#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮০
আফনান লারা
.
টাকা হাতে এসে গেছে।সেই টাকা নিয়ে সাগর ভাইয়া আর মিশু ভাবী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
একটা কথা সবার মাথা থেকে চলেই গিয়েছিল।আর সেটা হলো পাসপোর্ট।
না অর্ণবের পাসপোর্ট আছে আর না কুসুমের।পাসপোর্ট তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যাবে।এই কথা যখন মাথায় আসলো তখন অর্ণবের চিন্তা হাজারগুন বেড়ে গেলো।শুধু তাই নয়।বিদেশে যাবার যে পাসপোর্ট খরচ সেটা তো হিসাবই করেনি কেউ।
চিন্তায় তার মুখে যে হাসি ছিল সকালের দিকে, সেই হাসিটা গায়েব হয়ে গেছে এখন।মাথায় হাত রেখে মৃদুলকে ফোন করলো সবার আগে।সে তখন ভার্সিটিতে ছিল,স্যারদের সাথে একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিল বলে ফোন সাইলেন্টে রেখেছে।
ওকে না পেয়ে অর্ণব কুসুমকে রেখে একাই পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।পরে বাবা বললো যেহেতু কুসুমেরও পাসপোর্ট লাগবে হয়ত ওর ও প্রয়োজন পড়তে পারে অফিসে।
বাবার কথামতন কুসুম তৈরি হয়ে নিয়েছে যাবে বলে।অর্ণব ওকে নিতে চাচ্ছিলো না,কারণ তার শরীর এতই খারাপ যে ঠিকভাবে বসতেও পারছেনা।
—-
‘মৃদুল ভাইয়া একটু দাঁড়ান’
মৃদুল সেমিনার রুম থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছিল।একটা মেয়ের ডাক শুনে হাত ভর্তি ফাইল থেকে মাথা তুলে সামনে তাকিয়েছে।
গায়ে হলুদ রঙের লং ফ্রক আর গলায় ওড়না ঝুলিয়ে একটি মেয়ে ছুটে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’ভাল আছেন?’
‘খারাপ ছিলাম কবে?’
‘কি করছেন?’
‘মধু খাচ্ছি’
মেয়েটা এবার কপাল কুঁচকালো।কোমড়ে হাত রেখে বললো,’তোর এত কি সমস্যা আমার সাথে?ঠিক করে কথা বলতে পারিস না?অসভ্যের শেষ সীমা কোথাকার!’
তমাল মৃদুলের মতন ফাইল কতগুলো নিয়ে বেরিয়েছিল রুম থেকে।মেয়েটার মুখের ভাষা শুনে বললো,’এ্যাই তুমি জানো ও কে?এটা কি ধরনের ব্যবহার?একদম বিভাগীয় প্রধানের কাছে নালিশ করবো,আর ভাইয়া তুমি হা করে কি দেখছো?নালিশ করবে চলো’
‘প্রথমত, আমার ভাষা একেবারে ঠিক ছিল,টিট ফর ট্যাট যাকে বলে।দ্বিতীয়ত, আমি এই ভার্সিটির না।ভার্সিটি কেন,আমি তো কলেজেরই না।আমি ক্লাস টেনে পড়ি।এবার গিয়ে নালিশ করেন, যান’
তমাল চোখ কপালে তুলে বললো,’ওমা এই দুধের শিশু আমাদের ভার্সিটিতে এলো কি করে?এরে কে ঢুকতে দিয়েছে?’
মৃদুল পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল,মেয়েটা দেয়ালে হাত রেখে ওর পথ আটকে চোখ রাঙিয়ে বললো,’আপনি জানেন আমি আপনাকে পছন্দ করি,তাহলে কেন এমন করছেন?আমাকে পাত্তা দিতে আপনার কিসের এত কিপটামো?’
‘ভাইয়া তুমি ওরে চিনো?’
মৃদুল বিরক্তির স্বরে বললো,’আমার মুখের ভাষা খারাপ করবেনা।সামনে থেকে সরো।’
‘সরবোনা,কি করবেন?’
‘মৃদুল নিজের হাতের ফাইলগুলো তমালের ফাইলের উপরে রেখে দিয়ে পাঞ্জাবির হাতা তুলে বললো,’কি করবো?’
‘আপনাকে আমি ভয় পাইনা’
‘ছেলেরা হাতা তোলে মারার জন্য এটা ঠিক,তবে মৃদুল হাতা তোলে ভাষণ দেওয়ার জন্য।তো আমার ভাষণ শোনো।
যাকে বলে জরুরি তথ্য।
আমি বাচ্চা মেয়ে এজ অ্যা গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পছন্দ করিনা।সবসময় ম্যাচিউর মেয়ে পছন্দ করতাম।এখনও করি।আগে সিক্সে পড়তে,এখন টেনে পড়ছো।তাও তুমি আমার কাছে বাচ্চাই থাকবে।বিয়ে করার জন্য বাচ্চা মেয়ে আমার এক বিন্দুও পছন্দ না।কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও’
‘একজন ধোকা দিয়েছে বুঝলাম।তাই বলে আমি ধোকা দেবো সেটা কি করে ভাবেন?’
