#লবঙ্গ_লতিকা
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮
সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা শেষ করলো সাদ। রেডি হয়ে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা মাথার ঘোমটা ঠিক করতে করতে সাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাদ তমার দিকে দু’পা এগিয়ে গেল। তমা সাদের দিকে তাকিয়ে নিজের কোমরে হাত রেখে বললো,”এবার যা শর্ত ছিল তা পূরন করুন।”
সাদ মাথা ঝাঁকালো। তমা গিয়ে ফুচকা ওয়ালা মামাকে ফুচকা দিতে বললো। ফুচকা ওয়ালা মামা তমাকে বললো,” কয় প্লেট দিমু আপা?” তমা হেসে ফুচকা ওয়ালা মামাকে বললো,” দিতে থাকুন ইচ্ছেমত।”
তমা একপ্লেট ফুচকা হাতে নিতেই তমার সঙ্গীরা সব হাজির। ১০-১২ জন সঙ্গীসাথীকে দেখে তমা ফুচকা ওয়ালা মামার উদ্দেশ্য বললো,” যে যত প্লেট খেতে চায় দিন মামা।” সাদ মাটিতে পা খুড়ঁছিল। ভেবেছে এরা সব ছোট মানুষ। আর কতটুকুই বা খাবে? কিন্তু, সাদকে অবাক করে দিয়ে প্রত্যেকে ৪-৫ প্লেট করে ফুচকা খেয়েছে। ফুচকাওয়ালা মামাকে যখন বিল দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলো। তখন সাদ মুখ কালো করে ফেললো। এই সপ্তাহের পকেট মানি সব শেষ! কে যে বলেছিল তমার ফাঁদে পা দিতে! তমা মেয়েটাও অতি চালাক! হুহ! সাদ মনে তমার প্রতি চাপা রাগ রেখে বাড়ি ফিরে গেল।
সময় কখন কেটে যায় তা বোঝাই যায় না। পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেছে এভাবে। কালকে কাবিন পরিয়ে তমাকে একেবারে তুলে আনবে। শাড়ি,গহনাসহ আরো বেশ কিছু ডালা আজ তমাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। তমারাও অবশ্য অনেকগুলো ডালা পাঠিয়েছে।
সাদদের পুরো বাড়িতে লাইটিং করা। একটু পরপর গ্রামের মানুষজন উঁকি-ঝুকি মারছে। মহসীন খান অবশ্য অনিতাকে বলে দিয়েছেন, “আজকে যাঁরা বাড়িতে আসবে একটা মানুষও যেন খালি মুখে না যায়। ভরপেট খাইয়ে তারপর বিদায় দেবে।”
অনিতাও অবশ্য মহসীন খানের সঙ্গে দ্বিমত করেননি। খুশি মনেই সবটা মেনে নিয়েছেন। সাদের বিয়েতে সবচেয়ে আনন্দ করছে আঙুর বালা। এতদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। এখন বলো কয়েও বিছানায় দুদণ্ডের জন্য বসানো যাচ্ছে না। বাচ্চাদের মতো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছেন। সাদের বিয়ের উপলক্ষে মেহমানদের জন্য গামলা ভর্তি করে পিঠা বানিয়েছেন। তেলের পিঠা,নকশী পিঠা, সাজ পিঠা, আরও কত রকমের পিঠা বানিয়ে খাবার টেবিল ভরে ফেলেছেন।
নাদিয়ার তো আনন্দের শেষ নেই। একমাত্র ভাইয়ার বিয়ে বলে কথা। নাদিয়ার ছোট্ট আরেকটা বোন আছে; নাম পুতুল। পুতুল অবশ্য এখনও বেশ ছোট। সবে মাত্র বসতে শিখেছে। সাদের অবশ্য আর কোনো ভাইবোন না থাকায় নাদিয়া আর পুতুলকে বেশ আদর করে। যখন নাদিয়া আর পুতুলকে দেখে মন ভরে আদর করে। ছোট বাচ্চারা আসলেই নিষ্পাপ। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
সকালে সাদকে কয়েকবার ডেকে ঘুম থেকে তোলা হলো। সাদ ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাত মুখ ধুয়ে আসতেই বাইরে থেকে অনিতার ডাকাডাকি শুরু। সাদ টলমলে পায়ে বাইরে আসলো। সাদ বাইরে এসে দেখলো বাড়ির কাজের লোকেরা পাটায় হলুদ বাটছে।অনিতা সাদা ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট সাদকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” এটা তাড়াতাড়ি পরে এসো বাবা। তোমাকে সবাই হলুদ লাগানোর জন্য বসে আছে। ”
