রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
পর্বঃ৩৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat
আংটিবদলে বাধা পরায় ড্রয়িং রুমের সকলের মুখে বিরক্তি রেশ। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এটা কোনো কলিং বেল নয় বিরক্তির বেল বেজে উঠেছে। সবাই হতাশ হয়ে ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। নীল দরজা খুলতেই সাদা টুপি, পাঞ্জাবি পরা এক হুজুর সাহেব সালাম বিনিময় করে ভিতরে আসলেন। আদিব হাসান লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের সাথে কথা বলছে। আরশি বিস্মিত হয়ে সব দেখে যাচ্ছে। লোকটাকে দেখেই তার বুক ধক করে উঠলো। আজ কি তাহলে সত্যি সত্যিই আকদের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে? এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কি আমার জীবনটা পুরো পালটে যাচ্ছে? সবাই আবারও উৎসুক হয়ে আংটিবদলের জন্য এক হয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রর বাবা তাড়া দিয়ে বললেন-
“রৌদ্র আরশি মামুনিকে আংটি পড়িয়ে দে। তারপর আবার আকদের কাজ শুরু করতে হবে।”
রৌদ্র মাথা নাড়ালো। আরশির দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল রৌদ্র। আরশি রৌদ্রর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে হাতের দিকে দৃষ্টি রাখলো। বড়রা সবাই তাড়া দিচ্ছে। আর আরশির বন্ধুরা সকলে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশি এখনো স্থির চোখে রৌদ্রর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির মনে চলছে হাজারো চিন্তা ভাবনা। ডক্টর রোদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমার এই ব্যর্থতা নিয়ে ওনার সাথে নতুন জীবন শুরু করা কি ঠিক হবে! আমার জন্য উনি কোনো কষ্ট পাবে না তো!!
“আরশি মা কি ভাবছো? তুমি কি বিয়ের জন্য রাজি না? কোনো প্রব্লেম থাকলে আমাকে বলতে পারো।”
আদিব হাসানের কথায় পুরো ড্রয়িং রুমে চিন্তার ঝড় ভয়ে গেল। সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নীল আরশির পাশে এসে দাঁড়ালো। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মুখে হাসি টেনে আদিব হাসানের উদ্দেশ্যে বলল-
“নাহ নাহ তা হবে কেন! আশু বিয়েতে রাজি বলেই তো রেডি হয়েছে। তাই না আশু!”
নীল আরশিকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে আবারও বলল-
“এই আশু হাত বাড়িয়ে দে। শুধু শুধু সবাইকে চিন্তায় ফেলছিস কেন?”
আরশি কপাল কুচকে নীলের দিকে তাকালো৷ নীল চোখের ইশারায় হাত বাড়িয়ে দিতে বলছে। আরশি রৌদ্রর দিকে তাকালো। কালো শার্ট গায়ে জড়ানো। হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। চুল গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পরে আছে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ থাকলেও রৌদ্রর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাল্কা হাসির রেখা। আরশি রৌদ্রর হাসির দিকে তাকিয়েই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। রৌদ্রর হাসি মুখ খানিকটা প্রসারিত হয়ে এলো৷ আরশির হাত আলতো করে ধরে আরশির অনামিকায় আংটি পড়িয়ে দিল। সাথে সাথে ড্রয়িং রুম জুড়ে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। হাত তালি আর হাসির শব্দ বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে ভারি খাচ্ছে। আরশি মাথা তুলে সবার দিকে নজর বুলিয়ে নিতেই মুচকি হাসি দিলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল আকদের কাজ। সোফায় চুপচাপ বসে আছে আরশি। তার পাশেই আছে ডক্টর রোদ। হুজুর সাহেব কিছুটা সময় তার বড় খাতায় লেখালেখি করার পর আরশিকে কবুল বলতে বলা হলো। কবুলের কথা শুনেই আরশির হার্ট খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে। অস্থিরতায় দু হাত কচলানো শুরু করে দিয়েছে। পাশ থেকে নীলা আর কাসফিয়া বলল-
“আশু কবুল বলে দে।”
আরশি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা তুলে শান্ত গলায় বললো-
“ডক্টর রোদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
সবাই ভ্রু কুচকে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির মা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“এখন আবার কিসের কথা আরশি?”
