোমার এই অবস্থা? কে?
সাহিল সোরার দিকে তাকালো। নাহিলের হাত ধরে সোরার হাতের উপর রেখে দিয়ে বুক তুলে বলল
‘ সোরা আমায় মাফ করিস। নাহিলকে তাননা মুননাকে আগলে রাখিস। নাহিলকে সুযোগ দিস।
সোরা কাঁদল জোরে। জায়িদ এসে বলল
‘ সাহিল আমি তোর এমন পরিণতি চাইনি।
চোখের জল ছেড়ে দিল সাহিল। বলল
‘ ইয়াজিদকে মারবি। জিনিকে তাননা মুননাকে দেখবি। আলবিদা।
জিনিয়া চেঁচিয়ে উঠল।
‘ নাহ। নাহ। এই শাড়ি গায়ে আমি আপনাকে গ্রহণ করেছি, এই শাড়ি পড়ে আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আমাকে মেরে ফেলবেন না। আমি মরতে চাইনা। আপনি মারবেন না আমায়। যাবেন না। যাবেন না।
হাসল সাহিল। জিনিয়ার চোখের জলের ফোঁটা পড়ল তার চোখের উপর। চোখ বন্ধ করল সাহিল। বিড়বিড় করল
‘ মা, বাবা ক্ষমা করো। ক্ষমা করো।
জিনিয়া খেয়াল করল সাহিলের মাথা ভার হয়ে এল। হঠাৎ আচমকা বুক লাফিয়ে উঠল সাহিলের। জিনিয়া বুকে আগলে ধরল তাকে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দুনিয়ার মায়া ছাড়ল সাহিল। অন্ধকার করে গেল পুরো বাড়ি। নিঃস্ব করে গেল প্রিয়তমাকে। অনাথ এতিম করে গেল বাচ্চাদুটোকে।
তাননা মুননা মোনাজাত তুললো। আল্লাহ ভালু রাখু আব্বাকে। আল দুক্কু দিওনা। আব্বাকে এট্টু আদোল কলো। এট্টু ভালু রাখো। বলেই কান্না শুরু করলো দুজন।
জিনিয়া সাহিলের মাথা টেনে ধরল বুকে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বাড়ি কাঁপল। কাঁপল বাড়ির প্রতিটি আঙিনা। বাইরে ওঠা তপ্ত সূর্যটার আশেপাশের মেঘ যেন বের হতে শুরু করল ধীরেধীরে। ঢেকে যেত লাগলো সূর্যটা। জিনিয়া কাঁদল। তার কান্নার আওয়াজে কাঁদল গাছ। কাঁদল গাছের, ফুল,পাতা,পাখি ওই আকাশ আর সূর্য। যারা সাক্ষী ছিল তাদের ভালোবাসার। নোংরা, অমানুষ, জানোয়ার ঢাকা মেয়েটা নিথর হয়ে থাকা স্বামীর হাত ছোঁয়ালো নিজের মুখে। মৃদুমধুর স্বরে ডাকল
‘ শুনছেন। একটু ভালোবাসুন। নোংরা বলবোনা। একটু ভালোবাসুন। শুধু একটুখানি।
হাতটা চোখের জল, ঠোঁটের জলে ভিজিয়ে দিল জিনিয়া। সাহিলের মাথা রেখে সে শুয়ে পড়ল সাহিলের বুকের উপর। মাথা তুলে মুখ ধরে ডেকে বলল
‘ আল্লাহ! আমি এই বুকের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিনা কেন? শুনতে পাচ্ছিনা ভালোবাসি ভালোবাসি শব্দটা। কেন? কেন?
স্তব্ধ, শান্ত, ভারী পরিবেশকে ঠেলে দিয়ে হু হু করে বাতাস ডুকে এল বাড়িতে। যেন বাতাসের সুরে সুরে ধ্বনিত হলো অভিমানী গলার সেই শব্দমালা।

জিনি!

কিছুটা মেঘ এসে যদি থামে,
তোমার ওই সন্ধ্যানামার খামে।
কিছুটা রোদ যদি ঢাকা পড়ে যায়,
তোমার অনাদর,অবহেলায়,
জেনে নিও, খুঁজে আর পাবে না আমায়।
আমি ফিরব না আর ভালোবাসতে তোমায়।
হারিয়ে যাব বহুদূর অজানাই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here