#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat
রৌদ্র আরশিকে বারান্দায় আটকে রেখে রুমের বাহিরে চলে যায়। আরশি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র কাজ দেখে। পরক্ষণেই দরজায় ধাক্কাতে লাগলো।
“ডক্টর রোদ কোথায় আপনি? আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন কেন? দরজা খুলুন প্লিজ রোদ..”
আরশি বার বার রৌদ্রকে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। আরশির মনে খানিকটা ভয় ঢুকে যায়। ধীরপায়ে যেয়ে বারান্দার এক পাশে রাখা লোহার বেঞ্চিতে বসে পরে। মাথা নিচু করে রৌদ্রর এমন অদ্ভুত কাজের কারন খুঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে। পাখিগুলো পাখা ঝাপটিয়ে কিচিরমিচির করছে। আরশি মাথা তুলে পাখির খাঁচাগুলোর দিকে তাকালো। কিছুটা সময় পর আরশি উঠে আবারও দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো। কিন্তু এবারও আরশি নিরাশ হলো। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এবারও পাওয়া গেল না। আরশি পুরো বারান্দায় পায়চারী করছে। প্রায় আধঘন্টা পর সশব্দে বারান্দার দরজা খুলে গেল। আরশি ঝটপট মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো। রৌদ্র হাঁপাচ্ছে। বুকে ডান হাত দিয়ে বড় বড় করে শ্বাস টানছে। কিছুটা সময় পর অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো। আরশি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে চেয়ে আছে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করছে না। রৌদ্র নিজে থেকে বলবে সে অপেক্ষায় আছে আরশি। রৌদ্র নিম্ন স্বরে বলল-
“সরি আরু। আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আমি তো অল্প কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে এখানে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই বদমাইস গুলোর জন্য এমন হয়েছে।”
আরশি কপাল কুচকে তাকাতেই রৌদ্র থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে আবারও বলল-
“মানে নির্বান আর তোমার ফ্রেন্ড গুলো আমাকে আটকে রেখেছিল। ওদেরকে একটা কাজ করতে দিয়েছিলাম তাই একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু যখন তোমার কাছে আসতে চেয়েছি তখনই আমাকে বাধা দেয়। তাদের না-কি বখশিশ লাগবে। বখশিশ দেওয়ার পরেও আটকে রেখেছিল তারপর নীল সবাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে আসতে দিয়েছে।”
“আমাকে এখানে আটকে কেন গিয়েছিলেন?”
আরশির গম্ভীর কন্ঠে রৌদ্র আহত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আরশি গাম্ভীরতার সঙ্গে বসে আছে বেঞ্চিতে। রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোনো কথা না বলে রুমে চলে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আবারও ফিরে আসে রৌদ্র। হাতে অনেক গুলো সূর্যমুখী ফুল। রৌদ্র আরশির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিল। আরশির দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ পরে বলল-
“রৌদ্র আর রুদ্রাণীর নতুন জীবন এই সূর্যমুখী দিয়ে শুরু করতে চাই আরু। তোমাকে কতটা ভালো রাখতে পারবো জানি না তবে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারবো না। তবে আমি চাই আমাদের ভালোবাসা যেন কখনো পুরনো না হয়। আমাদের ভালোবাসা কখনো অতীত হোক সেটা আমি চাই না।”
আরশির দিকে রৌদ্র ফুল গুলো এগিয়ে দেয়। আরশি রৌদ্রর দিকে অপলকভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মুচকি হাসি দিয়ে আরশি সূর্যমুখী ফুল গুলো নিজের হাতে তুলে নিল। সরু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
“এই ফুলের জন্য এতো দেরি হয়েছে?”
রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। আরশি রৌদ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় উঠে আসার জন্য। রৌদ্র আরশির হাত ধরে তার পাশেই বসে পরে। দুজনে কিছুটা সময় চুপচাপ একে অপরের হাত ধরেই বসে থাকে। নিস্তব্ধতা ভেঙে আরশি রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-
“রোদ..আপনার কাছে কিছু চাইলে আপনি আমাকে দিবেন!”
