#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮১
আফনান লারা
.
পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হতে হতে বেশ সন্ধ্যা নেমে গেছে।ব্যস্ত নগরী ঢাকার রাস্তার ব্যস্ততা যেন সবেমাত্র শুরু।কুসুমের হাত শক্ত করে ধরে কদমের পর কদম ফেলছে অর্ণব।উদ্দেশ্য একটা সিএনজি পাওয়া।
বাসে করে যাওয়া যেতো,বাস ভাড়া সিএনজির তুলনায় অনেক কম।যেখানে বাস ভাড়া ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা সেখানে সিএনজি ভাড়া দুইশ টাকা।কিংবা তার ও বেশি।এরপরেও সিএনজি করে যাবার আরও অনেক কারণ আছে।কুসুম বাসে জার্নি করতে পারবেনা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে।কষ্ট হবে তার।মূলত এ কারণেই সিএনজির খোঁজ করা।
খুঁজতে খুঁজতে ফুটপাত শেষ হয়েছে,শেষ হয়েছে ব্যস্ত রোড ও।অথচ এখন পর্যন্ত সিএনজির দেখা মিলছেনা।কুসুমকে একটা দোকানের বাহিরে দাঁড় করিয়ে সে নিজেই একটু সামনের দিকে দেখে আসতে গেলো।
প্রেমিক- প্রেমিকা,প্রবীণ,পথশিশু।বলতে গেলে এই জায়গায় মানুষের অভাব নেই।শান্ত হয়ে দাঁড়ানো দায় হয়ে যায়।অর্ণব কোথায় যে গেলো,এখনও আসার নাম নিচ্ছেনা।এদিকে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সহজবোধ্য ঠেকছেনা।তাই সে একাই ঐ জায়গা ছেড়ে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে।যেদিকে অর্ণব গিয়েছে সেদিকে।কিছুটা পথ এসে দেখলো পথ শেষ।বিশাল বড় বাউন্ডারি মাটি থেকে উপর পর্যন্ত।তবে কি তার ভুল হলো কোথাও?পেছনে ফিরে আবার সেই দোকানটা সে দেখলোনা যেটার সামনে এতক্ষণ সে অপেক্ষা করেছে।ঐদিনকার মতন আজও কি সে হারিয়ে গেছে?তবে কি করে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে উনাকে?
কপালের ঘাম মুছে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো সে।কোথাও অর্ণবকে দেখা যাচ্ছেনা।এদিকে মাথা ঘুরছে জোরে জোরে।যেন এক্ষুনি নিচে পড়ে যাবে।
মাথায় হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে সে জিজ্ঞেস করলো উনি সাদা পাঞ্জাবি পরা কাউকে দেখেছেন কিনা।ভদ্র মহিলা প্রথমে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
এই শহরে শত শত ছেলের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি দেখা যায়।তবে এই মেয়েটা কোন ছেলের কথা জানতে চাইছে??
তিনি উত্তর দিতে চাইলেন কিন্তু তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে কুসুম।
অর্ণব একটা সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসেছে কুসুমকে নিয়ে যেতে। এসে দেখলো কুসুম ওখানে নেই।এই জায়গায়,এই সিচুয়েশনে ওকে হারিয়ে ফেললে বিষয়টা কত মারাত্নক হবে তাই ভেবে মাথায় হাত চলে গেছে তার।
ওর চিন্তায় বিভোর হয়ে ফুটপাত ছেড়ে মেইনরোডে নেমে পড়েছে সে।
ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পর কিছুদূর আসতেই মানুষের ভীড় নজরে পড়লো।কুসুম হতে পারে কিনা,তার কিছু হয়েছে কিনা এসব ভাবনার সঙ্গে যুদ্ধ করে সে ঐ ভীড়ের কাছে এসে উপস্থিত হলো।ঐ ভদ্র মহিলা কুসুমের মাথা তার কোলে রেখে বোতল থেকে পানি নিয়ে ছিঁটাচ্ছিলেন।অর্ণব সামনে থেকে মানুষ সরিয়ে নিচে বসে এক টানে কুসুমকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।ওর মুখে ছিঁটানো পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,’কি হয়েছে ওর?’
