শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩৩

0
2149

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৩

আঁখি অনেক ভাবনা চিন্তার পর রুম থেকে বের হলো। ভয় জিনিসকে পিছনে ফেলে রুমের বাইরে পা রাখলো। ওর দৃঢ় মনোবল ভয়কে জয় করতেই হবে। যতই শক্ত হচ্ছে না কেনো ভিতরে একটা খুঁতখুঁত থেকেই যায়। যদি ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি কিছু বলে ওকে? না বললেও মনে মনে কি ভাববে? এটাই শ্বশুর বাড়িতে প্রতিটা মেয়ের প্রধান ভয়। বাবার বাড়ি যতটাই ভয়হীন এখানে ততটাই ভয়। নিজের ইচ্ছায় কিছুই করা যায়না। করতে গেলেই ভয় হয় যদি কিছু বলে, না বললেও মনে মনে যদি বলে, এমন ভাবেই ভিতরে ভয় ঢুকে থাকে। যে মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি যায়নি, সে এই ভয়টা বুঝবে না। স্বাধীনত্ব যখন শেষ তখন ইচ্ছা করে একটু স্বাধীনতা পেতে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে বাবার বাড়ি। আগে বাবার বাড়ি যতই খারাপ লাগুক এখন সেখানেই প্রশান্তির জায়গা। আঁখি আস্তে করে হেটে ড্রইংরুমে আসতেই দেখলো আশরাফ খান সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। তার মানে তিনি অনেক আগেই জেগেছেন। এখন রান্না ঘরে যেতে হলে আশরাফ খানের সামনে দিয়েই যেতে হবে। আঁখির ভিতরে একটু ভয় লাগলো। কেমন ভাববেন তিনি? তবুও আমতা আমতা করে সামনে আগালো। আশরাফ খান আঁখিকে দেখে চা রেখে ওর দিকে তাকালো। আঁখি মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছিলো যেনো ওর দিকে না তাকায় কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। আঁখি জোরপূর্বক হেসে তাকে সালাম দিলো। আশরাফ খান সালামের জবাব নিয়ে চা খাওয়ায় মন দিলেন। আঁখি চুপচাপ হেটে রান্না ঘরে গেলো। দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখলো মিসেস শাহনাজ রুটি বানাচ্ছে, একজন কাজের লোক এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। আখির কেমন যেনো লাগলো। ও পরে পরে ঘুমাচ্ছে আর ওর শ্বাশুড়ি সকাল থেকেই কাজ করছে। বাড়িতে ওর মা কাজ করলে তো কখনও ওর খারাপ লাগতো না। আজ কেনো লাগছে? সাদিয়াও পরে পরে ঘুমাচ্ছে ওর মা বলে কিছুই মনে হচ্ছে না। আঁখি কি কাজ করবে তা খুঁজে পাচ্ছেনা। করার মতো তো কোনো কাজেই নেই। আঁখি চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকতেই মিসেস শাহনাজের ওর উপর চোখ পড়লো। তিনি মুচকি হেসে বললেন।

“আরে আঁখি? কখন এসেছো এখানে? কিছু লাগবে? সাজ্জাদ কি উঠেছে? ওর তো ৯টার আগে উঠার অভ্যাস নেই। এখন কি চেঞ্জ হয়েছে?”

মিসেস শাহনাজ নির্দিধায় কথাগুলো জিজ্ঞাসা করলেন। তবুও আঁখির কেমন যেনো মনে হলো। আঁখি জোরপূর্বক হেসে বললো।

“না মা সে উঠেনি। আর আমার কিছুই লাগবে না। আমি এমনি আসলাম আর কি! কিছু করতে হবে কি? তাহলে দিন আমি করে দিচ্ছি।”

“আমিও কি বলি! ওর স্বভাব তো কখনও যাবে না। আরে পাগল নাকি তুমি? কিছুই করতে হবে না। এসেছো দু’দিন হয়নি, তিনদিনের আগে কিছুই করতে হবে না। এমনিতে তো কাজের লোক আছেই। তুমি বরং গিয়ে সোফায় বসো। নাহয় এখানে দাঁড়িয়ে গল্প করতে পারো।”

আঁখি এবার একটু টেনশন মুক্ত হলো। ও মুচকি হেসে দাড়িয়ে রইলো। গল্প করার মতো কিছুই খুজে পেলো না। মিসেস শাহনাজ রুটি বানাতে বানাতে বললেন।

“তোমার বাবা হয়তো বেশি কষ্ট পেয়ছে। সেজন্য এমন করছে। তুমি মন খারাপ করো না। কিছুদিন গেলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আতিক ও তো এলো না একবারও। ও কি রাগ করেছে?”

