#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ১২
৩০.
স্নিগ্ধ গগন। কোলাহলপূর্ণ নগরী ধুম্রজালের বক্ষে বন্দী। চারপাশে শীতল শীতল আমেজ। গরম ধোঁয়া উঠা কফি সামনে রেখে বাইরে তাঁকিয়ে আছে সিলিভিয়া।ব্যস্ত নগরে গাড়ি যাতায়াতের দৃশ্য অবলোকন করছে সে। দৃঢ় অপেক্ষা কারো আগমনের। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর কফির মগে চুমু বসাচ্ছে সিলিভিয়া। প্রহর গুনতে লাগলো আপনমনে। সঠিক সময়টা যেনো হাতে ধরা দিতে চাইছে না। মনের মধ্যে হাজারো চিন্তা,আকাঙ্খা, বাসনা, অপূর্ণতা ঝেঁকে ধরছে তাকে।
কিয়দংশ মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর থাই গ্লাসের দরজা খুলে কফিশফের ভেতরে একটা মেয়ে প্রবেশ করলো। কোলে তার ষোল মাসের বাচ্চা। দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসছে সিলিভিয়ার দিকে।ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। কাছাকাছি আসতেই,বাচ্চাটা কোল থেকে হাত প্রসারিত করে দিলো সিলিভিয়ার দিকে।সেটা দেখে,সিলিভাও হাত টেনে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো।
মেয়েটি চেয়ারে বসতে বাসতে বলল,
— কেমন আছিস সিলি!
— আমি ভালো আছি,তুই?
সিলিভিয়ার কথার পিঠে রোদ বলে উঠলো,
— আমার আর ভালো থাকা কোথায়? সারাদিন সংসারের পেছনে খাটতে খাটতে দিন পার করছি। তার উপর একটা বাচ্চা।উফ,আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কোন দুঃখে যে রিলেশন করতে গেলাম,তারপর বিয়ে। আমার কপালটায় পুড়া, ধুর!
রোদের চোখেমুখে বিরক্তি,কন্ঠে অভিযোগের বন্যা।চোখের কোণে অসহায়ত্বের চাপ। সিলিভিয়া মৌন থেকে রোদকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর হালকা কেশে বলল,
—- তোর এতো ঝামেলা কোথায় ? তোর ছেলে সহ মোট তিনজন।যেভাবে বর্ণনা দিলি,শুনে মনে হলো দশ পনেরো জন সদস্য নিয়ে জয়েন ফ্যামিলি তে আছিস।
— সেটা হলেও বাঁচতাম।অন্তত বাচ্চাটা রাখার মতো কেউ থাকতো। সারাদিন বাচ্চা সামলাই, কাজকর্ম রান্না-বান্না যা পারি সাধ্যমতো করি।তারপরও তোর ভাইয়া বলে সারাদিন বাসায় বসে থেকে কি করি। কোন কিছুই পছন্দ হয় না তার।
এ পর্যায়ে সিলিভিয়ার কপালে সূক্ষ্ম একটা ভাঁজ পড়লো।এরপর বলল,
— বাচ্চা সামলানো,রান্নাবান্না করার পরও যদি কোন মেয়েকে স্বামীর কাছে শুনতে হয় সারাদিন বাসায় বসে কি করে? তাহলে তার ডাইরেক্ট একটা এ্যাকশন আছে। সেটা নিবি?
রোদ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
— কি এ্যাকশন রে সিলি?
— তুই এখন, এই মুহূর্তে, মামির কাছে চলে যা। ভাইয়াকে বলে দিস, তুই আর ফিরবি না। ভয় পাস না।কথাটা তুই এমনিতে বলবি। দেখ কি হয়?
রোদ চোখ কপালে তুলে বলল,
— আরে এটা করলে তো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।আমি চাই দাঁত কামড়ে সব সহ্য করতে।
সিলিভিয়া বিরক্ত হয় রোদের কথা শুনে, বলল,
— ঠিক আছে,কামড়ে সহ্য কর।দেখ দাঁত না ভেঙে পড়ে।তোর জায়গায় আমি হলে নির্ঘাত তোর জামাইয়ের জায়গা এখন হসপিটালে হতো। সেসব কথা বাদ দে। যেটা বলতে ডেকেছি তোকে।
রোদ মন খারাপ করে বলল,
— বল,
— আমি স্কলারশিপ পেয়েছি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি তে।
হঠাৎ রোদ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—- কী? সত্যি?
রোদের চিৎকারে সিলিভিয়া থমথম খেয়ে আশেপাশে তাঁকালো। সবাই কেমন অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে।সিলিভিয়া অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। এরপর তীক্ষ্ণ চোখে রোদের দিকে চেয়ে বলল,
— এতো জোরে চেঁচানোর কি হয়েছিলো?চেঁচালি কেন? প্রেস্টিজ ডুবাতে চাস?
রোদ আমোদিত স্বরে বলল,
— স্যরি, খুশীর দমকা সামলাতে পারিনি।তারপর বল প্ল্যান কি? ওখানে অবশ্যই আমার মামির বাসায় যাবি।তুই যাচ্ছিস জানলে ভীষণ খুশী হবে। তুই থাকতেও পারবি সেখানে।
সিলিভিয়া রোদের ছেলের মাথায় হাত ডুবিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বলল,
— যাওয়ার চেষ্টা করবো। আর আমি তো
ডরমিটরিতে থাকবো। শুধু শুধু উনাদের সমস্যায় ফেলতে চাই না।
— তো কবে যাচ্ছিস?
— দিন পনেরো মতো তো লাগবেই।
— ফুফি,সায়মন ভাইয়া যেতে দিচ্ছে কি করে?
আপত্তি করেনি?
