লবঙ্গ লতিকা পাঠ-৭

#লবঙ্গ_লতিকা
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৭

সাদের পা ব্যাথায় ফুলে গেছে। বাড়িতে আসার পর সাদকে পায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সাদ বলেছে সাদ পরে গিয়েছে। পরদিন সকালে জুলেখা সাদের সঙ্গে দেখা করতে। সাদকে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলে তমার মার খাবে ভেবে সাদকে ব্যাপারটা চেপে গেল। জুলেখা ঝাপসা চোখে সাদকে বললো,
” তমা যখন আট বছরের। তখন তমার বাবা মারা যায়।সারাদিন ঠিকই ছিল। রাতে হঠাৎ কী হলো জানি না। এক সাথে ঘুমাতে গেলাম। আমি উঠলেও তমার বাবা আর উঠলো না। পরিবারের একমাত্র ঢালই ছিল তমার বাবা। যে-ই পরিবারে বাবা থাকে না। সেই সংসার চালানো যে কত কষ্ট সেটা পরিস্থিতির খাতিরে আমি বুঝেছিলাম। শফিক বড় হওয়া না অবধি বেশ পরিশ্রম করে তমা আর শফিককে বড় করেছি। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। কখনো ওদের চাহিদা মেটাতে পারিনি। খুব অভাবে দিন কেটেছে। তমা ছোটবেলা থেকেই দুষ্ট। মানুষের গাছের ফল চুরি করে খেতো। যেখানে যেতো একটা অঘটন ঘটিয়েই বাড়ি ফিরতো। ও আমার হাতে কত যে মার খেয়েছে তাঁর হিসেব নেই। মারে কখনো ওর দুষ্টুমি কমেনি। উল্টো বেড়েছে! ওকে যে-ই কাজ করতে নিষেধ করতাম ও সবসময় সেটাই বেশি করতো। আজ এই বাড়ি থেকে বিচার আসতো তো কাল ও বাড়ি থেকে। আমিই বা কী করবো বলো? আমি মা! আমি যদি-ই এত অত্যাচার করি ও যাবেটা কোথায়? ওকে মারা বন্ধ করে আদর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুঝ দিতাম। ও এখনও অনেক কিছুই বোঝে না। কোথায় কী করতে হবে কোথায় কী বলতে হবে না সেসব জানে না। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে বারবার বিপদে পরে। মাঝেমধ্যে গ্রামের লোকজন ওর প্রতি বিরক্ত হয়ে ওকে পাগল বলতো। আমি কখনো ওর প্রতি বিরক্ত হতে পারিনি। কখনো ওর শখ আহ্লাদ মেটাতে পারিনি। আমি দিতে পারিনি বলেই তো ও নিজে চুরি করার সাহস করেছে। ”

জুলেখা হঠাৎ সাদের সামনে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। একটু থেমে আবার বললো,”তোমার দাদী মানুষটা খুব ভালো। সংসারের খরচ এক হাতে জোগাতে হিমশিম খেতাম। কখনো কারো কাছে ধার চাইলে কেউ দিতো না। পাছে যদি ধার নিয়ে ফেরত না দেই। তোমার দাদী প্রায়ই আমাকে গোপনে সাহায্য করতো। আমি আবার যখন সুযোগ পেতাম ধার পরিশোধ করে দিতাম। মাঝেমধ্যে ঘরে চাল থাকতো না। তোমার দাদী খুব সাহায্য করতেন। চাল তারপর তোমাদের ক্ষেতের শাক-সবজি এসব দিয়ে সাহায্য করতেন। আমার খুব উপকার হতো।”

জুলেখা এসব বলে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,” তোমার যদি তোমার কোনো আচরণে কষ্ট লাগে তুমি মাফ করে দিয়ো বাবা। ওর এত বুঝ জ্ঞান নেই। তুমি পারলে মাফ করে দিয়ো।”

জুলেখা এসব বলে ক্রন্দনরত দৃষ্টিতে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। সাদ চুপচাপ পা বিছিয়ে বসে রইলো।

