লীলাবালি🌺 পর্ব-৬

0
2403

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬
আফনান লারা
.
-‘দেখ অর্ণব ভাইয়ার ব্যাপারে যেই শোনে সেই আশ্চর্য হয়ে বলে ভাইয়ার মতন মানুষ হয়না,তিনি খারাপ কি করে হোন।ভালো বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তোলে।মনে হয় সমাজসেবক।’

মিলির কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে তাকালো জুথি।এরপর বললো,’উনার সাথে”ভালো” শব্দটা যায়না।আব্বু কি ভেবে যে তাকে আজ বাসায় ইনবাইট করেছে তাই ভেবে পাইনা আমি’

-‘দেখ আবার তোকে প্রাইভেট পড়ানোর দায়িত্ব না দিয়ে বসে’

জুথি হাসতে হাসতে বললো,’বাংলায় আবার কিসের প্রাইভেট! ‘
——-
বিকাল হতেই অর্ণবের মা আর ভাবী ব্যস্ত হয়ে গেছেন একটা কাজে।
তবে কি কাজ সেটা কুসুম দেখলো না,বুঝলো ও না।রুমে কিসব শাড়ী নিয়ে কথা বলছেন দুজনে।কুসুম আর সেদিকে গেলোনা।অর্ণবের ওয়ারড্রবটা খুললো।এর আগে ধরে ধরে শুধু দেখেছে।খোলার সাহস পায়নি।এখন খুলেই পেললো।ওয়ারড্রব ভর্তি অণর্বের টি- শার্ট,পাঞ্জাবি।
সবগুলো থেকে ভালো গন্ধ আসছে।অর্ণবের মা মনে হয় তিন বছর ধরে খুব যত্নে রেখেছিলেন এগুলোকে।
একটা পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে দরজাটা আটকে আসলো কুসুম।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলালো আগে তারপর পাঞ্জাবিটা পরে নিজের বেনি নাকের উপর রেখে মোছ বানিয়ে বললো,’কে তুমি?আমার মায়ের ফোন তোমার কাছে কেন?’

এটা বলে হেসে দিলো।অর্ণব যদি এখন থাকত তাহলে কি হতো??আচ্ছা তিনি এখন কি করছেন?পড়ছেন??নাকি ঘুমোচ্ছেন?’

তাড়াহুড়ো করে পাঞ্জাবিটা খুলে আগের জায়গায় রেখে দিলো কুসুম।কেউ দেখে ফেললে লজ্জার কূল থাকবেনা।
—-
জনাব করিম সোফায় বসে বসে স্কুলের খাতা সাজাচ্ছিলেন।জুথি তার রুমেই ছিল।উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল।বাসায় জুথি আর তার ছোট ভাই ফরহাদ,বাবা আর দাদা -দাদি মিলে থাকে।মা সিঙ্গাপুর থাকেন।বছর দুয়েক পর পর আসেন।সেখানে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে থাকেন।মূলত তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক।জুথির বাবার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল ভার্সিটিতে পড়াকালীন।জুথির বাবা পড়ালেখার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন।
সেখানে তাদের প্রেম করে বিয়ে হয়।জুথির জন্ম সেখানেই হয়।কিন্তু জুথির দাদা দাদি চাইতেন জনাব করিম যেন বাংলাদেশেই থাকেন।একমাত্র ছেলে তাদের।জুথির মা মিসেস করিম আবার তার মা বাবাকে ছেড়ে আসতে পারবেন না।যার কারণে তাদের এভাবে আলাদা থাকতে হয়।তবে যখন কেউ একজন বিদেশে আসেন গুনে গুনে অনেক মাস থাকা হয়।জুথি আর ফরহাদের এখানে থাকার কারণ হলো তাদের দাদা-দাদি।ওরা নিজ থেকেই এখানে থাকার ডিসিশন নিয়েছে।
এমন করেই চলে আসছে। ফরহাদ ক্লাস টু তে পড়ে এখন।
এখন সে ঘুমাচ্ছে,দাদা দাদির রুমে তাদের সঙ্গে।
সে সময়ে কলিংবেল বেজে উঠলো।জুথি শুনতে পেয়ে ওড়না নিয়ে ছুটলো দরজা খুলতে।অর্ণব এসেছে।ওকে দেখে ভেঁংচি মেরে জুথি চলে গেলো।

-‘আরেহহ অর্ণব যে!কতদিন পর দেখলাম।এসো বোসো’

অর্ণব সালাম দিয়ে ভেতরে আসলো।জনাব করিম চশমা খুলে হেলান দিয়ে বসলেন।অর্ণব তার সামনে বরাবর বসে জিজ্ঞেস করলো তিনি কেমন আছেন।

-“বেশ ভালো।আমি তো সেদিন জুথির ভার্সিটিতে গিয়ে তোমায় এক নজর দেখেই চিনেছিলাম।তাই জুথিকে জিজ্ঞেস করেছি তোমায় চিনে কিনা।কত বছর পর দেখলাম।আগের মতনই আছো দেখছি।তা চোখে চশমা পড়েছে কেন?’

