লাভ রেইন পর্ব-১৬

0
2303

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ১৬

৪০.
সাউথ হলের সামনে ছোট্ট রাস্তার পাশে বসার মতো পরিচ্ছন্ন একটা জায়গা রয়েছে। রোড ক্রস করে সেখানে যেতে হয়। সে প্রান্তে সিলিভিয়া বসে বসে আপন মনে নোট লিখছিলো। সম্পূর্ণ মনোযোগ নোট লেখায় নিবদ্ধ। দীঘল খোলা চুল চারপাশে গালিচার ন্যায় বিছিয়ে আছে। পরিধানে শুভ্র পোশাকের কারণে অপরূপা ও স্নিগ্ধ লাগছে। নিরিবিলি স্থানে হঠাৎ শব্দ তুলে চার জোড়া পায়ের আগমন হলো।

সিলিভিয়া মাথা তুলে তাঁকালো। গ্যাটলি ভ্রুঁ কুঁচকে সিলিভিয়ার কোলে থাকা নোটবুকের দিকে তাঁকালো। ড্যাবিয়ান পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। আমারা আর ক্যাডি সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে আছে। সিলিভিয়া তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয় আন্দাজ করতে পারলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে?

গ্যাটলি সিলিভিয়ার পাশে বসলো। এরপর নোটে চোখ রেখে বলল,

— তোমাকে জানানো হয়নি।গত দুইদিন ধরে
ছেলেটা তোমাকে খুঁজছে।

সিলিভিয়ার ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিলো,

— তো…?

আমারা পাশে বসলো,বলল,

— তো,সে আবারও এসেছে।

সিলিভিয়া শক্ত কন্ঠে বলল,

— আমাকে বলছো কেন?

ক্যাডি বলল,

— তোমাকেই তো বলতে হবে।
গত দুইদিন তোমার শরীর অসুস্থতার কথা বলেছি।
আজ আর বলা সম্ভব হচ্ছে না। আমি বলেছি
তুমি আজ এসেছো। সো, বাইরে চলো।

সিলিভিয়া সাবলীল কন্ঠে বলল,

— আমি যেতে পারবো না। তোমরা গিয়ে বলো
আমি ব্যস্ত আছি।

গ্যাটলি বলল,

— আমার মনে হয় না আজ ফিরে যাবে।
হাতে কিছু একটা ছিলো। দেখে মনে হয়েছিলো
কোন পেন্টিং। তুমি এসো।

গ্যাটলি,আমার,ক্যাডি সিলিভিয়াকে যথা সম্ভব বুঝালো,মানানোর চেষ্টা করলো।সব শেষে ধমকালো। তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। সিলিভিয়া শক্ত হয়ে আসন গেঁড়ে বসেছে, সে বসা থেকে এক চুলও সরাতে পারেনি।
সবশেষে ড্যাবিয়ান বিরক্ত হয়ে বলল,

— গত দুইদিন আগে ও সব ঠিকঠাক ছিলো।
আজ আবার কি হয়েছে। চলো তো। দেখো সে কি
বলতে চাচ্ছে। আমার অসহ্য লাগছে। তুমি গিয়ে ম্যাটারটা ওখানেই ফিনিশ করে দাও।

গ্যাটলি হুট করে সিলিভিয়ার ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করলো। স্ক্রিনে অসংখ্য কল মেসেজ দেখা যাচ্ছে। তখনি কল এসে ঢুকলো।গ্যাটলি সাথে সাথে রিসিভ করলো। এবং সিলিভিয়ার কানের সাথে ঠেকিয়ে দিলো। মাথা সরিয়ে নেওয়া আগে একটা পুরুষ্টু কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

— হ্যালো, সিলভার। হ্যালো?
হুয়াট হ্যাপেন্ড? হুয়াই ইউ আর ইগনোর মি সিলভার?

এই কন্ঠস্বর শুনে উপেক্ষা করার মতো সাহস সিলিভিয়ার হয়নি। কানটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো তার। ফোনটা নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো সিলিভিয়া।হালকা কেশে বলল,

— হ্যা,হ্যালো?

— অহ, ফাইনালি তোমার ভয়েস শুনতে
পেলাম সিলভার। কি হয়েছে তোমার? জ্বর কমেছে?

সিলিভিয়া অপরাধি কন্ঠে বলল,

— হ্যাঁ কমেছে। আচ্ছা আমি পরে ফোন
করি? একটু ব্যস্ত আছি।

— পরে নয়, এখনি বলো। আমি আজ রাতে
স্কটল্যান্ড ব্যাক করছি। নেক্সট মান্থ আসতে
পারবো নাকি জানি না। আমি গেইটের পাশে আছি।
চলে এসো।

