#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৪২
আফনান লারা
.
আজ নিজের অজান্তেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে কুসুম অর্ণবকে জড়িয়ে ধরেছিল এটা মনে পড়লো তার কিছুক্ষণ পরেই।মনে পড়ার পর ভয়ার্ত চোখে অর্ণবকে বারবার করে দেখছিল সে।
অর্ণব ধরে নিয়েছে কুসুম ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল তখন, ইচ্ছে করে তো ধরেনি।তাই বিষয়টাকে সে ওতোটাও গুরুত্ব সহকারে নিলোনা।
হোটেলে ফেরত যাবার সময় রাতে খাবে বলে কুসুমের জন্য কিছু খাবার কিনে নিলো সে।
রুমে ফেরার পরপরই ফোন নিয়ে পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো।কুসুম রিমোট নিয়ে টিভি অন করে ওর পাশে বসে চুপচাপ দেখছে।
সেসময়ে হালকা নড়চড়ে খোঁপার কাঁটা খুলে পড়ে যাওয়ায় ওর খোঁপার সব খাণি চুল এলোমেলো হয়ে খুলে গেছে।তার থেকে কস্কো সাবানের তীব্র ঘ্রান অর্ণবের নাকে আসতেই সে ঘুরে তাকালো।সেই কোঁকড়ানো চুল দেখে তার মনে পড়ে গেলো সেই স্বপ্নর দৃশ্যের কথা।সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আবারও ঘুরিয়ে নিলো সে।তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’তুমি চুলে সাবান দেও?’
-“হ্যাঁ।কেন?’
-“শ্যাম্পু করলে চুল ভালো থাকে আর সুগন্ধি ছড়ায়।এখন থেকে শ্যাম্পু দিবে।’
কুসুম মাথায় হাত দিয়ে কিছু চুল নাকের সামনে ধরে শুঁকে বললো,”ওটা দিলে আমার চুল রশির মতন ছুটে আসে হাতে।একবার দিয়ে যে ভুল করেছিলাম।তারপর থেকে কখনওই দিই নাই।’
কথাটা বলে কুসুম তার হাতের চুল ছাড়ার পর দেখলো হাতে কতগুলো চুল ছুটে চলে এসেছে।
তাই আবারও অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’দেখুন এখনও উঠে এসেছে।মনে হয় চুলে আর কিছুই দেওয়া যাবেনা’
অর্ণব পেছনে ফিরে কুসুমের হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে বললো,’একি অবস্থা।চুল আঁচড়াওনা তুমি?’
-“আঁচড়ালে মাথায় আর চুল থাকবেনা।আমি তিনদিন পর আঁচড়াই।আজ দুইদিন হলো’
-‘যাও চিরুনি আনো।আমি আঁচড়ে দেবো।তুমি হয়ত আঁচড়াতে জানোনা’
কুসুম যেন একটা বিরাট খুশির খবর শুনেছে।ছুটে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা চিরুনি বের করে এনে অর্ণবের কাছে ছুটে গেলো।অর্ণব চিরুনি দিয়ে ওর এলোমেলো কোঁকড়া চুলগুলোকে আস্তে করে আঁচড়াতে যেয়ে দেখলো চুল শুধু শুধু উঠে আসছে।
তা দেখে সে কুসুমকে বললো,’চুলের যত্ন নাও না বলেই এখন সব চুল উঠে যায় তোমার।আমি একটা তেল এনে দেবো।ওটার সঙ্গে নারকেল তেল মিশিয়ে চুলে দিবা,
দুপুরে শ্যাম্পু করবে দেখবে চুলের গোড়া মজবুত হয়ে চুল আর ঝরবেনা’
কুসুম মাথা নাড়ালো।অর্ণব কুসুমের চুলে বেনি করে দিয়েছে।
কুসুম বেনি ধরে বললো,’আপনি বেনি করতে জানেন?’
-“ইউটিউবে দেখেছি।এই আর এমন কি!’
