#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৪
আফনান লারা
.
অর্ণবের বাবা ওর এমন আচরণে ভীষণরকম ভাবে নিরাশ হলেন।ওর মায়ের কথায় ভরসা পেলেননা।অর্ণব কখনও কথা শোনার মতন ছেলে না তা জানা আছে।আজ এতগুলো বছর পর ফোন করার পরেও তার মন গলানো গেলোনা।তবে তার একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আমি তার বাবা মকবুল হাসান।সে তার সব জেদ এই আমার থেকেই পেয়েছে।জেদের দিক দিয়ে আমি প্রথম।তার জেদ আমার জেদের কাছে কিছুনা।যদি তার কোনোদিন বিয়ে হয় তবে কুসুমের সাথেই হবে।নাহলে কারোর সাথে হবেনা।
কপালে হাত রেখে সোফা থেকে উঠে রুমে যেতে যেতে তিনি বললেন,’বৌকে বলো তো এক কাপ চা পাঠাতে’
——-
যত সেলোয়ার কামিজ আছে সব একটা ব্যাগে পুরে নিয়েছে কুসুম।কাল বাবার সঙ্গে অর্ণবদের বাড়িতে যাবে।এই প্রথম সে ঐ বাড়িতে যাচ্ছে।বাবা বলেছেন স্কুলে ঈদের ছুটি দিলে কলিকেও রেখে আসবে যাতে কুসুমের ওখানে নিজেকে একা মনে না হয়।
মনে ভয় করছে একটা বিষয় নিয়ে।উনি যখন আসবেন তখন কি হবে?কি করে তার সামনে দাঁড়াবে।লজ্জা আর ভয় দুটোই মনের ভেতরে ডানা মেলে ঘুরপাক খাচ্ছে।যদি মুখ দেখেই মেজাজ খারাপ হয় তার?
টিনের বেড়ায় ঝুলানো ছোট আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ালো কুসুম।নিজের মুখে হাত রেখে বললো,’এই রুপে মুগ্ধ হলেও এই মানুষটিতে মুগ্ধ হবেননা জানি।আমি যে আপনার যোগ্য নই।ইশ যদি যোগ্য হতাম, আমার আর কোনো চিন্তা থাকতোনা।আপনার মুখে হাসি রাখবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম।কিন্তু সেটার ধারের কাছেও তো আমি নেই।আমাকে তো আপনি পছন্দই করেন না’
-“ওসব কি বলিস কুসুম?তুই এগুলো ভেবে সারাদিন মুখ ভার করে রেখে এতদিন শুকিয়ে যাচ্ছিলি?তোকে কে বলেছে অর্ণব তোকে পছন্দ করেনা?ঘরের ছেলে ঘরে একদিন ঠিক ফিরবে।আর সে তো তোকে এখনই দেখেইনি।পছন্দ করা না করা বিবেচনার কথা তো এখনও ওঠেইনি।’
-‘আমি যে পড়ালেখা জানিনা তা তো উনি নিশ্চয় শুনেছেন?এই জন্যই তো তার পালিয়ে বেড়ানো’
কুসুমের মা ওর হাত ধরে চৌকিতে বসিয়ে দুহাত দিয়ে মুখটা ধরে বললেন,’আমার মেয়ের অনেক গুণ।সে পাগল না হয়ে যাবে কই?ঠিক ধরা দেবে।অপেক্ষা করতে সমস্যা কোথায় মা রে??এত বড় বাড়ি,এত বড় বাড়ির ছোট ছেলে,আদরের ছেলে,শিক্ষিত সুপুরুষ, তাদের কত চাহিদা!!
হয়ত তার মনে সংশয় জাগবে তারপরেও দেখিস তোকে ঠিক আপন করে নেবে।তুই মানা করে দেবার মতন মেয়েই নস!!আমার কথা শোন।এত চিন্তা করলে চেহারা খারাপ হবে তোর।বিয়ের কথা চলাকালীন হাসিখুশি থাকতে হয়।তাহলে দেখবি রুপ বাহিয়া পড়তেছে।লেখাপড়া কি জিনিস?জরুরি হলো রুপ।যেটা তোরে আল্লাহ দিছেন।পড়াশুনা শুনছি অর্ণবই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে।আর সে নিজেও তো পড়তাছে।তারে পড়তে দিবিনা??
তুই চাস সে না পড়ে এসে তোরে বিয়ে করুক?’
