#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩
আফনান লারা
.
আজ প্রায় একটা বছর পর অর্ণবের বাবা মা কুসুমদের বাড়ি যাচ্ছেন।
অর্ণবের সাথে তাদের কোনো কথা হয়নি।হলে পরেরটা পরে দেখা যাবে।এখন যাচ্ছে কুসুমকে একবার সাথে করে তাদের বাড়ি নিয়ে আসতে।এরপর অর্ণবকে জোর করে হলেও বাড়ি এনে ছাড়বেন।অর্ণব আজ পর্যন্ত কুসুমের মুখ দেখেনি।দেখলে সে কিছুতেই না করতে পারবেনা,যেমন রুপ তেমন সে রুপের মায়া।এইসব ভেবে রেখে নিশ্চিত হয়ে তারা কুসুমদের বাড়িতে আসছেন।আজ আসার সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
বাড়িতে যাবার আগে কুসুমের বাবাকে বলেই তারা রওনা হয়েছেন।অর্ণবদের বাড়ি থেকে কুসুমদের বাড়ি তেমন একটা দূরেনা।ঘন্টা দুয়েক লাগে।কিংবা তার ও কম।
.
কুসুম বাড়িতে আসার পরই দেখলো মা আর কলি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।কারণটা সে একেবারে ভাবতেও পারেনি।
মা ওর মুখ টিপে ধরে পাউডার লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন,’সারাদিন ইতরের মন ঘুরে বেড়াস।তোর মতন যুবতী মেয়েদের ঘরের কাজের বাহিরে যদি কোনো কাজ থাকে তো সেটা হলো সাজনগোজন।সেটা তো তোকে দিয়ে জীবনে করাইতে পারিনা’
-‘তা তো শুনতে শুনতে কান পেকে গেছে।তো এই ভরদুপুরে আমাকে ধরে সাজাইতাছো ক্যান?’
কলি ফিক করে হেসে চোখ মেরে বললো,’তোমার জামাই আসবে তাই’
কুসুম আশ্চর্য হয়ে নিজেই উঠে চলে গেলো ঘর থেকে।মা পিছু পিছু এসে বললেন,’আরে যাস না। সে আসবেনা।তোর চাচি আম্মা আর চাচা আসবেন’
কুসুম থেমে গেলো।ভীষণ মন খারাপ হলো তার।হাতে কয়েকটা ইটের ভাঙ্গা টুকরো নিয়ে চললো নদীর দিকে।সেখানে মাটিতে বসে একটা একটা করে ইটের কণা ছুঁড়ে মারতে মারতে বললো,’আমার সাথে তাঁর কিসের শত্রুতা?কেন আমায় তিনি একবার স্বচোক্ষে দেখতে চাননা?তাঁর নামের সাথে আমার নাম জুড়েছে এতবছর হলো।আমি কি দেখতে এতটাই বিশ্রী??
ওহ আচ্ছা।আমি মূর্খ বলে??সে কি জানেনা আমি ছোট থেকে ভারতে ছিলাম নানার বাড়ি।সেখানে এমন জায়গায় ছিলাম যেখানে পড়াশুনার বালাই ও ছিলনা।বাবা মা বাধ্য হয়ে আমাকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন সে কারণ টাও কি তিনি জানেন না?
জীবনে পড়াশুনাই সব??তাহলে মানা করে দিলেই তো পারেন।আজ কেন তাঁর বাবা মা আসছেন আমাদের বাড়িতে?
কেন আসেন আর আমাকে দামি উপহার দেন?এরপর বলে যান একদিন তিনি ঠিক আসবেন।আর কবে আসবেন??
আমি এতটাই তুচ্ছ?
যদি কখনও আমার সাথে তার দেখা হয় আমি তাকে বলে দিব, পছন্দ না করলে যেন বিয়ের পিঁড়িতে না বসে।’
—–
-‘কুসুম কি ভাবিস এতো?আয় আমার সঙ্গে।তোর চাচি আম্মা এসে গেছেন।তোর জন্য কত কি এনেছে দেখবি আয়’
আম্মা কুসুমের হাত ধরে জোর করে নিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে।কুসুম মন খারাপ করে তার সাথে চললো।অর্ণবের আম্মাকে দেখে সালাম দিয়ে তার পাশে ঘেঁষে দাঁড়ালো সে।
-‘মেয়ের মুখে পাউডার লাগালেই হইবোনা পাপিয়া!কানের পেছনে কালো টিকাও লাগাইতে হবে।আমাদের কারোর নজর যেন না লাগে’
পাপিয়া এসে কুসুমের হাত ধরে বললো,’আপন মানুষের নজর লাগেনা গো আপা’
-‘এই শাড়ীটা আমি কুসুমের জন্য এনেছিলাম।অর্ণব এই ঈদে আসবেই।আর আমরা তো কুসুমকে সাথ করে……’
-‘আপা শোনেন একটা কথা বলি।অর্ণব সেই কোন বছর যে ঢাকা চলে গেছে।আর কি আসে নাই?আমার তো মনে হয় তার বিয়েতে কোনো মত নাই।মত থাকারও কথানা।আমার মেয়েটা ওর মত শিক্ষিত না।শিক্ষিত কি বলছি, ও তো পড়ালেখাই জানেনা।আপনার ওমন ছেলে কি আমার এমন মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়!!হওয়ার কথা?’
