#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আশু তুই তোর দেবর কে বলে আমার পেছনে যেন এভাবে সব সময় লেগে না থাকে।”
আরশিকে স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে রৌদ্র ফোনে কথা বলতে গেছে কিছুক্ষণ হলো। আরশি বসে বসে নীলদের জন্য অপেক্ষা করছিল তখনই নীলা এসে নাক মুখ কুচকে আরশিকে কথাটা বলল। আরশি ভ্রু কুচকে নীলার দিকে তাকালো। নীলার চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তি। নীলা কথাটা বলার পরেই নির্বান নীলার পেছন থেকে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে আরশির দিকে এগিয়ে আসে। খুব সুন্দর করেই শালীন কন্ঠে আরশিকে বলল-
“পাশের বারান্দা কেমন আছো তুমি?”
আরশি মুচকি হাসি বলল-
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন নীড়?”
নির্বান আড় চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ভালো তো থাকতে চাই কিন্তু কেউ আমাকে ভালো থাকতে দেয় না গো ক্রাশ ভাবি।”
আরশি নির্বানের কথায় ঠোঁট চেপে হাসে। নীলা গাল ফুলিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
“আশু তুই কি ওনাকে কিছু বলবি!”
আরশি হাত দুটো আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করল-
“কেন কি হয়েছে নিলু?”
“কি হয়েছে তুই জানিস না! উনি সব সময় আমাকে এতো ক্ষেপায় কেন? মাত্রই দেখা হলো আর উনি সাথে সাথেই শুরু করে দিয়েছে আজে বাজে কথা বলা।”
নীলা নাক ফুলিয়ে কথা গুলো বলল। নির্বান নীলাকে ক্ষেপানোর জন্য আরশিকে বলল-
“দেখলে ভাবি এতো বড় মেয়ে কতো ন্যাকামি করে কথা বলে!! আমি ওকে কিছুই বলিনি ও সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে তোমাকে।”
“তোরা কেউ কারও থেকে কম না নির্বান।”
রৌদ্র পকেটে দুহাত গুজে দিয়ে নীলের সাথে আসতে আসতে কথাটা বলল। নীল হাসি মুখে আরশির পাশে এসে দাঁড়ায়। আরশির মাথায় আস্তে করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“কিরে বিবাহিত বেবি কেমন আছিস?”
আরশি নীলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নীলের পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“তুই জীবনেও ভালো হবি না হারামি। তোকে না বলেছি আমাকে এই নামে ডাকতে না!!”
রৌদ্র তাদের ঝগড়া দেখে বিরক্ত হয়ে বলল-
“এই দুজন চুপ হতে না হতেই তোমরা দুজন শুরু করে দিলে! তোমরা এক এক জন এতোটা বিচ্ছু টাইপের হলে কি করে? মাঝ দিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে তোমরা সবাই।”
রৌদ্রর কথা আরশির তার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায়। আরশি কিছু বলার আগেই রৌদ্র কথা পাল্টিয়ে বলল-
“এখন তো নীল ওরা সবাই এসে পরেছে। চল এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কথাটা বলেই রৌদ্র ল্যাগেজ নিয়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যায়। নির্বান হাসি দিয়ে বলল-
“ক্রাশ ভাবি দেখলে তো ভাইয়া তোমাকে ভয় পেয়েছে।”
নির্বানের কথায় আরশি মুচকি হাসে। তারপর রৌদ্র পেছন পেছন আরশিরাও চলে যায়। রৌদ্র কেবিনে ল্যাগেজ রেখে কেবিনের বাহিরে চলে আসে। আরশিরা কেবিনের দরজার কাছে আসতেই আচমকা একটা দু-তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে এসে আরশির পা জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথেই আরশি থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রৌদ্র আর নীল ওরা কৌতুহলী চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি বাচ্চাটার দিকে ঝুঁকে মাথায় হাত রাখতেই বাচ্চাটা অস্পষ্ট ভাবে বলল-
“মাম্মা এসেছে। মাম্মা এসেছে।”
বাচ্চাটার মুখে মা ডাক শুনে আরশির অন্তর কেঁপে উঠল। স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে তার। হঠাৎই সামনে থেকে একটা লোক এসে বাচ্চাটাকে আরশির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
