#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৪১
আফনান লারা
.
জুথি বাসায় তার যা জমানো টাকা পয়সা ছিল সব নিয়েছে ঠিকই তবে শুরুতেই বিয়ার কিনতে ছোটেনি।হেঁটে হেঁটে লেকের কাছে এসে থেমেছে।স্থান রবীন্দ্র সরোবর। এখানে অর্ণবের সাথে একবার হাঁটা হয়েছিল।ঐ তো সেদিনই।গোলাপ ফুল দিয়েছিল অর্ণব।দেখতে দেখতে মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে জুথি।তার আশেপাশে শত শত মানুষ।যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউ ফ্রেন্ড সার্কেল সাজিয়ে আড্ডা পাতিয়েছে,কেউ বা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল হাতে ফুল কিংবা লাভ শেপ গ্যাস বেলুন নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে মিষ্টি আলাপ করছে।
কোণায় দেখা যায় স্বামী স্ত্রী আর তাদের দু বছরের ছোট্ট বাবু।বাবুটার হাতে এরোপ্লেনের বেলুন।
কেউ খেয়াল করছেনা জুথিকে।জুথির চোখ আকাশের দিকে।খোলা চুল দেরি করে আসা বাতাসে উড়ছে বারবার।গায়ে তার ধুসর রঙের জামদানি। হাতে মোটা বালা।আর কোনো অতিরিক্ত সাজ দেখা গেলোনা তার মাঝে।হঠাৎ নিজের সোজা লম্বা চুলের আগায় কেউ কিছু একটা করলো মনে হলো।কিন্তু কি করলো বোঝা গেলোনা শুরুতেই।কয়েক সেকেন্ড পর সে খেয়াল করলো তার চুল সহ আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে।একটা লাল টুকটুকে লাভ শেপের বেলুনের সুতা আটকানো ওর চুলের সাথে।বেলুনটা কয়েক ইঞ্চি উপরে গেলো যতদূর জুথির চুল উপরে গেছে ঠিক ততদূর।
জুথি চোখ মেলে দেখছে বেলুনটাকে।তার চুল ধরে রেখেছে বেলুনটা।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে চুল থেকে বেলুনটা ছুটিয়ে নিলো সে তারপর বেলুনটা ছেড়ে দিলো।মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে বেলুনটাকে ধরে ফেলে বললো,’আরে করছো কি!এত সুন্দর একটা মোমেন্ট উপহার দিলাম আর তুমি সব নষ্ট করে ফেলছো?’
-‘আপনি এখানে কি করেন?’
-‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’
-‘আমি এখানে সে কথা কে বললো আপনাকে?’
-“এদিক দিয়ে যাবার সময় খাম্বার মতন দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর চুল দেখেই চিনে ফেললাম।আর কিঞ্চিত ফর্সা পেটের ঝলক।না চিনে যাবো কই?’
জুথি চমকে পেটে হাত দিয়ে শাড়ী টেনে দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো ভয়ার্ত চোখে
মৃদুল হাসি দিয়ে বললো,’ভয় নেই।এত বড় বড় চুলের ঝাড়ের নিচে ঐ সাদা পেট মৃদুলের চোখে পড়লেও বাকিদের চোখে পড়বেনা।মৃদুল খুঁজতে জানে খাঁটি সোনা!!”
জুথি হাঁটা ধরলো সোজা।মৃদুল সঙ্গে আসতে আসতে বললো,’আরে আবার কই যাচ্ছো?’
-“ফ্লার্ট করছেন?নাকি অর্ণব আপনাকে পাঠিয়েছে আমাকে জ্বালাতন করতে?’
-“নাহ।ও কেন পাঠাবে?আমি যা করি নিজ থেকে করি।চা খাবে?’
