রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৪৪

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আরু কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?”

রৌদ্রর কথায় আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। রৌদ্রর হাত ছেড়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে চাপা কন্ঠে বলল-

“এই সময় যেহেতু এসেছেন আম্মু আব্বুর সাথে দেখা করেই যান।”

রৌদ্র নিজের দিকে একবার তাকিয়ে। আরশির দিকে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল-

“কিন্তু এভাবে কি করে?”

আরশি নিম্ন স্বরে ফিসফিস করে বলল-

“কিছু হবে না ভালোই লাগছে। কিন্তু এখন যদি আমি একা একা তাদের কাছে যাই তাহলে কে এসেছে না এসেছে এসব নিয়ে নানান রকম প্রশ্ন করে আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবে।”

রৌদ্র কিছু বলার আগেই আরশির আব্বু ড্রয়িংরুমে আসতে আসতে বলছেন-

“আরশি মা কে এসেছে! এতো সময় লাগছে কেন?”

আদিব হাসান ড্রয়িং রুমে এসে রৌদ্রকে দেখে বললেন-

“রৌদ্র তুমি! কেমন আছো?”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলল-

“আমি কল করে বলেছিলাম তোমরা এসেছো। তাই উনি তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে।”

রৌদ্র আদিব হাসানের দিকে এগিয়ে যায়। হাসি মুখে সালাম বিনিময় করে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরে। রৌদ্র কন্ঠ শুনে ভেতর থেকে আরশির মা আর কাসফিয়া আব্বু আম্মু সবাই বেরিয়ে আসে। রৌদ্র সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর আরশি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রৌদ্রর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখতে ব্যস্ত। লোকটা অল্পতেই সব কিছু সামলিয়ে নেয়। যে কোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখা অসীম ক্ষমতা এই মানুষটা মধ্যে আছে। আরশি রৌদ্রর থেকে চোখ সরিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায়।

————————

বিকেলে সবাই আবারও শপিংমলে এসেছে। গায়ে হলুদের শাড়ি কেনার জন্য আরশি একটা দোকানে বসে শাড়ি দেখছে। আর রৌদ্র তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সবাই অন্যসব দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আরশি একটা হলুদ রঙের শাড়ি গায়ের উপর রাখতেই দোকানদার অতিমাত্রায় উত্তেজনা নিয়ে বলল-

“ম্যাম এই শাড়িটায় আপনাকে খুব মানিয়ে। আপনি এটা নিতে পারেন।”

দোকানদারের কথায় রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে তাকালো। দোকাদার অতি উৎসাহ নিয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি একটা মুচকি হাসি দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রৌদ্র আরশির দিকে না থাকিয়েই গম্ভীর গলায় বলল-

“এই শাড়িটায় তোমাকে একদমই মানাচ্ছে না মিস আরু।”

আরশি রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। রৌদ্র তাকে না দেখেই এই কথা বলেছে ভেবে আরশি একটা জোরালো শ্বাস ফেলে। হাতের শাড়িটা রেখে দিতেই দোকানদার আরেকটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল-

“ম্যাম আপনি এই শাড়িটি দেখতে পারেন। আপনাকে খুব সুন্দর মানাবে এই কালারটা।”

আরশি শাড়িটি হাতে নেওয়ার আগেই রৌদ্র গাম্ভীর্যের সাথে বলল-

“এটাও ভালো লাগছে না।”

আরশি বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। দোকানদার এই শাড়িটাও রেখে দিয়ে অন্য শাড়িতে দেখাতে লাগলো। পর পর চার বার একই ঘটনা ঘটায় আরশি এবার প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। রৌদ্রর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালো। সে আগের মতোই ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আরশি রেগেমেগে হাতের শাড়িটাও রেখে দিল। দোকানদার আবারও একটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আরশি দাঁতে দাঁত চেপে বলল-

“ভাইয়া আপনি চুপ করুন। আপনার আর কিছু বলতে হবে না। এভাবে চলতে থাকলে বিয়ের ডেট এখানেই পাড় হয়ে যাবে।”

আরশি কথা গুলো বলেই উঠে রৌদ্রর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“কি শুরু করেছেন আপনি এসব? উনি তো ওনার কাজই করছেন। এখানে এতো জেলাস হওয়ার কি আছে অদ্ভুত! যাই হোক পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনি নিজেই সব পছন্দ করবেন। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। আপনি যা করার করুন।”