“সরি ম্যাম। আসলে ওর আম্মুও আপনার মতো শাড়ি পরে তো তাই আপনাকে ওর আম্মু ভেবেছে। সরি আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য।”
রৌদ্র আরশির মলিন মুখের দিকে তাকাতেই বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আরশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মুখে হাসি টেনে নেয়। লোকটার কাধে হাত দিয়ে বলল-
“সমস্যা নেই বাচ্চা মানুষ ভুল হতেই পারে।”
রৌদ্র কথায় লোকটা সৌজন্যমূলক হাসি দেয়। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পাশের কেবিনে চলে যায়। আরশি এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীল আরশিকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে। মুখে হাসি টেনে আরশিকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-
“কিরে শাকচুন্নি এখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবি না-কি! আমার পা ব্যথা করছে চল চল ভিতরে চল।”
নীলের ধাক্কায় আরশির স্তম্ভিত ফিরে। রৌদ্র দিকে এক পলক তাকিয়ে চুপচাপ কেবিনে ভেতর চলে আসে। নীল আর রৌদ্র একে অপরের দিকে তাকিয়ে জোরালো শ্বাস ফেলে। একে একে সবাই কেবিনে যেয়ে বসে পরে।
(সময়ের বহমান স্রোতের সাথে পালটে যায় অনেক যায় কিছু। আশেপাশের মানুষ, মানুষের অনুভূতি আর একে অপরের সাথে পুরনো সম্পর্ক সব কিছুই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হয়। সময়ের সাথে সব কিছু পরিবর্তন হওয়াই হয়তো সময়ের নীতি। এই দু’বছরে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। খুব কাছের মানুষ গুলোর সাথেও দূরত্ব বেড়ে গেছে এই সময়ের পরিবর্তনে। ঠিক যেমনটা হয়েছে আরশিদের বন্ধুত্বে। ছোট্ট বেলার সেই কাছের ফ্রেন্ড কাসফিয়া যার সাথেই আরশির বেড়ে ওঠা। সেই মানুষটার সাথেও তৈরি হয়েছে দূরত্ব। দেখা হওয়া, কথা বলা সব কিছুই যেন এখন দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কাসফিয়া এখন স্বামী আদ্রাফ আর তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রেন্ড সার্কেলের সব থেকে হারামি, দুষ্টু ছেলে নীলও এখন মনোযোগ দিয়ে বাবার ব্যবসায় সারাদিন পাড় করে দিচ্ছে। সব থেকে আবেগী নীলা নিজের ভাঙাচোরা হৃদয়টাকে নিজ হাতেই জোড়া দিয়ে এখন পাথরের ন্যায় মজবুত করে তুলেছে। উড়নচণ্ডী নির্বানও এখন তার প্রেয়সীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দিন রাত ছটফটিয়ে উঠে। সারাদিন হাসি মুখে মেয়েটাকে জ্বালাতন করলেও দিন শেষে অন্ধকারের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নির্বান জানে তার প্রেয়সী নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রেখেছে তবুও দিনের আলো দেখা দিতেই যেন নতুন আশা নিয়ে ভালোবাসার সংগ্রামে নেমে পরে। সবার কাছে পরিচিত বীরপুরুষ যে কি-না সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখে সেই বীরপুরুষটা-ও ভয়ে রাতের আঁধারে তার ঘুমন্ত রুদ্রাণীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিলেও এখন সেই মিথ্যাটাই দিন দিন রৌদ্রকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে যেন তার রুদ্রাণীকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে চারদিক থেকে চোরাবালির মতো আঁকড়ে ধরছে। সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক হাসিখুশি রাখা আরশি এখন রাস্তাঘাটে ছোট ছোট বাচ্চা দেখলেই ভেতর ভেতর ডুকরে কেঁদে উঠে। মা ডাক শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে যায়। এতো এতো পরিবর্তনের মাঝেও কিছু কিছু জিনিস পরিবর্তন হয়নি। রৌদ্র আর রুদ্রাণীর নিয়মিত চিঠি আদান-প্রদান কথা সেই আগেই মতোই রঙিন হয়ে আছে। রৌদ্র মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আরশি এখনো লজ্জায় নুয়ে পরে, অস্বস্তিতে হাত কচলাতে থাকে। আর রৌদ্র!! সে তো এখনও তার রুদ্রাণীর লাজুকলতায় প্রতিবার ঘায়েল হয়। বদলায়নি নীলের দায়িত্ববোধ-ও। আরশি আর নীলার প্রতি তার দায়িত্বটা সে সব কিছুর উর্ধ্বে রেখেছে। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে নীলাকে আগলে রাখতে ভোলেনি। প্রতিদিন এক বার হলে-ও আরশিকে ফোন দিয়ে ঝগড়া করা তার নিয়মমাফিক কাজের মধ্যেই পরে। প্রতি সপ্তাহে একবার নীলা আর আরশিকে নিয়ে ভার্সিটির পরিচিত দোকানে ফুচকা খাওয়া কখনো নীলের মিস হয়না। তিনজনের বন্ধুত্ব অটুট থাকলেও তার মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে আদ্রাফ আর কাসফিয়া।)
