#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩২
রাত ১০টা। আঁখি সারাটা সময় চুপচাপ বেলকনিতে বসে ছিলো। সাদিয়া আঁখিকে একটু আগেই খেতে ডেকে গেছে। সাজ্জাদ এখনও বাসায় ফিরেনি। আশরাফ খান একটু আগেই বাসায় ফিরেছেন। একটু বিশ্ব দাম নিয়ে সবাইকে খেতে ডেকেছেন। আঁখির মনটা একেবারেই ভালো নেই। একটুও খেতে যেতে ইচ্ছে করছেনা। ওর বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কে জানে আশিকুর রহমান ওর বাবাকে কি কি বলেছে। আঁখি খেতে না গিয়ে চুপ করেজ বসে রইলো। মিশেস শাহনাজ আবারও ওকে খেতে ডাকলেন। আঁখির অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও উঠে চোখ মুছে নিজেকে ঠিক করে নিলো। আস্তে করে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে খেতে চললো। ও চুপচাপ হেটে ড্রইংরুমে আসলো। আশরাফ খান ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। সাদিয়াও বসে বসে খাচ্ছে। মিসেস শাহনাজ খাচ্ছেন আবার এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। আঁখি ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। আশরাফ খান আঁখি কে দেখে মুচকি হেসে বললেন।
“এত দেরি করলে কেনো? এসো বসো!”
আঁখি ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। মিসেস শাহনাজ খাবারটা মুখে দিতে দিতে বললো।
“তুমি কি সাজ্জাদের জন্য অপেক্ষা করছো? ওর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। ও কখন আসে তার তো কোনো ঠিক নাই৷ রাত ১২টার আগে নাও আসতে পারে। তুমি বরং খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো! জেগে থাকলে শরীর দূর্বল হয়ে যাবে।”
“ওমন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করাটাও ঠিক না। তুমি খেয়ে যাও! নতুন বৌ রেখেও বাইরে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে? ও কি জীবনেও শুধরাবে না? আমি বুঝিনা এমন কেনো হলো!”
আশরাফ খান খেতে খেতে এ কথা বলছেন। আঁখি চুপচাপ ওদের কথা শুনছে। কোনো উওর দিচ্ছে না, কি বা বলার আছে ওর। সাজ্জাদের বিষয়ে ওর থেকে সাজ্জাদের বাড়ির লোকেই ভালো জানে। মিসেস শাহনাজ আঁখির প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। আঁখি অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপচাপ খাবারে হাত দিলো। রুই মাছ আর বেগুন ভাজি রান্না হয়েছে। গরুর মাংসও আছে। দুপুরে সাজ্জাদের বন্ধুদের জন্য রান্না হয়েছিল। এখনও তা আছে। আঁখির বেগুন ভাজিটা খুবেই পছন্দ ও চুপচাপ বেগুন ভাজি দিয়ে খেতে লাগলো। ওরা খাচ্ছে আর টুকটাক কথা বলছে। আশরাফ খান আঁখির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“তোমার বাবা কি এখনও রেগে আছে? তোমাকে কি বাসায় যেতে নিষেধ করেছে?”
আঁখির খাওয়া অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। ও খাওয়া রেখে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে রইলো। ওর বাবা ওকে বাসায় যেতে দিচ্ছেনা এটা খুবেই লজ্জার বিষয়। কি উওর দিবে ও? ওর কাছে এর উওর শূন্য। আশরাফ খান প্লেটের খাবার নাড়তে নাড়তে আবারও বললেন।
“যা করেছো তাতে এমন রাগ হওয়ারেই কথা। অনেক মানসম্মান গিয়েছে। নিরবের বাবাও অনেক কথা শুনিয়েছেন। তুমি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী! এমন ভুল করলে কিভাবে? তোমার বাবাকে একবার বললেই হতো। তিনি কি তোমায় বাধা দিতেন?”
