শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_১৯
#পলি_আনান
স্তব্দ খোলা আকাশের নিচে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে আরাফ।
রাত প্রায় এগারোটা, হৃদিতাকে খুজঁতে খুজঁতে ক্লান্ত সে।কয়েক মিনিট আগেই হৃদিতা ফোন দিয়ে তার অবস্থান সম্পর্কে জানিয়েছে।আরাফ বাড়ি ফিরে রাগে গিজগিজ করতে করতে ছাদে যায়।আজ হৃফিতা শুধু বাড়ি ফিরুক তবে আরাফ কি করবে সে নিজেও জানেনা
বাড়িতে ডুকতেই একে একে সবার কাছে জবাবদিহি করতে হয় হৃদিতাকে।বাড়ির বেশ কয়েকজন কুৎসিত ভাবে গালমন্দ ও করেছে তাকে। তবে সেদিকে কান না দিয়ে আগে আরাফকে খুঁজতে রুমে আসে।আরাফকে রুমে না দেখে ক্লান্ত হৃদিতা আগে সিধান্ত নেয় ফ্রেশ হয়ে নেবে।আজ সারাদিন ব্যস্ত সময় পার হয়েছে তার।
আরাফ রুমে ডুকে হৃদিতাকে দেখতে না পেয়ে আড় চোখে চারিদিকে তাকিয়ে চোখ বুলায়।হঠাৎ দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে আরাফ পেছনে ঘুরে তাকায়। গোসল সেরে হৃদিতা আরাফকে দেখেই ঢোক গিলে সে যানে আজ আরাফ রেগে আছে।
– আরাফ!
হৃদিতার ডাক আরাফের কর্ণকুহরে পৌছালো না।সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে স্বচ্ছ শুভ্র নির্মল হৃদিতার দিকে।টপটপ পানিয়ে পীঠের বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গেছে আরাফ সেদিকে তাকিয়ে চোখ বুলিয়ে নেয়।হৃদিতার চোখে চোখ রাখতেই তার রাগ যেন তড়াক করে বেড়ে যায়।দ্রুত হৃদিতাত দু’বাহু খামছে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
– কোথায় ছিলি?কোথায় ছিলি তুই?
– আহ!আরাফ ছাড় আমার লাগছে।
আরাফ হৃদিতার কথা শুনলো না বরং আরো জোরে দুই বাহু চেপে ধরে ঝাকিয়ে বলে,
– প্রশ্ন করেছি উওর দিবি,আর কোন কথা আমি শুনতে চাইনা।কোথায় ছিলি তুই?
– ক কবিরের বাড়ি!
হৃদিতার মুখে কবিরের নাম শুনতেই তাকে দেয়ালের সাথে ছিটকে সরিয়ে বিছানার চাদর খামচে বসে যায় আরাফ।আগেও ভার্সিটিতে কবিরের সাথে মেলামেশা মোটেও পছন্দ করতো না আরাফ। আজ যখন জানতে পারে হৃদিতা এত রাতে কবিরের সাথে ছিল তখন রাগটা আরো প্রকট ভাবে ধারন করে।নিজের রাগটা সামলাতে নিজেই নিজের উপর জোর খাটাচ্ছে কিন্তু রাগটা মোটেও থামছে না। এই মূহুর্তে যদি কাউকে বেদম পেটাতে পারতো তবেই আরাফের শান্তি হতো।
– কবিরের সাথে কি তোর?
– রেগে যাচ্ছিস কেন?আগে সম্পূর্ণ কথাটা শোন আমার।
– রেগে যাচ্ছি মানে কি?আমি তোকে আমার প্রশ্নের পালটা প্রশ্ন করতে বলিনি। ভেবে নিস না বন্ধু হিসেবে জিজ্ঞেস করছি।বাড়ির বউ এত রাতে বাড়ির বাইরে ছিল আর হাজবেন্ড হিসেবে আমি জবাব চাইতেই পারি।বল কি করছিলি তোরা?
– কবিরের ছোট বোন কেয়ার আজ জন্মদিন ছিল।আমার টিউশনের সামনেই তারা দাঁড়িয়ে ছিল আমার জন্য। বিশ্বাস কর আমি জানতাম না,মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে আমিও। সে চায় আমাকে নিয়েই কেক কাটবে তাই আমাকে জোর করে সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলো।আমি তোকে জানাতাম ঠিকি কিন্তু আমি তো ফোন নিতেই ভুলে গেছি আজ।তুই চেক কর ফোন ডয়ারেই আছে।এদিকে তোকে জানাবো জানাবো ভেবেও সবার আনন্দ মজলিশে ভুলে যাই পরে তো জানিয়েই দিলাম।সরি রে, আমি জানি তোরা চিন্তা করছিলি।
– ব্যস এইটুকুই?সরি বললেই হয়ে গেলো?
