#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৫৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“এই যে তুলতুলের আম্মু।”
আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ভ্রু জোড়া কিছুটা কুচকে এলো তার। কান দুটো খাড়া খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে কেউ কি তাকে সত্যি-ই ডাকছে কি-না! হঠাৎ আরশির দাঁড়িয়ে যাওয়ায় রৌদ্রর হাতে টান পরলো। আরশির হাত ধরে রেখেই রৌদ্র জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে আরু! দাঁড়িয়ে পরলে কেন!”
আরশি একপলকে আশেপাশে নজর বুলিয়ে মৃদু হেসে বলল-
“কিছু না এমনি।”
আরশি আবারও হাঁটতে লাগলো রৌদ্রর হাত ধরে। তাদের কিছুটা সামনেই নীল, নির্বান, আদ্রাফ, কাসফিয়া আর নীলা এক সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। এতক্ষন তারা সবাই একসাথেই দল বেধে হাঁটছিল কিন্তু আরশির এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়াতে কিছুটা সামনে চলে গেছে তারা।
“উফফ তুলতুলের আম্মু তোমাকে কতক্ষন ধরে ডেকে যাচ্ছি একটু দাঁড়ালে না কেন?”
এবার আরশি সহ বাকি সবাই হাঁটা থামিয়ে স্থির পায়ে দাঁড়ালো। বিস্মিত হয়ে সবাই আরশির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো। আরশি ড্যাবড্যাব করে ছেলেটাকে দেখছে। বুকে হাত দিয়ে বড়বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে আসার ফলেই এমনটা হয়েছে। আরশি কিছুক্ষন ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আরশি ছেলেটার সামনে এসে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
“আমি শুনেছিলাম আপনি ডাকছেন কিন্তু কোথাও দেখতে পাইনি তাই ভেবেছি হয়তো আমার মনের ভুল ছিল।”
ছেলেটা হাতের মানিব্যাগটা প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে। শালীন কন্ঠে বলল-
“রিকশায় থেকে ডাক দিয়েছিলাম তাই দেখতে পাওনি। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে আসলাম তোমার কাছে। যাইহোক এসব কথা থাক। আমার তুলতুল কেমন আছে? আমি যা বলেছিলাম তা সত্যি হয়েছে তো!!”
আরশি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল-
“হুম হুম আপনার কথাই সত্যি হয়েছে। আর তুলতুলও খুব ভালো আছে।”
আরশির কথায় ছেলেটা একটা মন কাড়া হাসি দিল। মাথার ঝাকড়া চুলে হাতের আঙুল দিয়ে চুল গুলো ঠিক করে নেয়। বাকি সবাই বিস্ময় নিয়ে আরশি আর অচেনা ছেলেটার কথপোকথন শুনছিল। নীল নিজের কৌতুহল দমাতে আরশির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল-
“আশু এটা কে?”
আরশি নীলের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল-
“তোদের তো বলেছিলাম একটা ছেলে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল! উনিই সেই ছেলে।”
নীলসহ বাকি সবার কৌতুহলী চোখে এখন কৃতজ্ঞতার ঝলক দেখা দিল। নীল তৎক্ষনাৎ ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল-
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের আশুর খেয়াল রাখার জন্য।”
নীল ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁডালো। ছেলেটা একটা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল-
“আমি তেমন কিছুই করিনি শুধু একটু হেল্প করেছি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে।”
রৌদ্র হাসি মুখে ছেলেটার কাছে এসে বলল-
“আজকাল অচেনা একজন মানুষের জন্য এতটুকু সাহায্য করাই অনেক বড় ব্যাপার।”
রৌদ্র ছেলেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল-
“আমি তুলতুলের আব্বু ড.রৌদ্র আহনাফ।”
ছেলেটা হাসি মুখে হ্যান্ডশেক করে ভদ্রতার সাথে বলল-
“আমাকে হয়তো আপনি চিনবেন। আমি ধ্রুব হাসান। আপনার পুরনো পেসেন্ট। আপনাকে চেনা চেনা লাগছিল এখন আপনার নাম শুনে কনফার্ম হলাম আপনি-ই আমার ডক্টর ছিলেন।”
রৌদ্র সরু চোখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল-
“তোমার আম্মুর সাথে এসেছিলে আমার কাছে! প্রায় দেড় বছর হবে তাই না!”
“হুম এমনই হবে। আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন শুনে ভালো লাগলো।”
“আমার যতটুকু মনে পরে তোমার দেশের বাহিরে যাওয়ার কথা ছিল চিকিৎসার জন্য।”
ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ থেকে একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল-
“কিছুদিন আগেই ফিরেছি দেশে। এখন খুব সুস্থ আছি। যাই হোক আপনাদের সাথে তো পরিচয় হলাম না!”
