#_লাল_নীল_সংসার_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_২০_
সময় প্রবাহমান। নদী,, সমুদ্রের ঢেউ যেমন,, বাধ্য হয়ে পাড় ভিজিয়ে দিয়ে যায়,, ঠিক তেমন ভাবে সময়কেও বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে নাহ,, সে চলতেই আছে আর চলতেই থাকবে।
……………….ছোয়া বিয়েতে নাহ করে নি। মিসেস. কেয়াও ছোয়াকে যথাসম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ছোয়া মেনে নিতে পারছিলো নাহ,, তাও আর একবার নিজের জীবনকে সুযোগ দিচ্ছে। সব মানুষের কথা উপেক্ষা করে,, বিষকন্যা পদবি ভুলে,, নিজের জীবনকে আর একবার সুযোগ দিচ্ছে সে।
রোজ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্না কাটি করে ছোয়া। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে গেছে শিশিরের পরিবার। শিশির ছোয়াকে সেরকম একটা ফোন দিচ্ছে নাহ। হয়তো,, ছোয়াকে সময় দিচ্ছে,, নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার জন্য। সাঝের মেডিকেল এয়াডমিশনের রেজাল্টের পর ছোয়া আর শিশিরের বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
………………..স্নেহার সাথে ইয়াশের বিয়ের কথা বললে,, স্নেহা জানায়,, আর কয়েকমাস পর তাদের অনার্স ফাইনাল এক্সাম। শেষ হবে তার অনার্সের পড়াশোনা। তাই এখন সে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় নাহ। এতো কষ্ট করে এতো পড়াশোনা করেছে,, তাই অনার্স লেভেল টাহ শেষ হলে বিয়ে করবে। তখন কানাডায় গিয়ে বাকি পড়া শেষ করতে পারবে। নাহলে,, শুধু শুধু ইয়ার গ্যাপ হবে তার। সবাই স্নেহার কথা মেনে নিয়েছে।
কিন্তু,, ইয়াশের সাথে স্নেহার বিয়ের কথা একদম পাকাপাকি করে রাখা হয়েছে। সবাই চেয়েছিলো এইংগেজমেন্ট করে রাখতে,, কিন্তু স্নেহা রাজি হয় নি। যাহ হবে সব পরীক্ষার পরে। অনার্স শেষ হওয়ারও বেশি দেরি নেই,, তাই কেউ আপত্তিও জানায় নি।
স্নেহা এখনও আদনানকে কিছু জানায় নি। জানাতে চেয়েছিলো,, কিন্তু কি ভেবে যেন মনে মনে ঠিক করে নিলো,, এইংগেজমেন্টের আগে আগে জানাবে। বিশেষ করে অনার্স এক্সামের পর জানাবে। তাই,, আদনানের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করে সে। কিন্তু,, ভেতরে ভেতরে কেমন যেন যন্ত্রণা অনুভব করে স্নেহা। কাউকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ব্যাথা অনুভব করে। কিন্তু,, কিছুই যে তার করার নেই। তাই নিজেকে সামলিয়ে রাখে স্নেহা।
……………………সাঝ সকাল থেকেই খুব চিন্তিত হয়ে আছে। আজ তার মেডিকেল এ্যাডমিশনের রেজাল্ট দিবে। ভয় লাগছে স্নেহার। সোফায় চুপচাপ বসে আছে। শিশির পাশে বসে চা পান করছে,, আদনান আরেক সোফায় বসে সাঝের রেজাল্ট জানার চেষ্টা করছে।
সাঝের পুরো শরীর দরদর করে ঘামছে। সাঝের মাথায় নানান রকম দুশ্চিন্তাও কাজ করছে। যদি মেডিকেলে চান্স নাহ পায়, তাহলে কি হবে? সব স্বপ্ন তো শেষ হয়ে যাবে। সাঝ তো জানে,, তার ভাইদের তাকে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ানোর সামর্থ নেই। আর তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে,, প্রাইভেট মেডিকেল স্টুডেন্টদের মূল্যায়ন করে নাহ। সেইটাও বড় কথা নাহ,, বড় কথা হলো,, সামর্থ নেই।
আদনান ল্যাপটপ ঘাটছে সাঝের রেজাল্ট জানার জন্য। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে,, তার বোন টাহ যেন মেডিকেলে চান্স পায়। আদনান একপলক সাঝের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার চোখ মুখ চিন্তায় ছোট হয়ে আছে। আবার ল্যাপটপে মন দেয় আদনান।
ছলছল চোখে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে আদনান। সাঝ শিশিরকে আকড়ে ধরে আছে। তার ভাইয়া তার সব থেকে বড় শক্তি। আদনান সাঝের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। সাঝ এই হাসির কোনো অর্থ বুঝলো নাহ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে।
শিশিরের যেন আর তর সইছে নাহ। আদনানের কাছের থেকে ল্যাপটপ টাহ নিয়ে নেয় শিশির। মনে হচ্ছে,, সাঝের নাহ,,শিশিরের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সাঝও একটু এগিয়ে আসে শিশিরের দিকে। শিশির,, সাঝ দুইজনেই ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ল্যপটপ স্ক্রিনের দিকে। ল্যাপটপ স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে,,,,,,,,,,,
Name : Shajh Rahman.