কুসুম খুশি হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে ঘুরে ঘুরে নিজের চুলের বেনি দেখছিল।
সেসময়ে অর্ণবের ফোনে কল আসলো মৃদুলের।মৃদুল বাসা ভাঁড়ার খোঁজ পাচ্ছেনা।দেরি হবে জানালো।
-‘ভাই কিছু একটা কর।হোটেলে এতদিন থাকা সম্ভব না।নড়তে পারিনা, চড়তে পারিনা।একটা রুম অথচ ভাঁড়া দু হাজার’
-‘শোন একটা কাজ করতে পারিস।মহাখালীতে আমার বাসার দোতলায় থাকতে পারিস।খালি আছে এখন যতদূর জানি।
জানিস তো বাবার সঙ্গে আমার মিল বেশি একটা নেই।তুই গিয়ে আমার পরিচয় দিলে হয়ত বাবা তোকে রাখবে।আমি নাহয় সব ভুলে বাবাকে ফোন করে বুঝিয়ে দেবো।যেহেতু বাবার সাথে আমার ভাল সম্পর্ক নেই সেক্ষেত্রে তোকে ভাঁড়া দিয়ে থাকতে হবে’
-“আরে বাসা পেলেই হলো।ভাঁড়া দেওয়া চিন্তার বিষয়না’
-‘তাহলে তোরা কাল সকালে রওনা হোস।আমি বাবার সাথে কথা বলে নেবো।ততদিন দেখি এদিকে বাসা পাই কিনা।তাহলে তোরা এখানে চলে আসিস’
-“থ্যাংক ইউ সো মাচ !!’
—
জুথি বাসায় ফিরে জানতে পারলো তার আর দশ দিন পর সিঙ্গাপুর যাবার ফ্লাইট।বাবা সব রেডি করে তারপর ফিরেছেন বাসায়।জুথি কাগজপত্র আর পাসপোর্ট নিয়ে একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে।মায়ের কাছে তার ওয়েস্টার্ন সব ড্রেস আছে।সুতরাং এখান থেকে বারতি জামা নিয়ে যেতে হবেনা।ফরহাদ জেদ ধরেছে সেও যাবে।কিন্তু বাবা ওকে যেতে মানা করলেন।কারণ দুই ভাইবোন চলে গেলে তার একা থাকা অনেক দুঃখের হয়ে দাঁড়াবে।
জুথি ব্যাগটা একপাশে রেখে বিছানায় বসে থাকলো।
-‘কুসুম যেভাবে তখন অর্ণবকে ধরেছিল তাতে মনে হয় ওদের মাঝখানে কোনো কিছুই আর বাদ নেই।অর্ণব এত সহজে সব ভুলে যেতে পারলো,আর আমি বোকা কিছু ভুলতে পারছিনা।
কেন পারিনা?
পারতাম অবশ্যই কিন্তু আমি তেমন স্বভাবের না যে আরেক ছেলের সহায় নিয়ে অতীত ভুলে যাব।মৃদুলকে আমি ইউস করতে চাইনা।আমাকে দিয়ে আর কাউকে ভালোবাসা হবেনা।
শুধু শুধু আমার সাথে সময় কাটিয়ে সে আমার প্রতি উইক হয়ে পড়বে অথচ এটার কোনো ফিউচার নেই।আমার পক্ষে সম্ভব না অর্ণবের বেস্টফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রেম জাতীয় কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলা।কিন্তু তাকে তো মানা করলেও শোনেনা।’
—–
মৃদুল বসে বসে তার ফোনে আজকের তোলা কিছু ছবি দেখছিল জুথির।
-‘কি প্রাণবন্ত একটা মেয়ে!এরকম মেয়েদের সাথেই কেন এসব ঘটনা ঘটে।তারপর তারা চুপচাপ হয়ে যায়?কেন এমন হয় তাদের সাথে?
