রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৪৯

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“নিলু তুই কি ইচ্ছে করেই নীড় ভাইয়াকে কষ্ট দিচ্ছিস? তুই কেন ওনাকে মেনে নিচ্ছিস না নিলু!”

আরশির কথায় নীলার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে আগের মতোই বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলার এমন নির্লিপ্ততা দেখে আরশির কপাল কুচকে এলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরের দোকানে বসে চা খেতে থাকা রৌদ্র, নির্বান আর নীলের দিকে তাকালো। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে নীলার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“নিলু যা চলে গেছে সেটা নিয়ে শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিস না। এভাবে আর কতদিন একা একা থাকবি? আদ্রাফকে ভালোবেসে তো কষ্ট ছাড়া কিছুই পাসনি। এবার না হয় অন্য কাওকে সুযোগ দে তোকে ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য। আর কেউ না বুঝুক তুই তো বুঝিস ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার কষ্ট কেমন হয়! তুই কি করে সেই একই কষ্ট আরেকজনকে দিতে চাচ্ছিস? মনে রাখিস একটা মানুষ সব সময় হাসিখুশি থাকে তার মানে এই না যে মানুষটার মধ্যে কষ্ট নেই। যাইহোক জীবনটা খুব সুন্দর যদি তুই সেটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারিস। যে তোকে সত্যিই ভালোবেসে আগলে রাখতে চায় তার কাছেই নিজেকে আত্মসমর্পণ করবি অন্য কারও কাছে না।”

আরশির কথা গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো নীলা। মনে হচ্ছে কোনো এক ভাবনার জগতে নিজের মনটা’কে হারিয়ে ফেলেছে। নীলা আর কোনো কথা বলেনি। সে এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার পুরো মাথা জুরেই এখন নির্বানের ভাবনা হস্তক্ষেপ কিরে নিয়েছে।

———————

রৌদদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। বাসায় এসেই সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সাবাই নিজেদের রুমে চলে যায়। কিন্তু আরশি তার শ্বাশুড়ির সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায় তবুও আরশি নিজেদের রুমে আসে না। সবার রাতে খাবার শেষে আবারও শ্বাশুড়ির সাথে আড্ডায় বসে যায়। রাত প্রায় দশটায় আরশি নিজের রুমে আসে। রৌদ্র সোফায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। আরশি রৌদ্রর দিকে একবার তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। চুল গুলোতে চিরুনী দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল-

“আপনি এখনো ঘুমাননি কেন? ল্যাপটপ নিয়ে কি করছেন এই সময়?”

আরশির কথায় রৌদ্র কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। সে আগের মতোই নিজের কাজে ব্যস্ত। আরশি কিছুটা ভ্রু কুচকে আবারও জিজ্ঞেস করলো-

“কি হলো কথা বলছেন না কেন আপনি?”

আরশির কথায় রৌদ্র মাথা তুলে আরশির দিকে তাকায়। আরশির নিজের চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত এখনো। রৌদ্র নুখে গম্ভীর্যতা এনে বলল-

“এতক্ষণে আমাকে আপনার মনে পরলো মিসেস আরু? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ভুলে গিয়েছিলেন আপনার হাসবেন্ডের কথা।”

আরশি আয়নার মধ্যেই রৌদ্রর দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। চুল গুলো হাত খোঁপা করে বিছানায় পা দুলিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল-

“এসব কথা বলছেন কেন? আবার কি নিয়ে রাগ করেছেন আমার উপর যে তুমি থেকে আপনিতে চলে এসেছেন?”

রৌদ্র ল্যাপটপটা বন্ধ করে সোফায় কাছের টেবিলের উপর রাখলো। ডানহাতের আঙুল দিয়ে চুল গুলো পেছনে ঢেলে দেয়। গম্ভীর্যতার সাথে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আরশির দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীরমুখে বলল-

“এখানে আসার পর একবারও কি আপনি আমার কাছে এসেছেন মিসেস আরু?”

