শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_৭
#পলি_আনান
দুপুরের রোদে পুকুরপাড়ে বসে আছে হৃদিতা।উঠানে উড়ে বেড়ানো কবুতর গুলো গম ছুড়ে দিচ্ছে।এক ঝাক কবুতর টিনের চাল থেকে উড়ে এসে উঠানে হৃদিতার দেওয়া খাবার খুটে খুটে খাচ্ছে; বিষয়টা এক মনে তাকিয়ে উপভোগ করছে হৃদিতা।কিন্তু তার দিকে দুটো চোখ নিষ্পলক ভাবে,তাকিয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ।পুকুর পাড়ের শেষ প্রান্তে লম্বা দুটো কড়াই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আরাফ।তার চোখ দুটো তৃষ্ণার্ত! হৃদিতাকে দেখার তৃষ্ণা তাকে আকুল করে দিয়েছে। টানা চারদিন হৃদিতা বাড়ি থেকে বের হয় নি। গত কাল বিকাল থেকে রাতের আটটা পর্যন্ত গাছ তলায় আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল আরাফ শুধু মাত্র হৃদিতাকে দেখার জন্য।পুকুরের বিপরীত পাশের দিকটায় ঝোপঝাড়ে আবৃত তাই প্রয়োজন ছাড়া কেউ সেদিকটায় তেমন যায় না কিন্তু ব্যাকুল আরাফ দিনের অর্ধভাগ অপেক্ষা করছিল হৃদিতার আশায়।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর যেন আজকে শেষ হলো। বেলা এগারোটার সময় এদিকটায় এসে হাজির হয় আরাফ।আর হৃদিতা একটার কিছুক্ষন পরেই পুকুর পাড়ে এসে বসে।
সেদিন নেহাকে ফোন করে ইনিয়েবিনিয়ে হৃদিতার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আরাফ।পরবর্তীতে জানতে পারে সেদিন মধ্যে রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর হয় হৃদিতার।তাই ভার্সিটিতে নিয়মিত ক্লাসে যেতে পারছে না সে।তারপর থেকেই চিন্তার পোকারা ভর করতে থাকে আরাফের মাথায়।নিদ্রাহীন, খাওয়া বিহীন আরাফ একমনে হৃদিতার চিন্তায় মগ্ন থাকে।হৃদিতাকে দেখার আকুলতা তাকে বার বার গ্রাস করে। তাই উপায় না পেয়ে কাল থেকেই হৃদিতাকে এক পলক দেখার জন্য এইভাবে অপেক্ষায় থাকে।বেশ কয়েকবার হৃদিতাকে ফোন করা হয় কিন্তু অভিমানী হৃদিতা আরাফের ফোন তুলে নি।
হৃদিতার পরা গাঢ় নীল ওরনাটা দিয়ে মাথার চুল সহ কপাল পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে সে।তবুও পুকুরের ওই পাড় থেকে একপাশটা স্পষ্ট দেখতে পারছে আরাফ।
– এহন তো সুস্থ হইসো তাহলে এইবার কামে হাত লাগাও।
সুফিয়ার কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকায় হৃদিতা।মাথার ওরনাটা আরেকটু টেনে কাচুমাচু হয়ে বসে সে।সুফিয়া তার বিপরীত পাশের ঘাটে বসে।
– কি হইলো কথা কওনা কেন?আর কত কাম করবো আমার নাতনিটা?এবার একটু হাত লাগাও।
– নেহা আপুতো সব কাজ করে নিয়েছে আমাকে আর কি কাজ করতে হবে?আর তো কোন কাজ নেই।
হৃদিতার কথায় ফিচেল হাসেন সুফিয়া।
– একটু আগে যে খাওন গিল্লা আইছো হেই গুলা কে ধুইবো?যাও পাকের ঘর থেকে থালাবাসন আর পাতিল গুলা ধুইয়া ঘরে তুলো।
গত চারদিন টানা ঘরে থেকে শরীরটা যেন অনায়ত্ত হয়ে গেছে তার। তাই একটু বাইরে আড়মোড়া কাটাতে প্রকৃতির হাতছানি নিতে এসেছে। কিন্তু সুফিয়ার কথা শুনে জ্বর যেন মাথা চওড়া দিয়ে এসেছে।
হৃদিতা উঠে গিয়ে পাকের ঘরে যায়। তিনটে পাতিল সাথে কিছু থালাবাসন নিয়ে পুকুর ঘাটে নেমে ছাই দিয়ে ধৌত শুরু করে।দূর থেকে আরাফ হৃদিতার কান্ডকারখানা দেখছে। এখনো সুস্থ হয়নি এই মেয়ে অথচ কাজ করতে লেগে গেছে।নিশ্চই এই বুড়ি দাদী খুঁচিয়ে খুঁচিতে এতক্ষন কিসব বলেছে তাই এই মেয়ে জ্বরের মাঝেও কাজ করছে।আরাফের ভীষণ রাগ লাগছে তবুও তার কিচ্ছু করার নেই।
তখনি আরাফের ফোনে আইদার কল আসে,
– হ্যালো দাদাভাই কোথায় তুমি?
