রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্বঃ৪৭

0
537

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“রুদ্রাণী..”

রৌদ্রর ডাকে আরশি ঘাড় বাকিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। রৌদ্র বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে আরশির দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরশির বারান্দার রেলিং-এ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ বাতাসের ঝাপটা এসে আরশির চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গায়ে লালচে-হলুদের সংমিশ্রণে সুতি শাড়ি জড়ানো। হাতে লাল আর হলুদ রঙের অল্প কিছু কাচের চুড়ি। নাকে ছোট্ট এক পাথরের নাকফুল। রৌদ্র আরশির পাশে এসে বারান্দার রেলিং-এ হাত রেখে বলল-

“গল্প উপন্যাসে পড়েছি বিয়ের পর না-কি মেয়েদের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় আজ তার প্রমাণ সরূপ তোমাকে দেখে ফেললাম। আজ তোমাকে একদম পারফেক্ট মিসেস ডক্টর লাগছে। বিয়ের অনেক দিন পাড় হয়ে গেলেও এতদিন তোমাকে প্রেয়সী হিসেবেই দেখেছি। তবে এই দু’দিন ধরে তোমাকে বউ বউ লাগছে। বউদের তোমার শাড়ি পড়া আমাকে স্মরণ করে দেয় তুমি আমার বউ। তোমার নাকের এই ছোট্ট জিনিসটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। সকালের তোমার ঘুমন্ত মুখটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় তুমি আমার ভালোবাসার জীবনসঙ্গিনী। এখন আমার প্রতি দিন শুরু হয় তোমার ঘুমন্ত চেহারা দেখে আর আমার নির্ঘুম রাত কাটে তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখে।”

রৌদ্র কথায় আরশি মাথা নিচু করে ফেলে। আরশিকে লজ্জা পেতে দেখে রৌদ্র হাসলো। আরশির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল-

“তোমার লজ্জা পাওয়াটা আমার বুকে তীরের মতো করে এসে আঘাত করে। তোমার এই লাজুকতা আমাকে বার বার ঘায়েল করে রুদ্রাণী। রোদের তীর্যক রশ্মির মতো ঝলসে দেয় আমার মনকে।”

রৌদ্রর কথা শুনে আরশির লজ্জার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দু হাত কচলাচ্ছে। রৌদ্র আরশির হাত ধরে তার কিছুটা কাছে নিয়ে আসে। আরশির হাতটা নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিয়ে বলল-

“এতো হাত কচলাতে হবে না। এখন বলো বারান্দায় একা একা কি করছিলে?”

আরশি একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক করে মাথা তুলে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বলল-

“কিছু না। এমনিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

“কাল থেকে আমি হসপিটালে যাবো। আর তোমাকেও কাল থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।”

আরশি ভ্রু বাঁকিয়ে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-

“দু’দিন যেতে না যেতেই শুরু হয়েছে আপনার পড়া পড়া করে জ্ঞান দেওয়া!”

রৌদ্র সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-

“আমার বউ হয়ে তুমি পড়াশোনাকে এতো ভয় পাও কীভাবে আরু! তুমি তো দেখছি খুব ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে।”

রৌদ্রর কথায় ধপধপ করে আরশির মাথায় রাগের আগুন জ্বলে উঠলো। জ্বলন্ত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“আপনি কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন ডক্টর। আমাকে অপমান করছেন আপনি!”

রৌদ্র আরশির রাগকে কোনো পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ততার সাথে বলল-

“আমি কোনো বাড়াবাড়ি করছি না মিসেস আরু। আমি একদম ঠিক বলেছি। প্রথম থেকেই দেখে আসছি আপনাকে পড়াশোনার কথা বললেই আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যায়।”

রৌদ্রর কথায় যেন আরশির রাগ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। রৌদ্রর গাঁ জ্বালানো কথায় আরশি প্রচন্ড রেগে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রৌদ্র হুট করেই আরশির ডান গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। আরশি স্তব্ধ হয়ে আছে। আচমকাই রৌদ্রর এমন কাজে আরশি বরফের মতো জমে গেছে। তৎক্ষনাৎ একরাশ লজ্জা এসে আরশিকে আঁকড়ে ধরে। রৌদ্র মুচকি হেসে বলল-

“কাল তোমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবো। তুমি রাজি তো মিসেস আরু!!”