আরশি হাল্কা হাসলো। এবার সে বুঝতে সক্ষম হয়েছে তার রৌদ্র কেন গোমড়া মুখে বসে আছে। আরশি মুচকি হেসে রৌদ্র মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় বলল-

“আমরা তো এখানেই এসেছি বিকেলে। আম্মুর সাথে গল্প করতে করতে কখন যে রাত হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। আর আপনার সাথে তো খাবার টেবিলে দেখা হয়েছিলো।”

রৌদ্র বিরক্তি প্রকাশ করে শক্ত গলায় বলল-

“খাবার টেবিলে একবারও আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।”

আরশি সরু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। নাক ফুলিয়ে রাগী কন্ঠে বলল-

“এবার কিন্তু আপনি শুধু শুধুই রাগ দেখাচ্ছেন। এখানে বেড়াতে এসে কি সারাক্ষণ আপনাকে নিয়েই বসে থাকবো না-কি! অদ্ভুত!”

“মিসেস আরু আপনি দেখছি নিজে ভুল করে এখন উল্টো আমাকেই ধমকাচ্ছেন!”

রৌদ্রর এমন কাঠাকাঠ গলা শুনে আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। রৌদ্রর অভিমান এতো সহজে ভাঙবে সেটা আরশি খুব ভালো করেই জানে। আরশি নিরাশ হয়ে আবারও বিছানায় বসে পরে। হতাশার সুর তুলে বলল-

“আচ্ছা এখন বলুন কি করতে হবে! কি করলে আপনার রাগ কমবে?”

রৌদ্র গম্ভীর গলায় বলল-

“বারান্দায় যাও আমি কফি নিয়ে আসছি।”

“আজ আকাশে চাঁদ নেই তাই চন্দ্রবিলাস করা যাবেনা। তাই শুধু শুধু বারান্দায় যেতে হবে না।”

রৌদ্র কথার সাথে সাথেই আরশি ফটাফট করে কথা গুলো বলে উঠলো। এটা রৌদ্র নিয়মিত কাজ। দু-এক দিন পর পর বারান্দায় চন্দ্রবিলাস আর বৃষ্টিবিলাস করা মাঝে মাঝে তো কোনো কারন ছাড়াই আরশিকে নিয়ে বারান্দায় অনায়াসে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়। আরশির কথায় রৌদ্রর ভ্রু জোড়া আগের থেকেও খানিকটা কুচকে গেল। জোড়ালো শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল-

“তুমি আমার পাশে থাকলে আকাশে চাঁদ তারা কিছুই থাকা লাগবে না রুদ্রাণী। তোমাকে নিয়ে শুধু অন্ধকার বিলাস করেও আমি ধন্য।”

রৌদ্র চলে গেল। আরশি এখনো রৌদ্র যাওয়ার পানে স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই রৌদ্রর কথা ভেবে আরশি আনমনেই হেসে দেয়।

————————

অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নীলা। ছাদের এক কোণে রেলিঙের উপর হাত রেখে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে। আরশির বলা কথা গুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো মতেই নির্বান বের হচ্ছে না নীলার মাথা থেকে।

“নিলু এখানে একা একা কি করছিস এই সময়?”

নীলের কন্ঠে নীলা পেছন ফিরে তার দিকে তাকায়। শান্ত গলায় বলল-

“কিছু না এমনিতেই এসেছি ঘুম আসছে না তাই।”

নীল নীলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল-

“আমি জানি কেন তোর ঘুম হচ্ছে না। মাথায় এতো চাপ দিস না। নিজের মন যা বলে তা-ই করিস। সঠিক মানুষের কাছে একবার নিজেকে ধরা দিয়ে দেখ হয়তো সারাজীবন ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখবে।”

নীলা নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। হঠাৎই নীলের ফোন বেজে উঠে। নীল ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মুচকি হাসিতে তার ঠোঁট হাল্কা প্রসারিত হয়ে গেল। নীলার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল-

“তুই দাঁড়া অফিস থেকে কল এসেছে। আমি কথা বলে আসি।”

নীলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই নীল ছাদের অন্য কোণায় চলে গেল। ফোন কানে দিয়ে মুচকি হেসে হেসে কথা বলছে নীল। নীলা আগের মতোই আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ নির্বান ওদেরকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে আসে। নীলাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাদের মাঝে এসে বলল-

“ঠকঠক.. একটু দরজাটা খুলবে নীলা?”

