শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩১

0
2061

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩১

সাজ্জাদ রুমের মধ্যে এদিক ওদিক পাইচারি করছে। রাগে ওর মাথা টগবগ করছে। আঁখি সেই যে ওয়াশরুমে ঢুকলো আর বের হওয়ার নাম নিচ্ছে না। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেছে কিন্তু আঁখি এখনও বের হচ্ছেনা। ওয়াশরুমে বসে ও কি করছে নিজেই জানেনা। ভিতর থেকে শুধু গুন আওয়াজ আসছে। সাজ্জাদ একবার হাটছে তো একবার বসছে। রনি, আশিক আর অর্বন বসে বসে ভালোই মজা নিচ্ছে। অর্নব কাল থেকে অফিসে জয়েন করবে শুনেতে ওরা সবাই আকাশ থেকে পড়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই সাজ্জাদের কথায় হা হয়ে গেলো। সাজ্জাদ বিছানায় বসে জোরপূর্বক হেসে বললো।

“আমিও ভেবে দেখেছি এভাবে আড্ডা করার চেয়ে জব করাটা অনেক বেটার। এতে আলাদা সম্মান থাকে। আমিও কাল থেকে জবের জন্য ট্রাই করবো।”

সাজ্জাদ নিজেও আড্ডাবাজি ছেড়ে চাকরি খুঁজবে বলছে। এতে সবারেই চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সবাই বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালো। সাজ্জাদের মনে হচ্ছে ও কোনো ভীন গ্রহের প্রানী। সাজ্জাদ ভ্রু কুচকে ওদের দিকে তাকালো। সবাই ওর তাকানো দেখে ব্যাপারটা চুপচাপ হজম করলেও রনি হজম করলো না। ও সবার মাঝে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো।

“বিয়ে করেই ভবিষ্যতের চিন্তা করতে শুরু করেছো মামা?ভালো ভালো। আমাদেরও উচিত বিয়ে করা। কতকাল আর সিঙ্গেল থাকবো। সিঙ্গেল থাকাই প্যারা।”

সাজ্জাদ ওর পিঠে কয়েকটা কিল ঘুসি দিয়ে বললো।

“সিংগেল থাকা প্যারা? বিয়ে তো করোনি কি করে বুঝবে এর জ্বালা। এই যে আমায় দেখো! একঘন্টা ধরে অপেক্ষা করেও গোসল করতে যেতে পারিনি। সারাদিন ক্যাচক্যাচ খ্যাচখ্যাচ। লাইফে এর মতো এর মতো জ্বালাই হয়না।”

ওরা কিছুই বললো না। ঘাড়বাকিয়ে চুপচাপ বসে পড়লো। ওরা একটু পর উঠে ড্রইংরুমে চলে এলো। ওরা যাওয়ার একটু পরেই আঁখি গোসল করে বের হলো। দরজা খোলার শব্দে সাজ্জাদ পিছনে ফিরে দেখলো আঁখি বের হয়েছে৷ হালকা গোলাপি কালার কামিজ সাথে সাদা স্কার্ফ ও প্লাজো। সাজ্জাদ হা করে তাকিয়ে থাকলো। মাথায় সাদা তোয়ালে পেচানো। হালকা হালকা চুল বের হয়ে আছে। এইমাত্র গোসল করার জন্য ওর চেহারা খুব মশ্রিন লাগছে। চেহারায় আলাদা একটা লাবন্য দেখা দিচ্ছে। সবসময়ের তুলনায় আঁখিকে একটু বেশিয়েই সুন্দর লাগছে। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আঁখি নিজের দিকে তাকালো। যে ওড়নাটা ঠিক আছে কিনা। দেখলো ঠিকই আছে তবুও আরেকটু ঠিক করে নিলো। সাজ্জাদ চোখ ফিরানোর নাম নিচ্ছেনা তাই আঁখি এদিক ওদিক তাকিয়ে হালকা কাশি দিলো। ওর কাশির শব্দে সাজ্জাদের ধ্যান ভাঙ্গলো। সাজ্জাদ নিজেও হালকা কেশে এদিক ওদিক তাকালো। ঘাড় চুলকে আঁখি কে পাশ কাটিয়ে একপ্রকার চোরের মতো ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলো। ওয়াশ রুমে ঢুকেই নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি মেরে বললো। “কি যে করিস্ না। মানইজ্জতের ফেলুদা করে ফেলেছিস্। ওর দিকে ওভাবে হা করে তাকানোর কি ছিলো? ও ভাবছে ওকে খুব সুন্দর লাগছে। তবে মানতেই হবে একটু বেশি সুন্দর লেগেছে।” এগুলো ভেবে সাজ্জাদ সাওয়ারের কাছে যেতেই দেখলো ওর তোয়াল নেই। তোয়ালে কোথায় গেলো? পরক্ষনেই মনে হলো আঁখির মাথায় দেখেছে। সাজ্জাদ খুব রেগে গেলো। ওর জিনিস কেউ ব্যবহার করুক তা ও মোটেও পছন্দ করেনা। সাজ্জাদ রেগে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আঁখি সবে মাত্র ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। সাজ্জাদের বের হওয়ার শব্দে পিছনে তাকালো। ভাবলো কি ব্যাপার? সবে ঢুকলো আর এর মাঝেই গোসল শেষ? এই ছেলেকি আদৌও কোনো জাদু টাদু জানে নাকি? তাহলে পোশাক চেঞ্জ হলো না কেনো? ওর ভাবনার মাঝেই সাজ্জাদ রেগে ওর কাছে এসে বললো।