আঁখির বাবার কথা মনে হতেই ওর খারাপ লাগতে শুরু করলো। চোখে এসে একরাশ জল ভীর করলো। কত মিলেমিশে থাকতো সবাই আর আজ ও সবার থেকে আলাদা। কে জানে বাসায় এখন সবাই কি করছে? আঁখি কান্না লুকিয়ে জোরপূর্বক হেসে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। মিসেস শাহনাজ আখির ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তাই কিছুই বললেন না। ওর দিকে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রুটি বেলতে লাগলেন।

————————–

আনিকা আজ একাই কলেজে যাচ্ছে। আঁখিকে ডাকতে গিয়েছিলো কিন্তু ও বলেছে কাল থেকে যাবে। নতুন বই কিনতে হবে। আজ ওর শ্বশুর কে বইয়ের লিষ্ট দিয়েছে। বই আনলে কাল থেকেই যাবে। ও বোধহয় পড়থম মেয়ে যে নিজের হাসব্যান্ড থাকতেও শ্বশুরকে দিয়ে বই কিনায়। আঁখির যদিও খুব খারাপ লেগেছে কিন্তু কিছু করার নেই। আঁখি গেলো না তাই আনিকাকে একাই যেতে হচ্ছে। তবে ওর খারাপ লাগছে না। কেনো জানি মনের ভিতরে খুশি খুশি লাগছে। অর্নবের চেহারা বার বার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কালকের কথাগুলো ওর খুব মনে ধরেছে। অর্নব খুব গুরুত্বপূর্ন কথা বলেছে। একেবারে ওর মন ছুঁয়ে গেছে। কাল সারারাত অর্নবের কথা ভেবেই কেটেছে ওর। অর্নবের সুমিষ্ট কথাগুলো সবসময় ওর কানে বেজেছে। আজ কেনো জানি অর্নবকে দেখতে ইচ্ছা করছে। আনিকা মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি কলেজের দিকে পা বাড়ালো। কলেজের কাছে গিয়ে আনিকা এদিক ওদিক তাকালো কিন্তু অর্নবকে দেখতে পেলো না। কোথায় গেলো? প্রতিদিন তো কলেজের গেটের কাছেই থাকে। তবে আজ কোথায় গেলো? আনিকা কলেজের বাইরে এদিক ওদিক খুঁজলো কিন্তু ওকে দেখতে পেলো না। আজ সাজ্জাদ, রনি বা আশিক কেউই নেই। পরক্ষনেই মনে হলো অর্নব বলেছে আজ অফিসে জয়েন করবে। ওকে দেখতে পারেনি বলে ওর খুব খারাপ লাগছে। আনিকা মন খারাপ করে কলেজের ভিতরে চলে গেলো।
অর্নব আড়াল থেকে এটা দেখে মুচকি হাসলো। বুকে হাত দিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো। “তুমিও আমায় ভালোবাসো আনিকা কিন্তু স্বীকার করোনা। অবশেষে আমার দরজায় পা দিলে। বেশি দেরি নেই, তোমায় আমার খাঁচায় বন্দী করার সময় হয়ে গেছে বুলবুলি!” কথাটা বলেই অড়নব অফিসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। এখানে শুধু এসেছিলো আনিকাকে দেখতে।

