লাভ রেইন পর্ব-৩৩

0
1986

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৩

৮৫.
সাদা,নরম’তুলতুলে বিছানা। দেখেই গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে সিলিভিয়ার। কিন্তু বাইরের আমেজপূর্ণ আয়োজনটায় ভাটা পড়বে ভেবে সে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলো সে। ঠাণ্ডাচ্ছন্ন পরিবেশে বাইরে আগুন জ্বালিয়েছে প্রেটার'(শেফ)। আজকের ডিনারের আয়োজনে আগুনে পুড়িয়ে ফিস, চিকে,বিফ কাবাব রাখছে প্রেটার।সাথে থাকছে আ্যপেল’পাই,কোব সালাদ ও তেহভীনের এখানকার প্রিয় খাবার ‘ক্যালিফোর্নিয়া রোল’স।দেখতে অদ্ভুত হলেও খাবারের স্বাদটা বেশ ভালো। সিলিভিয়া যেহেতু বাঙালি,সে হিসেবে তেহভীন সিলিভিয়ার জন্য ফ্রাইড রাইসও খাবারের ম্যানূতে রেখেছে।
আর সে খাবে অল্প কয়েক টুকরো কাবার লেবুর রস দিয়ে। কারণ রাইস তেহভীনের পেটে হজম হবেনা,সেটা সেদিন নিজের কুক করা বিরিয়ানী খেয়ে বুঝেছিলো।পেটে অদ্ভুত ব্যাথা,আরো বাহ্যিক সমস্যায় পড়েছিলো সে।যেটা সন্তপর্ণে সিলিভিয়ার কাছ থেকে গোপন রেখেছে তেহভীন।

কটেজের চারপাশে ছোটো ঘাসে ঢাকা উদ্যান। অর্থাৎ লন। লনের মাঝখানে প্রেটার আর তার ওয়াইফ এলরিন দুজনে মিলে ডিনার করার জন্য মাদুর পেতে রেখেছে।সাথে রাখছেপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। ডিনারারের আয়োজনটা সতর্কভাবে করছেন।প্রেটার এলরিনের থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস হাতে নিতে নিতে নিভু স্বরে বলতে লাগলো,

— উনারা হচ্ছেন লস এঙ্গেলসের নামকরা একজন স্টারের ব্রাদার আর তাঁর বান্ধবী। সো, আওয়ার হসপিট্যালিটি শ্যুড’নট বি ফ্ল্যাওয়েড।

এলরিন ঘাড় ঘুরিয়ে কটেজ’হাউজের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। তেহভীনের চেহারার কাঠামো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন,

— হোয়াট’ইস দ্যা নেইম ওফ দ্যা স্টার?

প্রেটার মৃদু হেসে বললেন,

— মি. ট্যানজিড!

এলরিন আর কিছু বললো না।চুপচাপ প্রেটারকে সাহায্য করতে লাগলো।

তেহভীন সিঙ্গেল কাউচে বসে ফোনে ভিডিও দেখছিলো। তখনি কটেজের কামরা থেকে সিলিভিয়া বেরিয়ে এসে একবার প্রেটার আর এলরিনের কাজ দেখলো। এরপর দৃষ্টি ছুঁড়লো তেহভীনের দিকে। সিলিভিয়ার উপস্থিতি অনুভব করতেই তেহভীন ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সিলিভিয়ার দিকে চাইলো। দু’জনের চোখাচোখি হয়।তেহভীন দূরন্ত হাসি হেসে বলল,

— সিলভার কোথায় বসবে ভাবছো?
ইউ ক্যান সিট ওন মাই লাপ,ইফ ইউ ওয়ান্ট।

সিলিভিয়া মৃদু হেসে তেহভীনের পাশের কাউচে বসে পড়লো। এরপর তেহভীনের চোখে চোখ রেখে বলল,

—- আই’এম নট ইন্টারেস্টেড ডিয়ার!

তেহভীনের ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সড়লো না,
সিলিভিয়াকে অবাক করে দিয়ে বলল,

— দ্যান,উই শ্যুড গু ইনসাইড, হোয়াট স্যেয়?

সিলিভিয়া ভড়কে গেলো তেহভীনের কথায়।সে যে মাত্রাতিরিক্ত পাজি সেটা কথা ধাঁচে বুঝা গেলো। সিলিভিয়া জবাবে কিছু বলতে পারলো না। নীরব থাকলো। তেহভীনে লনের দিকে একচোট চেয়ে সিলিভিয়ার দিকে ফিরে বসে বলল,

— টোমাকে শুন্দর লাগসে?