আঁখি এবার প্রচন্ড লজ্জা পেলো। ওর গায়েও পালিয়ে আসার সাইন লেগে গেলো। মানসম্মানের ভয়ে জীবনে প্রেম করলো না আজ তার দোষেই ওর ঘাড়ে। কথায় আছে যার জন্য রাজ্য ছাড়া, সেই এসে সামনে খাঁড়া। ওর বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। সবার সামনে আশরাফ খান আঁখিকে এভাবে বলায় ও খুব লজ্জা পাচ্ছে। একথায় ওর চরিত্রকেও ছোট করা হচ্ছে। যদিও আশরাফ খান অতটা ভেবে কথাটা বলেন নি। ফ্রি মনে বলে ফেলেছেন। বলার পড়ে বুঝতে পেরেছেন ভুল কিছু বলে ফেলেছেন। তিনি বিষয়টা বুঝতে পেরে হালকা কাশি দিয়ে বললেন।
“চুপ করে আছো কেনো? খাও! তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো। তুমি তো পড়াশোনা করো, পড়ালেখা বন্ধ করবে না। পরশু থেকেই কলেজে যাবে আমি বই কিনে আনবো। আমাকে লিস্ট করে দিও কেমন?”
আঁখি ঘাড় বাকিয়ে আশরাফ খানের কথায় সায় দিলো। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ খেতে লাগলেন। সাদিয়াও চুপচাপ খাচ্ছে। হঠাৎ করেই কলিংবেল বেজে উঠলো। সবাই বুঝে গেলো সাজ্জাদ এসেছে। মিসেস শাহনাজ উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। সাজ্জাদ বাইকের চাবি ঘুড়াতে ঘুড়াতে ভিতরে প্রবেশ করলো। আঁখি আড় চোখে একপলক তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলো। সাজ্জাদ চাবিটা পকেটে রেখে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আঁখির পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সাজ্জাদ কাউকে কেয়ার না করে চুপচাপ খেতে লাগলো। আশরাফ খান ওর দিকে তাকিয়ে বললেন।
“এভাবে আর কতদিন চলবে? এবার তো একটু ঠিক হও!”
সাজ্জাদ খাবার মুখে দিয়ে ওর বাবার দিকে তাকালো। মিসেস শাহনাজও স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। খাবার সময় এসব কথা বলাটা তার পছন্দ না। তিনি জানেন যখনেই সাজ্জাদের ভালো হওয়ার কথা উঠে তখনেই দুজনের মাঝে রাগারাগি হয়। আজও তার ব্যতীক্রম হবে না তা তিনি জানেন। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো। সাজ্জাদ মুখের খাবার চিবাতে চিবাতে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে না বোঝার ভান করে বললো।
“এভাবে মানে? কোন ভাবে চলার কথা বলছো?”
কথাটা বলে সাজ্জাদ আবারও খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওর হেয়ালী পনায় আশরাফ খান রেগে গেলেন। খাবার থেকে হাত উঠিয়ে কড়া চোখে তাকালেন। ও সবসময় বুঝেও অবুঝ হওয়ার ভান করে বসে থাকে। আশরাফ খান সাজ্জাদকে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললেন।
“বলতে চাচ্ছি চাকরি বাকরি ছাড়া আর কদিন থাকবে? তুমিতো আর নাবালক নও! বিয়েও করেছো। আগে তো নিজে বাবার ঘাড়ে বসে খেতে এখন কি বৌ নিয়েও আমার পয়সায় খাবে? এবার তো চাকরি করো!”
এমন কথা আশরাফ খান প্রায় বলেন। আজ আঁখির সামনে বলায় ওর গায়ে লাগলো। ও রেগে খাবার রেখে উঠে গেলো। বেসিনে হাত ধুয়ে বড় বড় পা ফেলে শব্দ করে নিজের রুমে চলে গেলো। যেনো সব রাগ ফ্লোরের উপর মিটাচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মিসেস শাহনাজ বিরক্ত হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো।
“হয়েছে শান্তি? এবার তোমার শান্তি হয়েছে? ছেলেটা সবে মাত্র খেতে বসলো এখন এসব না বললে হতো না? ও তো পরিবর্তন হয় না। এসব বলে বলে ছেলেটাকে কেনো রাগাও বলো তো?”