রৌদ্র ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি তুলে আরশির দিকে তাকালো। চোখ মুখে রাগের আভাস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আরশির। রৌদ্র কোনো কথা না বাড়িয়ে শাড়ি দেখতে লাগলো। বেশ খানিকটা সময় পর লালচে-হলুদ আর কমলা রঙের একটা শাড়ি পছন্দ করলো। আরশির গায়ের উপর রেখে মুচকি হাসি দিল। আরশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“এটায় তোমাকে একদম রুদ্রাণীর মতো লাগবে। এটাই বেশ মানিয়েছে তোমাকে।”

আরশি কোনো কথা না বলে রৌদ্র পছন্দ মতো সব নিয়ে নেয়। শপিংমল থেকে বাসায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় আটটা বেজে যায়। গাড়ি থামার সাথে সাথেই কাসফিয়া ক্লান্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। আরশি গাড়ি থেকে নামতে নিবে তখনই রৌদ্র তার হাত ধরে ফেলে। আরশি কৌতুহলী চোখে রৌদ্রর দিকে তাকাতেই রৌদ্র আরশির দিকে এগিয়ে যায়। আরশিকে কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল-

“এই রৌদ্র তার রুদ্রাণীকে বড্ড বেশি ভালোবাসে আরু।”

রৌদ্র কথাটা বলেই নিজের সিটে স্বাভাবিক হয়ে বসে। আরশি বিস্মিত হয়ে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল-

“মিস আরু তাড়াতাড়ি যাও কাসফিয়া দাঁড়িয়ে আছে তো।”

আরশি কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে চলে যায়। রৌদ্র অপলকভাবে আরশির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

————————

ব্যস্ততার মাঝেই কেটে গেল দু’দিন। আজ রৌদ্র আরশির গায়ে হলুদ। চোখের পলকেই যেন দিন চলে যাচ্ছে। বিয়ের কাজ নিয়েই সবাই ব্যস্ত। বিকেল চারটায় শুরু হবে হলুদের হলুদের অনুষ্ঠান। আরশি চুপচাপ সোফায় বসে সবার ব্যস্ততা দেখে যাচ্ছে। তার বন্ধুরা কখনো নিচে কখনো ছাদে দৌড়াদৌড়ি করছে। কারও হাতে গোলাপ ফুল। কারো হাতে গাঁদা ফুলের মালা। আরশি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ তাকে সময় দিচ্ছে না। সবাই বাড়ির সাজগোছ করতেই ব্যস্ত৷ আরশি উঠে তার বন্ধুদের কাছে এসে ধমকের সুরে বলল-

“আমি একা একা বসে বোর হচ্ছি তোদের কি সে দিকে খেয়াল আছে! আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তোরা আমাকে সময় না দিয়ে উল্টো আমাকে একা করে দিচ্ছিস।”

আরশির কথায় সবাই বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালো। নীল আরশির দিকে চেয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে কি? তোর বিয়ে তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমরা তো এখন তোকে বিদায় করার জন্য এসব কিছু করছি।”

আরশি রাগে তেতে উঠলো। নীলের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই নীলের চুল নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়। নীল হাতের গাঁদা ফুলের মালা গুলো ফেলে দিয়ে আরশির হাত চুল থেকে ছাড়ানো চেষ্টা করছে। আদ্রাফ, কাসফিয়া আর নীলা মিটমিটিয়ে হাসছে তাদের ঝগড়া দেখে। এই দুইটা মানুষ এক সাথে হলেই টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া লেগে থাকে। নীল আরশির হাত ছাড়ানো চেষ্টা করতে করতে অনুনয়ের স্বরে বলল-

“আশু প্লিজ চুল ছাড়। ব্যথা পাচ্ছি খুব।”

আরশি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“তোর মতো হারামির সাথে এমনটা-ই করা উচিত।”

আরশি নীলের চুল ছেড়ে দুহাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে নিল। নীল চুলে হাত বুলিয়ে নিতে নিতেই বলল-

“তোর মতো শাকচুন্নিকে যত তাড়াতাড়ি জামাইর বাড়ি পাঠিয়ে বিদায় করতে পারবো তত তাড়াতাড়িই আমরা তোর হাত থেকে রক্ষা পাবো।”

নীলের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আরশি তাদের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে থাকে। জোরালো শ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে যেতে যেতে শান্ত গলায় বলল-

“এখন আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছিস না যখন আমি থাকবো না তখন ঠিকই বুঝতে পারবি আমার গুরুত্ব।”