সাদ বিরক্তি মাখা চোখে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো। এসব গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয় মেয়েদের। ছেলেদের জন্যও যে এসব নিয়ম অনুষ্ঠান মানতো হয় কে জানতো! সাদ টিশার্ট, ট্রাউজার পরে বাইরে এলো। সবাই হলুদের বাটি সাজিয়ে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পরলো সাদের ওপরে। গালে,মুখে,নাকে,কপালে,হাতে একেবারে হলুদ দিয়ে লেপ্টে দিলো সাদকে। সাদ নিজের শরীরে এত হলুদের ছোঁয়া দেখে বারবার ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছিল সবার দিকে। কিন্তু সবার কী আর সেই খেয়াল আছে? সবাই তো নিজের মতো সাদকে হলুদ মাখাতে ব্যস্ত।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই দুপুরের দিকে সবাই তমাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। তমাদের বাড়ির সামনে বড় করে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। প্যান্ডেলের ভেতরে গিয়েই সবাই খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা সারবে।ছোট্টখাটো একটা স্টেজের মধ্যে তমা আর সাদকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তমা লাল বেনারসি শাড়ি পরিহিত। শাড়িটা অবশ্য সাদদের বাড়ি থেকেই দেওয়া।
তমার ঘেমে একাকার অবস্থা। সাদ একটু পরপর তমার দিকে তাকাচ্ছে। তমার অবশ্য কোনো হেরফের নেই। তমা সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে দেখছে। সাদ তমার পাশে হাত রাখলো। তমা প্রথমে একটু চুপচাপ থাকলেও পরে আগের অবস্থায় ফিরে গেল। টুকুস করে একটা চিমটি বসিয়ে দিলো সাদের হাতে।বসাদ নিরবে ব্যাথা সহ্য করে নিলো। এত মানুষ সামনে তাঁদের সামনে তো আর ঝগড়াঝাটি করা যায় না।
তমা বেশ কিছু সময় পর একটা মেয়েকে হাত ইশারায় নিজের কাছে ডাকলো। সম্ভবত এইটা সেই মেয়েটাই যে সাদকে পাদ নামে ভূষিত করেছিল। মেয়েটা তমার সামনে আসতেই তমা মেয়েটার কানের সামনে গিয়ে বললো,”কতক্ষন ধরে বসেই আছি। খাবার দিবে কখন? আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে! চারপাশে কত সুন্দর পোলাওয়ের ঘ্রান! আর আমি মরি খুদার জ্বালায়।”
মেয়েটা তমার কথায় ফিক করে হেসে ফেললো। হাসি চেপে রেখে তমাকে বললো,” দাঁড়া, আমি দেখতাসি।” এটুকু বলেই মেয়েটা তমার সামনে চলে গেল।
সবার খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বিয়ের পর্ব শুরু হলো। সাদ সাধারণ ভাবে কবুল বলে বিয়েতে মত দিলেও। তমা কবুল বলার সময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। সাদ বেশ কয়েকবার ফিরে ফিরে তমাকে দেখছিল।
বিদায়ের সময় তমা মা, ভাইকে ধরে বেশ ক্ষানিক সময় কেঁদে ছিল। শফিক বোনকে ধরে কেঁদেই ফেললো। এত আদরের বোন। একে ছাড়া থাকবে কীভাবে?
সাদদের বাড়ি গিয়ে তমাকে সাদের ঘরে বসিয়ে রাখা হলো। বাড়িতে একের পর এক মেহমান আসছে। আর সবাই প্রথমে সাদের ঘরে ঢুকে তমাকে দেখছে। সাদ অবশ্য অন্য ঘরে। নিজের মতো বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত সে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ই বিপত্তি বাঁধলো। অনিতা সাদ আর তমাকে একসঙ্গে থাকতে নিষেধ করে দিয়েছে। সারাদিন কথাবার্তা বলতে পারবে। কিন্তু, রাতে কিছুতেই একসঙ্গে ঘুমোতে পারবে না। বাড়ি ভর্তি মেহমান। তাই, অনেক ভেবেচিন্তে অনিতা আঙুর বালার সঙ্গে তমাকে ঘুমোতে বললেন।
তমা আঙুর বালার ঘরে গিয়ে দেখলো, আঙুর বালা তমার জন্য এক পাশে; জায়গা রেখে অপর;পাশে ঘুমিয়ে পরেছে। তমা গিয়ে চুপিসারে কোনো শব্দ না করে আঙুর বালার পাশে শুয়ে পরলো। তমার ঘুম আসছে না কিছুতেই। প্রথমত,মাকে ছাড়া তমার ঘুম আসে না। দ্বিতীয়ত, আঙুর বালা জোরে জোরে নাক ডেকেই চলেছে। তমা বিরক্ত হয়ে মাথা থেকে বালিশ সরিয়ে কানে চেপে ধরলো। ধুর ভালো লাগে না আর!
আঙুর বালা দরজা কিছুটা ফাঁকা রেখে ঘুমোয়। তমা হঠাৎ খেয়াল করলো দরজার পাশে কোনো এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তমা ভয় পেয়ে আঙুর বালার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,” দাদু! দেখেন দরজার সামনে কে যেন!একটু উঠেন! কে যেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ”
আঙুর বালা ঘুমের ঘোরে তমার হাতের বাঁধন থেকে হাত সরিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,” যা ছেম/ড়ি ! সারাদিন দিন-দুনিয়ার কথা কইয়া করকরাস! এহন ঘুমাইতে শুইলেও তোর জ্বালায় শান্তি নাই। ঘুমের ভিত্তেও করকরায়া আমার মাথা খাস!”
চলবে…