শরতের বৃষ্টি পর্ব-২৬

0
2212

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৬

রাত প্রায় শেষ হতে চললো। হালকা কিছু প্রহর বাকি আছে রাত শেষ হতে। আজ রাতে দুতলায় দু পরিবারের কারো চোখে ঘুম নাই বললেই চলে। আমিনুর রহমান নিজের রাগ আর ইগুকে দমন না করতে পেরে মেয়ের সাথে করা করা কথা বলেছেন তবে মনের কোথাও না কোথায় খারাপ লাগা কাজ করছে৷ তবে তার একটাই রাগ। মেয়েকে এত ভালোবাসা আর স্বাধীনতা দেওয়ার পরেও কেনো এমন একটা কাজ করলো। পুরো এলাকায় কলেজে তার মানসম্মান শেষ হয়ে গেলো। তাছাড়া নিরবের বাবা জানতে পারলে কি হবে? তাকে কি বলে বুঝ দিবেন। সারা রুম জুড়ে পায়চারী করছে আর এসব ভেবে চলেছেন। মিসেস রেকেয়া রহমান তো তখন থেকেই মেয়ের জন্য কেদে অস্থির।
আশরাফ খান কপালে হাত দিয়ে রকিং চেয়ারে দুলছেন। একেবারে নিরব হয়ে আছেন তিনি। এতবড় ছেলের গায়ে হাত তুলে কাজটা একেবারেই ঠিক করেননি। কোনো দিনও হাত তুলেননি আজ একেবারেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। প্রচুর রেগে গিয়েছিলেন। তার ভিতর অনেক অনুশোচনা কাজ করছে। যদিও ছেলে ভুল করেছে তাই বলে গায়ে হাত তোলাটা বেমানান। এই মারটা ছোটবেলায় মারা উচিত ছিলো। তবে আজ একটু হলেও ভদ্র হতো। এতটা বিগড়ে যেতনা। এই বিয়েতে যে অখুশি হয়েছেন তেমন না তবে একটু কষ্ট পেয়েছেন। তাকে জানালে তো অমত করতেন না খুশিতে মেনে নিতেন। এতটা মান সম্মান ও যেতনা। কপালে হাত দিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছেন তিনি। এত ভেবেও সামনে কি হবে সে হিসাব যেনো কিছুতেই মিলাতে পারছেন না।

ছাঁদে শক্ত করে রেলিং ধরে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে সাজ্জাদ। খুব বেশি রেগে আছে ও। কিছুতেই রাগটা কন্ট্রোল করতে পারছেনা। ওই অন্ধকার আকাশের দিকে ওর স্থির দৃষ্টি। বিশাল আকাশটা একেবারেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনটা একেবারেই ভালো নেই ওর। রাগ কষ্ট অভিমান সব মিলিয়ে একাকার হয়ে আছে। আজ প্রথম ওর বাবা ওকে মেরেছে। এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। ছোট থেকে অনেক ভুল করেছে কিন্তু কখনও মারেনি আজ কি ও বড় ভুল করেছে? কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি হলো। ওরা ভেবেছে একটা হয়েছে আরেকটা। যা ওদের প্লান তো দূরে ধারনার বাইরে। আজ বিকালে অর্নব, রনি আশিক আর ও মিলে কত প্লান করেছিলো। বলেছিলো আজ রাতে বাসার থেকে লুকিয়ে বন্ধুরা মিলে সিলেট ট্যুরে যাবে। এখানে বিয়েটাও আটকে যাবে ওদের আনন্দ ফুর্তিও হবে কিন্তু ভাগ্যের কথা কেই বা বলতে পারে? আঁখির পাকনামির জন্য সব গন্ডগোল হয়ে গেলো। ও নিজে তো বিপদে পারলোই ওকে নিয়েই পড়লো। সাজ্জাদ রেগে রেলিং এ ঘুষি দিলো। সারারাত কি এখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি বুঝতে পারছেনা। আঁখিকেও তো পাচ্ছেনা। ওকে ছাড়া বাসায় যাওয়াটা নিরাপদ নয়। ওই মেয়েকে পেলে ও আজ কি করবে নিজেও জানে না। কিন্তু কি আর করার সকাল ছাড়া ওকে পাওয়া যাবেনা তাই কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে রেগে জোরে জোরে পা ফেলে নিচে দিকে চললো।

