#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২০
৫১.
লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ‘হেরমন ওয়ে’ দিয়ে সোজা গিয়ে স্পিচ বাইক ওয়ে ক্রস করে গ্লেড ওয়েতে গিয়ে দাঁড়ালো সিলিভিয়া।এরপর ‘মেমোরিয়াল গ্লেডে’ প্রবেশ করলো সিলিভিয়া। শতাধিক স্টুডেন্ট এখানে উপস্থিত। সকলে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে একটা যুবককে একেকটা উৎসাহমূলক বাক্য ছুঁড়ছে,আবারও প্রেম নিবেদন বা প্রেমের আমন্ত্রণের দৃশ্য দেখে দু’পা পিছু হটে গেলো সিলিভয়া।আজ আর মেমোরিয়াল গ্লেডের গাঢ় সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে বিশাল আকাশ দেখা হবে না সিলিভিয়ার।
কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ির সাথে টুকটুকে লাল ব্লাউজ পড়লো সিলিভিয়া। হাঁটুর নিচে পর্যন্ত কালো চুল ছেড়ে রেখে দিলো। চুল তেমন পরিপাটি, গুছানো নেই আজ সিলিভিয়ার।ভবঘুরেদের ন্যায় রাস্তার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সিলিভিয়া। দিশাহারা পথিকের ন্যায় একবার কোন পার্কে যায়,তো আরেকবার কোন গার্ডেনে। অথবা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে স্টোর গুলোর দিকে চেয়ে থাকে। আজকের দিনটা অনে দীর্ঘতম মনে হচ্ছে সিলিভিয়ার।স্বচ্চ উজ্জ্বল আলো আঁধারিয়া দানবের গুহায় উঁকিও দিচ্ছে না। সবশেষে ‘পিউপল’স পার্কে এসে থামলো সিলিভিয়া। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে মানুষের সমাগম এখানে বেশি দেখা যাচ্ছে। গতবার যখন এখানে এসেছিলো,তখন সিলিভিয়ার মনে হয়েছিলো এ জায়গা সাইক্লিং এর জন্য বেস্ট। অতিরিক্ত খোলামেলা হওয়ার কারণেই এমনটা মনে করা।সাথে কয়েকজন সাইক্লিং করতে দেখে সিলিভিয়ার মনে চিন্তাটা এলো।
৫২.
আকাশের বিশালতায় বুদ হয়ে থাকা তেহভীন, আজ বিশাল আকাশের নিচে হন্য হয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। চোখেমুখে তন্দ্রাভাব থাকলেও সেটাকে পরোয়া করছে না সে। উদ্দেশ্য সিলিভিয়াকে খুঁজে বের করা। কোথাও না কোথাও হয়তো দেখা মিলবেই। উপরে হাসিমুখে চলার পথে পথিকদের উদ্দেশ্যে ‘হাই-হ্যালো’ শব্দ ছুঁড়লেও ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড হাঁসফাঁস করতে লাগলো তেহভীন। সিলিভিয়ার কি হয়েছে? সে কি অন্য কারো সাথে রিলেশনে কমিটেড হতে যাচ্ছে কি-না তার সব খুঁটিনাটির হিসাব আজ নিবে সে।
পার্ক থেকে বের হয়ে ‘গার্ডেন ভিলেজের’ উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলো সিলিভিয়া। তৎক্ষনাৎ কাউকে হন্তদন্ত পায়ে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো সে। দাঁতের সাথে দাঁত শক্তভাবে চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো আগত যুবকটির দিকে। মুখে কেমন কঠিন্যভাব ফুটে উঠেছ। সিলিভিয়ার সব রাগ এ পর্যায়ে এসে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এতোদিন পর মানুষটাকে দেখে কোন রাগের উপস্থিতি অনুভব করছে না সে।
তেহভীন এগিয়ে এসে কঠিন মুখে সিলিভিয়ার চারপাশে তাঁকালো।কাউকে না দেখে মনে মনে কিছুটা শান্ত হলো সে। কিন্তু উপরে চোখমুখ শক্ত করে রাখলো।রাগান্বিত দৃষ্টিতে সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে থাকলো।
তেহভীন লম্বা হওয়ায় সিলিভিয়া মাথা তুলে তাঁকিয়ে রইলো চুপচাপ। আজকের দিনে তেহভীনকে এখানে একটুও আশা করেনি সে। সিলিভিয়া মনে মনে ভাবলো তেহভীনকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সেটা তার দ্বারা হয়ে উঠছে না তখন।
তেহভীন পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা কল রেকর্ডিং ওন করলো। আলতো করে সিলিভিয়ার হাত ধরে কাছে টেনে এনে ফোনটা সিলিভিয়ার কানের পাশে রাখলো।
গত কালকের বলা কথা পূনরায় শুনতেই সিলিভিয়া চট করে চোখ তুলে তেহভীনের দিকে তাঁকালো। তেহভীনের চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।ফর্সা গালটা দেখে মনে হচ্ছে রাগ ঢেলে দিয়েছে।কিন্তু তা অপ্রকাশিত।
তেহভীন ছোট করে শ্বাস ফেলে বলল,
— আমি এই সেন্টেন্সের অর্থ বুঝিনি।
তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও, তুমি কি বলেছিলে কাল।
তেহভীন বুঝেনি শুনার পর সিলিভিয়ার ঠোঁট টেনে হাসলো। হাসিমুখে নিজের হাত ছাড়িয়ে সিলিভিয়া বলল,
— অহ! তেহভীন আমি বলেছিলাম আপনাকে
মিস করছি। সময় পেলে যেনো আপনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন।
সিলিভিয়ার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে তেহভীন ও হাসলো। এরপর বলল,
— সিলভার! এই মিথ্যেটা আমি তোমার
কাছ থেকে আশা করিনি। তুমি বলেছো
তুমি আমাকে চিনো না। আমি তোমার বন্ধু নয়।
কেন বলেছো তুমি এটা?