-‘কম্পিউটারের দোকানে জব করি।ট্রেনিং সেন্টার আছে।তেমন সমস্যা নেই।তবে মাঝে মাঝে পড়তে হয়’

-“তোমার বাবা মা কেমন আছেন?তারা তো কুমিল্লায় তাই না?’

-“জ্বী স্যার’

-‘তো শোনো তোমায় ডেকেছি একটা জরুরি কাজে।জানোই তো জুথি আমার একমাত্র মেয়ে।ওকে একা ছাড়িনা আমি।আর আমাদেরও দেশের বাড়ি কুমিল্লা।আমার ছোট ভাই কামরুলের বাসা ওখানে।তো তারা জুথিকে দেখেনা প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে।এবার ঈদে ওকে তারা দেখবেই দেখবে।তারা আসতে পারছেনা না দেশের বাড়িতে গৃহস্থের কাজ ফেলে।
জুথি এতদিন চট্টগ্রামে ছিল।আমার ট্রান্সফার একবার ঢাকায় তো আবার চট্টগ্রাম।আবার ঢাকায়।কি যে জ্বালা!!
ফরহাদ ছোট।বাসায় আমার বয়স্ক মা বাবা।জুথিকে সাথে নিয়ে কুমিল্লা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা।আমার ভাইয়ের সবগুলো মেয়ে।কোনো ছেলে নেই যে জুথিকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।আমি কাজ থেকে রেহাই পাচ্ছিনা যে ওকে দিয়ে আসবো।ঈদের সময় একটু ফ্রি থাকলেও বাবা মাকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব না।তাদের এমন হাল যে ধরে খাইয়ে দিতে হয়।বুঝোই তো।
তুমি যদি আমার এই উপকারটা করতে।তোমায় বলেছি কারণ তুমি ঈদে নিশ্চয় কুমিল্লায় যাবে?সাথে করে জুথিকে নিয়ে যেতে পারবেনা?তোমায় ভরসা করতে পারি।আমার কাছে পড়েছো কত বছর।পারবেনা?’

জুথি মনে মনে অর্ণবকে বকতে বকতে চা বানাচ্ছিল।এসব কিছু সে শোনেনি।অর্ণব প্রথমে রাজি হলোনা কারণ তার খেয়াল ছিল না কুমিল্লা যাবার।
যাওয়া মানেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা।পরে ভাবলো মা হয়ত বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারবে তাই হ্যাঁ বলে দিলো।জুথি চা নাস্তা নিয়ে এসে আবার নিজের রুমে ঢুকেছে।উনাদের মাঝে কি কথা হলো সে জানলোনা।অর্ণব চলে গেছে।
—-
মেসে ফিরে এসে মায়ের ফোনে কল করলো সে।সবার আগে জিজ্ঞেস করলো তাদের বাড়িতে কি কেউ এসেছিল আজ।মা স্বীকার করলেন না কুসুমের কথা।বললেন সকালে ঐ বাড়ির কজন এসেছিল ঘুরতে।অর্ণবও আর জেরা করেনি।শুধু বলেছে বাবাকে যেন মা ঠিকমত করে বোঝায়।
মা কুসুমকে দেখলেন টিভি দেখছে মনযোগ দিয়ে। তিনি অর্ণবকে লাইনে রেখে কুসুমের কাছে গিয়ে বললেন,’আমি এখন অর্নবের সাথে তোমার কত বলিয়ে দিব।তুমি তোমার নাম বলিওনা।কেমন?’

-“হ্যালো অর্ণব জানিস!আজ বিকালে মিশুর বাড়ির থেকে একজন মেহমান এসেছে।বাচ্চা একটা মেয়ে।গল্প শোনার জন্য বায়না করছে।আমি আর তোর ভাবী পিঠা বানাচ্ছি।হাতে কত কাজ আর সে গল্প শোনার জন্য পুরো বাড়ি মাথায় তুলছে।একটা গল্প শুনিয়ে দে না।তুই তো বাংলা পড়িস।কত উপন্যাস পড়িস একটা শুনিয়ে দে’

-“এ্যাহ??বাচ্চা মেয়ে?বয়স কত?ওগুলো ছোটদের শোনার মতন উপন্যাস না মোটেও।ওগুলো কেন শুনাবো?’

-“তাহলে হাট্টি মাটিম টিম শোনা! যেটা খুশি সেটা শোনা তাও কুসু!!ইয়ে মানে কাজলকে গল্প শুনা।মেয়েটা একটু থামুক।তার মনে শান্তি মিলুক’

অর্ণব বললো সে মিনিট কিনে কল করবে।মা আচ্ছা বলে ফোন রাখলো।কুসুমের ভয় করছে।অর্ণবের মা জোর করে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’সব বললেও যেন নাম না বলে’

দশ মিনিট পর অর্ণব আবার ফোন করেছে।কুসুম ফোন ধরে চুপ করে আছে।অর্ণব হালকা কেশে বললো,’আপনার নাম কি?’