– দূরে আছি কেন?
– আমার কোচিং আছে আমাকে একটু কোচিং এ পৌঁছে দিয়ে আসো না দাভাই।
– কেন ছোট চাচ্চু আর চাচিমা কোথায়?
– বাবা আর মা আজ বাইরে গেছে এখনো আসেনি।ফোনটাও সুইস্টপ।
– তুই একা চলে যা। দাভাই এখন দূরে আছি।
আরাফের কথা শুনে রেগে গেলো আইদা।
– তোমার বিড়াল কাল আমার পায়ে কামড়ে ক্ষত করে দিয়েছে। সেই বজ্জাত বিড়ালের কারনে আমি ঠিক মতো হাটতে পর্যন্ত পারছিনা আর তুমি বলছো একা যাবো?
– তোকে বলেছিনা হৃদিকে বিড়াল বলবিনা আর ভুলেও হৃদিকে বকবিনা বলে দিচ্ছি।দোষ তোর ও আছে কে বলেছে তোকে হৃদির লেজ ধরে টানতে।আর না হাটতে পারলে যাওয়ার কি প্রয়োজন আজব বুঝিনা আমি।
– তোমার মতো আমি পড়া চোর নই দাভাই।আমি আমার পড়া উসুল করার আগ পর্যন্ত কোচিং থেকে বাড়ি ফিরিনা।আজ কোচিংএ পরিক্ষা আছে আমায় নিয়ো চলো প্লিজ।
– বেশি পক পক করিস।দেখবো এই পড়া লেখা করে কোন মহা ভারত তুই শুদ্ধ করিস। বাই দা ওয়ে আমি আসছি অপেক্ষা কর।
আরাফ পকেটে ফোন পুরে হৃদিতার দিকে তাকায়।এখনো নুইয়ে নুইয়ে থালাবাসন ধৌত করছে সে।আরাফ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।দুহাত দিয়ে মাথার চুল টেনে আবারো তাকায় তার প্রেয়সীর দিকে।
– আরাফের ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুইটাতে কখনো দাগ লাগতে দেয় না।অবহেলা পেতে দেয় না।কষ্ট পেতে দেয় না।তাই তোমার নিশ্চই সুদিন আসবে অপেক্ষায় থাকো।
কেন্টিনে বসে লিবান, শাকীল আর নাফিসার সাথে আড্ডায় মশগুল আরাফ।দীর্ঘ চারদিন পর সে আজ ভার্সিটিতে এসেছে।আসার কথা না থাকলেও তিন বন্ধুত জোরাজোরিতে তাকে আসতে হয়েছে।
– এই লাইব্রেরিতে চলনা প্লিজ আমার কিছু বই লাগবে।
নাফিসার কথা শুনে কপাল কুচকে নেয় আরাফ।
– কিরে পড়ালেখা শুরু করলি নাকি?হঠাৎ বইয়ের জন্য এত তাড়া?
– ইয়েস বস, পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছি ফাইনাল এক্সামের এক মাসও বাকি নেই।এতদিন অনেক আড্ডা মাস্তি হয়েছে এবার অন্তত পড়ায় মন দে।
-আমার ম্যাম আসছে না। সো আমার পড়ালেখাও আপদত বন্ধ।
আরাফের কথা শেষ হতে চট করে লিবান প্রশ্ন করে,
– হ্যা তাই তো ভাবছি হৃদিতা আসছে না কেন?মেয়েটার তুই খোঁজ নিস নি আরাফ?