কুসুম জিভে কামড় দিয়ে বললো,’না না।তা কেন চাইবো?আমি চাই উনি পড়ুক।অন্তত আমার মতন যেন না হয়।অনেক পড়ুক।অনেক নাম হোক তার’
-“তাহলে?এরকম মন খারাপ করে থাকলে তোর মন খারাপের জোর তো পোলাটাকে দূর থেকে টেনে নিয়ে আসবে গ্রামে।তোরে বিয়ে করলে সে কি আর তোরে ছাড়া একটা দিন ও থাকতে পারবে?পড়াশুনা সব তো ডুবাবে’
কুসুম লজ্জা পেয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।মা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,’শুনেছি অর্ণব একটু রাগী হলেও মনের দিক দিয়ে অনেক ভালো একটা ছেলে।তোকে যদি ধমক ও দেয়,দু চারখানা কথাও শোনায় দিনশেষে এসে বুকে টেনে নিবে।আমার আর কোনো চিন্তা থাকবেনা তোকে নিয়ে।আমার এমন মেয়ে যেন অর্ণবের মতন একটা ছেলের ঘরে বউ হয়ে যায়।
মনে শান্তি নিয়ে মরতে পারবো’
-“মা ওসব বলোনা।তোমার আগে যেন আমি মরি।তোমার মৃত্যু আমি সইতে পারবোনা গো।যেন তার আগেই আমি মরে যাই’
——–
-‘কত বই!!ভাবছি লাইব্রেরি থেকে একটা উপন্যাস নেবো পড়ার জন্য।তুই কোনটা নিবি জুথি?’
-‘আমি কৃষ্ণকান্তের উইল নিলাম।’
-‘আচ্ছা তুই আজ প্রথম ক্লাসে আসিসনি কেন?’
-“রিকশা পাচ্ছিলাম না কি করবো?’
-“ভালো করেছিস।এখন চল নাহলে আবার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে’
ক্লাসে এসে বসতেই কিছুক্ষণ পর অর্ণবকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে জুথির মাথা হ্যাং হয়ে গেলো।এটা কি করে হয়।প্রথম ক্লাস তো মিস দিয়েছিল এই অর্নবের ভয়ে তাহলে সেকেন্ড ক্লাসে তার আসার কারণ কি?
নিজের কোথাও ভুল হয়েছে কিনা তা ভেবে রুটিনটা বের করে দেখলো ঠিকই তো আছে।এখন অন্য স্যারের ক্লাস।তাহলে এই লোকটা কেন?’
অর্ণব বই হাত থেকে টেবিলে রেখে বললো,’স্যার অন্য ডিপার্টমেন্টে গেছেন।হয়ত আসতে দেরি হবে যার কারণে ক্লাসটা তিনি করাতে পারবেননা।আমাকেই আসতে হলো’
জুথি মাস্ক টেনে মাথা নিচু করে বসলো কোণার দিকে চেপে।অর্ণব বইতে চোখ বুলিয়ে পুরো ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে নিতেই জুথিকে দেখতে পেলো।প্রথম ক্লাসে জুথি আসেনি তা সে জানতো।
জুথিকে চেনার একটা অন্যতম উপায় হলো ওর ডান ভ্রু ঘেঁষে একটা তিল আছে যেটা কিনা স্পষ্ট নজরে পড়ে।ওকে দেখে চিনতে পেরে অর্ণব বই খুঁজে একটা অধ্যায় বের করে বললো,’যে অধ্যায়টা পড়াচ্ছি তোমরা মনযোগ সহকারে শুনবে।এটা থেকে কমন পড়ে অনেক।’
জুথি ফোন বের করে দেখছে।পুরো ক্লাসটায় ঐ লোকটার উপর চোখ যেন না পড়ে তার জন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকতে হবে।
পড়াতে পড়াতে অর্ণব বুঝতে পারলো জুথি ফোন ঘাঁটছে।টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বললো,’ফোন নিয়ে যাব।’
জুথি চমকে ফোন লুকিয়ে তাকালো সামনে।অর্ণব একসাথে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,’যদি কেউ আমার ক্লাসে ফোন ঘাঁটো তবে।
তোমরা কত লাকি!!আমাদের সময় ফোন আনলেও স্যারের কথা শুনতে হতো।আর তোমরা ক্লাসে বসেও ফোন দেখার সাহস করে থাকো।যুগে যুগে কত কি দেখবো।’
জুথি আড় চোখে তাকিয়ে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে থাকলো।পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই অর্ণবের চোখ জুথির দিকে যাচ্ছিল।কারণ সবাই ওর দিকে মনযোগ দিয়ে চেয়ে থাকলেও একমাত্র জুথি অন্যমনস্ক।বিষয়টা ভালো লাগছিলনা একটুও।সে স্যার না বলে দাঁড় করিয়ে কথাও শুনাতে পারছেনা।কি করে টাইট দেওয়া যায় তাই ভাবছিল হঠাৎ প্রিন্সিপাল স্যার এসে রুমে দাঁড়াতেই তিনি জুথিকে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমক একটা দিলেন।জুথি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।তিনি এগিয়ে এসে বললেন,’একটা কথা জানো তোমরা?ভার্সিটি লাইফে সিলেবাসের চেয়েও কাজে দেয় প্রতিটা ক্লাস।স্যারের বলা কথাগুলো স্টুডেন্টরা নোট করে পর্যন্ত রাখে।আর তোমরা এত মূল্যবান ক্লাসে অমনোযোগী থাকো?’