অর্ণবের বাবা নড়েচড়ে বসলেন।অর্ণবের মাকে কথা বলতে মানা করে তিনি বললেন,’অর্ণবকে আমরা যা বলবো তাই শুনবে।আর আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি আমার ছোট ছেলের বউ করলে এই কুসুম মাকেই করবো।অর্ণব আমার কথা ফেলতেই পারবেনা।কুসুমের চেয়ে ভালো মেয়ে আমার অর্ণবের জন্য আমি পাবোনা।একমাত্র কুসুমই ওর মন জুগিয়ে চলতে পারবে।আর পড়াশুনা শিখতে কদিন লাগে??অর্ণব অল্প কদিনেই লেখাপড়া সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে।এটা নিয়ে ভাববার কিছু নেই’
কুসুমের মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেলো।যতদূর বোঝা গেলো উনার মনে হয় বিয়েতে মত নেই।জোর করে বিয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে বলেই কি উনি বাড়ি ফিরছেন না?’
-‘তো আপা আমি আজ আসার আরেকটা কারণ আছে।এই ঈদে আমি অর্ণবকে বাড়িতে এনেই ছাড়বো।তো চাচ্ছি কুসুমকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।অর্ণব একবার এসেই চোখের দেখা দেখুক।আপনি আমার কথা মাথায় নিয়ে রাখেন অর্ণব সেদিনই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে।’
কুসুমের মা বাবা দুজনেই সন্তুষ্ট হলেন উনাদের কথা শুনে।কিন্তু কুসুমের মন সাঁই দিলোনা কিছুতেই।
——–
পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব
সন্ধে হলে বসবো দু’জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভ’রে থাকবো চেয়ে…
মনে থাকবে?
-আরণ্যক বসু
-‘হ্যাঁ রে অর্ণব?? ষোল বছর শুনে মনে পড়লো।তোর হবু বউয়ের কি খবর?তার তো এখন ষোল হলো মনে হয়।
তিন বছর আগে তেরো বলছিলি না?’
অর্ণবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।ধপ করে বিছানায় বসে বললো,’ঐ মেয়েটার জন্য বাবা আমাকে ফোন দেয়না তিন বছর ধরে’
-‘তুই ও তো দেসনা’
-“আমি কেন দিব?আমি দেওয়া মানে ঐ মেয়েটার সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দেওয়া।যেটা আমি কখনওই করবোনা।’
-“ঠিক।পড়ালেখা না জানা একটা মেয়ের সাথে তোর বাবা কি হিসেব করে বিয়ে ঠিক করলেন আমার মাথায় ধরেনা।এটা অন্যায়।তোর মা কি এ ব্যাপারে তোর বাবাকে বোঝাননি?’
-‘মা কি বোঝাবে?মা নিজেই রাজি।জানিনা ঐ পরিবার বাবার কোন কালে কোন উপকার করেছিল যেটার ঋণ হিসেবে এখন আমার সাথে ঐ মেয়েটার বিয়ে দিতে চাচ্ছে।পড়ালেখা ম্যাটার করেনা আমার কাছে।ম্যাটার করে বয়স!!মেয়েটা আমার চেয়ে অনেক ছোট।হয়ত এখন ১৬হয়েছে কিন্তু তারপরেও সে যথেষ্ট ছোট।বাল্যবিবাহ ছাড়া আর কিছুনা।এত ছোট একটা মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবোনা’
-‘হায়রে!মানুষ বিয়ের জন্য ছোট কচি মেয়ে খোঁজে আর তুই প্রাপ্ত্যবয়স্ক খুঁজিস??’