– আরাফ প্লিজ তুই শান্ত’হ।
– কবিরের বোন তোকে এতই ভালোবাসে যে তোকে নিয়ে কেক কাটতে চাইছে নিশ্চই পরবর্তী বায়না জুড়বে তার ভাইয়ের বউ বানাতে?কি আমি ঠিক বলছি তো?
– আরাফ বিষয়টা এত বাজে ভাবে নিচ্ছি কেন তুই?
হৃদিতার চিৎকারে আরাফ দ্রুত এগিয়ে এসে হৃদিতার মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে যায়।
-হিসসস আওয়াজ নিচে!খবরদার গলার আওয়াজ চওড়া করবি না।
হৃদিতা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আরাফের দিকে।চেহারা একদম উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।হৃদিতা মাথা নাড়াতেই আরাফ তার হাত সরিয়ে নেয়।
– একটা কথা এই শেষ বারের মতো বলছি,তোর সাথে আমি যেন কবিরকে আর না দেখি মাইন্ড ইট!
– আজব!এইসব কি, তুই কিন্তু আমার ফোর্স করছিস।সে আমার বন্ধু হয় এর থেকে বেশি কিছু না।
– আমিও বন্ধুই ছিলাম তারপর বর!
আরাফের যুক্তিহীন কথায় হৃদিতার বেশ রাগ লাগে।মুখে হাত দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলে,
– আমি তোকে ভালোভাবে বলছি আরাফ।আমি কবিরকে জাস্ট বন্ধু ভাবি।আরেকটা কথা আমি যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে চলবো সেটা আমার ব্যাক্তি স্বাধীনতা।তোর সাথে আমার পথ চলা আর মাত্র কয়েকদিন তারপর প্রভা তোর জীবনে আমার জীবনেও হয়তো অন্য কেউ…
হৃদিতা কথা শেষ করার আগেই আরাফ তার চুলের মুঠি টেনে ধরে।
– তোর জীবনে অন্যকেউ মানে? অন্য কেউ মানে কি?
– কেন তুই প্রভাকে পেয়ে যাবি আমি কেন অন্য কাউকে পাবো না?
– তুই কখনো কারো সাথে নিজের জীবন জড়াবি না।তুই আমার চোখে চোখে থাকবি!
– প্রভা কি থাকতে দেবে আমায়?তুই আমাকে চাস নাকি প্রভাকে চাস আরাফ?
– আমার তো তোকে চাই।বুঝিস না কেন তোকে চাই।
আরাফের প্রত্যুত্তের হৃদিতা ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।উত্তেজিত হয়ে আরাফ সত্যিটা বলে ফেলেছে।
হৃদিতার চোখের দিকে তাকিয়ে আরাফ থেমে যায়।দ্রুত বিছানায় বসে হাটুতে হাত দিয়ে মাথা নুইতে নেয়।সব কিছু তার কাছে পাগল পাগল লাগছে। হৃদিতা আরাফের অবস্থা বুঝতে পেরে তার সামনে এগিয়ে আসে,মেঝেতে বসে আরাফের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়।
– আরাফ,তোর কি ইচ্ছে আমাদের পথচলা সারা জীবনের জন্য হোক,নাকি ক্ষনিকের?
– দেখ হৃদিতা তোকে আমি চাইলেও পাবো না।
– কিন্তু কেন তোর কিসের এত ভয়?