“তুমি কোন সাহসে আমার তোয়ালে ধরেছো? কাকে জিজ্ঞাসা করে ধরোছো স্টুপিড? Ans me damn it!”

আঁখি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এমন করছে কেনো সাজ্জাদ? সামান্য তোয়ালেই তো ধরেছে। এত রাগ তাও এই তোয়ালের জন্য? সামান্য তোয়াল ধরতে আবার অনুমতি লাগে? এই তোয়ালের জন্য এমন করছে মনে হয় কোন মহা রত্ন যেনো নিয়ে গেছে। সাজ্জাদ রেগে আঁখির মাথা থেকে তোয়ালে খুলে নিয়ে গেলো। তোয়ালেটা নিজের কাছে নিয়ে বললো।

“সাজ্জাদ নিশান্ত খান নিজের ব্যবহার করা জিনিসে কাউকে হাত দিতে দেয় না। তার নিজের জিনিস শুধু নিজের জন্যই বরাদ্দ। আন্ডারস্টান্ড? আই হোপ ইউ আর বেটার আন্ডারস্টান্ড!” কথাটা বলে সাজ্জাদ একটু থামলো। অগত্যা আঁখির দিকে হালকা এগিয়ে এসে আঙুল উচিয়ে বললো। ” শোনো মেয়ে! ফারদার আমাকে জিজ্ঞাসা না করে আমার কিছু ধরবে না। অন্যের জিনিস না বলে ধরা এগুলো কি ধরনের বদঅভ্যাস? আমার সাথে থাকতে হলে এগুলো এখনেই চেঞ্জ করো! নাহয় রুমের বাইরে যাও! আমার জিনিসে আর কখনও হাত লাগাবে না। মনে থাকে যেনো।”

আঁখি এতক্ষণ রেগে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছে। সামান্য তোয়ালের জন্য ওকে এত কথা শোনাচ্ছে? মানুষ তো সোনা রুপা নিয়ে গেলেও এমন করেনা। ওকে এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে? কিছু হলেই বের করে দিবে বলছে? নাহ এবার চুপ থাকাটা বড়ই বেমানান। আঁখি রেগে সাজ্জাদের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে বললো।

“আপনি কোন গ্রহের প্রানী বলেন তো? সামান্য তোয়ালের জন্য একজনকে এত কথা শোনাতে আপনার রুচিতে বাধছে না? কিছু হলেই রুম থেকে বের করার হুমকি দেন, কি মনে করেন আপনি নিজেকে? এই রুম একা আপনারেই আছে? আজ শ্বশুর আব্বা আসুক দেখি কে থাকে এই রুমে। আমাকে বের করলে আপনি নিজেও থাকতে পারবেন না। আমি মামলা করবো। নারী নির্যার্তন মামলা!”

সাজ্জাদ এবার প্রচন্ড রেগে গেলো। কোনো লোক সাহস পায়না ওর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে। আর যেই না মেয়ে সে আবার ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলছে? সাজ্জাদ দাঁতে দাঁত চেঁপে আঁখির দিকে এগিয়ে বললো।

“সামান্য দেড় ফুটের মেয়ে তার আবার এত তেজ? আমাকে হুমকি দেও তাইনা? আমি বুঝিনা এত সাহস কোথাও পাও তুমি। সামান্য পুলিশের ভয় দেখাও? এমন পুলিশ আমি দিনে দুপুরে পকেটে নিয়ে ঘুরি। যাও! মামলা করে দেখাও, দেখি কত পারো তুমি।”

আঁখিকে দেড় ফুট বলায় ওর গায়ে লাগলো। আঁখি বেশি খাটোও না, আবার লম্বাও না। ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। এই যুগে এটা ঠিকই আছে। তবে সাজ্জাদের কাছে ওকে একটু খাটোই লাগে। সাজ্জাদ ৫.৮ সেখানে ও নিতান্তই খাটো। আঁখি নাক ফুলিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“আমি মোটেও দেড় ফুট নই। কথাবার্তা ঠিক করে বলেন। দিনে দুপুরে পুলিশ পকেটে নিয়ে ঘুরে কি লাভ হলো? রাতের বেলা পকেটে নিয়ে ঘুরতেন তবে আজকের এইদিন দেখতে হতো না। আপনার মতো ভিনগ্রহের প্রানীর সাথে থাকতে হতো না। আমার সাথেই হাউকাউ আর পুলিশ দেখলেই মিউমিউ। হুহ দেখছিতো আমি। আমার সাথে চাপা কম মারেন। একটু আধটু চাপাবাজি আমিও করতে পারি।”