“ঠিকই বাবা! তুমি ভাইয়ার সাথে এভাবে কথা না বললেও পারতে। খুব বেশি হয়ে গেছে আজ!”
আশরাফ খান সাদিয়া বা মিসেস শাহনাজ কারও কথার উওর দিলেন না। আঁখির দিকে তাকিয়ে বললেন।
“তুমি কিছু মনে করো না। এসব মাঝে মাঝেই হয়। আমার যা আছে তা দিয়ে ও সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবে। কিন্তু ও অলস থাক আমি তা চাইনা। আমি চাই ও নিজের পায়ে দাড়াক। নিজের একটা পরিচয় হোক! তুমি একটু ওকে বুঝিয়ে বলো ঠিক আছে?”
আঁখি ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো। মিসেস শাহনাজ আঁখির হাতে সাজ্জাদের খাবারটা দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। আঁখি চুপচাপ খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। সাজ্জাদ রেগে বেলকনিতে বসে আছে। আঁখি আস্তে করে সাজ্জাদের কাছে গেলো। পিছন থেকে আলতো স্বরে বললো।
“খাবার এনেছি খেয়ে নিন! কখনও রাগ করে খাবার ফেলে আসতে নেই। এতে গুনাহ হয়।”
সাজ্জাদ কথাই বললো না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আঁখি পিছনে ফিরে আসতে নিলে সাজ্জাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো।
“আম্মু আমায় ছাড়া থাকতে পারে না, আমিও আম্মুকে ছাড়া থাকতে পারি না, সেজন্যই বাবার অপমান সহ্য করেও এ বাড়িতে থাকি। ছোট বেলা থেকে এরাই সুখে দুঃখে পাশে থেকেছে তাই এদের ছেড়ে যাইনা। বিয়ে করলে সংসারে ঝামেলা হয় তা ভেবে বিয়ে করিনি এতকাল। এখন সেই জ্বামেলাই হচ্ছে। যত ঝামেলাই হোক আমি এই পরিবার ছেড়ে আলাদা হবো না। বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। এখন থেকে তুমিও এই পরিবারের একজন। যতদিন বাঁচবে আমার সাথেই থাকবে। তুমি একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নেও! আমার সাথে থাকতে হলে আমার পরিবারের সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে হবে। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। যত যাই হোক এরাই আমার আপন। তাদের মন না পেলে আমার মনও পাবে না সেটা মাথায় রেখো! মা বাবা বা আমার বোনের সাথে নিজেকে তুলনা করবে না। তারা তাদের জায়গায় আর তুমি তোমার জায়গায়। আমার পরিবারের যা প্রাপ্য অধিকার তা তারা পাবে, আর তোমার প্রাপ্য অধিকারেও ত্রুটি হবে না ইনশাআল্লাহ। ছোট বেলা থেকে এদের সাথে থাকছি আর তুমি তো আজ এলে। তোমার জন্য এদের ছাড়তে পারবোনা। বিনিময়ে তোমায় ছেড়ে দিবো। অন্য মেয়েদের মতো যদি আলাদা হতে বলো আর তাদেরকে সম্মান না দেও। তবে তোমায় বাসার বাইরে ছুঁড়ে ফেলতেও আমি দু বার ভাববো না। কথাটা মাথায় রেখো! আর এখন থেকে সেভাবেই চলাফেরা করো।”