আরশি মলিন মুখে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটার মুখে মা ডাক শোনার পর থেকেই কোথাও যেন হারিয়ে গেছে আরশির ধ্যান। আরশিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নীল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রৌদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“ভাইয়া আপনি আমাদেরকে আপনার বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন এটা মনে হয় আশুর পছন্দ হয়নি।”
নীলের কথায় আরশি আর রৌদ্র দু’জনেই ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। সবার ঈদের ছুটি থাকায় রৌদ্র আর আরশি দুজন মিলেই প্ল্যান করেছিল এবারের ঈদ রৌদ্রদের বাসায় কাটাবে। আর সাথে করে নীল, নীলা আর নির্বানকেও নিয়ে যাবে। রৌদ্র নীলের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“এই কথা কেন বলছো নীল? আশু নিজেই তো খুব খুশি তোমাদের সাথে ছুটি কাটাবে বলে।”
নীল গোমড়া মুখ করে দু হাত ভাজ করে বলল-
“আশুকে দেখে তো মনে হচ্ছে না ও খুশি হয়েছে। আমরা আপনাদের দুজনের মাঝে এসে পরেছি বলেই হয়তো গাল ফুলিয়ে বসে আছে।”
নীলের কথায় আরশি ক্ষেপে ওঠে। রাগান্বিত চোখে নীলের দিকে তাকায়। সিট থেকে উঠে দাড়িয়ে নীলের চুলে টান দিয়ে আবারও নিজের সিটে বসে পরে। নীল মৃদুস্বরে চেচিয়ে ওঠে ব্যথায়। চুলে হাত বুলিয়ে মিনমিনিয়ে বলল-
“দেখলেন ভাইয়া সত্যি কথা বললেই দোষ।”
রোদ্র, নির্বান আর নীলা মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে আরশির নীলের ঝগড়া দেখে। আরশি রাগে গজগজ করে বলল-
“নীল একদম ফালতু কথা বলবি না বলে দিলাম। সব সময় দশ লাইন বেশি বোঝা বন্ধ কর।”
“তোর সাথে থেকেই তো দশ লাইন বেশি বোঝা শিখেছি তাই না রে নিলু?”
নীলের কথায় নীলা হকচকিয়ে উঠে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল-
“দেখ নীল সব সময় তোরা নিজেদের ঝগড়ার মাঝে আমাকে ফাসিয়ে দিবি না বলে দিচ্ছি। তোরা দুজন তো ঠিকই থাকিস শেষে দেখা যায় আমাকেই বোকা বানিয়ে দিস তোরা।”
নীলার কথায় কেবিনের সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। নির্বান হাসতে হাসতে নীলাকে বলল-
“বোকা মানুষকে আর কিভাবে বোকা বানাবে!!”
নির্বানের কথায় সবার হাসির পরিমান আরও বেরে যায়। নীলা সরু চোখে নির্বানের দিকে তাকালো। আরশিকে উদ্দেশ্য করে রাগী কন্ঠে বলল-
“আশু তুই কি তোর দেবরকে কিছু বলবি!!”
আরশি কোনো রকম নিজের হাসি চেপে রাখে। বড় বড় চোখ করে নির্বানের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বলল-
“নীড় আপনাকে কত বার বলবো সব সময় সবার সামনে সত্যি কথা বলতে হয়না।”
আরশি কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেয়। রৌদ্র মুগ্ধ হয়ে তার রুদ্রাণীর হাসি মুখ খানা দেখে যাচ্ছে। তোমার মলিন মুখটা আমাকে বড্ড কষ্ট দেয় রুদ্রাণী। বার বার মনে হয় আমি হয়তো তোমার ইচ্ছে পূরণে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি আরু। আমি তোমার মুখে সব সময় হাসি দেখতে চাই। তোমার হাসির জন্য এই রৌদ্র সব কিছু করতে রাজি। রৌদ্র মনে মনে কথা গুলো ভেবেই একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে।
চলবে…
(আজকের পর্বটা অগোছালো হয়েছে দুঃখিত। হয়তো আপনাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কোনো ধামাকা আসবে পরবর্তীতে। ধামাকার জন্য অপেক্ষা করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️)