-‘আমি কিছু খুঁজিনা।মোট কথা এখন বিয়ে করতে চাইনা।ক্লাসের বাইরে পার্ট টাইম একটা জব করি।নিজের খরচ নিজে চালাই।এখনও সেভাবে ভালো একটা চাকরি পাইনি, কি করে আমি ঐ মেয়েটার দায়িত্ব নেবো?ভাব!!তিনবছর আগে আমার কোনো চাকরিই ছিলনা,মেয়েটা আরও পুচকে ছিল।বাবার চিন্তাধারা সব আহেলি যুগের।’
মৃদুল বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বললো,’আমায় দিয়ে দে।আমার অনেক শখ পুচকে একটা মেয়ে বিয়ে করবো।না থাক!তোর ঐ পুচকে হবু বউ পড়াশুনা জানেনা।আমি নিজের পড়াশুনা শেষ করতে আধপাগল হয়ে গেছি।বিয়ের পর বউকে পড়াতে পারবোনা’
অর্ণব ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল।বিকাল পাঁচটা বাজে তখন।ফোন হাত থেকে রাখতেই দেখলো বাবার নাম্বার থেকে কল।আজ তিনটা বছর পর বাবা কল করেছে।প্রথম কয়েক সেকেন্ড অর্ণব তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা।হাত কেঁপে উঠেছিল।পরে খুশি হয়ে রিসিভ করে সালাম দিলো বাবাকে।
-‘কেমন আছো অর্ণব?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন বাবা?’
-‘ভাল থাকার কারণ রেখে গিয়েছো?’
-‘ভাইয়া টাকা পাঠায়না?’
-‘তোমার ভাইয়া তো আর আমার সুখের মূল না।আমার সুখের মূল দুই ভাগ হয়েছে।যার বেশিরভাগ আজ তিনটা বছর ধরে নিরুদ্দেশ ‘
অর্ণব এদিক ওদিক তাকিয়ে দম ফেললো।বাবা আবার বললেন,’ঈদে আসছো?’
-“আসতে পারি যদি….’
-“যদি??’
-‘ঐ আগের বিষয় যেন না ওঠে।আমি এসবে নাই আগেও বলেছি এখনও বলছি।’
বাবা লাইন কেটে দিছেন।অর্নব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকলো।এরপর নেট অন করে ফেসবুকে ঢুকতেই মেজাজ যা খারাপ ছিল তার দ্বিগুণ আকারে খারাপ হয়ে গেলো।সকালের সেই জুথি মেয়েটা কি করে ওর আইডি পেলো কে জানে।কোনো পোস্ট বাকি রাখে নাই সবগুলোতে হাহা রিয়েক্ট দিয়ে যমুনা নদী বানিয়ে দিয়েছে।
অর্ণব রাগে ক্ষোভে নিজেও গেলো হাহা দেবে বলে।ওমা আইডি লক করে রেখেছে তাই আর পারলোনা।সোজা মেসেজ দিয়ে বললো,’আপনার সমস্যা কি?’
জুথি এক্টিভ ছিল।মুচকি হেসে মেসেজটা সিন করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো তারপর রিপ্লাই করলো,’আপনি কে?ঠিক চিনলাম না তো’
-‘আমি অর্ণব হাসান।আপনাদের সিনিয়র।চিনতে পারেননি বুঝি?’
-‘ওহ হো!!আমাদের গেস্ট টিচার।গোলাপ দেননি তারপর আবার দিতে চাইছিলেন সেই ভাইয়া।চিনছি এবার’
-‘হাহা দেওয়ার সময় চোখ আকাশে তুলে হাহা দিচ্ছিলেন?না চিনে হাহা দিছেন?’
-‘আসলে রিয়েলে আপনাকে যেমন লাগে আর ফেসবুকে কার মতন লাগে থাক বললাম না।আমি ভাবলাম আইডিটা আপনার হতেই পারেনা।বিশ্বাস করুন’
-‘হাহা রিয়েক্ট সরান।এত তর্ক করার মন মানসিকতা আমার অন্তত এই মূহুর্তে নেই।”
-“সরাবোনা।বরং আরও দেবো।কি করবেন?’
ফোন রেখে অর্ণব বসে বসে রাগে ফুঁসতেছে।ছোট থেকেই তার রাগ নাকের ডগায় থাকে।মাঝে মাঝে প্রকাশ করতে পারে আর মাঝে মাঝে একেবারেই পারেনা।এখনও হয়েছে তাই।
——
-‘কি বললো সে?’
-“কুসুম তো কাল আসবে তাই না?আমাদের সাথে তো আসেনি।বাপের সাথে কাল আসবে।কি যে উত্তর দেবো।তোমার ছেলে ওর কথা শুনতেই চায়না।কি করি একটু বুদ্ধি দাও আমায়’
-‘আচ্ছা আমি ফোন করে দেখবো।’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/