রৌদ্র হাল্কা হেসে বলল-
“একটি বার চেয়েই দেখো তুমি।”
আরশি ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“আমাকে কথা দিন আপনি কখনো পাল্টাবেন না। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে এই রূপেই দেখতে চাই।”
রৌদ্র আরশির হাত আরও শক্ত করে নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিল। মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“কথা দিচ্ছি রৌদ্র আর রুদ্রাণীর ভালোবাসা কখনো পুরনো হবে না। হবে না কখনো অতীত। না হবে মলিন, ধূসর বর্ণহীন। আমাদের ভালোবাসা সব সময় সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তবে যদি কখনো আমার ভালোবাসার বউয়ের কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমার এই হার্টের ডক্টর নিজেই হার্ট এট্যাক করে মরে যাবে।”
কথা বলেই রৌদ্র শব্দ করে হেসে ওঠে। আরশি তার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র হাসি থামিয়ে আবারও বলল-
“সত্যি বলছি তোমার কিছু হয়ে গেলে। আমি সত্যিই হার্ট এট্যাক করে সাথে সাথেই মরে যাবো।”
আরশি রৌদ্রর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
“আপনার কি আজে বাজে কথা না বললে হয় না! অসহ্যকর”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি মিসেস আরু। অনেক ভালোবাসি।”
হঠাৎ করেই রৌদ্রর মুখে ভালোবাসার কথা আরশি ভ্রু কুচকে ফেলে। পরক্ষেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। কিছুটা সময় নিয়ে নিম্ন স্বরে বলে-
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি রোদ।”
রৌদ্র আরশির লাজুক চেহারা দেখে হাসলো। আবারও দুজনের মাঝে একঝাঁক নিরবতা এসে হানা দিল।
যদি বলি আমার প্রতিটা রাত তোমার কোলে চাই,
বলো ঠোঁটের ছোঁয়ায় আদর মাখাবে গালে?
যদি বলি হ্যাঁ হাসছি আমি শুধুই তুমি আমার তাই,
বলো ছেড়ে তো দেবেনা কখনো মনের ভুলে?
আজ দ্বিতীয় বারের মতো আরশির রৌদ্র কন্ঠে গান শুনছে। রৌদ্রর কন্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অপলকভাবে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে আছে আরশি।
গোধূলি আকাশ মুছে দিলো সাজ
অযথা দূরে তবু তুমি আজ,
অভিমানী ভুল ধরবে আঙ্গুল
মন করে বায়না।
তুমি কি আমায় করবে পাগল
শাড়ির আঁচল, চোখের কাজল,
প্রেমে তুমিও পড়ে যাবে হায়
দেখো যদি আয়না।
আরশির রৌদ্রর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রৌদ্রর কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে গাইতে লাগলো-
বাঁচি এই বিশ্বাসে, শেষ নিঃশ্বাসে
তোমাকেই পাশে চাই,
তুমি না থাকলে আমি শূন্য এ মহাদেশে।
যদি ঘুমিয়েও পড়ি
শেষ ঘুমে আমি তবুও তোমাকে চাই,
তুমি স্বপ্নেই এসো রূপকথার ওই দেশে।
রৌদ্র আরশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আরশির মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আবারও গান গাইতে লাগলো-
আমি বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে
যত কথা আছে সবই তোমাকেই বলি।
আমি কান পেতে সেই মনের গভীরে
লুকোনো যন্ত্রনা শুনে ফেলি।
আরশি রৌদ্রর কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে। রৌদ্র গান থামিয়ে আরশির দিকে তাকায়। ঘুমন্ত অবস্থায় লাল শাড়িতে মোহনীয় লাগছে আরশিকে। রৌদ্র আরশির কপালে গভীরভাবে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে বলল-
“তোমার কিছু হলে এই রৌদ্র কখনো ঠিক থাকতে পারবে না রুদ্রাণী। তোমাকে ছাড়া এক দিন থাকাও আমার জন্য খুব কষ্টকর।”
————————