সিলিভিয়া চমকে উঠলো।আবারও তেহভীনের বিশ্রী ল্যাঙ্গুয়েজ শুনে হতাশ হলো সিলিভিয়া। হঠাৎ সিলিভিয়ার মনে হলো তেহভীন বাংলা ভাষা বুঝে, আর অস্পষ্ট বলতেও পারে।শুধু তানজিদের মতো করে শুদ্ধভাবে বলতে পারেনা।এমনটা মনে হলো কেন বুঝলোনা সিলিভিয়া। তাই সিলিভিয়া
বাংলায় বলল,

— তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে তেহভীন!

তেহভীন স্বাভাবিক ভাবে বলল,

— ডন্যবাড!

এ পর্যায়ে সিলিভিয়া হাসি আটকাতে পারলো না। উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে গেলো। তেহভীনের দু’কাধের উপর হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলল,

— চলো, তুমি এখন থেকে আমার
সাথে বাংলায় কথা বলবে। ইংলিশ বলতে বলতে
আমার মুখ ব্যাথা করছে।

তেহভীন শান্ত চোখে চেয়ে বলল,

— টোমাডের ল্যাঙ্গুয়েজ এ কটা বলটে কেষ্ট হয় এমার। সো, আই কান’ট। বাট ইউ ক্যান স্যেয়। আই আন্টার্স্ট্যান্ড।

সিলিভিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এরপর পেছন ফিরে তাঁকালো। প্রেটার আর তার ওয়াইফ কাজে ব্যস্ত। তাই তেহভীনের দিকে ফিরে নিচু হয়ে চট কর কপালে একটা চুমু দিয়ে তৎক্ষনাৎ কটেজের ভেতরে ঢোকে গেলো। তেহভীন সিলিভিয়াকে পালাতে দেখে হাসলো। এরপর পূনরায় মনোযোগ দিলো ফোনে। কিন্তু দশমিনিট অতিক্রম হওয়ার পর একটা মেইল আসলো তেহভীনের ফোনে। নোটিফিকেশনটা দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো তেহভীনের। এটা একটা ওয়ার্নিং ম্যাসেজ। কান্ট্রি ক্রসের ওয়ার্নিং।কিন্তু তেহভীন তো এবার এখানে কান্ট্রি ক্রস করে আসেনি। সরাসরি টিকেট করে এসেছে। নাকি কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে করছে কাজটা,যাতে সে এখানে আসতে না পারে।

৮৬.
বিশাল আকৃতির উড-ট্রি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দানব আকৃতির একটা গাছের মধ্যখানি অংশে যাতায়াতের সুনিপুণ পথ দেখে বিস্মিত হলো সিলিভিয়া। চোখমুখে নতুত্ব আবিষ্কারের ছোঁয়া। সিলিভিয়ার চেহারায় বিমূঢ় ভাব দেখে ছোট করে হাসলো তেহভীন। আসার আগে সিলিভিয়া আসতে চাইছিলো না।তেহভীন জোর করে এনেছে এক প্রকার। পাশে একটা রিভার আছে। এখানে সম্পূর্ণ জায়গা দেখা হয়নি,অথচ চলে যেতে হবে আজ।রিভারটা দেখে না গেলে মনটা আফসোস করবে খুব। তাই ব্রেকফাস্ট না করেই চলে এসেছে। তেহভীন সিলিভিয়াকে বলল,

— কখনো যদি জঙ্গল পরিদর্শন করার জন্য বের হও? তখন অবশ্যই মর্নিং প্রেয়ার সেড়ে তারপরের সময়টায় বের হয়ে যাবে। খেতে ইচ্ছে করলে খাবারটা সাথে নিয়ে নিবে। কারণ ডাউন টাইমে (ভোরের সময়ে) ফরেস্টের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে। দেখতে অনেকটা মিসট্রেরিয়াস দেখাবে। যেটা রোদ উঠার পর তুমি উপলব্ধি করতে পারবে না। এখনের পরিবেশটাও বেশ উপভোগ্য।

— আচ্ছা গাছ গুলো অনেক পূরানো তাই না?

তেহভীন দীর্ঘকায় গাছগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,

— ইয়েস! শুনেছি এই গাছগুলো ১২০০-১৮০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।আর এই ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে এদের জন্ম।এই জায়গাটিই হচ্ছে এখানকার জন্মস্থান।

—- ভালো লাগছে এমন একটা জায়গায় এসে।
তবে আমাকে একটা কথা বলো তেহভীন। হামবোল্ট পয়েন্ট থেকে ফিফটি ইয়ার্ড গেলে কি হয়? কি আছে ওখানে?