-‘আপনি যান এখান থেকে।আমাকে একা থাকতে দিন দয়া করে’
মৃদুল থেমে গেলো।জুথি কিছুদূর গিয়ে সেও থামলো।তারপর পেছনে তাকালো
মৃদুল বেলুনটা ঘুরাতে ঘুরাতে অন্যদিকে চলে গেছে।জুথি ওর চলে যাওয়া দেখছে দাঁড়িয়ে।পাক্কা দু মিনিট ধরে পেছনে তাকিয়ে থেকে জুথি যখন চুলে হাত দিলো দেখলো তার সব গুলো চুলের আলাদা আলাদা অংশ করে তিনটা বেলুন লাগানো।সেগুলোও উড়ছে।এটা দেখে রাগ করবে নাকি হাসবে এসব না ভেবে এদিক ওদিকে সে মৃদুলকে খুঁজতে লাগলো।মৃদুল দুহাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললো,’এইবার বেলুন কিন্তু আমি লাগাইনি।জনবল লাগিয়ে করিয়েছি।ঐ যে পিচ্চি বাবুগুলা দেখছো ওরা করেছে।অবশ্য জনপ্রতি দশটাকা করে দিতে হয়েছে।সে যাই হোক, হাসি ফোটাতে আমার লাখ টাকা গেলেও টের পাবোনা’
জুথি এক এক করে বেলুনগুলো খুলে বাচ্চাগুলোকে ফিরিয়ে দিয়ে বসলো চেয়ারে।মৃদুল ও বসলো।তবে চুপচাপ অবস্থায় চায়ের কাপটাও এগিয়ে ধরেছে সে।জুথি কাপটার দিকে তাকিয়ে বললো,’আপনি এরকম কেয়ার কেন করেন?পছন্দ করেন আমায়?নাকি অন্য কিছু?’
-‘পছন্দ কি জিনিস?অনেক আগে একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। সে এমন চিট করেছে যে আমি পণ করেছি আর কোনো নারীকে সেভাবে পছন্দ করবোনা।আসলে আমি অনেক বছর ধরে একাকিত্বে ভুগেছি।জানি এটার মতন খারাপ লাগা বুঝি আর কিছুতে নেই।তো ভাবলাম তোমাকে এমন সিচুয়েশন থেকে বাঁচিয়ে তুলবো।
তোমার একাকিনী ভাব যাবে সাথে আমারও।’
জুথি মৃদুলের কথায় কান দেয়নি।চা খেতে খেতে পাশে বসা একটা কাপলকে মনযোগ দিয়ে দেখছিল।দেখে মনে হয় যেন কালই তাদের বিয়ে হয়েছে।মেয়েটার মুখের হাসির কোনো অন্ত নেই।হাত ভর্তি মেহেদি।বারবার ঘোমটা টানছে।
আর ছেলেটার চোখ মেয়েটার থেকে নড়ছেইনা।কি সুন্দর এক দৃশ্য।মৃদুল জুথির চাহনি দেখে নিজেও তাকালো।জুথি কি ভালো লাগা খুঁজে পেয়েছে সে বুঝলোনা।এমন কাপল সে বহু বার দেখেছে।তাই ভেংচি কেটে মানিব্যাগ বের করে চায়ের টাকা দিয়ে আসলো।এসে দেখলো জুথি তার জায়গায় নেই।কপালে হাত দিয়ে এবার এক দৌড় দিলো সামনের দিকে।অনেকক্ষণ যাবত খোঁজার পর পেলো জুথিকে।সেই বাচ্চাগুলো একজোট হয়ে জুথির হাতে বেলুনের সুতো গিট্টু দিয়ে দিচ্ছে আর জুথি হাসছে ওদের সাথে।মৃদুল এগিয়ে এসে চোখ মারলো বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে।
——
অর্ণব কুসুমকে সাথে নিয়ে একটা শপিংমলে এসেছে।সেখানে খাবারের অর্ডার করে বসে আছে এখন।কুসুমের হাতে একটা আইস্ক্রিম।কিছুক্ষন আগে অর্ণব কিনে দিয়েছিল।আইস্ক্রিম খেতে খেতে কুসুম এখানকার মানুষগুলোকে দেখছিল হা করে।কি সুন্দর মানুষগুলো।কিছু কিছু মেয়ের পোশাকে অভিনবতা দেখে মাঝে মাঝে সে তার শাড়ী টেনেটুনে ঠিক করছে তো আবার চুল ঠিক করছে।অর্ণব বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,’আমি বললাম না শাড়ীতে ঠিক আছে।এরকম বোধ করছো কেন?নরমাল হও’
কুসুম হঠাৎ করে প্রশ্ন করলো মৃন্ময়ী কেমন আছে।
অর্ণবের মাথাতেই ছিলনা জুথির কথা।কুসুমের প্রশ্ন শুনে ওর মুখের দিকে দু মিনিট তাকিয়ে থেকে বললো,’আমিও জানিনা।আচ্ছা মৃদুলকে কল করে দেখছি’
মৃদুল জুথিকে নিয়ে ঐ শপিংমলেই এসেছে।এমনিতে ঘুরতে।
অর্ণব ওকে কল করায় ফোন বের করে কানে ধরে সামনে তাকাতেই দেখলো ওরা দুজন বসে আছে ওখানে।মৃদুল চোখ বড় করে পাশে তাকালো।জুথি একটা প্লাস্টিকের ফুলের টব দেখছিল হাত দিয়ে ছুঁয়ে।এখনি ওদের দেখেনি।
মৃদুল চট করে ওর হাত ধরে টেনে অন্যপাশে নিয়ে আসলো।
-‘আজব!কি হলো?হাত ছাড়ুন!’