– না তার খোঁজ নেওয়া আমার কাজ না।আচ্ছা এবার আমাদের লাইব্রেরিতে যাওয়া উচিত।
লিবানের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সবাইকে নিয়ে লাইব্রেরির দিকে যায় আরাফ।কিন্তু লাইব্রেরিতে গিয়ে এমন একটি সিন দেখবে তা মোটেও ভাবে নি সে।হৃদিতা আর কবির একসাথে বসে আছে।কবির হৃদিতাকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে পড়া বোঝানোর চেষ্টায় মগ্ন।বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও আরাফের কছে বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না।লাগবে কি করে হৃদিতার পাশে কোন ছেলে কে দেখা আর আরাফের মাথায় আগুন লাগা সমান কথা।
– ওই হৃদিতা এসেছে।
নাফিসার কথায় ঘাড় কাত করে আরাফ।ভেতটায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলেও এই মূহুর্তে বন্ধুদের সামনে কোন প্রতিক্রিয়া করা যাবে না। তাই নিজেকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে ধাতস্ত করে।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান
একটি টেবিলের হৃদিতা আর কবির মুখোমুখি বসে আছে হুট করে আরাফ ধড়াম করে কবিরের পাশের চেয়ারে বসে পরে।আকস্মিক এমন কান্ডে হৃদিতা চকিতে তাকায়।কিন্তু আরাফকে দেখেই উদ্দীপ্ত চোখ দুটো শান্ত হয়ে যায়।চোখ দুটো শান্ত থাকলেও ভাবধারায় যেন রাগ ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে।কবির আরাফকে দেখেই একটু নড়েচড়ে বসে।আরাফ হৃদিতার চোখে চোখ রাখতেই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় হৃদিতা।হালকা গোলাপি রঙের শার্টের এলোমেলো কলার দু হাত দিয়ে টেনে ঠিক করে নেয় আরাফ।তার সাথে সাথে পেশিবহুল হাতটার স্লিভটা কোনুই পর্যন্ত উঠিয়ে কবিরের দিকে ঘাড়ঘুরিয়ে তাকায়।কাজ গুলো আরাফ শান্ত ভাবে করলেও, বিষটি যেন কবিরক মারার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।দূর থেকে শাকীল লিবান আর নাফিসা আরাফের কান্ডকারখানা দেখছে।
– উরিম্মা,আরাফ এমন করে কেন?কিছু কি বুঝলি নাফু?
শাকীলের প্রশ্নে নাফিসা আবারো আরাফকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কিন্তু নিদিষ্ট কোন উওরে সে সীমাবদ্ধ হতে পারছে না। আরাফ কি করতে চাইছে?
– না রে এখনো কিছু বুঝতে পারছিনা। গত চারদিন হৃদিতাকে পড়াতে আসেনি। আজকে যাও এলো কিন্তু কবিরের সাথে ব্যস্ত বিষয়টি আরাফের খারাপ লাগার কথা কিন্তু তাতে আরাফের কি সে তো পড়াচোর; না পড়লে তো বেঁচে যায়।
– আমিও তা জানি কিন্তু আরাফের ইশারা ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কবিরকে মারবে। দেখ কেমন করে তাকাচ্ছে কবিরের দিকে।
– দূর কিসব ফাউল কথা বলছিস?আমাদের আরাফ এইসব মারপিটে নেই।
– ভুলে কি যাচ্ছিস নোমান ভাইয়ের রক্ত আরাফের শরীরে বইছে। আর নোমান ভাই যা আগুন সেই আগুনের কিছুটা তাপ আরাফের গায়ে লাগারি কথা।
– সেই সব আমাদের ভেবে কাজ নেই চল আমরা ক্লাসে যাই। ক্লাস সময় হয়ে গেছে।
তারা তিনজনেই দ্রুত ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।
এদিকে আরাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদিতার দিকে।এতদিন না দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে একদিনে।
– এখানে কি চলছে? আর পিচ্চি আমাকে পড়াতে আসিস নি কেন?