সিঁড়িতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে আঁখি। চোখে পানি টলমল করছে। হৃদয় টা ভেঙে চুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে একেবারেই খেয়াল নেই ওর। নিরবে চোখের জল ফেলছে। ওর বাবা যে এমন ব্যবহার করবে তা ওর ধারনার বাইরে ছিলো। কি হয়েছে তা তো ওকে বলতেই দিলো না। কি করে বোঝাবে ও এসব চায়নি। কখনও কি ওদের বাসায় যেতে পারবে? নাহয় কোথায় যাবে? সাজ্জাদ তো নিবে না বলেই দিয়েছে। কোথায় থাকবে কি করবে তা ভেবে আরও কান্না পাচ্ছে আঁখির। আজ যদি সাজ্জাদের পিছনে গোয়েন্দাগীরী করতে না যেতো তবে এমন হতোই না। এখন ওর নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। সাজ্জাদ সিঁড়ি দিয়ে নামতে ছিলো। সিঁড়ির মাঝে আঁখিকে দেখেই চিনে ফেললো। ওর পা শ্লো হয়ে গেলো। ওর রাগ যেনো তরতর করে আকাশ ছুয়ে গেলো। সাজ্জাদ রেগে আঁখির দিকে এগিয়ে এসে বললো।

“এই যে ঝামেলার ডিব্বা! নাহ ডিব্বা না ট্যাংকি হবে। তুমি আস্ত একটা ঝামেলা। আমার পিছনে বাশ দিয়ে এখানে বসে আবার কি ভাবছো? যে পুরো বাঁশ ঝাড় টা কিভাবে দিবে সেটা? ”

আঁখির মন একটুও ভালো নেই। সাজ্জাদের সাথে ঝগড়া করার মুডে ও নেই। তাই কথা শুনেও চুপ করে বসে রইলো। সাজ্জাদ আঁখি কে চুপ থাকতে দেখে হতভম্ব হলো। আঁখি তো চুপ থাকার মেয়ে না। এতক্ষণে ওকে কিড়িমিড়ি করে ধরার কথা ছিলো। কিন্তু এটা কি হলো? সাজ্জাদ আবারও রেগে বললো।

“আমায় ঝামেলায় ফেলে এখানে শান্তিতে বসে আরাম করছো? বাহ! চমৎকার, দরুন, ভাবাই যায়না। শোনো! এটা আমি সাজ্জাদ নিশান্ত খান কিছুতেই হতে দিবো না বুঝলে? ঝামেলা তোমাকেই মিটাতে হবে। পাকনামি করে আমায় ঝামেলায় ফালাইছো এখন চুপ করে আছো কেনো? নাচো! বক্স ছেড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচো। নাচতে নাচতে তিনতলা ভেঙে আমার মাথায় পড়ো! এখন এই একটা জিনিসেই বাকি রাখছো। যত্তসব ফালতু মাইয়া!”

আঁখি এতক্ষণ চুপচাপ বসে শুনছিলো। এবার ওর নাচ নিয়ে কথা বলেছে এখন চুপ থাকা মানে নিরবে অন্যায়, অপমাম সহ্য করা। নাহ ও কিছুতেই অপমান সহ্য করবে না। চোখটা মুছে রেগে দাঁড়িয়ে গেলো। সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রেগে চিল্লিয়ে বললো।

“তখন থেকে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছেন কেনো? ঝামেলা আমি আপনাকে ফালাইছি নাকি আপনি আমায় ফালাইছেন? আমি নাহয় গিয়েছি। আপনি কি পুরুষ মানুষ হইছেন যে একটা বিয়ে আটকাতে পারলেন না? এখানে ঘেউ ঘেউ করছেন কেনো? কাজের সময় তো বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে ছিলেন। আমায় আসছে ক্ষমতা দেখাতে। কাজের সময় তো করতে পারলেন না?”

আঁখির চোখের পানি দেখে সাজ্জাদ থমকে গেলো। তারমানে আঁখি কাদছিলো? কিন্তু কাঁদবে কেনো? ওর বাবাও কি জেনে গেছে? আঁখি কেও বের করে দিয়েছে? সাজ্জাদ চুপচাপ তাকিয়ে এসব ভাবছে। আঁখি ওর চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।

“কি মি. সাজগাজ! সাহস শেষ? আপনার সাহস কতখানি তা আমি জানি। শুধু আমার সাথেই পারেন অন্যের বেলায় তো ফুস! আবার আমায় বলে। হুহ!”

কথারা বলেই আঁখি মুখ ভেঙচি দিলো। ওর কথা শুনে সাজ্জাদ রেগে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আঁখি ওর রাগকে মোটেও পাত্তা দিলোনা। এমনিতেই থাকার মতো জায়গা নেই কোথায় যাবে তারও ঠিক নেই৷ এখন সাজ্জাদ কে ভয় পেয়ে ওর দু পয়সার ও লাভ নেই। সাজ্জাদ কথা না বলে আঁখির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আঁখি পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকালো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা ও। ওকে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? পরক্ষনেই খেয়াল হতেই হাত ছাড়াতে ছাড়াতে সাজ্জাদ কে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে বললো।

“এই! এই! আমার হাত ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? হাত ছাড়ুন! একি কথা কানে যাচ্ছে না? ছাড়ুন বলছি!”