সাদিয়া আঁখির থেকে নেওয়া হিজাবটা পড়েই আজ কলেজে এসেছে। নীল সাদার কম্বিনেশনে হিজাবটি খুবেই সুন্দর লাগছে। মাঝে মাঝে সাদা ওয়াস্টোন বসানো। যে পড়বে তাকেই এতে মানাবে। সবাই খুবেই প্রশংসা করেছে। সাদিয়া খুবেই খুশি হলো। নিরবের পছন্দ খুবেই সুন্দর। ও হাসি মুখে কলেজ থেকে ফিরছে। নিরব কাল থেকেই একেবারে নিঃশ্চুপ। রুম থেকেই বের হয় না। কিন্তু আজ সকালে সব কিছু পিছনে ফেলে রুম থেকে বের হলো। যদিও আঁখিকে ভোলা ওর পক্ষে অসম্ভব। সারাটাজীবন আঁখি ওর মনের একটা জায়গা জুড়ে থাকবে। তবুও যার বিয়ে হয়ে গেছে তাকে কি করে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। কতদিন আর ঘরে থাকবে? ওসব কা পুরুষের কাজ। নিরব আর বিয়ে করবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আর দু মাস ছুটি আছে তারপর আবার আগের মতো দূরে চলে যাবে৷ ও নিজেই ট্যানেস্ফার ক্যান্সেল করে দিবে। যত আঁখির কাছাকাছি থাকবে ততই ওর কষ্ট বেশি হবে। তার থেকে দূরে থাকাই ভালো। এতে কষ্ট শেষ হয়ে যাবে না, একটু কমানো যাবে। নিরব ট্যানেস্ফার ক্যান্সেল করতেই যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হতেই দেখলো ওর কেনা হিজাবটা পড়ে একটা মেয়ে আসছে। নিরব হিজাবটা আঁখি কে দিয়েছিলো তার মানে ওটা আঁখিই হবে। নিরবের মুখে হাসি ফুটলো। যাক আঁখি ওর দেওয়া হিজাবটা পড়েছে। ওর মনে আলাদা প্রশান্তি ছেয়ে গেলো। কিন্তু কাছে আসতেই ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। কান্নাকাটি করার কারনে নিরবের চোখ ঠিকটা খেয়াল করতে পারেনি। এমনিতেও সারারাত না ঘুমিয়ে ছিলো। সেজন্য দূর থেকে সাদিয়াকে দেখে আঁখি ভেবেছে। সাদিয়া ওর কাছে এসে মুচকি হেসে দাড়ালো। ওর হাসি দেখে নিরবের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ও কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো। ও আঁখি কে পছন্দ করে প্রথম একটা জিনিস দিলো তা আবার আঁখি ওকে দিয়ে দিলো? যদি নিজে না পড়বে তবে ওর থেকে নিলো কেনো? তখনেই ফিরত দিয়ে দিতো। নিয়ে আবার অন্যকে দেওয়ার মানে কি? নিরব অপমানিত বোধ করলো। নিরবকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিয়া ভাবছে ওকে খুবেই সুন্দর লাগছে। নিরব হয়তো ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। সাদিয়ার ভিতরে ভিতরে খুবেই খুশি লাগছে। নিরবকে কিছু বলতে না দেখে সাদিয়া মুচকি হেসে বললো।

“আমাকে কেমন লাগছে? নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে?”

এই কথায় নিরবের আরও রাগ হলো। সাদিয়ার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ালো। সামনে যেতে যেতে রেগে বললো।

“যার জিনিসে তাকেই ভালো মানায়। ধার করে নেওয়া মানুষ গুলোকে তো শুধুই ভিখারী মনে হয়।”

নিরব আর পিছনো তাকালো না। সাদিয়া ওর দিকে রেগে তাকিয়ে রইলো। ওকে ভিখারী বলছে? ও ভিখারী আর আঁখি কি রাজরানী? ওই আঁখির জন্য ওকে ভিখারী বলছে? আসলে তো আঁখিই ভিখারী। ওর বাবার নিজস্ব বাড়ি আছে আর আঁখির বাবা তো ফ্লাট কিনে থাকে। সাদিয়া আঁখির উপর খুব রেগে গেলো। বড় বড় পা ফেলে আঁখির উপর রেগে বাসার দিকে গেলো।

——————————

“আম্মু! তুমি এখানে একা একা কাজ করোছো তোমার ছেলের বৌ কই? তাকে বাড়িতে এনেছো কি বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে? তুমি বান্দির মতো সারাদিন খাটবে আর সে বসে বসে রানীর মতো খাবে?”

সাদিয়া রেগে বাসায় ঢুকে দেখলো ওর মা রান্নাঘরে কাজ করছে। আঁখি ওখানে নেই। ওর রাগটা যেনো আরও বেড়ে গেলো। রেগে ওর মাকে এসব বললো। মিসেস শাহনাজ ওর কথা শুনে চমকে তাকালো। সাদিয়ার কি হয়েছে যে এত রেগে আছে? এসবেই বা বলছে কেনো? মিসেস শাহনাজ অবাক হয়ে বললেন।

“এই তুই পাগল হয়ে গেছিস্? এসব আবোল তাবোল কি বলছিস? আঁখি শুনলে কি ভাববে বলতো? তোর একমাত্র ভাইয়ের বৌ তাকে নিয়ে এসব বলছিস কেনো?”