আরাফের মুখে পিচ্চি ডাকটা শুনেই অবাক দৃষ্টি ভঙ্গিতে তাকায় কবির।কবিরকে এই মূহুর্তে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার তাই কবিরের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– এখন কি তোমার কোন কাজ আছে?আমি পিচ্চির সাথে কিছু কথা বলবো তুমি যাও।
সহসা কবির ব্যাগ নিয়ে চলে যায়।আরাফের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে গেলেই বিপদ।
ক্লাস শুরু হওয়ায় লাইব্রেরিতে থাকা সবাই বেরিয়ে যায়।বাকি থাকে হৃদিতা আরাফ আর একটি মেয়ে।কিছুক্ষণ পরে সে মেয়েটিও চলে যায় তখনি হৃদিতা ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয়।যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আরাফ ব্যাগ টেনে আবার বসিয়ে দেয়।হৃদিতা বিরক্ত অঙ্গভঙ্গি নিয়ে আরাফের দিকে তাকায়।
– কি হচ্ছে এইসব।
– খবরদার আর এক পা বাড়ালে এখনে তুফান হতে যাবে বলে দিলাম।
– হলে হোক আমি বাড়ি যাবো।
আরাফ আর কথা বাড়ালোনা।সে যানে হৃদিতা কেমন মেয়ে অন্তত এই দুইদিনে সে বুঝে নিয়েছে হৃদিতা তাকে মোটেও ভয় পায়না বরং আগুনের মাঝে তুষ দিলে যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে।ঠিক তেমন আরাফ রেগে গেলে হৃদিতা তার রাগ আরো দুইগুন বাড়িয়ে দেয়।আরাফ উঠে গিয়ে লাইব্রেরির দরজাটা বন্ধ করে দেয়।ছিটকিনি লাগাতে গিয়ে আবারো থেমে যায়। কি মনে করে ছিটকিনি না লাগিয়ে আবার ফিরে আসে হৃদিতার কাছে।
– এবার বল আমার সাথে এতদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিস কেন?আমি জানি তোর জ্বর কিন্তু তবুও ফোন ধরিস নি একটা মেসেজের এন্সার দিস নি কারনটা কি?
– আমার ইচ্ছে হয় নি তাই ফো ধরিনি।
– আমাকে পড়াবে কে?
– আমি জানিনা তবে আমি আর তোকে পড়াতে পারবো না। আর হ্যা তোর নোমান ভাইকে যা করার করে নিতে বলিস তবুও তোকে পড়াবো না।
– আমাকে না পড়ানোর কারনটা কি?
– আশা করি সেদিন বিকালের পর আর কোন কারন তোর জানতে চাইবার কথা না।আমি গেলাম গুড বাই!
হৃদিতা আবার উঠতে নিলেই আরাফ হৃদিতার হাত টেনে বসিয়ে দে।এবং নিজেও টেবিলের উপর উঠে বসে।আরাফ আর হৃদিতা এখন মুখোমুখি। না চাইলেও হৃদিতা দৃষ্টি সরাতে পারছে না।
– সেদিন কি হয়েছিল আমাদের মাঝে?খারাপ কিছু তো হয়নি তুই শুধু শুধু নিযে থেকে বিষয়টা খারাপ করছিস।
– তুই একা একটা মেয়েকে পেয়ে কি সব উলটা পালটা কথা বলেছিস।তোর কাছে আমি এক চুল পরিমানেও নিরাপদ নয়।আমি আর তোর সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চাইনা।
হৃদিতার কথা শুনে আরাফের মাঝে অনুশোচনার সৃষ্টি হয় কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ না করে উলটো হৃদিতাকে রাগ দেখায়।
– তুই সত্যি আমাকে পড়াবি না তাইনা?
– না পড়াবো না।
– ওকে তোকে একটা ভিডিও দেখাই বাকিটা সিধান্ত তোর।
আরাফ একটি ভিডিও হৃদিতার সামনে ধরে।বিষটি কয়েকদিন আগের।পশ্চিম বাজারে হৃদিতার খালু ওয়ালীদের সাথে দোকান করে এমন একটি যুবক চাঁদা না দেওয়ায় এবং এর সাথে নোমানের লোকদের সাথে তর্ক করার বেশামাল ভাবে মারা হচ্ছে তাকে।কয়েক মিনিট ভিডিওটা দেখেই শরীরের রক্ত হিম হয় যায় হৃদিতার। মাথা নুইয়ে বলে,
– প্লিজ বন্ধ কর।
আরাফ বন্ধ করে হৃদিতার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো।
– তোর খালুর সাথেও নোমান ভাই এমনটা করবে। যদি আমাকে না পড়াস এবার বল আমাকে পড়াবি?