‘আমাকে হয়ত তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, আমি কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলো।ওর কি হও তুমি?’
‘স্বামী’
কথাটা বলে অর্ণব ওকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো।দাঁড় করিয়ে রাখা সিএনজিতে এনে তুললো ওকে।ওরা এখন যে জায়গায় সেখানে দূর দূরান্তেও কেনো হাসপাতাল নেই।থাকলেও সেটা বহুদূর। কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বাবাকে কল করে জানতে চাইলো এই মূহুর্তে কি করবে সে।বাব ওকে জলদি বাসায় চলে আসতে বললেন কুসুমকে নিয়ে।তাই করেছে সে।ওকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসলো।মিশু ভাবী আর মা মিলে ওর হাত পা ঘঁষে,চোখ মুখে পানি দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারলেন না।
বাধ্য হয়ে কাছের একটা ফার্মেসী থেকে ছোটখাটো একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে সাগর ভাইয়া।
অর্ণব কুসুমের ডাক্তারকে দু তিনবার ফোন করেছে।তিনি ব্যস্ত থাকার ফলে রিসিভ করলেননা।
ব্রেইন টিউমার শুনে সাগর ভাইয়ার আনা ডাক্তার ভয়ে কোনো চিকিৎসা করেননি।বললেন যে হাসপাতালে ওর চিকিৎসা করানো হয়েছিল সেটাতেই নিয়ে যেতে।এখন কিছু করলে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে তো সবাই ওনাকেই দোষারোপ করবে।
অর্ণবকে কুসুমের কাছে রেখে সবাই বাহিরে বসে কথা বলছিল।সাগর এম্বুলেন্সে খবর দিচ্ছে।কুসুমের মা চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন।
—-
‘কুসুম!শুনতে পাও!!কি হয়েছে তোমার?বলবেনা?দেখো আমি তোমার পাশে।তোমার হাত ধরেছি।তাকাবেনা?লজ্জা পাবেনা?তোমার শরীর নড়ছে তো,বেশ দেখছি।ঠিকঠাক শ্বাস নিচ্ছো তাহলে কেন চোখ মেলে তাকাওনা কুসুম?’
কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলছিল সে।সেসময়ে মা ঢুকতে চেয়েছিলেন রুমে।ওকে আবেগী দেখে আর ঢুকলেননা।একা থাকতে দিলেন।
অর্ণব কুসুমের হাতের তালু ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’দেখো আমাকে ভয় দেখাবেনা।আমি জানি তুমি এখনই আমার দিকে তাকাবে।ফ্যাল ফ্যাল করে।তাকাও’
এরপরেও কোনো উন্নতি হচ্ছেনা দেখে অর্ণব কুসুমের আরও কাছে এসে বসলো।ওর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো,’আমি কিন্তু জুথিকে কখনও ছুঁইনি,মোট কথা জীবনে কোনো নারীকে ছোঁয়া হয়নি এমন করে।তোমায় ও ছুঁতাম না।কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ অনেক সময় ধরে তো!যেটা আমার সহ্য হচ্ছেনা।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।তোমার চোখ মেলাতে হবে।তার জন্য আমার মন আমাকে যে পথ দেখায় আমি সে পথেই চলবো।আমি জানি তুমি রাগ করবেনা আমার এই কাজে।দেখো এখনও সময় আছে চোখ মেলে তাকাও নাহলে যেটা ভাবছি সেটাই করে নেবো’
কুসুম চোখ মেললোনা।অর্ণব ওর মুখটা ধরে তাকিয়ে আছে।