“আল্লাহর রহমতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। যাক তাহলে বিয়ের চিন্তা শেষ, এখন তো শুধু রৌদ্রর বাচ্চাদের সাথে খেলার অপেক্ষা।”
সকালের নাস্তা করার সময় ডাইনিং টেবিলে সবার সামনেই নির্বানের আম্মু মজার ছলে কথাটা বলল। কথাটা শোনার সাথে সাথেই আরশির মুখের ভঙ্গিমা পালটে গেল। এই মুহূর্তে অন্য কোনো স্বাভাবিক মেয়ে থাকলে হয়তো লজ্জায় নুয়ে পরতো তবে আরশির ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন। থমথমে চেহারায় খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে আরশি। রৌদ্র স্থির চোখে আরশির মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে। রৌদ্র মা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“হ্যাঁ সেই অপেক্ষা তো করবোই। আল্লাহ হাতেই তো সব কিছু। উনি যখন ইচ্ছে আমাদের অপেক্ষার পহর শেষ করবেন।”
রৌদ্রর মা’র কথা শুনে আরশি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। নাস্তা শেষে আরশি নির্বানের আম্মুর সাথে সোফায় বসে নির্বানকে নিয়ে কথা বলছে। নির্বানের আম্মু আরশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“জানো মা এই ছেলেটা ঘুমালে দিনদুনিয়ার কোনো হুশই থাকে। কুমিরের মতো পরে পরে বেঘোরে ঘুমায়।”
নির্বানের আম্মুর কথা শুনে আরশি হাসছে। তখনই নির্বান সোফায় শুয়ে থাকা অবস্থায় পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তার মার দিকে অলস ভঙ্গিতে চেয়ে বলল-
“উফফ মা বাসার নতুন বউকে এসব কি বলছো তুমি! ক্রাশ ভাবি তুমি আম্মুর কথায় কান দিও না তো।”
নির্বানের আম্মু নির্বানের পায়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“বেশি কথা না বলে এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কর যা।”
আরশি নির্বান আর নির্বানের আম্মুর খুনশুটি দেখে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে।
————————
“তখনকার জন্য থ্যাংকস মা।”
রৌদ্র রান্নাঘরে এসে তার মা’কে জড়িয়ে ধরে কথাটা বলল। রৌদ্র মা তার ছেলের পিঠে আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“এখনে থ্যাংকস বলার কি আছে!”
রৌদ্র তার মা’কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“তুমি সব কিছু শুনে আমাদের বিয়েতে রাজি হয়েছো তাই থ্যাংকস। আরুকে অস্বস্তি পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছো এই জন্য থ্যাংকস ”
ছেলের কথা রৌদ্র মা মুচকি হাসলেন। রান্নাঘরের কাজ করতে করতেই বললেন-
“তুই তো ব্যস্ততায় নিজেকে একদম পালটিয়ে ফেলেছিলি। দিন দিন কেমন গম্ভীর হয়ে উঠেছিলি। কিন্তু আরশি তোর জীবনে আসার পর থেকে তুই আবারও আগের মতো হাসিখুশি থাকা শুরু করেছিস। এই জন্য আমি আরশির কাছে অনেক ঋণী৷ আরশি আমাদের পুরনো রৌদ্রকে আবারও আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর তার থেকেও বড় কথা হলো তুই আরশিকে ভালোবাসিস। এখন তোর ভালোবাসা যেমনই হোক সেটা তোর কাছে থাকলেই তুই খুশি থাকবি আর তোর খুশিতেই আমরা খুশি রৌদ্র।”
রৌদ্র তার মা’র কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হেসে বলল-
“লাভ ইউ মা।”
রৌদ্রর মা হাসলো। তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল-
“যা এখন আরশির কাছে যা। আর হ্যাঁ আরশিকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে না বলিস। আল্লাহ চাইলে সব কিছুই সম্ভব হবে।”
চলবে….
[গল্পটা শেষ করবো কবে?? প্রায় পঞ্চাশ পর্ব হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো শেষ হচ্ছে না।🤦♀️ যাইহোক গল্পটা কেমন লাগছে আপনাদের মন্তব্য জানান। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]