– হ..হ্যা।
হৃদিতার সম্মোতিতে আরাফের মুখে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি।
এদিকে তিনদিন থেকে রুমে বন্ধীনি হয়ে আছে মাইশা।বিডিতে যাওয়ার জন্য সব গোছগাছ করতেই বিষটি তার বাবা আঁচ করতে পারেন।একপর্যায়ে এইসব বিষয় নিয়ে বাবা মেয়ের প্রচুর তর্কবির্তক হয় উপায় না পেয়ে তার বাবা বাইরে থেকে তাকে বন্ধী করে কাজে চলে যান। খাওয়ার সময় একজন মেড এসে খাওয়ার দিয়ে যায় এই ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া তার বারন। বন্ধী রুমে নোমানের কথা ভাবা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার। সকাল থেকে নোমানকে বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করলেও সে ফোন রিসিভ করেনি।অবশেষে এই মূহুর্তে ফোন রিসিভ করলো নোমান।
– এই মেয়ে কি সমস্যা তোমার?এইভাবে একাধারে
ফোন দিয়ে যাচ্ছো কেন তুমি?
– তুমি ফোন রিসিভ করছো না কেন নোমান?
– আমার কি তোমার ফোন রিসিভ করা ছাড়া আর কাজ নেই নাকি। এখন রাখছি
– নো নো নো ভুলেও কল কাটবে না। না হলে আমি কিন্তু বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করবো। সেটা আশা করি তোমার জন্য আরো বড় বিপদ বয়ে আনবে।
– কেন ফোন করেছো তা বলো?
– আমাকে বাবা বাড়িতে বন্ধী করে রেখেছে আমি তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য রাস্তা পাচ্ছিনা
প্লিজ নোমান হেল্প মি!
– আংকেল ঠিক করেছে একদম সঠিক কাজটাই করেছে। তোমাকে উচিত শেকল দিয়ে বেধে রাখা কারন তুমি তো মেন্টালি সিক পার্সন।
– নোমান!এইসব কি ধরনের কথা আমি তোমায় ভালাবাসি আর তুমি আমায় পাগল বলছো?
– তো কি? আমার কাছে ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই ব্যস্ত আছি।এইসব পাগলামি ছেড়ে পড়াশোনায় মন দাও। তোমার টাকাওয়ালা বাবা তোমাকে একটা ভালো পজিশনে নিয়ে যেতে পারবে।দেখবে অনেক টাকার মালকিন হয়ে যাবে।
– আমার কিচ্ছু চাইনা। টাকা চাইনা আমার।আমার তোমাকে চাই নোমান।প্লিজ আই নিড ইউ।
– আমাকে প্রয়োজন ওকে নিশিরাতে চলে এসো। নিশিরাত ছাড়া মেয়েদের কোন মূল্য নেই নোমানের কাছে।
নোমানের উওরে বেশ রাগ লাগলো মাইশার।সারা শরীরে কেউ যেন আগুনা জ্বালিয়ে দিয়েছে।দ্রুত ফোন কেটে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় এতটা অবহেলা কেন করে নোমান তাকে?তাকে কি ভালোবাসা যায় না।একদিন আসবে এই মাইশা নামের মেন্টাল সিক পার্সনটার জন্য তুমি পাগল থাকবে দেখে নিয় নোমান।শুধু মাত্র আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি।
লাইব্রেরিতে থাকা বড় বড় বইয়ের তাক গুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদিতা।আরাফকে পড়া দিয়ে লাইব্রেরির চারদিকটা ঘুরে দেখছে।এদিকে আরাফ পড়া রেখে তার চাল-চলনের কার্যকলাপ দেখছে। দেয়ালের কোনার দিকটায় সবচেয়ে উচু তাকে একটি বই দেখেই দৃষ্টি আটকে যায় হৃদিতার।দ্রুত সেই বইটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়েলে খেয়াল করে বইটি তার নাগালে নেই।লাফিয়ে ঝাপিয়ে বইটা নেওয়ার নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য।আরাফ দূর থেকে হৃদিতার কান্ড দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।