রৌদ্র আরশির পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বিনয়ের সাথে বলল-
“মিস আরু হয়তো আমার সাথে কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চায়। আমার কোনো আপত্তি নেই বিয়েটা ওনার মতামতেই হবে।”
রৌদ্রর কথায় সবাই শান্ত হয়ে গেল। পাশ থেকে রৌদ্রর মা নরম গলায় বললেন-
“সমস্যা নেই আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। তোমরা যাও রুমে গিয়ে আলাদা করে কথা বলে আসো।”
সবার অনুমতি নিয়েই তাদের দুজনকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। আরশির রুমে এসে রৌদ্রর পুরো রুম ঘুরে ফিরে দেখছে। আরশি চুপচাপ ভ্রু বাঁকিয়ে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সে নিজের মতো রুমে হাঁটাহাঁটি করছে। দু হাত পকেটে গুজে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনার রুমটা তো খুব সুন্দর মিস আরু।”
রৌদ্রর কথায় আরশির ভ্রু কুচকে এলো৷ বিরক্তির স্বরে বলল-
“আমি এখানে আপনাকে রুম দেখাতে নিয়ে আসিনি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।”
রৌদ্র হাল্কা হেসে ভাবলেশহীন ভাবেই বলল-
“হুম হুম আপনি বলুন আমি শুনছি।”
রৌদ্রর নির্লিপ্ততা দেখে আরশি খানিকটা শক্ত গলায় বলল-
“আপনি কি দয়া করে একটু সিরিয়াস হবেন!”
রৌদ্র আরশির দিকে এক নজর তাকিয়ে বিছানায় বসে পরলো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বলল-
“কি বলবেন জলদি বলুন।”
“আপনি কি সব ভেবেচিন্তেই আমাকে বিয়ে করছেন ডক্টর! আমি আপনাকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি ব্যর্থ। আমি একটা অসম্পূর্ণ মেয়ে।”
রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল-
“আপনার তো মা হওয়ার চান্স আছে। কিন্তু আমি তো পুরোই ব্যর্থ, বাবা হতে অক্ষম। এই জন্যেই কি আমাকে বিয়ে করতে আপনি এতো ভাবছেন মিস আরু?”
আরশি ভড়কে উঠলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
“আমি কখনোই আপনার এসব নিয়ে ভাবিনি ডক্টর। কোনো কিছু না জেনে শুনেই কথা বলছেন কেন আপনি!”
রৌদ্র হাসলো। একটু জোরেই হাসলো। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আরশির তীক্ষ্ণ চোখ রৌদ্রর হাসি পর্যবেক্ষণ করছে। রৌদ্র আরশির মুখোমুখি হয়ে শীতল কন্ঠে বলল-
“আপনি আমার ব্যর্থতা নিয়ে ভাবছেন না অথচ আমাকে ঠিকই বাধ্য করছেন আপনার এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে ভাবতে। এটা কি ঠিক হচ্ছে মিস আরু?”