আরশি নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো। কেউ আর কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে তাদের দু’জনকে। চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করছে রৌদ্র আর তার রুদ্রাণী।

————————

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আরশি বরাবরের মতো পাশে তাকালো। কিন্তু আজ রৌদ্রকে পাশে দেখতে না পেয়ে আরশির উঠে বসলো। অগোছালো চুল গুলো হাত খোপা করে। বিছানা থেকে নেমে যায়। হঠাৎই বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে একটা নীল রঙের কাগজ দেখতে পেল। আরশি কোতুহলবশত কাগজটা হাতে তুলে নেয়। বিস্ময় নিয়ে কাজগের ভাজ খুলতেই আরশির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

প্রিয় রুদ্রাণী,

অনেক দিন পর তোমাকে চিঠি লিখলাম। নিশ্চয়ই আমার চিঠির অপেক্ষায় ছিলে তা-ই না রুদ্রাণী! দুঃখিত ব্যস্ততার জন্য তোমাকে চিঠি লেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে এবার থেকে একদম ঠিকঠাক নিয়মিত চিঠি দিবো তোমার নামে। আসলে ভালোবাসার মানুষকে পাশে পেলে সব কিছুই একদম এলোমেলো হয়ে যায়। সময় যেন চোখের পলকের সাথেই চলে যায়। তাই আর কোনো কিছুর খেয়াল থাকে না। তবে আর যাইহোক রৌদ্র তার রুদ্রাণীকে নীল চিরকুট দেওয়া কখনো ভুলবে না। তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে ভুলে যাবে আমাকে চিঠি লেখা??

[বিঃদ্রঃ চিঠির উত্তর খুব তাড়াতাড়ি চাই। তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করা আমার জন্য খুবই কষ্টকর।]

ইতি
রৌদ্র

আরশি চিঠিটা পড়া শেষে হাসিমুখেই নীল চিরকুটটা ভাজ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। রৌদ্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে বলল-

“আরু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমাদের যেতে হবে।”

আরশি মাথা দুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষন পর দুজনে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়। কাসফিয়া রেডি হয়ে সোফায় বসে ফোন টিপছে। রৌদ্র কাসফিকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“সরি কাসফিয়া আমাদের দেরি হয়ে গেল।”

কাসফিয়া ফোন থেকে নজর সরিয়ে গোমড়া মুখে বলল-

“আপনারা কাজটা একদমই ঠিক করেননি ভাইয়া।”

আরশি কাসফিয়ার কাছে এসে ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“কেন আমরা কি করেছি?”

কাসফিয়া গম্ভীর গলায় বললো-

“কি করেছিস মানে! তুই আর দুলাভাই আমাকে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিস কেন? তোদের নতুন বিয়ে হয়েছে। আমি তোদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে থেকে কি করবো?”

আরশি সিরিয়াস হয়ে বলল-

“তাহলে কি তুই ওই ফ্ল্যাটে একা একা থাকবি না-কি!”

রৌদ্র আরশির কাছে এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“এতো বড় ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে একা একা থাকবে এটা তোমার জন্য খুব বিপদজনক। আর আমিও সারাদিন হসপিটালে থাকবো আরুও এই বাসায় একা একা থাকবে। তার চেয়ে বরং তুমি এখানে থাকবে এটা তোমাদের দুজনের জন্যই ভালো।”

কাসফিয়া আর কথা বাড়ালো না। তাদের কথাই মেনে নেয়। নাস্তা করা শেষে রৌদ্র আরশি আর কাসফিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। আরশি আর কাসফিয়াকে ভার্সিটিতে দিয়ে রৌদ্র হসপিটালে চলে যায়। নীল আরশিকে দেখে দুষ্টুমি করে বলল-

“বিবাহিত বেবি তোমার নতুন বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে?”

আরশি কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীলা আর নীলের মাঝে বসে পরে। হঠাৎই নীলের পিঠে সজোড়ে একটা থাপ্পড় মেরে আরশি ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“আসতে না আসতেই শুরু হয়েছে তোর হারামিগিরি।”

নীল ব্যথায় মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে। ডান হাত পিঠে দিয়ে বলল-

“তুই আসলেই একটা শাকচুন্নি। কই নতুন বিয়ে হয়েছে সেই জন্য ট্রিট দিবি তা না করে উল্টো আমার মতো নিরীহ একটা ছেলেকে মারছিস। তোর কি আমার জন্য একটুও দয়ামায়া হয় না!!”

নীলের কথায় আরশি শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“নিলু তোর ভাই না-কি নিরীহ একটা ছেলে!!”

