লাল_ছাতি সূচনা_পর্ব

গভীর রাতে ফিসফিসানির আওয়াজে নূরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঘুমঘুম চোখে আশেপাশে তাকালো সে। তার পাশটা খালি, ঘরেও কেউ নেই। ফিসফিসানিটা গাঢ় হচ্ছে। ধ্বনি অনুসরণ করে নূর দৃষ্টিপাত করলো বারান্দা সংলগ্ন জানালাটির দিকে। বারান্দায় রিদওয়ানকে দেখা যাচ্ছে। সে ফোনে ব্যাস্ত। ঘড়ি না দেখলেও এটা বলাটা খুব কঠিন নয় এখন গভীর রাত। এতো রাতে কখনোই রিদওয়ানকে ফোনে ব্যাস্ত দেখে নি নূর। কারোর কি বিপদ হল! বিপদ আপদের বাপ মা নেই, হুটহাট কখন কার হয় তা অনুমান করা কঠিন। নূর ধীর পায়ে উঠে বারান্দার দিকে এগোলো। বারান্দার কাছে যেতেই রিদওয়ানের ক্ষীণ উত্তেজিত কন্ঠ কানে এলো নূরের,
“রাগবো না মানে! আমার জায়গায় যে কেউ হলেই রাগতো! রাত তিনটা কি কোনো সময়? একটু হলেই তো নূরের ঘুমটা ভেঙ্গে যেতো। কি উত্তর দিতাম তখন?”

কারোর কথায় আড়িপাতা উচিত নয়, কিন্তু আজ কেনো যেনো নূরের ইচ্ছে হলো রিদওয়ানের কথা শুনতে। রিদওয়ানের কন্ঠের স্বর বাড়লো, সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“এই কাঁদবে না, আমি কাঁদার কোনো কথা বলি নি তোমাকে, পারমীতা। আর এখন ফোন রাখছি, নূরের ঘুম পাতলা। আমরা কাল দেখা করেই কথা বলবো। রাখছি ”

পারমীতা নামটি শুনতেই থমকে যায় নূর। নামটি শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে। কারণ পারমীতা তার খুব ভালো বান্ধবী। কিছুদিন হলো সে রিদওয়ানের যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেখানেই জয়েন করেছে। নূরের মাথাটা ঝিম ধরে এসেছে। প্রথম সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে, উপরন্তু পারমীতার নামটি। মেয়েটি কেনো এতো রাতে রিদওয়ানকে ফোন করবে! শুধু ফোন নয়; সে আবার কাঁদছিলো ও। কিন্তু কেনো!

ফোন কেটে পেছনে ফিরতেই চমকে উঠে রিদওয়ান। নূর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে আশা করে নি সে। নূরকে দেখে রীতিমতো থতমত খেয়ে যায় রিদওয়ান। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
“এ..একি তুমি এখানে?”

রিদওয়ানের আড়ষ্টতা নূরের মনে সন্দেহের ক্ষীন দাগ টানে। রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে রিদওয়ান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার বারান্দার হলুদ আলোতে চকচক করছে। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। সে কিছু একটা লুকাতে চেষ্টা করছে নূর থেকে। নূরের ভ্রুযুগল সরু হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে সন্দীহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে,
“পারমীতা এতো রাতে কেনো ফোন দিয়েছে?”

নূরের আচমকা প্রশ্নে একটু নড়ে চড়ে উঠে রিদওয়ান। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“আসলে কাল একটা প্রেজেন্টেশন আছে তো, সেই বিষয়ে হেল্প চাই ওর”

রিদওয়ান মিথ্যে বলছে। নূর এতোও বোকা নয় এই সামান্য বিষয়টা বুঝবে না। সে আশাহত হলো, হৃদয়টা কিঞ্চিত আহত ও হলো। রিদওয়ান তাকে সত্যিটা বললো না। একটা মানুষ যখন নিক থেকে সত্যি না বলে, তাকে জোর করে লাভ হয় না। তাই নূর কথা বাড়ালো না। ঘুরে রুমে চলে গেলো। নূর চলে গেলে রিদওয়ান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।