— করেছে,অনেক কষ্টে মানিয়েছি।
সিলিভিয়ার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রামিশ এসে উপস্থিত হলো তাদের মাঝে।রোদ একটু চমকে গেলো এভাবে রামিশের আগমনে। রামিশ সিলিভিয়ার পাশে বসতে বসতে বলল,
— আপু আপনাকে তো আগে দেখিনি।সিলির
কি হন আপনি?
রোদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
— আমি সিলির কাজিন,আপনি?
রামিশ হাসিমুখে কিছু বলতে যাবে,তার আগে আঁড়ালে রামিশের হাতটা আঁকড়ে ধরলো সিলিভিয়া। রামিশ অবাক হয়ে সিলিভিয়ার হাতের দিকে তাকালো।অতঃপর মৃদু হেসে বলল,
— আমি সিলির বন্ধু।
তাদের মধ্যে কথোপকথন চলতেই লাগলো।সিলিভিয়া নীরব থেকে মনের সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত।
৩১.
আগের সময়ে বিমানের খুঁটিনাটি কিছু বিষয় দেখার জন্য ‘গ্রাউন্ড টেকনিশিয়ান’ থাকতো।এখন সেই কাজটি পাইলটদের অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে পালন করতে হচ্ছে।ছোট থেকে ছোট কাজ করার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র সই করতে হয়।বিমান কতৃপক্ষকে জানাতে হয়। ভীষণ হিমশিম খেতে হচ্ছে তেহভীনকে। কালকের জার্নিটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো তার জন্য। আবহাওয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকার পরও কেন যেনো মানসিক চাপটা সামলানো যাচ্ছিলো না। দক্ষ পাইলট হয়েও আজ পর্যন্ত এমন সিচুয়েশনে পড়েনি তেহভীন।যার ফলে মাঝখান থেকে লিভ নিতে হয়েছে তাকে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা অবশ্যক একজন পাইলটকে।
বাইশ দিন পর আজ নিজের শহরে ফিরেছে তেহভীন। ছুটির দিন হওয়াতে তায়্যিবাও আজ বাড়িতে ছিলেন। তেহভীন কে দেখে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যান উনি। ছেলে মেয়ে বাড়িতে আসলে তায়্যিবার মনে হয় যেনো ‘ঈদ এসেছে।’
তামান্না কে সাথে না দেখে তায়্যিবা জিজ্ঞেস করলেন,
— তেহভীন! তোমার সিস, আসেনি?
পায়ের মোজা খুলতে খুলতে তেহভীন জবাবে বলল,
— চারদিন পর আসবে সিস,আমি এবার আটদিনের ছুটিতে এসেছি।
তায়্যিবা ভারী অবাক হয়ে বললেন,
— আটদিন? কিভাবে সম্ভব? আগে তো এতদিন নাও নি।তোমার ড্যাড কিছু বলেনি?ইনপেক্ট উনি বলেছিলে; আগামী ছয়মাস তোমরা দুই ভাইবোন কোন ছুটি পাবেনা, বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য।তাহলে?
তেহভীন মৃদুস্বরে হাসলো।বলল,
— সেটা ড্যাড নিতান্ত রাগ থেকে বলেছেন।
আমার উপর উনার ক্ষোভটা আবার বেশি।হয়তো ব্রাদারের চেয়ে কম,কিন্তু আছে। আর এবারের ছুটিটা আমি সিকন্যাসের কারণে নিয়েছি।
তায়্যিবা হাত প্রসারিত করে তেহভীনের কপাল,গলা সব ছুঁয়ে দেখলেন।শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে জানতে চাইলেন,
— কোথায় সিকন্যাস?
তেহভীন চোখে হাসলো,বললো,
— আমি ব্রাদারের কাছে যেতে চাই মম।
আই মিস হিম মম।
তেহভীন নিঃশব্দে নিজের কামরায় চলে আসলো পোশাক বদলে ফ্রেস হয়ে,নরমাল ট্রাউজার,টি-শার্ট পরিধান করলো। দরজা লকড করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হঠাৎ বুকের ভেতর ব্যাথা অনুভব করলো। এই ব্যাথাটা গতদিন গুলোতেও সে অনুভব করেছে।
কিছু একটার অভাব অনুভূত হচ্ছে তার।সব থেকেও যেনো নেই,নিজের একটা অস্থিত্ব কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছে।
চোখজোড়া বন্ধ করার সাথে সাথে নিজের ছোট একটা পাগলামির কথা মনে পড়লো তেহভীনের। যেটা সে কাজে ফেরার আগে করেছিলো। বেড থেকে উঠে কাবার্ডের ছোট একটা ড্রায়ার থেকে একটা বাক্স বের করলো। নিঃসন্দেহে প্রথম দর্শনে যে কেউ ভেবে নিবে বাক্সটির মধ্যে রিং রয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে যখনি বাক্সটি খুলা হবে।
তেহভীন সন্তপর্ণে বাক্সটি খুলল,তার মধ্যে থেকে অভাবনীয় কিছু বের করলো সে। মোট চারটা বেশ লম্বা,সোজা, রেশমি কালো চুল বের করলো।
চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো তেহভীনের। অধরে চাপ প্রয়োগ করে হেসে বলল,
— তোমার মাথার একলক্ষ পঞ্চাশ হাজার চুলের মধ্যে থেকে চারটা চুল আমার কাছে সিলভার।প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।আমি এই চুল তোমাকে না বলে চুরি করে এনেছি।
একটু চুপ থেকে তেহভীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূনরায় বলল,
— কিছু পছন্দের জিনিস চুরি করে আনলে
পাপ হয়না সিলভার।অন্তত বন্ধু হিসেবে তো নয়।
(চলবে)