কথাটা বলে সাজ্জাদ রুমে চলে গেলো। আঁখি ওখানেই হা করে দাড়িয়ে রইলো। বুঝতে পারছেনা ওকে এসব কেনো বলছে৷ ওর কি কোনো দোষ পেয়েছে? নাকি নিজের বাবার রাগ ওর উপর ঝাড়ছে? তবে যাই হোক! সাজ্জাদের কথাগুলো খুব ভালো লেগেছে আঁখির। প্রতিটা ছেলেরেই এমন মনোভাব থাকা উচিত তাহলে আর কোনো পরিবার আলাদা হতো না। কোনো মা বাবাকে একা থাকতে হতোনা, তাদের যেতে হতো না বৃদ্ধাশ্রমে! বাংলাূেশের প্রতিটা ছেলে যদি নিজের বৌকে প্রথমদিনেই এসব বলে দিলে বাংলাদেশে আর একটাও বৃদ্ধাশ্রম থাকতো না। প্রতিটা পরিবার থাকতো সুখি। আর কোনো বাবা মা তার ছেলেকে বিয়ে করাতে ভয় পেতো না।
—————————–
সকাল বেলা। সূর্যের আলো চোখে পরতেই আঁখির ঘুম ভাঙলো। ও আবার কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু পড়েই খেয়াল হলো ও শুয়ে আছে কেনো? ও তো নিজের বাড়ি নেই শ্বশুর বাড়িতে। এখানে বাবার বাড়ির মতো থাকা যায় না। লোকে খারাপ বলবে। আঁখি কাঁথা সরিয়ে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই দেখলো সাজ্জাদ কাত হয়ে শুয়ে আছে। চুলগুলো বেশ এলোমেলো। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ও। কখন উঠবে কে জানে? তবে সকালের সূর্য ওর চেহারায় পড়ায় খুবেই সুন্দর লাগছে। ফর্সা চামরায় সূর্যের আলো অসাধারন কিরন দেয়। সিলকি চুলগুলো রোদের আলোয় চিকচিক করছে। আঁখির ইচ্ছা হলো চুলগুলো ধরার। হাত বাড়িয়ে ধরতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে নিলো। সাজ্জাদ জেগে গেলে ওকে একদম বেহায়া বলবে। এমনিতেও মিথ্যুক, ঝগড়া আলি উপাধি পেয়ে গেছে ও। এখন আর বেহায়া উপাধি পেতে চায়না। ঘুমের মাঝে নিস্পাপ লাগছে ওকে আর উঠলেই রাগি লোক। আঁখি সাজ্জাদ কে একটা ভেংচি দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ৮টা ৫ বাজে। আঁখির মাথায় হাত। সূর্যের আলো দেখে ভেবেছিলো ৬টা বাজে এতো নাস্তার সময় হয়ে গেলো। সবাই মনে হয় উঠে গেছে। ওকে কি বলবে এবার? আঁখির কেমন যেনো লাগছে। সবার মাঝে যেতে আনিজি ফিল করছে। যদিও সামনে সামনে কিছু বলবে না তবে মনে মনে তো বলবে মেয়ের আক্কেল নেই। দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। এবার কি করবে আঁখি? কি করে সবার মাঝে যাবে? আঁখি মহা ঝামেলায় পড়লো। নিজের বাড়িতে থাকলে আজ এত কিছু ভাবতে হতো না। ভয়ও লাগতো না। যখন ইচ্ছা উঠে নাচতে নাচতে খাবার খেতে চলে যেতো। এই প্রথম আঁখির ছেলে না হতে পেরে আফসোস হচ্ছে। সাজ্জাদ কি সুন্দর পরে পরে ঘুমাচ্ছে। ওর বাড়ি হলে ও নিজেও ঘুমাতো, এত ভয় বা আনিজি লাগতো না। এবার বুঝতে পারলো নিজের বাড়ি আর পরের বাড়ির তফাত। আঁখি মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলো। হালকা দরজা খুলে বাইরে উকি দিলো। রান্না ঘর থেকে শব্দ আসছে। তারমানে মিসেস শাহনাজ নাস্তা বানাচ্ছেন। এবার আঁখির আরও কেমন কেমন লাগছে। যদি ওখানে গেলে মিসেস শাহনাজ কপাল কুচকে থাকে? রেগে রেগে ওর সাথে কথা বলে? আঁখি এসব মনে করেই যাবে কি যাবে না সেটাই ভাবছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে….
(রি-চেইক করিনি ভুল হতে পারে। কষ্ট করে বুঝে নিবেন। শুভ রাত্রি গাইস্)