লবঙ্গ লতিকা পর্ব ২৬ (শেষ)

#লবঙ্গ_লতিকা
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৬ (শেষ)

তমা সাদের দেওয়া শাড়িটাই পরেছে। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক। তমা ধীর পায়ে রিসিপশনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। সাদ তমাকে দেখা মাত্রই থমকে গিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। মা যখন বলেছিল তমাকে লাল শাড়ি পরিয়ে ঘরে তুলবে। সাদ তখন এমনটাই কল্পনা করেছিল। কিন্তু, বাস্তবটা একটু বেশিই সুন্দর। সাদ মুখটা ব্যঙ্গ করে তমাকে বললো,” কাজের মেয়েরা যতই সুন্দর করে সাজুক না কেন কাজের মেয়েদের বুয়ার মতোই লাগে দেখতে।”
তমা চোখ মুখ কুঁচকে সাদের দিকে তাকালো। এত সুন্দর একটা দিনেও এসব কেউ বলে? সাদ আবার তমাকে হাই দিয়ে বললো,” হাই থম্মা! তোমাকে আজকে কী যে লাগছে না! পুরো আমাদের বাসার কাজের বুয়া রহিমা খালার মতো। রহিমা খালা অবশ্য তোমার মতো এত আটা,ময়দা, সুজি মাখে না। তবুও উনি অনেক ভিউথিফুল!”
তমা বিরক্ত হয়ে সাদের মুখশ্রীর দিকে তাকালো। সবসময় অপমান করে সাদ!

সাদের কয়েকজন বন্ধু সাদ আর তমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সাদের সঙ্গে কথা বলে তমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, “আরে এটা আমাদের ভাবী না? আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”

তমা সালামের জবাব দিয়ে কিছু বলার আগেই সাদ পাশ থেকে বলে উঠলো,”আরে কী যে বলিস না!আমার বউ কত সুন্দর! এটা আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে। ঘর মুছতে এসেছে এখানে।”

তমা রোষাগ্নি দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। সাদের কথা সাদের বন্ধুরা ঠাট্টা হিসেবেই নিয়েছে। হাসতে হাসতে সবাই সাদকে বললো,
” সাদ তোর বদঅভ্যেস আর গেল না। ভাবী মন খারাপ করবেন না। ও এমনই, আসি ভাবী;সময় করে একদিন ঘুরে যাবেন আমাদের বাড়ি থেকে। এই সাদ! ভাবীকে নিয়ে যাস আমাদের বাড়িতে।”

সাদ তুখোড় দৃষ্টিতে তমার দিকে বললো, “হ্যাঁ, যাবো একদিন সময় করে। আমার সুন্দরী বউকে নিয়েই যাবো।আমি আবার বুয়াদের সাথে বেশি ঘুরাঘুরি করতে পারি না।” সাদ এটুকু বলেই মুখ অন্যদিকে ফিরালো।
তমা রাগে ওখানেই বসে পরলো। সাদ সবসময় এমন করে! সবার সামনে এভাবে বলার কী খুব দরকার ছিল?
সাদ তমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মহারানী রাগে ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে গেছেন।

পুতুল আর নাদিয়াও তমার পাশে বসে ছিল অনেকটা সময়। তাঁরা তাদের ভাবীমনিকে অনেক ভালোবাসে।

খাওয়ার টেবিলে সাদের সঙ্গে বসেছে তমা। সাদ যদি তমাকে এক মিনিটের জন্যও শান্তি দিতো! একটু পরপর তমার পায়ে নাগড়াই দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। তমার হাতে চিমটি কাটছে। তমা তবুও মুখ বুঁজে সহ্য করছে কারণ, আশেপাশে মানুষ আছে। ওনাদের সামনে সাদের সঙ্গে রাগারাগি করলে খারাপ ভাববে। সাদ এই সুযোগটাই নিয়ে ফেললো। খাওয়ার সময় তমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”আস্তে খাও, খাবার কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না। এত এত খেলে পরে দোখা যাবে রাতে ঘুমোতে গিয়ে আমার এত সাধের খাটটাই ভেঙে ফেলেছো। আমার কিন্তু একটাই খাট। ভেঙে গেলে কিন্তু নিচে শোয়াবো তোমাকে।”
তমা ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”বাঁচাল”

বিদায়ের সময় তমা কাঁদো কাঁদো চোখে শফিক আর আরেকবার মায়ের দিকে তাকালো। জুঁইও তমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো। জুঁই হলো তমার ভাবী। শফিকের বউ, খুব আদর করে তমাকে। তমারও জুঁইয়ের সঙ্গে বেশ ভাব। তমা এবার দৌড়ে গিয়ে তাদের জাঁপটে ধরে কেঁদে ফেললো। সাদ তমাকে টিপ্পনী কেটে বললো,” আরে আস্তে কাঁদো! এমনিতেও কাজের বুয়াদের মতো লাগছে দেখতে। এর মধ্যে এত কাঁদলে দেখা যাবে তোমাকে দেখে মানুষ ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। ”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! গাড়িতে ওঠার আগ অবধি তমা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললো। গাড়িতে উঠে সবার শান্তনাতে একটু হলেও ঠান্ডা হলো। তবুও মন বেজায় খারাপ তাঁর!