-‘ককককাজল’

-“ওহ।মিশু ভাবীর কি হোন?’

-‘খালাতো বোন’

-“ওহ!কিসে পড়েন আপনি?’

-‘পড়িনা।’

-‘কতদূর পড়েছেন?’

কুসুম এবার এদিও ওদিক তাকালো।চাচি কোথায় যেন চলে গেছেন।কি উত্তর দেবে সে??তাও বুদ্ধি করে বুকে সাহস নিয়ে বললো,’গল্প শোনাবেন নাকি ফোন রেখে দেবো?’

অর্ণব থতমত খেয়ে বললো,’আপনার বয়স কত??সেটা অন্তত বলুন।সেরকম গল্প শোনাবো তাহলে।১-১০হলে মিনা রাজুর।১০-২০হলে অন্যগুলো’

কুসুম ভেবে কি বলবে বুঝছেনা তাও বললো দশের উপরে।অর্ণব ভাবছে কোনটা বললে ভালো হবে।পরে বললো চোখের বালি শোনাবে।আপাতত মাথায় সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের পড়াচ্ছে সেটা।
কুসুমের দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।কেমন যেন অনুভব হচ্ছে তার।অর্ণবের একবারের জন্য ও মনে হয়নি এটা কুসুম হতে পারে।
সে সংক্ষিপ্তে চোখের বালি গল্পটা বলে যাচ্ছে।
মাঝ পথে ওকে থামিয়ে কুুসুম বললো, ‘মা যাকে পছন্দ করেছে তাকে মহেন্দ্র বিয়ে করেনি কেন?’

অর্ণব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,’ছেলের পছন্দ হলো আসল পছন্দ।সারাজীবন সে ঐ মেয়ের সাথে কাটাবে তার মা কাটাবে না।তাই ডিসিশানটা ছেলের নেওয়া যথাযথ’

কুসুম চুপ করে থাকলো।বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের প্রেমকথা শুনে সে আবারও অর্ণবকে থামিয়ে বললো,’তাহলে যখন এই মেয়েকে তার পছন্দই হয়েছে তখন কেন সে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করলো এবার পরকিয়া হয়ে গেলোনা?’

অর্ণব বিরক্তি নিয়ে বললো,’বাচ্চা মেয়ে বাচ্চা মেয়ের মতন থাকবা।এত জেনে তোমার কি হবে?এত সম্পর্ক ভেদাভেদ তোমায় জানতে হবেনা।চুপচাপ শুনো আর ঘুমিয়ে পড়ো।কি সুন্দর ইন্টারেস্টিং একটা উপন্যাস বলছিলাম মাঝে মাঝে এত প্রশ্ন কেন করতেছো?তোমার জ্বলতেছে কেন?ঠিক করেছে বিনোদিনীকে বিয়ে না করে আশালতাকে বিয়ে করেছে।আবার ঠিক করেছে বিনোদিনীর সঙ্গে প্রেম করে।আমি মহেন্দ্রকে সাপোর্ট করছি’

কুসুম রাগ করে বললো,’আমার জ্বলছে কারণ আমি কুসুম।আপনি যদি আমায় পছন্দই না করেন তবে কখনও বিয়ে করবেন না জানি।কিন্তু পরে আমার প্রেমে পড়তে পারবেননা বলে দিলাম।এটা খুব খারাপ।ভালবাসলে একজনকে বাসবেন।এমন কারোর প্রেমে পড়বেন না যার সাথে প্রেম সমাজ মেনে নিবেনা’

অর্ণব আশ্চর্য হয়ে বসে আছে।এতক্ষণ সে কুসুমের সাথে কথা বলছিল??এই সেই কুসুম??কি তার কথার তেজ!!!
একবারও মনে হয় সে পড়ালেখা জানেনা!
কি তার যুক্তি!

অর্ণব চুপ করে থাকলো।কুসুম ও চুপ।অর্ণব এবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো,’আমি চাইনা আপনাকে বিয়ে করতে।বাবা মা জোর করে বলে এখন আমি বাড়ি থেকে এতদূর। আপনি এসেছেন ভাল কথা।তাদের একটু বুঝান।আপনি বুঝালে তারা বুঝবে’

কুসুম বিরক্ত হয়ে বললো,’আমি জানি আপনি আমায় পছন্দ করেন না।এ কথা আমি আরও অনেকবার তাদের বলেছি।কিন্তু তারা আপনার মত আর আমার মতকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না।কিন্তু আপনার মনের কথা শুনে বুঝলাম এই বিয়েটা অমঙ্গল ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবেনা।আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো বিয়ের কথা চাপা দেওয়ার।আপনি ভালো থাকবেন”

কুসুম ফোন রেখে দিলো।অর্ণব ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।ওপাশের মানুষটাকে হঠাৎ খুব দেখতে ইচ্ছে হলো।কি সুন্দর বোঝে!!!
যদি তার বয়স আরেকটু বেশি হতো আমি মানা করতাম না।কিন্তু!!
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here