#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৪
মসজিদের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে অসহায় ভাবে বসে আছে রনি। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সাজ্জাদ আর আঁখির ঝগড়া দেখে ও ক্লান্ত। ওদের মাঝে গেলে উল্টো ওকে মারছে। রনি উপায় না পেয়ে অর্নব আর আশিককে ফোন করেছে। ওরা আসছি বলে এখনও আসছেনা। পুলিশের ভয়েই হয়তো আসছেনা। যদি আসতো তবে অন্তত এতক্ষন ওর একা একা অসহায়ের মতো বসে থাকতে হতো না। ওর ভাগ্যটাই খারাপ আঁখি আর সাজ্জাদের মাঝে ফেসে গেছে। আঁখি গালে হাত দিয়ে অন্য দিকে মুখ করে রেগে বসে আছে। সাজ্জাদ ও ওর দিকে একেবারেই তাকাচ্ছে না। পুলিশ ওদের ধরে মসজিদে নিয়ে এসেছিলো। ওরা খুব বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু পুলিশ মহোদয় ওদের একবারের জন্যও ছাড়েনি। যদি ছাড়তো আখি ততক্ষনাৎ পালিয়ে যেতো। ওদের মসজিদে এনেই ইমামকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। তখন থেকেই একজন আরেকজন কে দোষ দিচ্ছে। সাজ্জাদ বলছে আখির দোষ আর আঁখি বলছে সাজ্জাদের দোষ। রনি আসলেই বুঝতে পারছেনা দোষটা কার? আঁখি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও সাজ্জাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো।
“সব আপনার জন্য হয়েছে। আপনি জেনে শুনে এমন করেছেন। এবার আমি আব্বুকে কি বলবো?”
সাজ্জাদ বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকালো। ও নিজেও তো ঝামেলায় পড়েছে। বাড়িতে ওর বাবাও বিয়ের কথা বলছে। এখন ওর বাবা তার বন্ধুকেই বা কি বলবে। সাজ্জাদ যেমনি হোক ও চায়না ওর বাবার মানসম্মান একটু কমুক। এলাকায় জানাজানি হলেও তো বিরাট সমস্যা। এলাকায় এর একটা নামডাক আছে। সাজ্জাদ বাজে চিন্তায় ভুগছে আর আঁখি তখন থেকে একেই কথা বলে যাচ্ছে। সাজ্জাদ রেগে ওকে ধমক দিয়ে বললো।
“এই চক্ষু! একদম চুপ! তখন থেকে পকপক করেই যাচ্ছে।আমার মাথাই গরম করে দিয়েছে। কি বলবে তা পাকনামি করার আগে মনে ছিলো না? যা করতে এসেছো সেটাই বলবে। মুরগি ধরতে এসে নিজেই মুরগি হয়ে গেছে এবার বুঝো অন্যের পিছে লাগার মজা! ফাজিল কোথাকার!”
সাজ্জাদের কথা শুনে আঁখি হা করে ওর দিকে তাকালো। ওকে ফাজিল বলছে? ও তো মেয়েট ফাজিল নয় যথেষ্ট শান্ত সভ্য। আবার ওর নামটাকে নিয়েও অসম্মান? তাও এই রনির সামনে? আঁখি রেগে বসা থেকে উঠে সাজ্জাদের সামনে গেলো। কোমরে হাত দিয়ে আঙুল উচিয়ে চিল্লিয়ে বললো।
“এই একদম বাজে কথা বলবেন না। কি ভাবেন নিজেকে? হুম? এত ঝগড়া মারপিট পারেন তো পুলিশকে থামাতে পারলেন না কেনো? আসছে পারোনি। কত পারেন তা জানা আছে। কে ফাজিল হুম? এক নাম্বার ফাজিল আর টাউটবাজ তো আপনি আবার আমায় বলছেন? আপনার ভাগ্য ভালো যে আপনাকে পুলিশে ধরার আগেই বেঁচে গেলেন। নাহলে এতক্ষণে জেলে থাকতেন!”