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে কুসুমের মুখ থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,’আমি এটা পারবোনা যাও।আমাকে দিয়ে হবেনা।তুমি চোখ মেলো।আমাকে দিয়ে এত বড় সাহসের কাজ হবেনা।এত পরীক্ষা নিওনা।দেখো আমি কত কষ্টে আছি।একবার দেখো’
সব রেখে দু মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে ছিল সে।কুসুম যেন পাথর হয়ে গেছে।ওর এমন নিস্তব্ধ হয়ে থাকা তার গায়ে আগুনের লাভার মতন ঝরছে।
দম আটকে কুসুমের দিকে ফিরে বসলো পুনরায়।অসহায়ের মতন ওর দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে মাথা এগিয়ে এনে ওর ঠোঁটের খুব কাছে গিয়ে থামলো।সিনেমায় দেখে চুমু দিলে নায়িকার জ্ঞান ফিরে।
এটা সিনেমা নয়,বাস্তব।
তবে তাই হোক।সিনেমার মতন না হোক।
কুসুমের পিঠে হাত রেখে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো সে।
নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আস্তে আস্তে বললো,’আমায় আর একটিবার দেখো,আমি যে তোমার চোখ বন্ধ আর দেখতে পারছিনা।’
‘আমি তো ভাল আছি’
কুসুমের কথা শুনে অর্ণবের অশ্রু ঝরা থামলো।ওকে বুক থেকে সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
কুসুম অর্ণবের এমন হাল দেখে অবাক হয়ে আছে।কেমন অবস্থা করে রেখেছে সে নিজের সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে, এটা দেখে সে আশ্চর্য হয়ে বসে আছে।
—-
আজ ভোরে রওনা হবে জুথি আর তার পরিবার।বাবাকে কিছু জানানো হয়নি।সারপ্রাইজ দেবে মা তাই।
এদিকে জুথি মৃদুলের চিন্তায় শেষ।সে চায়না মৃদুল জানুক।
এদিকে এয়ারপোর্টের পাশাপাশি একটা হোটেলে রুম ভাঁড়া নিয়েছে মৃদুল।কাল সকালে গিয়ে এয়ারপোর্টে বসে জুথিকে ভিডিও কল দেবে।সে চায় জুথিকে হাতেনাতে ধরতে।হবু শাশুড়ির সাথে আলাপ ও হয়ে যাবে। একটা বুদ্ধি করে আগে থেকে কল করা বন্ধ রেখেছে সে।
এদিকে জুথি ভেবেছে ও হয়ত সব ভুলে কাজে ব্যস্ত বলে আর কল করছেনা।
তার কল না করার কারণ ওর কাছে অজানা।
—-
‘তুমি জানো? আমার তো জানটাই বের হয়ে আসছিল’
‘হুম বুঝতে পারতেছি’
‘কেন এমন ভয় দেখাও বলো তো??আমি তো ভেবেছিলাম!’
‘মরে গেছি,তাই তো?’
‘না,তা কেন ভাববো?।’
কুসুম হাত বাড়িয়ে অর্ণবের চোখের পানি মুছে দিয়ে ওকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে।
তখন কুসুমের মা কাঁদতে কাঁদতে আসতেছিলেন কুসুমকে একবার দেখতে।ওদের এমন অবস্থায় দেখে তিনিও চলে গেলেন অর্ণবের মায়ের মতন।ঢুকলেননা ভেতরে।
‘জানো আমি তোমায় বড্ড ভালবেসে ফেলেছি।তোমার বন্ধ চোখজোড়া আমার জানটা নিয়ে যাচ্ছিল আর একটুর জন্য।
আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।তোমায় ছাড়া কিসের মাঝে ছিলাম এতক্ষণ তা যদি তুমি দেখতে।বিশ্বাস করো!!মৃন্ময়ীর বেলায় আমার এই অনুভূতি হয়নি,তাকে হারিয়ে আমার এই কষ্ট হয়নি যতটা আজ হচ্ছিল।তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই ভালবেসেছি,এর আগে কাউকে না।’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://facebook.com/groups/676436250036874/