আরশি আর পেছন ফিরে তাকালো না। দেখলো না তার দিকে তাকিয়ে থাকা কয়েক জোড়া সিক্ত চোখগুলো। নীল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির রুমের দিকে। মুহুর্তের মধ্যেই তাদের উজ্জ্বল হাসি মুখখানা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। আরশি শান্ত গলায় এমন কথা বলবে সেটা কেউ আশা করেনি। আদ্রাফ নীলের কাধে হাত রেখে বলল-

“নীল হাতে বেশি সময় নেই। স্টেজ সাজানো এখনো বাকি। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করতে হবে।”

নীল আদ্রাফের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিচ থেকে ফুল গুলো তুলে নেয়। গম্ভীর পায়ে ছাদের উদ্দেশ্যে চলে যায়। নীলের সাথে সাথে বাকি সবাই চুপচাপ মলিন মুখে চলে যায়।

————————

হলুদের সাজে নিজেকে সাজিয়ে চুপটি মেরে বসে আছে আরশি। লালচে-হলুদ রঙের শাড়িতে কমলা রঙের পাড়। গায়ে জড়ানো বেলি, লাল গোলাপ আর গাঁদা ফুলের অলংকার। তাজা ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে আরশির চারপাশে। মুখে হাল্কা মেকআপ। দু চোখে কাজল আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক। হাতে পায়ে রক্তলাল রঙের আলতা। এই মুহূর্তে কোনো ফুলপরি থেকে কম লাগিছে না আরশিকে। শাড়ি পরে নড়াচড়া করা আরশির কাছে খুবই বিপদজনক মনে হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেই মনের মধ্যে ভয় ঝেঁকে ধরে। এই বুঝি শাড়ির কুচি খুলে যাবে। এখনই হয়তো হোঁচট খেয়ে পরে যাবে। এসব ভেবেই মনের মধ্যে ভয় নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

বিকেলের শেষ সময়। পশ্চিমা আকাশের সূর্য রক্তিম আভা ধারণ করছে। বিকেল চারটায় হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করার কথা হলেও পুরো ছাদ জুড়ে এখন নিস্তব্ধতা ঘেরে আছে। সকলের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আরশি স্টেজের সোফায় ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। হঠাৎ করে এমন কিছু হয়ে যাওয়ায় কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে আরশি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও অনুষ্ঠানের মূল মানুষটা-ই সকাল থেকে গায়েব। রৌদ্র সকাল বেলা বাসা থেকে বেরিয়েছে এখনো তার ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। রৌদ্র ফোনে ট্রায় করেও সবাই ক্লান্ত। বার বার রৌদ্রর নাম্বারে করলেও প্রতিবার ফোন বন্ধই এসেছে। নির্বান, নীল আর আদ্রাফ বেরিয়েছে রৌদ্রর খোঁজে। রৌদ্র বাবা-মা চিন্তায় অস্থির হয়ে পরেছে তাদের ছেলের জন্য। আরশি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই আরশির ফোন কেঁপে উঠলো। আরশি ফোন নিয়ে স্কিনের তাকাতেই বড় বড় করে নীড় লেখা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আরশি সোফা থেকে উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। আরশি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে নির্বান অস্থিরতার সাথে বলল-

“হ্যালো ক্রাশ ভাবি! ভাইয়ার গাড়ি এক্সিডেন করেছে। ভাইয়া এখন হসপিটালেই আছে।”

নির্বানের কথা শুনে আরশির পুরো দুনিয়া ঘুরে গেল। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে তার। পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। আরশির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নির্বান আবারও অস্থির কন্ঠে বলল-

“হ্যালো কিছু বলছো না কেন! ভাবি ফুপিমণি কে কিন্তু কিছু বলো না। আমার ফোনে চার্জ….”

নির্বানের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন কেটে গেল। আরশি কোনো রকম নিজেকে সামলিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল কাওকে কিছু না বলে। ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে একা একাই বেরিয়ে পরলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আরশি স্থির চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অঝোরে নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে। চোখের কাজল গুলো লেপ্টে যাচ্ছে চোখের পানিতে। নির্বানের কথা গুলো মনে পরতেই তার বুকে বার বার মোচড় দিয়ে উঠছে। দুচোখ যেন অন্ধকার হয়ে আসছে।

চলবে…

[দুঃখিত দেরি করার জন্য। প্রতি শুক্রবারই বাসায় মেহমান থাকে তাই এই দিনটাই গল্প লেখা খুব মুশকিল হয়ে পরে। দুঃখিত। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here