Medical Reg. No : 15326…
Marit List : 2
Earned Marks : 98.7
Selected Medical College : DMC
শিশির নিজেই সাঝকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। সাঝও কান্না করে দেয় শিশিরকে জড়িয়ে ধরে। আদনানের চোখও ছলছল করে উঠে। ওদের কান্নার আওয়াজ শুনে,, আহিয়া রহমান আর আজিজ রহমান দৌড়ে আসে। আহিয়া রহমান আদনানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলে ওঠে,
–” কিক কি হয়েছে?”
আদনান চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে মায়ের কাছে এগিয়ে আসে। আহিয়া রহমান কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
–” সাঝ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে মা! আমাদের বোন একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে। ওর স্বপ্ন পুরনের চাবি হাতে পেয়ে গেছে মা!”
আদনানের কথা শুনে আহিয়া রহমান আর আজিজ রহমানের চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটাহ অনেক খেটেছে। স্বপ্ন পুরনের পথে এগিয়েছে। রহমান পরিবারের সব থেকে বড় সুখ উপস্থিত হয়েছে। শুধু সাঝের স্বপ্ন নাহ,, রহমান পরিবারের সবার স্বপ্ন রঙিন হতে চলেছে।
★
শিশির ছোয়ার বিয়ে ঘরোয়া ভাবে দেওয়া হবে বলেই,, দুই পরিবারের মতামত। শিশির নিজেও চায় নাহ ধুমধাম করে বিয়ে করতে,, ছোয়ারও একই মতামত। তাই বর,, কনের মতামতের উপর ভিত্তি করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয় দুই পরিবারের গুরুজনেরা।
কিন্তু,, আহিয়া রহমান নিজের দুই ছেলের বউয়ের জন্যই সোনার তৈরি একটা আংটি,, গলার চেইন একটা,, আর কানের এক জোড়া দুল গড়ে রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন,, আলাদা করে আংটি বদলের অনুষ্ঠান করবেন,, আর সেখানে এই আংটি দিবেন,, বিয়ের দিন একটা নাকফুল আর কানের দুল জোড়া দিবেন আর বধু বরন করে তোলার সময় চেইন দিয়ে বউ ঘরে তুলবেন।
তাই আহিয়া রহমানের মনের আশাও পূর্ন করার জন্য বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আংটি বদলের ছোট্ট অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। শুধু পরিবারের মানুষগুলো। আংটি বদল অনুষ্ঠানে শিশিরের পরিবার আর ছোয়ার পরিবার সহ এক খালা এবং এক খালাতো বোন।
শিশিরের বাসার সবাই ছোয়াদের বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। শিশিরের আজ অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। আজ ছোয়াকে আংটি পরাবে। আজ থেকে ছোয়া তার বাগদত্তা হিসাবে পরিচয় পাবে এক সপ্তাহের জন্য। আর তারপরই পরিচয় পাবে তার বউ হিসাবে। ভাবতেই এক শান্তি লাগছে শিশিরের।
এইদিকে…….