সিলিভিয়ার উত্তরের আশা না করে তেহভীন ফোন কেটে দিলো। দু’হাত পকেটে গুঁজে চুপচাপ মৃদুগতিতে হাঁটছে। সে অন্য কারো ফিয়ন্সে এ কথা
জানার পরও মনটা বার বার সিলিভিয়ার প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ছে। অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে। সেটাকে তেহভীন বন্ধুত্ব রূপে গ্রহণ করছে সর্বক্ষণ। সিলিভিয়াকে প্রেমিকারূপে মানতেও মন সায় দিচ্ছেনা।তাহলে ‘বেংলাডেশ থেকে ফেরার আগে আমি কেন সিলভারের চুলে কিস করেছি। ওর চুল আমার পছন্দের বলে?
কোথায় বাঁধা সেটাও বুঝতে পারছেনা তেহভীন। এতোদিন ক্যাথরিনকে ফিয়ন্সে হিসেবে মনে মনে জেনে এসেছে। অথচ আজ সব এলোমেলো।

তেহভীন মানুষের সেন্স ওফ হিউমার নিয়ে ভীষণ সেনসিটিভ। বিষয়টাকে সে একটা ট্যালেন্ড হিসেবে এক্সিকিউট করে। আর যার সেন্স ওফ হিউমার ভালো, তাকেও বিশেষভাবে পছন্দ করে তেহভীন।যেখানে মেক-আপ দিয়ে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আঁড়াল করে ফেলেছিলো, সেখানে সিলিভিয়া কিভাবে বুঝতে পেরেছে সেটা নিয়ে ভাবছে তেহভীন।

সিলিভিয়া ‘সাথের গেইট’ দিয়ে বের হয়ে দেখলো তেহভীন মৃদুগতিতে পায়চারী করছে। দৃষ্টি পিচঢালা রাস্তায় নিবদ্ধ। সিলিভিয়া কাছাকাছি গিয়ে ছোট একটা কাশি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে তাঁকালো তেহভীন।সিলিভিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

— এতো দেরী হলো কেন আসতে?

— ড্যাবিয়ানের সাথে একটু কথা বলছিলাম।

— ড্যাবিয়ান,ড্যাবিয়ান, হু ইজ ড্যাবিয়ান?
তোমার ফ্রেন্ড? সিলভার ডোন্ট ফরগেট, এখানে তোমার একমাত্র ট্রাস্টেড ফ্রেন্ড আমি।যাকে তাকে
তুমি কেন ফ্রেন্ড বানাবে?

সিলিভিয়া কথা পিঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো,
তেহভীন সেই সুযোগ না দিয়ে আবার বলতে লাগলো,

— আম সিউর,গত দুইদিন আমি
যে তোমার খুঁজ নিচ্ছি সেটা তোমাকে জানায়নি ওরা।

— আপনি ভুল ভাবছেন। তেমন কিছু নয়।

— গাড়িতে বসো সিলভার।

তেহভীন গাড়ির দরজা খুলে দিলো। সিলিভিয়া আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সিলিভিয়াকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেহভীন গাড়ির গ্লাসে শব্দ করে টোকা মারলো। সিলিভিয়া চুপচাপ একদম গাড়ির দরজার কাছে গিয়ে ঘেঁষে বসলো। তেহভীনও বসলো। দরজাটা একটু জোরে আঁটকালো। সে শব্দে সিলিভিয়া হালকা কেঁপে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। তেহভীন যে রেগে আছে সেটা বুঝত দেরী হলো না সিলিভিয়ার।
সিটে পিঠ ঠেকালো তেহভীন,চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগলো দৃঢ়ভাবে।এতোটা রাগ আগে কখনো হয়নি তার। আশ্চর্য ভাবে কোথায় থেকে এতো রাগ আসছে সেটাই বুঝতে পারছে না সে।

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাবো স্যার?

তেহভীন চোখ বুঁজা অবস্থায় বলল,

— ‘ফেকাল্টি গ্লেড’

ড্রাইভার মাথা নেড়ে ফেকাল্টি গ্লেডের দিকে গন্তব্য স্থির করলো। সিলিভিয়া পাশ থেকে একবার তেহভীনকে আরেকবার ড্রাইভার কে দেখতে লাগলো। এখানে কথা বলার মতো কোন বিষয় খুঁজে পেলো না সিলিভিয়া।তাই চুপচাপ বাইরে তাঁকিয়ে রইলো।

৪১.
‘ফেকাল্টি গ্লেডে’ এসে সিলিভিয়ার মনে হলো সে
সবুজ প্রকৃতির রাজ্যে এসেছে। স্ট্রিট ভিউ থেকে শুরু করে প্রবেশ পথেও নিঁখুত সবুজের সমারোহ। সিলিভিয়া আর অন্য কিছু মন গেলো না।বিমুগ্ধ হয়ে চারপাশে সুদৃশ্যমান দৃশ্য অবলোকন করতে লাগলো। তেহভীন একটু পর পর টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছে। গাড়িতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো খেয়াল ছিলো না তার। রাগের বসে উত্তেজিত হওয়া স্নায়ু হঠাৎ শিথিল হয়ে যাওয়াতে ঘুমটা চলে এসেছিলো তার। ঘুম ভাঙার পর সব কিছু ফুরফুরে লাগছে। শুধু মাঝেমাঝে চোখ জ্বলছে। তেহভীন সিলিভিয়াকে বলল,

— জায়গাটা সুন্দর তাই না সিলভার?