অর্ণব মিটমিট করে হাসছে।মনে মনে বলছে, স্যার আরও ভাল করে বকুন।
প্রিন্সিপাল স্যার জুথির দিকে ফিরে বললেন,’করিম ভাইয়ের মেয়ে তুমি।বেশি কিছু বললাম না, কিন্তু স্যারের মতন মেধা হয়ত তোমার মাঝে নেই।তোমার বাবা কোথাও বেড়াতে গেলেও হাতে বই নিয়ে যেতেন।তোমাকে আরও মনযোগী হতে হবে।পড়াশুনার চিরবন্ধু হলো এই মনযোগ।এটা না থাকলে সারারাত বই নিয়ে বসে থাকলেও লাভ হবেনা।’
অর্ণব দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে নড়ে দাঁড়ালো।করিম স্যারকে সে চেনে।কলেজের টিচার উনি।এককালে তার কাছে সে প্রাইভেটও পড়েছিল।কিন্তু মনে পড়ছেনা তার বাসায় তো কোনোদিন এই ক্ষতিকে দেখলোনা সে।তাহলে?? ‘
—–
বাবার হাত ধরে এই প্রথমবার কুসুম অর্ণবদের বাড়িতে পা রেখেছে।শুরুতে যে সোফার রুম সেখানে অর্ণবের মা আর ভাবী দাঁড়িয়ে ছিলেন।কুসুমকে মিষ্টি মুখ করিয়ে ভেতরে আনলেন তারা।
কালো বোরকা পরে এসেছিল সে।কুসুমের বাবা সোফায় বসতেই ভাবী কুসুমের হাত ধরে নিয়ে গেলেন ভেতরের রুমের দিকে।একটা রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’তুমি বুঝি কুসুম??মিনারপুরের?’
-‘জ্বী।’
-‘জানো আমিও ওখানকার।কেমন আছো তুমি সেটা বলো আগে’
কুসুম হাসি দিয়ে বললো ভালো আছে।তারপর রুমটায় একবার চোখ বুলালো।একটা কাঠের ওয়ারড্রব, একটা আয়না,একটা নরম তুলোর বিছানা,একটা টেবিল,চেয়ার,বেলকনি সবই দেখলো।সবুজ রঙ করা রুমটায়।ওকে এভাবে দেখতে দেখে মিশু ভাবী বললেন,’তুমি রুমটা দেখো আমি একটু আসছি।এক মিনিট কেমন?একটা জিনিস বানিয়েছি তোমার জন্য’
ভাবী চলে যাবার পর কুসুম বোরকা খুলে বিছানায় রেখে মাথায় ওড়না দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।
টর আগে এরকম বড় আয়না সে দেখেছে পাশের বাসার মিতুলদের।তাদের নিজেদের এমন আয়না ছিলনা।নিজেকে ভালো করে দেখতে যেয়ে খুশিতে পা উঁচু করে ঘুরলো।ঘুরতে ঘুরতে হাত লেগে ড্রেসিং টেবিলে উল্টো করে পড়ে থাকা একটা ছবি নিচে পড়ে গেলো হঠাৎ।জিভ কামড়ে কুসুম নিচ থেকে তুলে নিলো ছবিটা।ওড়না দিয়ে ছবিটা মুছতে যেতেই দেখলো ওটা অর্ণবের ছবি।
তবে সে জানতোনা ছবির এই ছেলেটাই অর্ণব।নীল টিশার্ট পরা।কক্সবাজারে পানি ছোঁয়ার সময় তোলা ছবিটা।চোখে সানগ্লাস।
ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে দেখলো কুসুম।অর্ণব নাকি তার বড় ভাই সাগর ঠিক বুঝতে পারলোনা।মিশু চায়ের কাপ হাতে রুমে এসে বললো,’ওটা কে বলোতো?’
কুসুম আন্দাজে সবসময় ভুল করে তাই বললো,’আপনি বলুননা উনি কে?’
-‘এটা তোমার হবু বর’
কুসুমের হাত কেঁপে উঠলো।ছবিটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো সে।মিশু হেসে দিয়ে চায়ের কাপটা ওর সামনে রেখে বললো,’রান্নাবান্না পারো তো?আমাকে হেল্প করতে পারবে তো?’
কুসুম মাথা নাড়ালো।মিশু অর্ণবের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমার ভাগ্য দারুণ।অর্ণব খুব ভালো একটা ছেলে’
চেয়েও কুসুম কিছু বলতে পারলোনা।মনে তাকে নিয়ে অনেক কিছু জানার কৌতূহল।
চায়ের কাপটা হাতে ধরে আড় চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো সেই ছবিটার দিকে।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/