‘ধোকা দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?সরো তো।আজাইরা সময় নাই আমার হাতে ”
তমাল দশটা ফাইল একসাথে ধরে কাঁপা কাঁপা কদম ফেলছিল।মেয়েটার গাল ফুলা দেখে যেতে যেতে বললো,’আচ্ছা তুমি ভাইয়াকে চেনো কি করে?’
মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বললো,’আমি অনামিকার বোন’
কথাটা শুনে তমাল হাত থেকে সব ফাইলই ফেলে দিয়েছে।চোখ বড় করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’একই মাচার কুমড়োর স্বাদ একই রকম।এই কথা মৃদুল ভাইয়া জানে বলেই তুমি অল্প বয়সে পেকে যাবার পরও মেনে নেয়নি।বাই দ্যা ওয়ে,আমি পিচ্চি!! তুমিও পিচ্চি!চলো আমাদের পিচ্চি আনার প্ল্যানিং করি এবার।কি বলো?দেখো তুমি অতীতে একজনকে পছন্দ করতে এটা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘শাট আপ!আপনাকে আমি বিয়ে করবো?বডি দেখেছেন নিজের?আমাকে কোলে নিলেই তো ধপাস করে পড়ে যাবেন। এসেছে বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানিং নিয়ে।
‘বডি দিয়ে প্রেম হয় নারে পাগলী। ভাইয়া আসলে ঠিক বলেছিল,তুমি একটা দুধের শিশু।তোমার সাথে ব্রেক আপ।বাই’
‘আশ্চর্য! প্রেম হলো কখন যে ব্রেক আপ বলে চলে গেলো!’
—-
অর্ণব অফিসের কর্মচারীর সাথে কথা বলছে।এসময় টাতে কুসুমকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে এসেছিল সে।
বসে থাকাকালীন ওর হাতে একটা কাগজ আর একটা কলম লেগেছে।পাশের টেবিল থেকে তুলেছিল।
তাতে অর্ণবের নাম লিখলো।নিজের নাম ও লিখলো।তারপর তাতে কলমের কালি মোটা করে এঁকে ফুল আঁকলো।কি মনে করে জুথির নামটাও লিখলো।লিখেছে মিননয়ি।
তারপর সেই নামটা আবার কেটে দিলো।এরপর ফিক করে হেসে কাগজটা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেলেছে।
সে যেখানে বসে আছে তার ঠিক সামনেই দেয়ালে লাগানো বিশাল আয়না।কাগজটা লুকানোর সময় তার চোখ পড়েছিল ওটাতে।
আজ অনেকদিন ওর আয়না দেখা হয়না।অসুখ হলে কোন মানুষটা আয়না দেখার সময় পায়?
কুসুম ও পায়নি।এখন নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারলোনা।
এই মেয়েটা কে?চোখের নিচে কালো দাগ।ঠোঁট মুখ শীর্ণ।কেমন রোগা লাগে।যেন কতদিন কিছু খাওয়া হয়না।
‘এমন হাল হলো কেন আমার?আমি কি তবে মরে যাব?আমি মরলে উনি কি কাঁদবেন?এখন যেমন করে কাঁদেন?
তারপর কি বিনু খালার স্বামীর মতন আরেকটা বিয়ে করবেন?
সে ঘরে বাচ্চাকাচ্চা হবে।আরও কত কি!
যদি উনিও এমন করেন,সেটা নিশ্চয় আমি দেখবোনা।কিন্তু এমনটা যে করবেন তাই ভেবেই তো অশান্তি লাগছে।
তার স্ত্রী হতে পেরে কত খুশি হয়েছিলাম, সে খুশি শেষ হয়েছিল মিননয়ি আপু আর তার সম্পর্কের কথা জানার পর।এরপর আবারও আমার বোকা মাথায় ভালবাসার ফুল ফুটেছিল।ভেবেছি এইসব আমারই।আমিও সুখী হতে পারি।সময় আছে অনেককককক।
কিন্তু আজকাল মনে হয় সময় নেই বললেই চলে।বুঝি এখনই ঢলে পড়বো মৃত্যুর কোলে।আচ্ছা আমি যে মরবো বাবা মায়ের পরে আর কে কাঁদবে?