শেষের কথাটা একটু জোরেই বলল তেহভীন। সিলিভিয়া প্রথমবারের মতো তেহভীনের ধমক শুনে
ভড়কে গেলো। তেহভীন দ্বিগুন রুষ্ট হয়ে বলল,
— ইউ ইনসাল্ট মি সিলভার।
আমার ব্রাদারের সামনে তুমি আমাকে
ইনসাল্ট করেছো। যেখানে ব্রাদার জানে তুমি-আমি
খুব ভালো একজন বন্ধু, সেখানে কাল কথাটা বলে
আমাকে অনেক প্রশ্নের মুখে ফেলেছো।
তেহভীনের মুখে কথাটা শুনে চমকে গেলো সিলিভিয়া।’ইনসাল্টেরর কথাটা কেন এসেছে সেটা ওর বোধগম্য হলো না।নেহাৎ কাল সে রেগে ছিলো যার জন্য কথাটা বলেছিলো সে। সিলিভিয়ার ভাবনার মধ্যে তেহভীন একটা আশ্চর্যজনক কথা বলে উঠলো,
— আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো। মনে মনে ভালোবেসো। সেটা বেংলাডেশে থাকা অবস্থায় আমি বুঝেছি। তোমার চোখ দেখলে আমি সব বুঝতে পারি। এখন তোমার টার্ন, তুমি আমার চোখের দিকে চেয়ে বলো, আমার এতো রাগ আসছে কেন তোমার উপর? ব্রাদার তোমার ব্যাপারে জানার জন্য এতো কৌতূহলী কেন? তোমাকে দেখার জন্য আমার চোখ জ্বলে কেন? আনসার মি!
সিলিভিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে তাঁকালো তেহভীনের দিকে। তাহলে কি তেহভীন ও?
— বেংলাডেশ থেকে ফিরে আসার আগে শেষবার তোমাকে দেখার জন্য আমি পেছনে ফিরেছিলাম।তুমি দেখোনি। তোমার ওই ফ্রেন্ড রামিশ, সে তোমার কাঁধে হাত রেখেছিলো। এই সিনটা আমাকে সেদিন খুব রাগিয়ে দিয়েছিলো। কেন রাগ হয়েছিলো আমার? কাজে ব্যাক করার পর সারাদিন তোমার কথা ভাবতে ভাবতে মেন্টালি কতোটা ডিস্টার্ব হয়ে পড়েছিলাম তুমি জানো?
আর সাডেনলি,এখানে এসে তোমাকে প্রথমবারের মতো দেখেও আমি শকড হয়ে গিয়েছিলাম। আর তুমি তখন নতুন বন্ধু পাতিয়ে রেখেছো।
আর আমার বেলায় বলছো বন্ধু পাতানোর সময় হয়নি। কিভাবে বললে তুমি কথাটা?