ছোয়া নিজের রুমে আয়নার সামনে বসে আছে। তার পরনে একটা গাঢ় নীল রং এর শাড়ি,, চোখে মোটা করে কাজল,, ঠোটে হালকা লিপস্টিক,, চুলগুলো খোপা করে গজরা লাগানো,, সাথে হালকা গয়না,, অসম্ভব মায়াবী লাগছে ছোয়াকে।
ছোয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছে রিংকি ( ছোয়ার খালাতো বোন )। ছোয়ার সাজ প্রায় শেষের পথে। রিংকি আয়নার দিয়ে ছোয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” বুবুন! তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”
ছোয়া হালকা হাসে। এমন সময় স্পন্দন দৌড়ে আসে। ছোয়া স্পন্দনের দিকে তাকাতেই বুক টাহ ধুক করে উঠে। কারন,, স্পন্দনের চোখে পানি। ছোয়া ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে,
–” স্পন্দন! ভাই আমার। কি হয়েছে তোর? কান্না করছিস কেন?”
স্পন্দন কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
–” বুবুন! খালামনি বললো,, তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তুমি নাকি পর হয়ে যাবে। এই বাড়িতে খুব একটা আসবে নাহ। আমাকে মায়ের দেখাশোনা করতে বলেছে। তুমি কি আমাকে ছেড়ে একদম চলে যাবে,, বুবুন? ভুলে যাবে আমাকে?”
ভাইয়ের মুখে এইসব কথা শুনে ছোয়ার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়। সত্যিই তো,, তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সেই বাড়িকে আপন করে নিতে হবে তাকে। সব সময় ভাইয়ের সাথে,, মায়ের সাথে আর থাকা হবে নাহ তার। এ কেমন জীবন মেয়েদের? একদিকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে,, অন্যদিকে নিজের মানুষদের ছেড়ে যেতে কষ্টও লাগে। ছলছল করে উঠে ছোয়ার চোখ।
ছোয়ার বুকের ভেতর একটা চাপা যন্ত্রণার সৃষ্টি হচ্ছে। সত্যি বলতে,, শিশিরকে স্বামী হিসাবে পাওয়ায় ছোয়া আনন্দিত কিন্তু,, নিজের পরিবার ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট যেন বুকের মাঝে হানা দিচ্ছে তার। ছোয়া এক হাত দিয়ে ভাইকে কাছে টেনে নেয়। তারপর ভাইয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” কে বলেছে? আমি তোর বুবুন, তোর বুবুনই থাকবো। তোর যখন যা দরকার হবে,, শুধু আমাকে একটু কল দিয়ে বলবি। দেখবি তোর বুবুন,, সব হাজির করেছে। যখন মনে পড়বে,, ভিডিও কল দিবি। ঠিক আছে?”
–” সত্যি?”
ছোয়া স্পন্দনের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ওঠে,
–” একদম।”
স্পন্দন মুচকি হাসি দেয়। ভাইয়ের এমন হাসি দেখে বুক টাহ যেন ভরে যায় ছোয়ার। এমন সময় মিসেস. কেয়া ভেতরে আসে। মিসেস. কেয়া ছোয়ার দিকে তাকিয়ে একটা সন্তুষ্টির হাসি দেয়। মেয়েটা যে এমন একটা জীবন পাবে,, ভাবতেই পারেন তিনি। মিসেস. কেয়া এগিয়ে এসে স্পন্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
–” স্পন্দন! বাবা! বাইরে যাও। মেহমানদের সাথে গিয়ে দেখা করো। যাও।”
স্পন্দন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” ওনারা চলে এসেছেন?”
–” হুম!”
স্পন্দন এক দৌড়ে বাইরে চলে যায়। ওদের আসার কথা শুনে,, ছোয়া,কিছুটাহ কেঁপে উঠে। নিজের হাতের দিকে তাকায়। কোনো আংটি পরে নি আজ ছোয়া। শিশিরের পরানো আংটি সে আজ পরবে। তার উপর শিশিরের একটা অধিকার চলে আসবে। আর কয়েকদিন পর তাদের বিয়ে হবে। সংসার হবে তাদের। কিছুটাহ শিউরে উঠে ছোয়া!!!
#_চলবে…………🌹
{{ হ্যাপি রিডিং…..!!!❣️ }}