নির্বানের উদ্ভট কথায় নীলা ভ্রু বাঁকিয়ে নির্বাকের দিকে তাকালো। আবছায়া আলোয় নির্বানের চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছে। চুল গুলো সব সময়ের মতোই অগোছালো। চোখের বড়বড় পাপড়ি গুলো একটু পর পর পলক ফেলছে। নীলা নিজেকে সামলিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিছুটা সন্দেহের গলায় বলল-

“ছাদের মাঝখানে কি আপনি দরজা দেখতে পাচ্ছেন না-কি?”

নির্বান নীলার দিকে এসে ফিসফিস কিরে বলল-

“ছাদের মাঝে দরজা না থাকলেও তোমার মনের মাঝে তো দরজা আছে সেটাই না হয় একটু খুলে দাও।”

নীলা প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে নীল তাদের দু’জনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবারও নিজের মতো করে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরে।

————————

রৌদ্র মা কফির মগ দুটো রৌদ্রর হাতে দিতেই রৌদ্র মগ গুলো টেবিলে উপর রেখে দেয়। পকেট থেকে ওষুধের পাতা বের করে কফির একটা মগে ওষুধ মিলিয়ে দেয়। রৌদ্র মা প্রচন্ড অবাক হয়ে তার ছেলের কর্মকাণ্ড দেখছে। অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রৌদ্রকে-

“রৌদ্র এসব কি করছিস? কিসের ওষুধ মিশিয়ে দিলি কফিতে?”

রৌদ্র কফির মগে চামচ নাড়তে নাড়তে শান্ত গলায় বলল-

“ট্রেনে একটা বাচ্চা ভুলে আরুকে মা ডেকেছিল। তারপর থেকেই আরুর মুড অফ। তাই আমি বাসায় এসে আমাদের হসপিটালের ডক্টরের সাথে আরুর ব্যাপারে আবারও কথা বলেছি। উনিই বলেছেন এই ওষুধটা আরুকে খাওয়ানোর কথা। আরুকে সরাসরি তো দিতে পারবো না তাই কফিতে মিলিয়ে দিচ্ছি।”

রৌদ্র মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-

“এসব করার কি দরকার রৌদ্র? এমন তো না যে বাচ্চা না হওয়াতে আমরা আরশিকে অবহেলা করছি। তাহলে কেন তুই আরশিকে নিয়ে এতো চিন্তা করছিস?”

রৌদ্র তার মা’র দু কাধে হাত রেখে বলল-

“এসব আমি বাচ্চার জন্য বা আমাদের জন্য করছি না মা। এসব কিছু আমি আরুর ইচ্ছে-পূরণ করার জন্য করছি। আরুকে সম্পূর্ণ খুশি দিতেই এসব করছি। রাস্তাঘাটে বাচ্চা দেখলে আরুর চোখেমুখে কষ্টের ছাপ আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আরুর এই কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ওর মলিন মুখ দেখলে আমার মনে হয় আমি আরুকে ভালো রাখতে পারছি না। আমি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি আরুকে সুখে রাখতে।”

রৌদ্রর মা রৌদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-

“এসব নিয়ে ভাবিস না রৌদ্র। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রৌদ্র মাথা নাড়ালো। কফির মগ হাতে নিয়ে তার মা’র উদ্দেশ্যে বলল-

“মা আমি যাচ্ছি এখন আর ওষুধের কথা কিন্তু….”

রৌদ্র পেছন ফিরে আরশিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই রৌদ্র থেমে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। মনের মধ্যে ভয়ংকর রকমের ভয় এসে ঝেঁকে বসেছে। আরশিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। রৌদ্র স্থির চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…

[আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করে আজ রাতেই আরেক পর্ব দিব। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here