জুথি হাত ছাড়িয়ে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।ওদিকে অর্ণব কলে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে।
-“ভাই তোরে আমি পরে কল করছি”
-“আগে বল জুথি কেমন আছে?’
-“ভালো’
-‘কই তুই?যে গান আমাদের পাশে বাজতেছে সেটা দেখি তোর পাশ থেকেও শোনা যায়।তুই সীমান্ত সম্ভারে নাকি?’
-“নানানানা।কে বললো?গান তো একটা দোকানে বাজছে।’
—
জুথি সোজা চলে গেছে অনেকদূর।মৃদুল কল কেটে আবারও ছুটলো সামনের দিকে।অর্ণবের সন্দেহ হলো বলে সে উঠে একটু এগিয়ে দেখতে গেলো।
মৃদুল হন্তদন্ত হয়ে জুথিকে খুঁজতে ব্যস্ত। এদিকে কুসুম অর্ণবকে যেতে দেখে সেও গেলো।কিন্তু এত এত গলির মাঝে সে নিজেই হারিয়ে গেছে।এখন অর্ণবকে কোথাও পাচ্ছেনা।সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরা কাউকেই নজরে আসছে না তার।
কুসুমের চোখে পানি এসে গেছে।এত এত মানুষের ভীড়ে কোত্থাও কাছের মানুষটার ঝলক না দেখে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে হাঁটার গতি বাড়িয়ে ছুট লাগালো সে।
ওদিকে অর্ণব মৃদুলকে কোথাও না পেয়ে যখন ফিরে আসলো তখন সিটে কুসুমকে না দেখে তার মনে হলো পায়ের তলার মাটিটাই বুঝি সরে গেছে।এবার সে কুসুমকে খুঁজতে ছুটলো।
মৃদুল আর খোঁজ পাবেনা ভেবে জুথি একটা শপের সামনে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছিল ঠিক সেসময়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কুসুম ওর সামনে দিয়ে গেলো।ওর মুখ দেখেই চিনেছে জুথি।ওকে ছুটতে দেখে সেও পিছু পিছু গেলো।দু কদম হাঁটার পর তার হাঁটার গতি নিঃশেষ হয়ে পড়েছে।সে দেখলো কুসুম কিছুদূর যেতেই অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ।এই দৃশ্য দেখে জুথির মুখের হাসি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। চুপ করে শুধু দেখছে সে।অর্ণব প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও পরে কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কাঁদতে মানা করলো।
আশেপাশের মানুষেরা তাদের কাজ ফেলে দেখছে ওদের দুজনকে।
অর্ণব দুহাত দিয়ে কুসুমের চোখ মুছে হাতটা শক্ত করে ধরে চলে গেছে।জুথি এখনও ওখানে দাঁড়িয়েছিল।ওরা চলে যাবার পর মুখটা ফ্যাকাসে করে পিছনে ফিরতেই মৃদুলকে সামনে পেলো সে।
ও রাগান্বিত হয়ে আছে।রেগে রেগে বললো,’কি সমস্যা তোমার?আমি তোমার খেয়াল রাখছি বলে সবসময় আমায় দৌড়ের উপর রাখবে?আশ্চর্য! আর একবার এমন লুকোচুরি খেললে থাপ্পড় মেরে দেবো দু গালে দুইটা।এরকম সীমা অতিক্রম করা মেয়ে আমি এর আগে দেখিনি।অনামিকাও এত বেয়াদব ছিলনা।আমার হাতে চড় খেয়েও দাঁত কেলাতো’
জুথি চোখ নামিয়ে যেতে যেতে বললো,’তাই সে আজ আপনার না,অন্য কারোর।সবসময় হাসির মূহুর্ত কাটানো মানুষটা নিজের হয়না।দিনশেষে যেমন সে দাঁত কেলায় দিনশেষে সে অন্য কারোর হতে একদিন সময় লাগায়না।’
মৃদুল কোমড়ে হাত রেখে বললো,’প্লিজ আবার যেওনা।ওকে আমি সরি!!খাবে কিছু?’
চলবে♥