— অনেক, আপনি এসেছেন আগে?

— অবশ্যই এসেছি। তোমাকে একটা স্টোরি শুনাই?
বসো নিচে।এখানে প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়।

সিলিভিয়া সম্মতি জানিয়ে নিচে সবুজ টানটান ঘাসের উপর বসে পড়লো। তেহভীন বলতে লাগলো,

— আমার বয়স যখন একুশ।তখন আমি প্রথম ক্যালিফোর্নিয়াতে আসি। তুমি হয়তো জানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর গড়ে ৭০০- এর অধিক ইংরেজি ভাষার মুভি রিলিস করে থাকেন। তন্মধ্যে যদি নিজের একটা মুভি থাকে তাহলে কেমন ফিল হবে?

সিলিভিয়া তেহভীনের কথায় তেমন সন্তুষ্ট বোধ হতে পারলো না। তবুও মুখে বলল,

—- অবশ্যই ভালো লাগবে।

— তো, আমার আর আমার ব্রাদারের ছোট থেকে
ইচ্ছে ছিলো হলিউডে কাজ করার।আনফরচুনেটলি,ড্যাড বিষয়টা জানতে পেরে ভীষণ রেগে যান।দ্যান,আমাদের স্ট্রিক্ট লাইফ শুরু। তারপর যখন আমি প্রথম ক্যালিফোর্নিয়াতে আমি আমার আন্টির সাথে,সুযোগ তখনি চলে আসে। আমি তখন পাইলটের জব নেয়নি,এভিয়েশন ইন্সটিটিউট থেকে কোর্স কম্পলিট করেছি।সি.পি.এল হাতে আসেনি। তখনি একটা মুভির অফার পেয়ে যায়।আমি তেহভীন, সুবর্ণ সুযোগ পায়ে ঠেলিনি,আন্টির সাহায্যে মুভিতে কাজ শুরু করি।বলে রাখি,আমার আন্টি একজন নাম করা মডেল ছিলেন। আর উনার মেয়ে ক্যাথরিন আমার ফিয়ন্সে সে একজন ডক্টর।
এখন তুমি বলো,তুমি কেন সেদিন রেসট্রনে মুভির কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?

সিলিভিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো।মুভির নায়ককে দেখে এতো ভালো লাগতো, তার সবকিছু একদম দৃষ্টি বন্দী করে ফেলেছিলো সিলিভিয়া। তেহভীনকে হাসতে দেখার পর মনে হলো হাসিটা কোথায় যেনো দেখেছে। কৌতূহল চাপাতে না পেরে ফট করে সেদিন জিজ্ঞেস করে ফেললো।
সিলিভিয়া নিচু স্বরে বলল,

— আপনার হাসি। একদম হুবহু। চরিত্র,রূপ,পোশাক চেঞ্জ হলেও,আপনার হাসিটা চেঞ্জ হয়নি। মুগ্ধ করার মতো হাসি।আমার ভালো লাগে।

তেহভীন সিলিভিয়ার কথায় পূনরায় হেসে ফেললো।
এরপর বলল,

— ও এই ব্যাপার? আমি তো ভেবেছি তুমি
কোন ক্রিমিনার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের লোক। তাদের দৃষ্টি-বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ, ধারালো হয়। তোমার ক্ষেত্রে এটাই মাথায় এসেছিলো আমার।

এবার সিলিভিয়া হাসলো তেহভীনের কথায়। সে যে মজা করে বলছে,সেটা কথা ধরণ দেখে বুঝা যাচ্ছে। তেহভীন আর সিলিভিয়া দু’জনে আরো টুকটাক কথোপকথনের সারলো। তন্মধ্যে কথার ফাঁকে তেহভীন আশেপাশের বাগান,গাছগাছালি,ভাষ্কর্য সব সিলিভিয়াকে ঘুরিয়ে দেখালো। চলে আসার পথে তেহভীন কাপড়ের মুড়ানো একটা পেন্টিং সিলিভিয়ার হাতে দিলো। এরপর বলল,

— বন্ধু হিসেবে আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা উপহার। কাল সারারাত জেগে পেন্টিং করেছি। আমি পেন্টিংএ খুব বেশি ভালো নয়,একদম কাঁচা। তোমার ভালো না লাগলে স্যরি।

সিলিভিয়া কাপড় সরিয়ে পেন্টিংটায় দৃষ্টিনিবদ্ধ করলো। তৎক্ষনাৎ বাকরূদ্ধ হয়ে যায় সিলিভিয়া। এতো সুন্দর পেইন্টিং আগে কখনো দেখেনি সে। অজস্র গোলাপের মাঝে সিলিভিয়ার প্রতিচ্ছবি কত সুন্দর করে রং-তুলির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছে। ডানে উপরের দিকে ইংরেজি ও বাংলা অক্ষরে লেখা, ‘রোজগার্ল-গোলাপকন্যা’।

(চলবে)

নোটঃ রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি। পরে সময় হলে সংশোধন করে নিবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here