ভাব নিয়ে কথাটা বললো আঁখি। সাজ্জাদ আঁখির থেকে তোয়ালেটা নিয়ে বললো।

“একদম বাজে কথা বলবেনা ফালতু মেয়ে।”

কথাটা বলেই আঁখি কে কিছু কলার সুযোগ দিয়ে সাজ্জাদ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আঁখি বাহির থেকে চিল্লিয়ে বললো।

“আপনি কাকে ফালতু বলছেন কাকে? ফালতু তো আপনি। যে যেমন সে অন্যকেউ তেমনি মনে করে।”

সবাই ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলো। ওদের ঝগড়া শুনে সবাই চুপ করে গেলো। মিসেস শাহনাজ কপালে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।

“হায় আল্লাহ! কি করবো ওদের নিয়ে? ওরা তো প্রতি মিনিটে মিনিটে ঝগড়া করে। উঠতে বসতে যেতে আসতে ঝগড়া। এত ঝগড়া করে তো বিয়ে করলো কেনো? এখন সংসার করবে কিভাবে?”

সাদিয়া ওর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বললো।

“শান্ত হও মা! ওরা তো আগেও সাপ আর বেজির মতো ঝগড়া করতো। কিন্তু হঠাৎ বিয়ে করলো কেনো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি ভাবছি ভালো হয়ে গেছে কিন্তু এখন তো দেখছি আগের মতোই আছে।”

মিসেস শাহনাজ হতাশ হয়ে বসে রইলেন। রনি অর্নব আর আশিক চুপচাপ বসে রইলো। ওরা তো জানে বিয়ে কি করে হয়েছে। যেভাবে বিয়ে হইছে সেখানে তো এমন হওয়ারেই কথা। ওদের তো শুধু ঝগড়া হয়না। প্রতি সেকেন্ড সেকেন্ড রায়াড হয়। যাকে বলে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ।

—————————-

দিনের শেষে ওই আকাশে
সন্ধ্যা যখন নামে
সূর্য যখন একা মনের
ভিতরে তাকিয়ে দেখ
পাবে আমার দেখা।

সন্ধ্যা বেলা। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। তবে মাঝে মাঝে চারপাশ থেকে পশু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আঁখি বেলকনিতে একা চুপচাপ মন খারাপ করে বসে আছে। ওর বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। ওর বাবা হয়তো এখনও রেগে আছে। যদি বাসায় গিয়ে আবার দেখতে পারতো ওর বাবার রাগ কমছে কিনা তাহলে ভালো হতো। কিন্তু ওর শ্বাশুড়ি তো বলে দিয়েছে তিন দিনের আগে নতুন বৌ বের হওয়া নিষেধ। নাহলে ঠিকই ওদের বাসায় যেত। আতিকও একবারও আসলো না। হয়তো ওর বাবা কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে। কত সুখের সংসার ছিলো ওদের কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না। আজ এখানে একা বসে আছে বাসায় থাকলে সবার সাথে কত মজা হতো। আতিকের সাথে ঝগড়া করতো কত মজা আনন্দ। আতিকের সাথে কাটানোর সময়টা মনে পড়ছে। আতিককে খুব মিস করছে ও। এখানে খুব একা একা লাগছে। বাসায় একা একা থাকলেও ভালো লাগে। এখানে সবার মাঝেও ভালো লাগেনা। সাজ্জাদ দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যে বের হয়েছে আর বাসায় ফেরার নাম নেই। বিকালে সাদিয়ার কাছে শুনেছে নিরবের ওমন পাগলামো করার কারন ওর বাবা জেনেছে। আশিকুর রহমান বিষয়টা যেনে ওর বাবাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। আমিনুর রহমান নাকি মাথা নিচু করে চুপ করে ছিলেন। তিনি লজ্জায় মাথা উঠাতে পারেননি। একথা শুনে আঁখি খুবেই কষ্ট পেয়েছে। ওর বাবা হয় তো এখন ওর উপর আরও রেগে আছে। ওর জন্য ওর বাবাকে এত কথা শুনতে হয়েছে। আঁখি বেলকনিতে বসে নিরবে চোখের জল ফেলছে। এত ভালোবাসা দিয়েছে ওর বাবা আর আজ ওর জন্যই কত নিচু হতে হয়েছে৷। কখনও ওর বাবার মাথা নিচু হয়নি আজ মেয়ের জন্য নিচু হতে হয়েছে। আঁখির খুব কষ্ট লাগছে। কেনো যে গেলো, এর আগে মরে গেলেও ভালো হতো আজ অন্তত ওর বাবাকে এতটা নিচু হতে হতো না।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

(রি-চেইক করিনি। ভুলত্রুটি মাফ করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here