— কুইকসেন্ড( চোরাবালি)

সিলিভিয়া অভিজ্ঞের মতো বলল,

—- কিন্তু কুইকসেন্ড থেকে বাঁচার অনেক উপায়
আছে। টুয়েন্টি পিউপল যারা মারা গেছেন তারা সকলে একি কারণে মরেছেন? তুমি কিকরে জানো ওখানে কুইকসেন্ড আছে?

তেহভীন ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

— সাইনবোর্ড আছে। তাতে লেখা;
‘ডেঞ্জার কুইকসেন্ড’
স্টেয় এওয়ে!

সিলিভিয়া কৌতূহলী সব প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসে তেহভীনের কাছে।তেহভীন একটার পর একটা জবাব দিয়ে যায়।তেহভীনের ক্লিন’ফ্রেশ এ্যালিগেন্ট চেহারাটায় বিরক্তি ছিঁটেফোঁটাও নেই। আর না আছে তার কন্ঠস্বরে রুক্ষতা।কতো কোমল,নমনীয় আচরণ। সিলিভিয়া মুগ্ধ হয় খুব। সব শেষে তার মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়ে গেলো। এতোসুন্দর রিভার। নিজের দেশের রিভারগুলো অবস্থা একদম যা-তা। আর এখানে স্বচ্ছ নীল পানি। গাঢ় সবুজ গহীন জঙ্গলের গাঢ় নীল নদী। ব্রিজের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে নদীর সৌন্দর্য দৃষ্টিগোচর করা যায়। পানির উপরে ধুম্রজালের আভাসও দেখা যাচ্ছে। তেহভীন কাঁধ থেমে ব্যাগটা নামিয়ে ছোট দু’টো কাপ,ফ্লাস্ক বের করলো। একটা কাপ সিলিভিয়ার হাতে দিয়ে গ্রিন-টি ঢাললো। এবার সিলিভিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায় চায়ের রঙ দেখে। সে নীল,লাল,কালো চা খেয়েছে তবে একদম গাছের পাতার রঙের চা কখনো পান করেনি। সিলিভিয়া তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,

— এটা গ্রীন-কালারের টি কেন?

— গ্রীন-ফরেস্টে এসেছো।গ্রীন-টি খাবে না?
এটা এখানকার স্পেশাল টি।

— রেসিপি?

— প্রেটার বানিয়েছে।আমি জানি না।

সিলিভিয়া চোখ বন্ধ করে চুমুক দিলো। অদ্ভুত একটা স্বাদ,হালকা মিষ্টি,স্বাদ ভিন্ন হলেও খারাপ না।তবে একটু ঝাঁঝাঁলো। তিন-চার চুমুক দেওয়ার পর ঝাঁঝালো স্বাদটা সয়ে গিয়ে মিঁইয়ে যায়।টি টাও পছন্দ হয়ে গেলো সিলিভিয়ার। এরপর তেহভীন একটা বক্সে মাটলওফ,কর্নব্রেড,আর একটা চিজবার্গার দিলো। সেগুলো দেখে সিলিভিয়া ভেতরে ভেতরে লজ্জাবোধ করলো খুব। আসার আগে সে না খেয়ে আসতে চাইছিলো না।আর সেজন্য তেহভীন খাবার তার অগোচরে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। সিলিভিয়া নিজেকে সামলালো। এরপর চুপচাপ খেতে লাগলো। আজকের দিনটা খুবই চমৎকার ভাবে শুরু হয়েছে। যদিওবা ঘন জঙ্গলের তলদেশে দাঁড়িয়ে সূর্যদয় দেখার ভাগ্য হয়নি আজ।তবে দিনটা খুব ভালো কাটবে আশা রাখলো। আজ দুপুরে লাঞ্চের পর বার্কলে তে ফিরে যেতে হবে। তারপর রাতের ফ্লাইটে তেহভীনও চলে যাবে নিজের গন্তব্য। না জানি আবার কোনদিন সময় পেয়ে হুট করে ছুটে আসবে। সিলিভিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা করতে এসে, সেটার প্রতি টানটা হারিয়ে যাচ্ছে।তেহভীন আগেই সাবধান করেছিলো তাকে। সে বাকিসব সম্পর্কের মতো সামাজিক যোগাযোগ রাখবে না যাতে সিলিভিয়ার পড়াশোনা থেকে ফোকাস হারিয়ে যায়। কিন্তু সিলিভিয়ার মন এসব মানতে নারাজ। সিলিভিয়া এতসব ভাবনার মাঝে খাওয়াটা শেষ হয়ে গেলো। তেহভীন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সিলিভিয়ার হাবভাবে লক্ষ করেও কিছু বললো না।

(চলবে)

দেরী হওয়ার জন্য দুঃখীত! রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি।প্রচুর মাথা ব্যাথা আজ দুইদিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here