সারাদিন ঘরে পা বিছিয়ে বসে থাকতে থাকতে সাদ বিরক্ত। বিকেলে একটু বাড়ি থেকে বের না হলে সবকিছু কেন যেন ফিঁকে ফিঁকে লাগে। সাদ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি থেকে বের হলো। রাসেল কাকার চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলো। সাথে তিন কোনা বন রুটি সাইডে সাদা ক্রিম মাখানো। বনরুটি চায়ে ভিজিয়ে সাদ মুখে দিলো। দূর থেকে দেখতে পেল তমার মতো কে যেন হেঁটে চলেছে। কিছুক্ষন পর ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো। ওটা আসলে তমা। এক হাতে বড় বটির মতো কী যেন। আর আরেক হাতে অনেকগুলো ডাব। সাদ বুঝতে পারলো তমা গাছ থেকে ডাব পেরেছে। সাদ চা বনরুটি শেষ করে তমার দিকে এগিয়ে গেল। তমা অবশ্য বেশ খানিকটা দূর এগিয়ে গিয়েছে। সাদ পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকলো “তমা!”

তমা চমকে পেছন ফিরে তাকালো। সাদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তমার দিকে এগিয়ে গেল। সাদ তমার কাছে যেতেই;তমা বটি সাদের দিকে এগিয়ে বললো,” পা ভেঙে শান্তি হয়নি? আরেকবার ডাকাডাকি করলে পা বটি দিয়ে কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো।”

সাদ বটির দিকে একবার তাকালো। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো। তমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তমা আসলেই বটি দিয়ে সাদের পা কেটে ফেলতে পারে। সাদ তমার হাতে থাকা ডাবের দিকে আঙুল দিয়ে বললো,” কী এগুলো?”

তমা জোর করে হেসে বললো,” আমাদের গাছের মুলা।”

সাদ অবাক হয়ে তমাকে বললো,”এগুলো তো ডাব।”

তমা রেগে গিয়ে বললো,” জানেন যখন জিজ্ঞেস করলেন কেন?”

সাদ ঢোক গিলে বললো,”এমনি।”

তমা সাদকে রেখেই হাঁটা শুরু করলো। সাদ দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,” যাচ্ছো কোথায়?”

তমা চোখ কুচকে জোর করে হেসে বললো,” শশুর বাড়িতে! ”

সাদ ঠোঁট টিপে হেসে বললো,” তুমি কী ভুলোমনা তমা! তোমার শশুর বাড়ির রাস্তা এদিকে না। ওদিকে! চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

তমা রেগে সাদের দিকে তাকালো। সাদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো, “এতগুলো ডাব নিয়ে যাচ্ছো। আমাকে একটাবার সাধলেও না। ”

তমা বটি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বললো,” আপনি এত ছোঁচা কেন? আপনাকে আমি ডাব দেবো না। যান ভাগুন!”

সাদ আঙুল ভাঁজ করতে করতে তমাকে বললো,” কী করলে ডাব দেবে?”

তমা ভেবেচিন্তে উত্তর দিলো,” আমি যা চাইবো সেটা দিতে হবে। তাহলে ডাব দেবো। ”

সাদ প্রশ্নতর দৃষ্টিতে তমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” কী চাও? যা চাইবে তাই দেবো।”

তমা ডাবগুলো নিচে রেখে বললো,” এই সামনের স্কুলটা চেনেন? সকালে স্কুল ছুটি হলে ফুচকা ওয়ালা মামা বসে। আমাকে ফুচকা খাওয়াতে হবে।”

সাদ মাথা নাড়িয়ে বললো,” তা খাওয়াবো। এখন আমাকে ডাব কেটে খাওয়াতে হবে।”

তমা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো,” সামনের গাছ তলায় চলুন। ওখানে বসে ডাব কেটে খাওয়াবো।”

গাছ তলায় গিয়ে সাদ পা মেলে বসলো। এত হাঁটাহাটি করে এখন পা ব্যাথা করছে। তমা বটি দিয়ে অতি দক্ষতার সহিত ডাব কেটে সাদকে দিলো। সাদ ডাব হাতে নিতেই তমা বললো,” সকাল বেলা স্কুলের সামনে আমার জন্য দাঁড়াবেন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আমি বাড়ি গেলাম।”

তমা এতটুকু বলেই হাঁটা শুরু করলো। সাদ ডাবের পানিতে চুমুক দিতে দিতে তমার চলে যাওয়া দেখলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here