নূর এবং রিদওয়ানের বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক। তাদের প্রেমের বিয়ে নয়, যাকে বলা হয় সম্পূর্ণ ঘটা করে বিয়ে। পারিবারিক পছন্দে বিয়ে হয়েছে তাদের এবং সাবলীল, সুন্দরভাবেই সংসার করছে এই দম্পতি। একটা সুন্দর সম্পর্ক যাতে এক নিবিড় বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। যেদিন প্রথম রিদওয়ানকে দেখেছিলো নূর সেদিন ই তার মনে ধরে তাকে। লাল ছাতি হাতে নূরের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরণে নীল শার্ট, হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছিলো। হাতে কালো ডায়ালের ঘড়ি। কাঁধে ছিলো ল্যাপটপের ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো সে এসেছে অফিস থেকে। বিয়ের পূর্বে নূরের সাথে একবার দেখা করতে চেয়েছিলো সে। লোকটিকে ছবিতে দেখে ভালো লাগলেও সামনাসামনি দেখে মনের আঙ্গিনায় বেশ প্রভাব ফেলেছিলো। মনে দাগ কেটে ছিলো লোকটি। ভালোলাগাটা সুগাঢ় হয়েছিলো। অবশ্য এতো ভদ্র, স্থির ব্যাক্তিকে যে কারোর ই মনে ধরবে। এক স্নিগ্ধ, শালীন ব্যাক্তিত্বের মানুষ রিদওয়ান। আজ অবধি তাকে কখনো উচ্চ স্বরে কথা বলতে দেখে নি নূর। অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন মানুষ রিদওয়ান। তার বাবা-মার প্রতি কোনো দায়িত্ব এড়ায় না সে। উপরন্তু নূরের প্রতি তার বন্ধুসুলভ এবং যত্নশীল আচারণে আরোও তার প্রতি আকৃষ্ট হয় নূর। ধীরে ধীরে এই আকর্ষণ ভালোবাসার স্নিগ্ধ অনুভূতি দেয় তাকে। কিন্তু রিদওয়ানের দিক থেকে সম্পর্কটা আগায় নি। এর কারণ নূরের জানা নেই। লোকটি নূরের ভালোমন্দের খেয়াল রাখলেও কখনো মুখ ফুটে বলে নি যে সে নূরকে ভালোবাসে। তাই এই ছয় মাসে সম্পর্কটা যেনো কোথাও একটা থেমে আছে। এতোদিন মাথা না ঘামালেও আজ কেনো জানে বিষয়টা ভাবাচ্ছে নূরকে। রিদওয়ানের সন্দেহজনক আচারণ তাকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে,
“সে কি আদৌ তাকে মনে ঠায় দিয়েছে?”

সকাল হতে না হতেই ব্যাস্ত শহরের ব্যস্ত কোলাহল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, এ যেনো নিত্য দিনের সঙ্গী। ভাদ্র মাসের তীর্যক সোনালী কিরণ নূর এবং রিদওয়ানের ছোট রুমটিকে আলোকিত করে তুলেছে। আড়মোড়া দিয়ে উঠে নূর। আজ অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে উঠতে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা জানান দেয় রাতের অসম্পূর্ণ ঘুমের। চোখ খুলতেই নজর পড়ে রিদওয়ানের দিকে। সে তৈরি হচ্ছে। অফিসের জন্য বের হবে। হাই তুলে নূর বলে,
“তুমি রেডি হয়ে গিয়েছো, আমায় ডাকলে না যে?”

রিদওয়ান টাই বাঁধতে বাঁধতে মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
“তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে, তাই ডিসটার্ব করলাম না।”
“মা-বাবা খেয়ে নিয়েছেন?”
“সেই কখন, জানোই তো মার টাইমিং।”

নূর ছোট্ট করে “হু” বলে। সে কাতর চোখে দেখতে থাকে তার বরকে। আজ বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। কালো শার্ট, কালো টাই এ বেশ মানাচ্ছে। বুকের বা পাশটা অস্থির হয়ে আছে। কেনো যেনো সূক্ষ্ণ ব্যাথা তার হৃদয়কে গ্রাস করছে। সূক্ষ্ণ সন্দেহ মস্তিষ্ককে ব্যাকুল করে তুলছে। মনের এক কোনে রিদওয়ানকে হারানোর সূক্ষ্ণ টলমলে ভয়টা উঁকি দিতে লাগলো। চোখের কোনে নোনা জল জমতে লাগলো নূরের। এর মাঝেই রিদওয়ানের সুন্দর কন্ঠটি কানে এলো,
“কি হলো? আজ অফিস যাবে না?”
“মাথা ব্যাথা করছে, আজ যাবো না।”
“খুব বেশি ব্যাথা করছে? জ্বরটর বাধালে?”

রিদওয়ানের কন্ঠে অস্থিরতার পরিচয় পেলো নূর। তার মুখ খানিকটা চিন্তিত হয়ে আছে। নূরের জন্য এখনো সে আগের মতোই রয়েছে। রিদওয়ান তার কাছে এসে বসলো, কপালে হাত দিয়ে বললো,
“জ্বর তো নেই, মাইগ্রেনের সমস্যা আছে নাকি তোমার?”

রিদওয়ানের চোখে নিজের প্রতি অস্থিরতা দেখে অস্থির ব্যাকুল মনটা শান্ত হয়ে যায় নূরের। মুচকি হেসে বলে,
“সামান্য মাথা ব্যাথা দেখি সাহেবকে ব্যাস্ত করে তুলেছে! চিন্তা করো না, আমি রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো। ”
“সত্যি তো তো?”
“হু, শুধু আসার সময় আমার জন্য সেলিমের হোটেলের সিঙ্গারা নিয়ে এসো।”
“পাগলী”