আরশি কথাটা বলেই আবারও হাসতে লাগলো। আরশির সাথে সাথে নীলা, কাসফিয়া আর আদ্রাফও হাসছে। নীল তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধমকের স্বরে বলল-

“দাঁত কেলানো বন্ধ কর তোরা।”

নীলের কথা শুনে সবাই আরও বেশি করে হেসে ওঠে। হাসিঠাট্টার মাঝে হঠাৎ করেই আদ্রাফ বলল-

“দোস্ত আমি আমার আর কাসফির সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে দিয়েছি।”

আদ্রাফের কথায় সবাই থমকে যায়। হতভম্ব হয়ে আছে সবাই। নীলা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। কাসফিয়া প্রচন্ড অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“তুই আমাকে না জানিয়েই সব বলে দিলি আদ্রফ!! আর আমাদের সম্পর্কের কথা শুনে আংকেল আন্টিই বা কি বলেছেন?”

আদ্রাফ সহজ গলায় জবাব দিল-

“তেমন কিছু না। বলেছে আমাদের ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই তোর বাসায় কথা বলবে।”

আরশি আর নীল চুপ করে আছে। দুজনের মনেই চলছে নীলাকে নিয়ে হাজারো চিন্তা ভাবনা। নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে আদ্রাফ আর কাসফিয়াকে দেখে পরক্ষণেই মুচকি হাসি দিয়ে খুশিতে গদগদ করে বলল-

“তার মানে খুব শীগ্রই আমরা তোদের বিয়ে খাচ্ছি!”

আদ্রাফ কোনো উত্তর দিল না শুধু মাথা চুলকিয়ে হাল্কা হাসি দেয়। আরশি আর নীলের একে অপরের দিকে একবার চেয়ে নীলার দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসি দেয়। মুহুর্তেই নিজেদের স্বাভাবিক করে নেয়। নীল আদ্রাফের কাধে হাত দিয়ে বলল-

“বাহ আশুর বিয়ে দেখে মনে হচ্ছে তোরও বিয়ে করার শখ জেগেছে আদ্রাফ!!”

আদ্রাফ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“আরে বিয়ের কথা বলিনি জাস্ট আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছি।”

আরশি দুষ্টুমি করে বলল-

“আচ্ছা তোকে কি এখন থেকে আমরা দুলাভাই ডাকবো না-কি কাসফি কে ভাবি ডাকবো!! আমি তো খুবই কনফিউজড।”

কাসফিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকায়। সাথে সাথেই নীলা, আরশি আর নীল ঝংকার তুলে হেসে ওঠে। নীলা হাসছে প্রান খুলে। নীলে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে এতদিনে। অন্য কারও ভালোবাসার মানুষকে সে নিজের মনে রাখতে চায় না। তাই আদ্রাফের জন্য জমিয়ে রাখা গচ্ছিত ভালোবাসা গুলো নীলা অনেক আগেই নিজের মনে দাফন করে দিয়েছে। মেনে নিয়েছে কাসফিয়া আর আদ্রাফের সম্পর্ক। বন্ধ করে দিয়েছে নীলার মনে ভালোবাসার দরজা।

——————————

হসপিটালে রোগী দেখার পর রৌদ্র আরশির সাথে কথা বলার জন্য পকেটে থেকে ফোন বের করতে নেয়। তখনই পকেটের মধ্যে একটা লাল রঙের চিরকুট পায়। রৌদ্র মুচকি হাসে চিরকুটটা দেখে।

প্রিয় রৌদ্র,

অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে মনে রাখার জন্য। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাকে ভুলেই গেছেন। সত্যি বলতে আপনার নীল চিরকুটটাকে বড্ড মিস করছিলাম। চিঠির মাধ্যমেই তো ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছি তাই কখনো চিঠি দেওয়ার কথা ভুলবো না।

[বিঃদ্রঃ রুদ্রাণী তার রৌদ্রকে কখনো কষ্টে মাঝে রাখে না। তাই তাড়াতাড়ি করেই চিঠির উত্তর দিয়ে দিলাম।]

ইতি,
রুদ্রাণী

চিঠিটা পড়ে রৌদ্রর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো৷ ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে রৌদ্র নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। তবুও মনের কোণে কিছুটা ভয় আর আক্ষেপ রয়েই গেছে। আরশিকে সত্যিই সকল সুখ দিতে পারবে কি না! আরশির মা ডাক শোনার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারবে তো!! যদি কখনো রৌদ্রর মিথ্যে কথা আরশি জেনে যায় তখন কি হবে!! রৌদ্র নিজের মনে নানানরকম চিন্তা ভাবনা করেই মলিন মুখে বসে রইলো।

চলবে….

ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here