শেষ কথাগুলো সিলিভিয়ার মাথার উপর দিয়ে গেলো। কথাবার্তার ধাঁচ শুনে মনে হচ্ছে তেহভীনও তাঁকে পছন্দ করে। কিন্তু মুখের কথা সেই বন্ধুত্ব পর্যন্ত আঁটকে আছে। সিলিভিয়া চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— আমি এখানে সিরিয়াস কিছু দেখছিনা তেহভীন।
যাস্ট এভয়েড ইট। তুমি হয়তো মেন্টালি টায়ার্ড। তোমার ঘুমের দরকার। চোখ লাল হয়ে আছে। চলে যান।
— আই এম নট টায়ার্ড সিলভার।আই নিড ইউ! আমি আমার মনের কনফিউশান দূর করতে চাই।
লাস্টবার বলেছিলাম তোমাকে একটা ক্যাম্পিং করবো? আমার অন্যান্য ফ্রেন্ডদের সহ নিয়ে। প্ল্যান চেঞ্জ,শুধু তুমি আর আমি যাচ্ছি।
সিলভার বলে উঠলো,
— অসম্ভব! আমি কোথাও যাচ্ছি না।
আমি যেতে পারবো না।
— কেন পারবে না? ইউ ডোন্ট লাভ মি?
তেহভীনের এমন একটা প্রশ্নে থমথম খেয়ে গেলো সিলিভিয়া। দু’প্রান্তে মাথা নাড়ালে তেহভীন তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— ফাইন! তাহলে আমার আর চিন্তা রইলো না।
আমি ভাবছিলাম তুমি আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছো।
আমাকে এতোদিন মিস করেছো? শোনো,
তুমি আমাকে ভালোবাসো, পছন্দ করো এটা জটিল কোন বিষয় নয়। এটা তোমার মনের অনুভূতি। তুমি এটাকে মিথ্যে প্রমাণ করবে,বা আমার থেকে লুকিয়ে রাখবে কেন? আমি রেখেছি? তোমাকে আমার তোমার চেয়েও বেশি পছন্দ। অনেক অপ্রিয় কিছুর মাঝে তুমি আমার জন্য বিষেশভাবে প্রিয়। আমি লুকাচ্ছি কথাটা? আমি চাই না আমাদের মাঝে কোন বিষয় গোপন থাকুক। আর আমি এনগেজড সেটার জন্য যদি তোমার আমার সাথে মিশতে সমস্যা হয়। তাহলে বলবো,আমি এনগেজড,ম্যারেড নয়।
— আমি তেমন কিছু ভেবে কথাটা বলিনি।
কাল আমি রেগে ছিলাম সেজন্য মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিলো।
— তুমি আবারও মিথ্যে বলছো সিলভার।
তোমার রাগ ওই স্টুপিড মেয়েটার জন্য উঠলেও মূল রাগের কেন্দ্রবিন্দু আমি। আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখিনি বলেই তুমি আমার গিফটাও এখন অবধি খুলে দেখো নি। কেন?
সিলিভিয়া এবারের ধরা খাওয়াটা হজম করতে পারলো না। দ্রুত দৃষ্টি নত করে ফেললো। জবাব দেওয়ার মতো আর কোন বাক্য খুঁজে পেলো না।তেহভীন কিভাবে সবটা বুঝতে পারছে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না সিলিভিয়া।সে কি জাদু টোনা জানে? তেহভীন সিলিভিয়ার নুইয়ে যাওয়া দৃষ্টি দেখে কিছু বললো না আর। আজ সিলিভিয়াকে শক্ত কিছু বলে কাঁদানোর ইচ্ছে ছিলো তেহভীনের। কিন্তু ‘সিলভারকে’ আজ অন্যদিনের তুলনায় বেশি সুন্দর লাগছে তেহভীনের কাছে।তাই নজর এবং কথা দুটোই থমকে গেছে আজ তার।
— কোথায় থাকছো তুমি এখন? প্লিজ আমাকেও
নিয়ে চলো। এয়ারপোর্টে জিডি দেখিয়ে এখানে এসেছি আমি। অযথা সময় নষ্ট করতে চাই না।
সিলিভিয়া আর কিছু বললো না।চুপচাপ তেহভীনের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। একটু আগে মনে হয়েছিলো তুফান এসেছে।এখন সব নিস্তব্ধ। অর্থাৎ পাশে দাঁড়ানো সুদর্শন পুরুষটি নিস্তব্ধ, আশেপাশের লোকসমাগম এখনো মজুদ রয়েছে। আজকের ভালোবাসা দিবসে না পাওয়ার মধ্যে অনেক কিছুই পেয়ে গিয়েছে সিলিভিয়া। মনের অনুভূতি প্রকাশ করা জটিল বিষয় না।কিন্তু অপরপাশের মানুষটির আকস্মিক রূপ জটিল মনে হচ্ছে এখন সিলিভিয়ার। মানুষটির আগমন ‘এক টুকরো’ ভালোবাসার চেয়েও কম নয়। সব রাগ কষ্টের কারণ হয়না,কিছু রাগ সুখের বন্যাও বয়ে আনে।
(চলবে)