“শুনুক! তাতে আমার কি? আমি কি ভয় পাই? আমি তারটা খাইও না পড়িও না। আমি আমার বাবারটা খাই, আর নিজেও তো আমার বাবারটা খায় তো এত রানী সেজে থাকার কি? একটু কাজ করলেও তো পারে।”

আঁখি গোসল শেষ করে রান্নাঘরের দিকেই আসছিলো। সাদিয়ার কথা শুনে ও থমকে গেলো। ও জেনো অবাকের শেষ পর্যায় পৌছে গেলো। সাদিয়া ওকে তো আগে ভালোই বাসতো এখন এসব বলছে কেনো? কি করেছে ও? সব ননদরাই কি এমন হয়? ওরা ভাবিদের পিছনে লেগে থাকে? আঁখিতো সাদিয়াকে অন্য রকম মনে করেছিলো কিন্তু ও নিজেও অন্যদের মতো প্যাচ লাগাচ্ছে। আসতে না আসতেই ওকে খাওয়ার খোটা দিচ্ছে? কাজ নিয়ে কথা বলছে? ও তো রান্না ঘরে এতক্ষণ ছিলো। সাদিয়া নিজেই সকাল থেকে কিছু করেনি ও আবার ওকে বলছে? শ্বশুরবাড়ির সবাই এমন হয় কেনো? তারা কেনো আপন করে নেয় না? আঁখি আর দাড়ালো না। কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে এলো। মিসেস শাহনাজ সাদিয়াকে ধমক দিয়ে বললো।

“কি বলছিস এসব? দিবো এক থাপ্পড়, তুই কোনো কাজ করছিস আবার অন্য কাউকে বলোছ? তুই নিজে একদিন পরের বাড়ি যাবি না? সেদিন বুঝবি যা এখান থেকে। একদম ফালতু কথা বলবিনা আর কখনও। সাজ্জাদ শুনলে না জানি কি করে। বাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে পারে।”

“হ্যাঁ থাকো তোমার ওই ছেলেকে নিয়ে। ওই ছেলে বৌয়ের আঁচল ধরেই থাকবে। তোমাকেই বান্দির মতো খাটাবে।”

কথাটা বলেই সাদিয়া রেগে চলে গেলো। আঁখির পক্ষ নেওয়ায় ওর মায়ের প্রতিও রাগ হলো। মিসেস শাহনাজ কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলেন। কে জানে কি হয়েছে আজ? এমন করার কারন বুঝতে পারছেন না তিনি। সাজ্জাদ শুনলে বাসা ছেড়েই চলে যাবে। তখন তিনি থাকবেন কি করে? তার ছেলে যেনো তাকে ছেড়ে না যায় তার জন্য তিনি বৌকে কাজ করে খাওয়াতেও রাজি।

আঁখি রুমে গিয়ে বালিশ নিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখের জল যেনোবাঁধ মানছে না ওর। শ্বশুর বাড়ি আসতে না আসতেই ওকে এসব শুনতে হচ্ছে? কখনও ভাবেনি এমন হবে। এসব তো শোনারেই কথা ওর। ওর জামাই বেকার কাজ করেনা আজও সকালে সেজেগুজে আড্ডা দিতে চলে গেলো। ওর বই আনতেও শ্বশুর কে বলতে হয়েছে। তাহলে তো ওর ননদ এসব বলবেই। যার জামাই বেকার তাকে তো সবসময় এসব শুনেই যেতে হবে। আজ সাজ্জাদ চাকরি করলে কখনই ওকে এসব বলতে পারতো না। কেনো ওর সাথেই এমন হলো? ওর জামাই য়বার মতো কর্মঠ হলে তো আজ এসব শুনতে হতো না। বেকার ছেলের প্রতিটা বউকেই শ্বশুর বাড়ির সবার খোটা শুনে থাকতে হয়। এটাই জগতের নিয়ম!

ইনশাআল্লাহ চলবে….

এডিট ছাড়া পর্ব……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here