ধ্রুব হাসি মুখে সবার সাথে এক এক করে পরিচয় হয়ে নেয়। ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে আরশির দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল-
“আচ্ছা তুমি আমাকে আপনি আপনি করে বলছো কেন? আমি তো তোমার থেকে ছোট হবো। আর হ্যাঁ আমি সবাইকে তুমি করে কথা বলায় অভ্যস্ত তাই তোমাদের সবাইকে তুমি করে বললে কিছু মনে করো না।”
আরশি হাসলো। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল-
“আচ্ছা এখন থেকে তাহলে তুই করে বলবো চলবে তো!”
“চলবে না দৌড়াবে।”
ধ্রুবর কথায় সবাই হেসে দেয়। রৌদ্র ধ্রবর কাধে হাত রেখে বলল-
“যদি তোমার কোনো প্রব্লেম না থাকে তাহলে আমাদের সাথে চল। সবাই একসাথে ডিনার করবো। কোনো না মানবো না। তুলতুলের পক্ষ থেকেই এই ট্রিট মনে করো।”
ধ্রুব কিছুটা ইতস্তত বোধ করছে। নীল আদ্রাফ আর নির্বান এক প্রকার জোর করেই ধ্রুবকে তুলে নিয়ে গেল রেস্টুরেন্টে। রৌদ্র আরশি একে অপরের হাত ধরে হাসতে হাসতে তাদের পেছনে হেটে যাচ্ছে।
—————————
রৌদ্র বেড রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরশিকে অপলক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। আয়নায় নিজেকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আরশি। পেটে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কতটুকু বড় হয়েছে তাদের তুলতুল। রৌদ্র গত তিনমাস ধরেই আরশির এই কাজ নিয়মিত দেখে আসছে। অবশ্য গত তিন মাসে প্রেগ্ন্যাসির কারনে আরশির মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শরীর আগের থেকে খানিকটা ভারি হয়ে এসেছে। গাল গুলো কিছুটা ফুলে গেছে। তুলতুল বড় হয়ে আরশির পেট উঁচু করে তুলেছে। খানিকটা মোটা হয়ে যাওয়ায় আরশির সৌন্দর্যের লাবণ্যতা বেড়েছে আগের থেকে অনেক। কিন্তু এই সৌন্দর্য আরশির চোখে পড়ে না। রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আরশিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আরশির কাধে নিজের থুতনি রেখে আয়নায় আরশির প্রতিবিম্ব দেখছে। তবে এতে আরশির কোনো হেলদোল নেই। আরশি আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল-
“আমি দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছি তাই না রোদ! গাল গুলো দেখেছেন কেমন আলুর মতো হয়ে যাচ্ছে।”
রৌদ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-
“হুম… তুলতুলের আম্মু গুলুমলু হবে এটাই স্বাভাবিক আরু।”
আরশি আয়নায় রৌদ্র দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বলল-
“আমি মোটা হয়ে গেলে আপনি আমাকে আগের মতো ভালোবাসবেন তো রোদ?”
ইদানীং আরশির এসব অদ্ভুত রকমের প্রশ্নে রৌদ্র মাঝে মাঝে বড্ড ক্ষেপে যায়। আজও তা-ই হলো আরশিকে ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি দাড় করে কড়া গলায় বলল-
“আপনাকে আমি কতবার বলবো মিসেস আরু আমি আপনার রূপ দেখে ভালোবাসিনি, যে রূপ নষ্ট হয়ে গেলেই আমার ভালোবাসা কমে যাবে। অযথা এসব উদ্ভট প্রশ্ন কেন করেন আপনি মিসেস আরু!”
রৌদ্র এমন কঠিন বাক্যে আরশির কোনো ভাবান্তর হলো না। সে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-
“আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন ছিল জিজ্ঞেস করি!”
রৌদ্র ভ্রু কুচকে ফেলে। দু’হাত ভাজ করে গম্ভীর গলায় বলল-
“আবারও যদি আজেবাজে প্রশ্ন করেছেন তাহলে আজ আপনি এই রুমে একা একা ঘুমাবেন মনে থাকে যেন।”
আরশি রৌদ্রর দিকে সরু চোখে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। একটা জোড়ালো শ্বাস নিয়ে বলল-
“আপনি রেগে গেলে সব সময় আমাকে আপনি সম্মোধন করে কথা বলেন কেন রোদ?”