ফুলসজ্জার রাত! পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো। তমা চুপটি করে খাটের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। সাদ কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে ঘরে প্রবেশ করলো। তমা চুপচাপ বসে আছে। টু শব্দও করছে না। সাদ ঘরে ঢুকেই জোরেশোরে হাত ওপরে করে একটা হাই তুললো। তমা চমকে উঠে সাদের দিকে তাকালো। সাদ তমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” ঝাঁঝের রানী লবঙ্গ লতিকা! এবার যাবে কোথায়? তোমাকে তো এবার বাগে পেয়েছি। ”

তমা ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বসলো। কী নি/লজ্জ রে বাবা! কিছুই মুখে আঁটকায় না। সাদ তমার দিকে এগুতে এগুতে বললো,” টানা কত্তগুলো বছর অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। তুমি খুব কঠিন একটা মানুষ! কিছুই বোঝো না।”

তমা মুখ ফুলিয়ে বললো,” বড়রা যদি না আসতে দেয় তবে আমি কী করে আসতাম? সবকিছুতে শুধু আমারই দোষ খুঁজে পান আপনি।”

সাদ কিছুটা থেমে বললো,” হুম, এবার এসব বাদ দাও থমা! একটু কাছে এসো তো। আমার পা-টা টিপে বাদ। ব্যাথা করছে অনেক।”

তমা রাগী রাগী চোখে সাদের দিকে তাকালো। সাদ তমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,” আমার লালটু বউ। রাগ করে না,
ওটা তো এমনি বলেছি। তুমি তো লবঙ্গ লতিকা। তোমায় কত ভালোবাসে নিজের কাছে রাখবো। তোমাকে দিয়ে পা টেপাবো না কি?”

তমা লজ্জা পেয়ে সরে যেতে চাইলে সাদ তমার হাত ধরে বললো,”লাজে রাঙা হলো কনে বউ গো। মালা বদল হবে এই রাতে…”

তমা আড়ষ্ট হয়ে সাদের বুকে মুখ গুঁজল। এই ছেলেটা যেন যেন কেমন কেমন! শুধু লজ্জা দেয়! সাদ তমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,” লবঙ্গ লতিকা! ”

তমা চোখ বন্ধ করে লজ্জায় মাথা নুয়ালো। সাদ তমাকে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো। তমা সাদের সান্নিধ্যে এসে পুরনো দিনের কথা ভেবে স্মৃতির মায়ায় কেঁদে ফেললো। এই তো কিছুদিন আগেরই কথা। সাদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলো। একেবারে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক তাদের। কেউ কাউকে দু’চোখ পেতে দেখতে পারতো না। কিন্তু, এখন? দুজনের প্রতি দুজনের অগাধ টান, ভালোবাসার অদ্ভুত অনুরক্তি। আচ্ছা এমনটা কী হওয়ার ছিল? তমা সাদের গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,” আচ্ছা, এটা কী বাস্তব? ”

সাদ দুষ্টুমি করে তমাকে একটা চিমটি দিলো। তমা কিছু বলার পূর্বেই সাদ বললো,” ঝাঝের রানী লবঙ্গ লতিকা। সবকিছুর সুদ তুলবো আজ। ভূতের ভয় দেখিয়েছো। ফাটা ফুচকা বলেছো। আমার নামের ব্যঙ্গ করেছো। সবকিছুর কড়ায় গন্ডা বদলা নেবো।”

তমা সাদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। এই ছেলেটা এমন কেন? কখনো কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। আবার কখনো শুধু শুধু পেছনে লাগে। অকারণে তমাকে ক্ষেপায়। কবে শুধরাবে এই ছেলেটা? না কি সারাজীবন এভাবেই তমার জীবনে দুষ্টু মিষ্টি একটি সুন্দর চরিত্র হয়ে ফুটে থাকবে? তমা কিছুই জানে না। কিছুই না। শুধু এটুকুই জানে তাঁর পাশে অবস্থানকৃত সাদ নামের ছেলেটি তাঁকে নির্দ্বিধায় অনেকটা ভালোবাসে। এবং তাঁকে সারাজীবন গভীর সমাপনে আগলে রাখবে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here