নূরের নাকটা টেনে উঠে দাঁড়ালো রিদওয়ান। রিদওয়ান অফিস যাবার পর কিছুক্ষণ বসে রইলো বিছানায়। কিভাবে পারলো সে রিদওয়ানকে সন্দেহ করতে। হতেই পারে সত্যি পারমীতা অফিসের কাজেই ফোন দিয়েছে। শুধু শুধু রাতের ঘুমটা হারাম করলো। নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মারলো সে। তারপর, বিছানা গুছিয়ে বের হয় নূর। শ্বাশুড়ি নাজমা বেগম ডাইনিং টেবিলে বসে চালকুমড়ো কাটছেন। নূরকে দেখেই তিনি বললেন,
“আজ অফিসে গেলে না যে নূর?”
“মাথা ব্যাথা করছিলো মা, আর আমার ছুটি আছে। একদিন কামাই এ কিছু হবে না।”
“খুব বেশি?”
“না মা, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। চা খাবেন?”
“খেলে মন্দ হবে না।”

নাজমা বেগমের সাথে নূরের বেশ খাতির। মহিলা তার চাকরিকে খুব সাপোর্ট দেন, তার মতে মেয়েদের যদি দক্ষতা থাকে শুধু বাসায় বসে এই দক্ষতার উপর মরিচা পড়াবে কেনো! চা খেতে খেতে নাজমা বেগম বলে উঠলেন,
“কাল একটু ভালোমন্দ রান্না করো নূর।”
“কেনো মা, কেউ কি আসবে?”
“রিদওয়ান বললো, ওর কলিগেরা নাকি আসবে।”
“আমাকে তো বললো না এ ব্যাপারে কিছু!”
“হয়তো ভুলে গিয়েছে। আসলে কাজের যা চাপ। আমাকে বলেছে আজ বের হবার সময়।”
“ওহ”

নূর আর কথা বাড়ালো না। নাজমা সাহেবের সাথে ঘরের কাজে হাত লাগালো। সারাটা দিন টুকিটাকি কাজ করেই পার করলো নূর। শুক্রবার ব্যাতীত শ্বশুর শাশুড়ীকে তেমন সম্য দেওয়া হয় না নূরের। আজ বহুদিন বাদে তাদের সাথে আড্ডা দিয়েছে সে, নিজের একান্ত সময় কাটিয়েছে নূর। মাঝে মাঝে এমন ছুটি নেওয়া উচিত। পরিবারকে সময় দেওয়াটাও জরুরি। এতে পরিবারের সম্পর্কগুলো দৃঢ় হয়।

রিদওয়ান ফিরলো রাত নয়টায়, হাতে নীরের পছন্দের সিঙ্গারা। যদিও ঠান্ডা হয়্র গিয়েছে। তবুও নূরের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট। রাতের খাওয়ার সময় নূর কথাটা পারলো,
“মা বললো, কাল নাকি তোমার কলিগরা আসবে। আমায় তো বললে না, হুট করে এই আয়োজন?”
“আসলে এবার প্রমোশনের পর রিজবি বেশ জিদ করছিলো, বিয়ে প্রমোশন দুটোই হলো। অথচ খাওয়ানো হয় নি। তাই ভাবলাম দাওয়াত করি। আগে তো তুমি ছিলে না, মাকেই বলতাম। তাই সে অভ্যাসটাই রয়ে গেলো।”
“সমস্যা নেই, আসলে হুট করে মা বললো তাই আর কি! তা কারা আসছে?”
“রিজবি, মনির, তানি, শুভ আর পারমীতা।”
“পারমীতাও আসছে?”

নূরের প্রশ্নে বিষম খায় রিদওয়ান। রিদওয়ানের বিষম লাগায় পানি এগিয়ে দেয় নূর। পানি খেতে খেতে রিদওয়ান বললো,
“আসলে ও তো জুনিয়র, উপরে তোমার বান্ধবী। তাই ওকে ও বলেছি৷”

নূর কিছু বললো না, তবে মনটা খচখচ করছে। পারমীতা নামটা যেনো গলার কাটার মতো বিধছে; না বের করতে পারছে, না গিলতে পারছে।

শুক্রবার,
সকল কলিগের সাথে পারমীতাও আসলো নূরের বাসায়। মেয়েটি সত্যি খুব অপরুপা, কিন্তু তার ভাগ্যটা আর পাঁচটা মানুষের মতো নয়। এতো সুন্দর মেয়েটিও প্রতারিত হয়েছে। প্রতারিত হয়েছে ভালোবাসায়। নূরকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো সে। বহুদিন বাদ দেখা হচ্ছে তাদের। খাওয়া শেষে সবাই যখন গল্পের আসর বসালো তখন নূর খেয়াল করলো রিদওয়ান এবং পারমীতা উভয়ই নেই। নূরের মনে কৌতুহল জন্মালো। তাদের খুজতে খুজতে নূর পৌছালো নিজের বেড রুমের বাহিরে। দরজাটা হালকা ভেজানো। বুকটা অহেতুক কারণেই ধরফর করছে নূরের। কেনো যেনো খুব কাঁপছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দরজাটা খুললো নূর। দরজা খুলতেই যা দেখলো তাতে নূরের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। রিদওয়ান পারমীতাকে জড়িয়ে ধরে আছে………..

চলবে

[আসসালামু আলাইকুম ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। কেমন লেগেছে জানাবেন, পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

লাল_ছাতি
সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here