– আমি যদি তোকে আমার করে রাখি তবে নোমান ভাইয়ের আদরের বোন প্রভার কি হবে?তুই জানিস প্রভার মা বাবা নেই।নোমান ভাই তার একমাত্র দূর্বলতা। এদিকে নোমান ভাই প্রভার কোন চাওয়া ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি।আমি তোর দিকে অগ্রসর হলে নোমান ভাই তোর ক্ষতি করবে।তোর খালা,খালু সবার ক্ষতি করবে। আমার হাত পা অদৃশ্য শেকলে বাধা।
হৃদিতা দাঁড়িয়ে যায়। আরাফের দিকে অভিমানী সুরে বলে,
– ঠিক আছে তুই তোর রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়।কোন দিন আমার কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবি না।তুই আমাকে খুব শীঘ্রই ডির্ভোস টা দিয়ে দিস আমি কবিরের সাথেই আমার বাকি জীবন কাটিয়ে নেবো।
হৃদিতার কথা শেষ হতেই আরাফ আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকায়
– খুন করে ফেলবো আমি যদি দুইটাকে একসাথে দেখি।তুই বিয়ে করতে পারবিনা তোকে আমি কারো সাথেই সহ্য করতে পারবো না।
আরাফের কথাটা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু হৃদিতার চড় তার গালে পড়তে দেরি হলো না।
– কাপুরুষ তোকে আমি এই চড়টা আগেই মারা উচিত ছিল।নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে।আমাকে কি তোর হাতের পুতুল মনে হয়।ইচ্ছে হবে ধরবি ইচ্ছে হবে ছাড়বি।
হৃদিতা আরাফের কাছে আরেকটু এগিয়ে আসে। তার শাটের কলার ধরে বেশ রাগ নিয়ে বলে,
– তুই আমাকে ছেড়ে যাবি? যা সমস্যা নেই যা।কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না।একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কেউ আলাদা করতে পারবে না আমায়। মনে রাখিস তুই।বিয়ে যখন একবার করেছি আর সেই বিয়ের পূর্ণতা দেবো আমি।দেখি তোর প্রভা কি করে কেড়ে নিয়ে যায় তোকে।
লেখনীতে পলি আনান।
হৃদিতার কথার উলটো পিঠে আর কোন জবাব দিল না আরাফ। হৃদিতার সামনে হাটু মুড়ে বসে টলমল চোখে আবদার ছুড়ে দেয় হৃদিতার কাছে,
– জীবনে কোন ঝড় আসলে আগলে রাখতে পারবি আমায়?আমি না বড্ড ভীতু অন্য কোন বিষয়ে নয় শুধু তোর জন্য। যদি তোর কিছু হয়ে যায় আমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবো না রে।
হৃদিতা আরাফের সামবে হাটু মুড়ে বসে যায়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।আরাফের শার্টের কলারটা খামছে ধরে কাদঁতে কাদঁতে বলে,
– পারবো, পারবো আমি তুই শুধু আমার পাশে থাকিস।
আরাফ হৃদিতাকে জড়িয়ে নেয়।অসংখ্য ভালোবাসার পরশ একে দেয় হৃদিতার চোখে মুখে।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জন জীবনের ব্যস্ততা বাড়ছে।মাইশা আর নোমানের সম্পর্কের পূর্ণতা অতী দ্রুত চায় নোমান।তাই দুই সাপ্তাহের মধ্যেই তাদের এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান করবে বলে সিধান্ত নেয় নোমান।কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় প্রভা আগামীকাল বাংলাদেশে আসবে বলে সিধান্ত নেয়।একদিকে নোমানের বিয়ে অন্যদিকে আরাফের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে বিডিতে আসার কথা ছিল তার আগেই।
সব মিলিয়ে বাড়িতে আনন্দ বিরাজ করলেও আনন্দ নেই হৃদিতা এবং আরাফের মাঝে।তারা এখন পরিপূর্ণ স্বামী স্ত্রী। কিন্তু প্রভা তাদের জীবনে ফিরে এলে কি করবে তারা।
ত্রমশ রাত গভীর হচ্ছে কিন্তু ঘুম নেই হৃদিতা আর আরাফের চোখে।
– হৃদিতা আমার আজ রাতে ঘুম হবে না রে।কি করবো আমি।প্রভা কাল বিডিতে এলে সব এলো মেলো হয়ে যাবে।
– চিন্তা করিস না তুই যা হবে ভালোর জন্যই হবে।
– মানে কি তুই আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবি তা ভালোর জন্য হবে।
হৃদিতা প্রত্যুওর করলো না। চুপচাপ ভাবতে থাকে।
– হৃদিতা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
– কি?
– তুই কাল সকালে সবাইকে বলবি তুই প্রেগন্যান্ট দেখবি তাহলে বাড়ির কেউ আমাদের আলাদা করতে চাইবে না।আর যত ঝড় তুফানি হোক আমি বাহানা জুড়ে দেবো আমি আমার সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারবো না।
– এইসহ লেইম বুদ্ধি তোর মাথায় থাকে। আজব একটা বাচ্চা নিয়ে আমি মিথ্যা বলতে পারবো না।ঘুমা তুই?
আরাফ বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে যায়।হৃদিতা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে।ভাবতে থাকে কী হবে তাদের ভবিষ্যত।
#চলবে….