আমাকে যখন একটা মেয়ে ধোকা দিয়েছিল সেসময়ে আমি ছিলাম চুপচাপ,ভদ্র স্বভাবের।এরপর ধোকা খেয়ে আমি হয়ে গেলাম মজার একটা মানুষ।ছটফটে।
দুজন মানুষ দুরুপে পরিণত হয়েছে চিট হবার পর।
আমার খুব ইচ্ছে হয় জুথির খারাপ লাগাগুলোকে দূর করে দেই।তাকে আমার মতন হাস্যজ্জ্বল জীবন উপহার দিই।তার মলীন মুখটা দেখলে খারাপ লাগে অনেক।এই মেয়েটা সেদিনই তো ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে কতইনা দুষ্টুমি করেছিল আর এখন সব থাকলেও তার মাঝে চঞ্চলতা নেই।’
—
অর্ণব ফোন রেখে ঘুমাচ্ছিল।মেসে থাকলে বই পড়তো এসময়ে।কুসুম বসে থাকতে থাকতে একেবারে বোর হয়ে গেছে।অর্ণব ওর সাথে অতিরিক্ত কথা বলেনা কখনও।দরকার পড়লে বলে তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
ব্যাগে চিরুনিটা রাখতে গিয়ে একটা কাগজ হাতে আসলো।এটা হলো ওর রিপোর্ট।আজ সকালেই হাসপাতালের একজন লোক এসে দিয়ে গেছে।তাড়াহুড়োতে ছিল বলে সে ব্যাগে পুরে নিয়েছিল।কাগজটা মেলে ধরে উল্টে পাল্টে দেখলো কিছুক্ষণ। সব ইংরেজীতে লেখা।এগুলো তো বোঝার কথানা।অর্ণবকে একদিন সময় করে দেখাবে ভেবে কাগজটা গুছিয়ে আবার সে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
অর্ণব এপাশ ওপাশ করতে যেয়ে খানিক চোখ খুলে দেখতে পেলো কুসুম বসে বসে বেনি খুলছে মুখটা কালো করে।
এটা দেখে সাথে সাথে উঠে বসে সে জিজ্ঞেস করলো এমনটা করার কারণ কি।
-“আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।মনে হয় মরে যাবো।মাথাটা বুঝি ছিঁড়ে যাচ্ছে।নাহলে বিশ্বাস করুন! এই বেনি আমি খুলতাম না ‘
-‘চা খাবে?’
-“নাহ।’
কুসুম আবারও বেনি খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অর্ণবের মন চাইলো চা খেতে।কিন্তু পাঁচ তলা থেকে নেমে চা খেয়ে আবার পাঁচ তলায় উঠার মন মানসিকতা তার আপাতত নেই।মেসে থাকলে এতক্ষণে হাজার কাপ চা খাওয়া হয়ে যেতো।হোটেলে আসে যারা দূরে থাকে তারা।আর আমি এই অঞ্চলের মানুষ হয়ে কিনা হোটেলে থাকছি এত কষ্ট করে।
হঠাৎ সে দেখতে পেলো কুসুমের চোখে পানি।হুট করে কান্না কেন করছে তার মানে বুঝতে না পরেে জিজ্ঞেস করলো কারণ টা কি।কুসুম জানালো সে বেনি খুলতে পারছেনা,মাথা ব্যাথায় কষ্ট হচ্ছে তার।
অর্ণব এগিয়ে গিয়ে ওকে সামনে বসতে বলে নিজেই বেনি খুলতে লাগলো।কুসুম বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে।
অর্ণব বেনি খুলে চুলে সিতা কেটে দিতে দিতে বললো,’তোমার মাথায় তেল লাগবে।তেল দিলে ব্যাথা চলে যাবে সব।চুলের গোড়াও মজবুত হবে।এরকম ছোট কারণে কান্না কেন করতেছো?তুমি তো সহজে কাঁদোনা।আজ পর্যন্ত তোমায় কত কি বললাম তাও কাঁদতে দেখলাম না আর সামান্য মাথা ব্যাথায় কাঁদছো?’
কুসুম মাথা ঘুরিয়ে বললো,’আপনি মাথা টিপে দিয়েছেন এখন বেশ ভালো লাগছে।আচ্ছা আমার সাথে চড়ুই পাখি খেলবেন?’
-‘সেটা কিভাবে খেলে?’
কুসুম ঘুরে বসে অর্ণবকে তার দুহাত বিছানায় রাখতে বললো।তারপর নিজের একটা হাত রেখে বাকি হাতের আঙ্গুল দিয়ে অর্ণবের হাতের আঙ্গুল গুনতে গুনতে বললো,’চড়ুই পাখি বারোটা,ডিম পেড়েছে তেরোটা,একটা ডিম নষ্ট, চড়ুই পাখির মনে বড় কষ্ট।এবার এই আঙুলটাকে গুজে রাখেন’
অর্ণব ফিক করে হেসে বললো,’এরপর সব আঙ্গুল শেষ হলে ধুরুম করে বাড়ি দিবা তাইনা?তবে জেনে রাখো এই গেম আমি জিতবো।হেহে!!’
অর্ণবের হাসি দেখে কুসুম ও হেসে ফেললো।
চলবে♥