হৃদিতা আরো বেশ কয়েকবার বইটি নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য হওয়ায়।আশে পাশে চেয়ার খোঁজার জন্য চোখ বুলায়।হঠাৎ সে অনুভব করে তার পেছনে কেউ আছে কিন্তু কে? দ্রুত পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সাথে ধড়াম করে বারি খায় সে।বিরক্তে মুখ কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে এই ছেলেটা তো আরাফ।আরাফ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
– এমনি এমনি তোকে আমি পিচ্চি বলিনা। দেখ সামান্য একটা বই নিতে পারিস না।
হৃদিতা সহসা তার চোখ নামিয়ে নেয়।আরাফের প্রশস্ত বুকটার দিকে তাকিয়ে হৃদিতা নিজেই ভড়কে যায়।আরাফের বুকের শেষ প্রান্তে হৃদিতার মাথা গিয়ে ঠেকেছে।মানে কি এই ছেলের সামনে দাঁড়ানো আর নিজের হাইট নিয়ে লজ্জায় পড়া একই ব্যাপার।
হৃদিতাকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাফ নিঃশব্দে হাসে।হঠাৎ আরাফ উপলব্ধি করে হৃদিতা স্বাভাবিক নেই সে কাঁপছে।আরাফ দ্রুত বইটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে হৃদিতাকে টেনে এনে চেয়ারে বসায়।হৃদিতা তার হাত ঝাকড়া মেরে সরিয়ে দিতে গেলে আরাফ আরো শক্ত করে আঙুলের ভেতর আঙুল ভাজ করে হৃদিতার হাত জড়িয়ে ধরে।
– ত..তুই সুস্থ নেই হৃদিতা।আজ ভার্সিটিতে কেন এসেছিস?
– আমি সুস্থ। তুই আমার হাত এইভাবে ধরেছিস কেন?ছাড় আমাকে।
হৃদিতার কন্ঠ কাপঁছে।হুট করেই তার জ্বর আবার বেড়ে গেছে।
– উহ’হু একদম চুপ। হঠাৎ করেই তোর জ্বর বেড়েছে।আমি তোর শরীরের তাপ উপলব্ধি করতে পারছি।
– আ..আমি ঠিক আছি। তুই আমার হাত ছাড় প্লিজ।
হৃদিতার কন্ঠস্বর কাঁপছে।মুখ দিয়ে কথা বলাটাও তার জন্য এখন বড্ড কষ্টের।
– আরাফ তোর হাত ধরেছে অন্য কেউ নয়।প্লিজ সত্যি কথা বল ডাক্তার দেখিয়েছিস?
– না।আর আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। ওষুধ খেয়েছি।এবার ছাড় আমায় আমি বাড়ি যাবো
হৃদিতা আরাফকে তার হাত ছাড়তে বললেও আরাফ উল্টো আরো শক্ত করে ধরে।
– ওষুধ খেয়েছিস মানে?চারদিনের জ্বরে শুধু ওষুধ খেলেই চলবে না কি?দ্রুত আমার সাথে এখন ডাক্তারের কাছে যাবি।
– ছাড় আমাকে আমি বাড়ি গেলেই ঠিক হয়ে যাবো।
হৃদিতার তর্কে এবার বেশ রেগে যায় আরাফ। ধমকের সুরে চিৎকার দিয়ে বলে,
– বাড়ি গেলে ঠিক হবি মানে?বাড়িতে গেলে ঠিক হবি মানে কি?পুকুর ঘাটে রোদের মাঝে থালাবাসন ধুলে তুই ঠিক হয়ে যাবি নাকি?
আরাফের কথায় চমকে তাকায় হৃদিতা। মনে পড়ে যায় গত কালকের দুপুরের কথা মানে কি আরাফ যানলো কি করে?
– ক.. কি বলছিস তুই?
– ভুল কিছুতো বলিনি! মনে রাখবি তুই চাইলেও না চাইলেও দুটো চোখ তোকে সারাক্ষণ পাহাড়া দেয়।তাই নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করলেও এই দুটি চোখ থেকে আড়াল করা তোর সম্ভব নয়।
#চলবে….