আঁখির কথা সাজ্জাদের কানেই যাচ্ছেই না। ও আঁখি কে চুপচাপ টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আঁখি অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ আঁখি কে ওদের বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে কলিং বেল দিলো। আঁখি হাত ধরেই আছে ছাড়ছে না। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে মিসেস শাহনাজ তাড়াতাড়ি এসে দরজা খুললো। সাথে সাদিয়াও এসে হাসি মুখে দাড়িয়েছে। মিসেস শাহনাজ দরজা খুলেই হাসিমুখে বরনডালা নিয়ে দাড়ালেন। আঁখি মাথা উচু করে সামনে তাকাতেই মিসেস শাহনাজ আর সাদিয়াকে দেখতে পেলো। ওদের দেখে কেমন যেনো একটা লজ্জা পেলো। প্রতিদিন দেখে ওদেরকে কখনও তো ওর এতটা অস্বস্তি হয়নি আজ কেনো হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছেনা। অস্বস্তিতে সালাম দিতেও ভুলে গেলো। আঁখি লজ্জায় মাথা নিচু করে সাজ্জাদের ধরে রাখা হাতটা মোচড়াচ্ছে। ও হাতটা ছুটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। এই হাতটা ধরে রাখার জন্যই আঁখির ৫০%লজ্জা লাগছে। মিসেস শাহনাজ মুচকি হেসে বললেন।

“আরে লজ্জা পেতে হবে না আমরা পরিচিত লোকেই তো। মাথা উচু করো!”

আঁখি লজ্জায় পেলেও হালকা মাথা উচু করলো। মিসেস শাহনাজ ওদের দুজনকে একটু মিষ্টি খাইয়ে ভিতরে আসতে বললেন। ওদের ভিতরে আসতে বলে মিসেস শাহনাজ নিজের স্বামীকে ডাকতে গেলেন। আঁখি চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাজ্জাদ ওর হাত ধরে টেনেই ভিতরে আনলো। সাদিয়া ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো।

“এত দেরি হয়েছে দেখে আমি ভাবলাম বউকে বেনারসি পরিয়ে আনবি এতো দেখি না সেলেয়ার কামিজ। তো আসতে এত দেরি হলো কেনো?”

সাজ্জাদ রেগে সাদিয়ার দিকে তাকালো। সাদিয়া ওকে পাত্তা না দিয়ে আঁখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।

“আরে আঁখি আপু! সরি ভাবি! এত লজ্জা পাচ্ছো কেনো? নতুন বৌ বলে? আরে আমরা আমরাই তো! আমার তো ভালোই লাগছে যে তোমার সাথে সারাদিন গল্প করতে পারবো। মজা হবে ভাইয়াকে দুজনে মিলে জ্বালাবো।”

সাজ্জাদ আবারও ওর দিকে রাগি চোখে তাকালো। এর মাঝেই আশরাফ খান সেখানে আসলেন। আঁখি কাচুমাচু হয়ে তাকে সালাম দিলো। প্রথমবার ভুল করেছে এবার আর করলো না। আশরাফ খান এক পলক আঁখি আবার সাজ্জাদের দিকে তাকালো। সাজ্জাদ মোটেও ওর বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। আশরাফ খান বুঝতে পেরেছেন ছেলে অভিমান করেছে পরে ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আঁখির হাতে সালামি হিসেবে একটা বক্স দিয়ে বললেন।

“সুখি হও! আর বাদর কে একটু মানুষ করার চেষ্টা করো। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে যাও! আমরাও একটু ঘুমাই! আজ সারারাত একটুও ঘুম হয়নি। ”

কথাটা বলেই আশরাফ খান চলে গেলেন। মিসেস শাহনাজ ও অনেক ক্লান্ত তাই ঘুমাতে গেলেন। সাজ্জাদ আঁখির হাত ছেড়ে রেগে চলে গেলো। আঁখি চুপচাপ ওর পিছনে পিছনে গেলো। সাদিয়া এই বিয়েতে বেজায় খুশি। নিরব আর ওর লাইনটা এখন ক্লিয়ার। ও মুচকি হেসে রুমে চলে গেলো।

ইনশাআল্লাহ চলবে….

(রি-চেইক করিনি ভুলত্রুটি মাফ করবেন। শুভ রাত্রি গাইস্)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here