সাজ্জাদ কপাল কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
“জেলের থেকে কম কষ্টে আছি? এর থেকে জেলে থাকাই বেটার ছিলো। তোমার মতো মেয়ের সাথে থাকার চেয়ে জেলে বসে মশার কামর খাওয়াও অনেক শান্তির বুঝেছো? গলা না যেনো বাস, চিল্লিয়ে কালা বানিয়ে দিলো।”
আঁখি সাজ্জাদের কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে ওর দিকে তাকালো। ইনডাইরেক্টলি কি ওকে ঝগড়া আলী বলেছে? করেছে? ওর থেকে জেলে থাকাও ভালো? এত্ত বড় অপমান? তখন তো মিথ্যে বললেই ওকে জেলে পাঠানো যেত। এটা মনে হতেই ওর কপাল চাপরাতে মনে চাইলো। এই সাজগাজের যখন জেলে যাওয়ার ইচ্ছা তো জেলে পাঠালেই পারতো। আঁখি কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
“এত জেলে থাকার শখ তা আমাকে বললেই পারতেন। আমি তখন বলতাম আমি নিজে আনিনি আপনারা জোর করে এনেছেন তাহলেই তো হতো। চলুন এখন পুলিশের কাছে বলে আপনার জেলে থাকার শখটা পুরন করি।”
ওর কথা শুনে সাজ্জাদ খুব রেগে গেলো। এই জিনিসটার সমাধান কি হবে সেটাই ভাবতে ছিলো কিন্তু ওর পক পকানিতে কিছুই পারছেনা। সাজ্জাদ রেগে সিঁড়ি থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। আঁখির সামনা সামনি দাড়িয়ে বললো।
“এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো আর একটা কথা বললে। বেয়াদ্দব মেয়ে! ঝগড়া আর ঝামেলা ছাড়া কিছু পারো না তুমি? যেদিন থেকে আমার লাইফে আসছে সেদিন থেকেই এটা ওটা ঝামেলা করেই আসছে। এত কথা বলতাছো কেনো হুম? আমি কি তোমায় এনেছিলাম? নাকি তুমি নিজে এসেছো? এখন আবার এত কথা বলছো কেনো? নিজের দোষে বিপদে পড়েছো। আমি এর দায় নিতে পারবো না। যেখানে ইচ্ছা যাও! এখান থেকে সরো! Go! Leave now!”
সাজ্জাদের কথা শুনে আঁখি ভয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাজ্জাদের রাগে ও অনেক ভয় পেয়েছে। রনিও ঢোক গিয়ে একটু নড়ে চরে আবারও গালে হাত দিয়ে বসলো। ওর মনে হচ্ছে ঝগড়ায় এবার নতুন ভাবে মোড় নিয়েছে। এতক্ষণ একরকম চলতে চলতে একঘেয়েমি চলে আসছিলো। সাজ্জাদ নিজের মাথার চুল মুঠ করে ধরে অন্যদিকে ফিরে গেলো। আঁখি এখন চুপ করে দাড়িয়ে আছে। ভয়ে মাথা ওঠাচ্ছে না যদি থাপ্পড় দেয়? সাজ্জাদ ওকে যেতে বলেছে এই রাতে একা ও কোথায় যাবে? বাড়িতে গিয়েই ওর বাবাকে কি বলবে? ওর বাবাকি ওকে মারবে নাকি বকবে? যদি ওর বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়? তাহলে কোথায় যাবে? সাজ্জাদও হয়তো মেনে নিবে না। নিলেও ওর সাথে তো থাকা যাবেনা। যেখানে শত্রুতা সেখানে বন্ধুর হাত বহুত দূরে। এতক্ষণে আঁখির মাথায় সঠিক চিন্তা ভর করলো। আঁখি ভাবতে ভাবতে একটু সামনে এগিয়ে গেলো। ভাবলেশহীন ভাবে একটি গাছের নিচে বসলো। রনি তাকিয়ে তাকিয়ে দুজনের কাজ দেখছে। তিনজনেই চুপচাপ বসে আছে। গভীর রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। শরহের সবাই ঘুমন্তু। হঠাৎ করে অর্নব আর আশিক ওদেক কাছে তাড়াহুড়ো করে এসলো। অর্নব এসেই রনিকে বললো।
“কি হয়েছে মামা! এত জরুরি ডাকলি কেনো?”
ওদের দেখেই রনি রাগি চোখে তাকালো। লাফ মেরে দাড়িয়ে অর্নবের পিঠে কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে বললো।
“শালা বেইমান! দেখে গেলি পুলিশে ধরছে আর এসে জিজ্ঞাসা করছোছ কেনো ডাকছি? আমাদের জন্য একটু চিন্তা হয় নায়? যে ওরা কোথায় আছে পুলিশে কি করলো? বিপদেই বন্ধুর আসল পরিচয়। তোরা দুজনেই হারামী। দেখ আমি সাজ্জাদের পাশে রয়ে গেলাম বন্ধুর মতো।”
রনির কথা শুনে সাজ্জাদ কপাল কুচকে ওর দিকে তাকালো। অগত্যা ওর কাছে এসে গালে হালকা থাপ্পড় দিলো। রনি গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ আরেকটা থাপ্পড় মেরে বললো।
“মেরেছি কেনো বুঝোছ নি?”