রৌদ্র ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে। আরশির দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে। শান্ত গলায় বলল-
“আমি চাইলেই আমার রাগ অন্য ভাবে প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু আমি রাগের মাথায় ভুলেও কখনো তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমাদের দেশে এমন অনেক পুরুষ আছে যারা রাগের মাথায় তাদের স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে, চেচামেচি করে, তুইতোকারি করে কথা বলে, ধমকায়, বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। কিন্তু আমি এভাবে নিজের রাগ প্রকাশ করতে চাই না। আমি কাপুরুষের মতো নিজের রাগ অন্যের উপর মেটাতে চাই না। রাগের মাথায় এমন কোনো ব্যবহার বা কথা বলতে চাই না যার কারনে পরে আফসোস করতে হয়। আর তোমাকে ভুলেও কোনো কষ্ট দিয়ে ফেললে তার দ্বিগুণ কষ্ট হয়তো আমি পাবো। তাই আমি রেগে গেলে তোমাকে আপনি করে বলি আর যখন বেশি রাগ হয় তখন তোমাকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা না বরং রুম আলাদা করার কথা বলি। যেন একই বাসায় থেকে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই নিজেদের মান-অভিমান ভুলে যেতে পারি। দূরত্ব যেন সৃষ্টি না হয় আমাদের মাঝে। কারন আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু। কোনো ভুলবোঝাবুঝি হলে সেটা ভালোবাসা দিয়ে ঠান্ডা মাথায় মিটিয়ে নিতে চাই। তুচ্ছ কারণে আমার ভালোবাসার বউকে কষ্ট দিব, আঘাত করে করে কথা বলবো, বাজে ব্যবহার করবো এমন কাপুরষ না তোমার রোদ। রোদ তার রুদ্রাণীকে আজীবন নিজের কাছে রাখতে চায় তাই রোদ তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে নেয়। বুঝেছো আরু!”
আরশি মাথা নাড়িয়ে জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতো বলল-
“হুম বুঝলাম।”
রৌদ্র আরশিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে পেছন থেকে আবারও জড়িয়ে ধরলো। আয়নায় আরশির দিকে চেয়ে শীতল গলায় বলল-
“তুমি কি জানো রুদ্রাণী তুমি আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছো!”
রৌদ্রর কথায় আরশি ভ্রু কুচকে ফেলে। রৌদ্র হাল্কা হেসে আরশির পেটে নিজের দু’হাত আলতো করে রেখে বলল-
“সত্যি বলছি তুমি আগের থেকেও অনেক কিউট হয়ে গেছ। একদম গুলুমলু। আর তোমার গাল গুলো দেখলে তো ইচ্ছে টুপ করেই খেয়ে ফেলি।”
রৌদ্র কথাটা বলেই আরশির গালে আস্তে করে একটা কামড় দিল। আরশি ভ্রু কুচকে রৌদ্রর দিকে তাকালো। তাকিয়েছে বললে ভুল হবে। তীর নিক্ষেপের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে রৌদ্রর দিকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
“কি করছেন আপনি এসব!! আপনি মজা কিরছেন আমার সাথে তাই না রোদ!”
রৌদ্র তপ্ত শ্বাস ফেলে। আরশিকে আগের থেকেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শীতল কন্ঠে বললো-
“আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু। ভালোবাসি তোমার সব কিছুকে শুধু তোমার রূপ, গুনকে না। আমি প্রথম প্রেমে পরেছিলাম তোমার অগোছালো চেহারা দেখে। তোমার ভালোবাসায় পরেছি তোমার অস্বস্তিতে ঘেরা মুখ দেখে। তখনও তোমাকে ভালোবেসেছি। আর এখনও তোমার এই গোলাগাল কিউটনেসে ভরা চেহারাকে ভালোবাসি। আর বুড়ো বয়সে তোমার কুচকে যাওয়া চামড়া, সাদা হয়ে যাওয়া চুল, দাঁতবিহীন হাসি সব কিছুকেই ভালোবেসে যাবো। আমি আগেও তোমাকে ভালোবেসেছি, এখনো তোমাকে ভালোবাসি আর বুড়ো বয়সেও তোমাকেই ভালোবেসে যাবো।”
আরশি লাজুক হাসি দিয়ে ঘুরে রৌদ্রকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। রৌদ্রর বুকে মুখ গুজে দিয়ে নিম্নস্বরে বলল-
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি রোদ। বুড়ো বয়সেও আপনাকে ভালোবেসে যাবো তুলতুলের আব্বু।”
রৌদ্র হাল্কা হেসে আরশির মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলল-
“কাল কিন্তু নীলদের বাসায় যেতে হবে। ভুলে যেও না কিন্তু।”
আরশি মাথা নাড়ালো। রৌদ্র আরশিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
“চল এখন ঘুমাবে। রাত হয়েছে।”
চলবে…
[আসসালামু আলাইকুম। আশাকরি সবাই ভালো আছেন। প্রথমেই সবাইকে সরি বলছি এতদিন অপেক্ষা করানোর জন্য। বেস্টির বাসায় বেড়ানো শেষ তাই আজ থেকে নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ আর আকাশ সমপরিমাণ ভালোবাসা।❤️❤️]