মিননয়ি আপু কাঁদবেন?উনি তো খুব ভাল।হয়ত কাঁদবেন।আমি মরেছি বলে না,আমার উনি কাঁদছেন দেখলে তারও কান্না এসে যাবে।
যদি উনাকেই বিয়ে করেন তিনি??’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খালি পা দিয়ে টাইলসে ঘঁষতে ঘঁষতে কুসুম আবার ভাবলো।উনি বিয়ে করলে মন্দ হবেনা।
আমার কারণে তাদের মাঝে যে দেয়াল খাড়া হয়েছিল,সেই আমার কারণেই ঐ দেয়াল বিলীন হয়ে যাবে।কি সুন্দর নিয়তি।মানে আপুর কপালে আমার তিনিই ছিলেন।মাঝখানে আমি এসেছি অতিথি পাখি হয়ে।মৌসুম শেষ,আমারও যাওয়ার পালা।
যদি তিনি মিননয়ি আপুর সাথে সুখে থাকেন তবে আমি চাইবো আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যাই।আমাকে তাহলে আর কষ্ট পেতে হবেনা,আর কাউকেও আমার অসুখ বয়ে কষ্ট পেতে হবেনা।একদিনে কাঁদুক,পরেরদিন সুখে থাকুক’
হঠাৎ পায়ে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে ভাবনার বাহিরে চলে আসলো কুসুম।চেয়ে দেখলো অর্ণব হাঁটু গেড়ে বসে ওর পায়ে জুতো পরিয়ে দিচ্ছে।কুসুম ওকে দেখে পা সরিয়ে নিয়ে বললো,’ছিঃ!পায়ে হাত লাগাচ্ছেন কেন’
‘ফ্লোর কত ঠাণ্ডা দেখেছো?খালি পায়ে যে থাকছো এত,জ্বর হলে কি হবে জানো?’
‘আমি পরে নিচ্ছি।আপনি হাত লাগাবেন না দয়া করে’
‘জুতো পরানো শেষ’
উঠে ওর পাশে বসলো অর্ণব।কুসুম মাথা নিচু করে বসে আছে।অর্ণব বললো,’অপেক্ষা করতে বললো।তোমার কিছু সই লাগবে।নিজের নাম লিখতে পারবে তো?’
কুসুম মাথা নাড়ালো।অর্ণব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল।সেসময়ে কুসুম ওর হাতঘড়িটা ধরে ফেললো।
অর্ণব থেমে ওর দিকে চেয়ে আছে এখন।
‘এগুলো কেন করেন?’
‘বললাম না,যেদিন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবে আমি সব দায়িত্ব ভাবি সেদিন বলবো এসব কেন করি’
কুসুম হাত ছেড়ে দিলো।ও চলে যাবার পর সে কাগজের আরেকটা পৃষ্ঠা নিলো টেবিল থেকে।সেটাতে অর্ণব,কুসুম নাম দুটো লিখছেই তো লিখছেই।থামাথামি নেই।
অর্ণব কলা,পাউরুটি নিয়ে এসে পড়তেই ও কাগজটা লুকিয়ে ফেলার বৃথা চেষ্টা করলো।অর্ণব দেখে ফেলেছে।খাবারগুলো ওর কোলে দিয়ে বললো,’কি লুকালে?’
‘কিছুনা’
অর্ণব ওর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দেখলো পুরো কাগজটা জুড়ে বিশ,বাইশবার করে অর্ণব কমা কুসুম লেখা।
কাগজ থেকে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো কুসুম মাথাটা একেবারে নিচু করে ফেলেছে লজ্জায়।
অর্ণব কাগজটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,’আর কোনো নাম শিখতে হবেনা?’
‘কি নাম?’
‘ধরো, তোমার আমার মেয়ের নাম’
কুসুম এত লজ্জা পেলো যে উঠে চলেই গেলো।অর্ণব বসে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখে ভাবছে সামান্য এ কথায় এত লজ্জা পাবার কি আছে।যাবার পথে কুসুম কাগজটা ফেলে গিয়েছিল।মিনিট দশেক পাশের করিডোরে ঘোরাফেরা করে আবার চলে এসেছে সে।অর্ণব খাবারের প্যাকেট গুছিয়ে রেখে অফিসারের সাথে কথা বলতে গেছে।চোরের মতন ওকে দেখতে দেখতে সিটে বসে কাগজটা তুলে হাতে নিয়ে দেখছে।এপাশে তারই লেখা অর্ণব কুসুম।কোনো কিছু খেয়াল না করে কাগজটা রেখে পাউরুটি ধরতে নিল সে, তখনই চোখ পড়লো কাগজটার উল্টো দিকে।
কাগজটার উল্টো পিঠ জুড়ে অর্ণবের হাতে লেখা অর্ণব,কুসুম আর আরও একজনের নাম।একটি মেয়ের নাম।
নামটি হলো”লিলি””
কুসুম নামটা দেখে ভাবছে অর্ণব এই নামটা কেন ঠিক করলো।ওকে আসতে দেখে কাগজটা সে রেখে দিছে।অর্ণব তার পাশে বসে বললো,’জানতে চাইবেনা লিলি নাম কেন রাখলাম?’
‘কেন?’
‘কুসুম নামের অর্থ ফুল,অর্ণব নামের অর্থ সমুদ্র।
আর লিলি হলো এমন একটা ফুল যেটা কিনা বিদেশে সমুদ্রের আশেপাশে ফোটে।মিনি হোয়াইট লিলি।
লিলি অর্থ বিশুদ্ধতার প্রতীক।তোমার সরলতার প্রতীক হবে আমাদের মেয়ে।
বাবা মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে দিতে হবেনা?’
কুসুম মুচকি হেসে কাগজটাকে ভাঁজ করে নিলো।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://facebook.com/groups/676436250036874/