রনি মাথা নাড়ালো। মানে ও বুঝেনি। অর্নবও পিঠে হাত দিয়ে ওদের কাহিনী দেখছে। ওরা দুজনও কিছু বুঝেনি।সাজ্জাদ রনির দিকে তাকিয়ে বললো।
“বিনা দোষে যে অর্নবকে মারলি তাই মারলাম। তুই অর্নবকে বলতাছোছ? ভুলে গেছোছ? তুই নিজেও গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড় দিতে লাগছিলি? শুধু পুলিশ ধরে ফেলছে তাই। নাহলে আমায় একা রেখেই পালাতি।”
রনি ধরা খাওয়া চোরের মতো আমতা আমতা করতে লাগলো। অর্নব এসব বাদ দিয়ে সাজ্জাদকে বললো।
“এসব ছাড়! কি হয়েছে সেটাই বল?”
সাজ্জাদ ওদের সব কিছু বললো। সব শুনে অর্নব আর আশিক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। আশিক বোকা চোখে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।
“সাপে সাপে বিয়ে শুনেছি কিন্তু সাপ আর বেজিতে বিয়ে হয় তা তো শুনি নি। সংসার করবি কি করে তোরা? সারাদিন তো সাপ আর বেজির মতো ঝগড়া করোছ!”
“এই আমি সংসার করবো সে কথা তোকে কে বললো? এটা কি বিয়ে? এখানে দুজনের কেউয়েই রাজি ছিলাম না। সো বিয়ে হয়নি৷ এখন আঁখি ওদের বাড়ি চলে যাবে আর আমি আমাদের বাড়ি। এই কথা শুধু আমাদের চারজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যদি বাইরে যায় তবে খবর আছে।”
ওর কথা শুনে সবাই অবাক হলো। অর্নব সাজ্জাদের পিঠে হাত রেখে বললো।
“কি যা তা কথা বলতাছোছ? মসজিদে বসে বিয়ে হয়েছে। বিয়েটা যেভাবে হোক হয়েছে এখন তোরা হাসব্যন্ড ওয়াইফ। তুই যা করতে চাইতাছোছ তাতে গুনাহ হবে।”
সাজ্জাদ ওর কথায় পাত্তাই দিলোনা ওরা অনেক বোঝালো কিন্তু মাথায় নিলো না। আঁখি এখনও চুপচাপ বসে আছে। সাজ্জাদ আঁখির কাছে গিয়ে বললো।
“দেখো! বিয়েটা দুজনের অমতে হয়েছে। এটা কোনো বিয়েই না একটা এক্সিডেন্ট। তাই আমি চাচ্ছি না এ বিষয়ে কেউ জানুক। এসব ভুলে গেলেই ভালো। তুমি তোমার বাড়ি আর আমি আমার বাড়ি আগের মতোই থাকবো। চলো!”
আঁখি অবাক চোখে সাজ্জাদের দিকে তাকালো। কি বলছে এসব? বিয়ে নিয়ে ছেলে খেলা? সাজ্জাদ কে বিয়ে করে আবার নিরবের বউ হবে? এটা তো পাপ? এবার কি করবে? আঁখি করুন চোখে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ কিছু না বলে সামনে আাগালো। আঁখি উপায় না পেয়ে ভাবলেশহীন ভাবে ওর পিছে পিছে চললো। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। দুজনের কেউ কারো সাথে কথা বলছেনা। আঁখি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। হালকা বাতাসে ওর মাথার ওড়না দোলছে। সাজ্জাদ কয়েকবার আর চোখে ওর দিকে তাকালো। আঁখিকে মন মরা দেখে ওর একটুও ভালো লাগছেনা। আঁখিকে হাসিখুশি আর ঝগড়ার চেহারায় ভালো মানায়। এসব ভেবেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো মন দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই আঁখি ভাবলেশহীন ভাবে নেমে পড়লো। সাজ্জাদের সাথে কথা না বলে ছোট ছোট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আঁখি শব্দহীন ভাবে পথ চলছে যেনো কেউ জানতে না পারে। আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো যাতে কেউ জেগে না যায়। কেউ দেখলেই হাজার প্রশ্ন করবে। আখি দরজা বন্ধ করে ড্রইং রুমে আসতেই দেখলো ওর মা বাবা সোফায় বসে আছে। আমিনুর রহমান ও রোকেয়া রহমান দুজনেই রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। আঁখি ভয় পেয়ে পা চলা থামিয়ে দিলো। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে চুপচাপ ভাবতে লাগলো প্রশ্ন করলে কি জবাব দিবে? আঁখির গলা শুকিয়ে আসছে। যদি জেনে যায় তবে ওর কি অবস্থা হবে?
সাজ্জাদ গাড়ি রেখে আস্তে করে বাসার সামনে গেলো। যাদি কেউ যেনে যায় সেই ভয়ে আস্তে করে দরজা খুললো। ভিতরে পা রাখতেই দেখলো ওর বাবা আশরাফ খান গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে আছে। পাশে ওর মা বোনও আছে। সাজ্জাদ অবাক হয়ে তাকালো। ওর বাড়ির সবাই জেগে আছে কেনো সেটাই বুঝতে পারলো না।
ইনশাআল্লাহ চলবে….