আরশি কিছু বলল না। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো তার বলার মতো কিছু নেই। রৌদ্র আরশিকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো। রৌদ্র আরশির একদম কাছে এসে আরশির গাল দু’হাতের মাঝে আগলে নিল। আরশির মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললো-
“তুমি কি ভুলে গেছো আমি তোমাকে কি বলেছিলাম! আমি শুধু তোমাকে চাই আরু।”
রৌদ্র আরশির গাল থেকে হাত নামিয়ে নিল। আরশির দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানে ফিসফিস করে বলল-
“মৃত্যু আমৃত্যু আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার ব্যর্থতা, মন খারাপ সব কিছু চাই। তোমার চোখের অশ্রুজল, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দুটোই চাই। তোমার লজ্জা, অস্বস্তি, রাগ সব কিছু চাই। শুধু তোমার ঘৃণা নয় ভালোবাসাটা-ই চাই।”
রৌদ্র কথা গুলো বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরশি এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশির হাত আপনা আপনি আরশির গালে চলে গেল। দু’হাত দিয়ে নিজের গাল ঢেকে আছে। আচমকাই নীলা রুমে এসে অস্থিরতার সাথে বলল-
“আশু তাড়াতাড়ি চল সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
আরশি কিছু বললো না। আগের মতোই গালে হাত দিয়ে মূর্তি মতো দাঁড়িয়ে আছে। নীলা আরশির দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-
“কিরে গাল ঢেকে রেখেছিস কেন! তাড়াতাড়ি চল।”
নীচ থেকে ডাকাডাকির শব্দ ভেসে আসতেই নীলা হন্তদন্ত হয়ে আরশির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নীচে এসে আরশিকে আবারও রৌদ্রর পাশে বসিয়ে দিল। রৌদ্র আড়চোখে আরশিকে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। আরশি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। হুজুর সাহেব আবারও আরশিকে কবুল বলতে বলল। আরশি চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিল। নিজেকে শান্ত করে নিম্ন স্বরে কবুল বলে ফেলল। পর পর তিনবার কবুল বলেই আরশি নিজের জীবন রৌদ্রর সাথে জড়িয়ে নিল।আরশির কবুল বলার পর রৌদ্র কোনো সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গেই কবুল বলে দেয়। আকদ ভালো ভাবে সম্পূর্ণ হতেই পুরো বাড়ি জুড়ে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। আরশিকে একে একে সবাই জড়িয়ে ধরছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে। রৌদ্র আর আরশিকে নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাই নিজেদের মতো করে আড্ডায় মেতে উঠলো।
———————
আকাশে গোলাকার চাঁদের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। চাঁদটা কিছুক্ষন পর পর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঁকি দিচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে চারপাশে। পুরোটা ছাদ জুড়ে আরশির বন্ধুদের হৈচৈয়ের শব্দে পরিবেশ গরম হয়ে আছে। রৌদ্র আর আরশি চুপচাপ বসে আছে তাদের মাঝে। আজ রাত সবাই আরশির বাড়িতেই থাকবে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয় আদিব হাসান একপ্রকার জোর করেই রৌদ্রদের রেখে দিয়েছে। বড়রা সবাই নিচে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছে আর ছোটরা সবাই ছাদে আড্ডার আসর জমিয়েছে৷ আড্ডার এক পর্যায়ে কাসফিয়া হুট করেই রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করল-
“আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি এর আগে কখনো কাওকে ভালোবেসেছেন? না-কি আশুই আপনার প্রথম ভালোবাসা!”
কাসফিয়ার সাথে সবাই তাল মিলিয়ে রৌদ্রর কাছে উত্তর জানতে চাইছে। রৌদ্র আরশির দিকে এক পলক তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“নাহ আরু আমার প্রথম ভালোবাসা না। এর আগেও আমি একজনকে ভালোবেসেছি। আর এখনো তাকে ভালোবাসি।”
রৌদ্রর উত্তরে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সবার মাঝেই গম্ভীরতা এসে ভর করেছে। রৌদ্র এমন কোনো উত্তর দিবে সেটা কেউ-ই আশা করেনি৷ বিশেষ করে আরশি। আরশি তো বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর রোদ এর আগেও একজনকে ভালোবেসেছেন আর এখনো ভালোবাসেন! কিন্তু উনি তো আমাকে বলেছিলেন উনি এর আগে কখনো প্রেম ভালোবাসা করেনি। আমিই তার জীবনে প্রথম মেয়ে। তাহলে কি রোদ আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে!! আরশি মনে নানানরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখে মুখে কৌতুহল নিয়ে রৌদ্রর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। নীল উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আপনি আমাদের সাথে মজা করছেন তাই না ভাইয়া?”
রৌদ্র দু হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে গম্ভীরমুখে বলল-
“এসব নিয়ে কখনো মজা করা যায় না।”
কাসফিয়া কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করলো-
“তাহলে কি?”
চলবে…
[ব্যস্ততার জন্য রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। জানি একটু অগোছালো হয়েছে তাই দুঃখিত। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️]