শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩৬

0
2158

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৬

আঁখি অনেক দিন ধরে কলেজে যায়নি। আজ আনিকা আর ও একসাথে কলেজে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছা ছিলো পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করবে কিন্তু আফসোস এই ওর ভুলের জন্য বিয়ে হয়েই গেলো। ওর ভুল না হলেও বিয়েটা তো হওয়ারেই ছিলো। হয়তো নিরবের সাথে হত এখন সাজ্জাদের সাথে হয়েছে। আসল কথা ভাগ্য যার সাথে লিখেছে তার সাথেই হত। আঁখির কলেজে যেতে কেমন যেনো লাগছে। ওর বিয়ের কথা সবাই জেনে গেছে। কিভাবে হয়েছে সেটাও এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। লোকে ওর দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। আবার এটা ওটাও বলছে। আঁখির খারাপ লাগলেও অতটা পাত্তা দিচ্ছে না। মানুষের কাজেই কানাঘুষো করা। সত্যিটা কি তা দেখবে না। যা শুনবে তা নিয়েই পড়ে থাকবে। আঁখি এসব ভাবতে ভাবতেই পথ চলছে। এর মাঝেই আনিকা বলে উঠলো।

“সব মেয়েরা তাদের বান্ধবীকে তাদের বাসর সম্পর্কে কিছুনা কিছু বলে। তুই তো কিছুই বললি না। কিছু তো বল!”

আঁখি পুলকিত চোখে ওর দিকে তাকালো। ওর বাসর রাত কবে হলো? আঁখি একটু ভাবলো। নাহ ওর তো ওমন কোনো রাত মনে পড়ছে না। সাজ্জাদের সাথে কোনো রাতের কথা মনে হতেই ওর ঝগড়ার কথাই মনে পড়ছে। আর তা যে সে ঝগড়া না, তুমুল ঝগড়া। আঁখি শ্বাস ছেড়ে আনিকার দিকে তাকিয়ে বললো।

“আমার তো বাসর হয়নি তো বলবো কি ছাতার মাথা? এই জীবনে আমার বাসর হবে না বুঝলি? ওই মানুষটার সাথে বাসর না হওয়াই ভালো দোস্ত! আস্ত শয়তান একটা। সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগে থাকে।”

“ভাইয়ার দোষ কেনো দেছ? তুই নিজেও তো ভাইয়ার পিছনে লাগোছ। দুজনেই সমান অপরাধী।”

আখি হাটা থামিয়ে চোখ গরম করে আনিকার দিকে তাকালো। আনিকা ঠোঁট উল্টে ওর দিকে তাকালো। আঁখির গরম চেহারা দেখেই ও কাঁদো কাঁদো মুখ করে জোর পূর্বক হাসলো। আঁখির দোষ বলা যাবে না। তাহলেই ক্ষেপে যাবে। এই দুটো আর ঠিক হলো না সারাক্ষণই ঝগড়ায় থাকে। তো এদেন মিল হবে কি করে? মানুষ তো বিয়ের পর থামে এরা তো এখনও চালিয়ে যাচ্ছে আল্লাহ জানে কতদিন চলে। আনিকা হাটতে হাঁটতে বললো।

“সরি দোস্ত! মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।”

“আর যেনো এমন না হয়। তোর কাছে তো সাজ্জাদ ভাইয়াই ভালো। হুহ বেটা খাটাশ!”

মুখ বাকিয়ে কথাটা বললো আঁখি। আনিকা কিছুই বললো না। চুপচাপ সামনে আগাচ্ছে। ও জানে আঁখিকে বুঝিয়ে লাভ নেই। আনিকা এসব ছেড়ে বললো।

“এই বাড়িতে তোর কেমন লাগে রে? সবাই ভালো তো?”

আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাদিয়ার কথা মনে হতেই ওর খারাপও লাগলো আবার রাগও হলো। সাদিয়ার এমন করার কারও খুঁজে পাচ্ছেনা ও। আর সাজ্জাদ তো আছেই। ও জব করলে হয়তো এসব শুনতে হতো না। এই সমাজে বেকারের বৌ হলে এমনেই কথা শুনতে হয়। যার টাকা পয়সা যত, তার বউর সম্মানও তত! এমটাই হয়ে থাকে। টাকার এতটাই মুল্য যে এ দিয়েই ভালোবাসা আদর সম্মান সব কিনা যায়। আঁখি ঘরের কথা বাইরে জানাতে চাইলো না। এটা কোনো মেয়েরেই জানানো ঠিক না, এতে নিজেই ছোট হয়ে যায়। আঁখি একগাল হেসে হাটতে হাটতে আনমনে সামনে তাকিয়ে বললো।

“সবাই ভালো রে। তবে বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আগে বুঝিনি এখন বুঝি। বাবার বাড়ি সবথেকে স্বাধীন জায়গা। বাবা মার কাছেই সব থেকে নিরাপদ স্হান। কোথাও ভালো নাগলেও ওখানে ভালো লাগে। ওই জায়গাটা খারাপ হলেও সময়ের পরিবর্তনে বোঝা যায় ওটাই নিরাপদ ছিলো। বাবার বাড়ি এতটাই শান্তি যেখানে মন খুলে হাসা যায়, কথা বলা যায়। দোষ করলেও কিছুই মনে হয় না। মা হাজার বকলেও কিছুই মনে হয়না। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে প্রতিটা মেয়ের আতংক নিয়ে থাকতে হয়। কেউ কিছু না বললেও কথা বলতে ভয়, যদি ভুল হয়? তারা দোষ মনে করে। কথা বলতেও আনিজি লাগে ওখানে। একটা জিনিস নিজের হাতে ধরে খেতেও লজ্জা লাগে। যদি তারা আড় চোখে তাকায়! এটা প্রতিটা মেয়ের ক্ষেত্রেই হয়। আসলে যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি না গেছে সে বুঝবে না দোস্ত!”

আনিকা নিঃশ্চুপ। ওকেও তো শ্বশুরবাড়ি বাড়ি যেতে হবে। তখনও কি এমন মনে হবে? অবশ্যই হবে, বাবা মা ছাড়া একটু ভালো লাগবে না। কিকরে থাকবে তাদের ছাড়া? শ্বশুর বাড়ির কথা মনে হতেই ওর মনে হলো অর্নবের কথা। অর্নব কাল মেসেজ করেছিলো। আনিকা আর উওর দেয়নি। একটু ভাব নিয়েছে। মনে মনে ভাবলো আজও কি অর্নব আসবে না? আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“আঁখি! অর্নব কাল থেকে আড্ডা দেয়না। অফিসে যায়। হয়তো আবারও বাড়িতে প্রস্তাব দিবে। তোরও বিয়ে হয়ে গেছে আমি এবার রাজি হয়েও যেতে পারি।”

কথাটা বলেই লজ্জা রাঙা হাসি দিলো আনিকা। আঁখি জোরপূর্বক হাসলো। সবাই আড্ডা ছেড়ে নিজেকে তৈরি করছে আর সাজ্জাদ? আখি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মুচকি হেসে আনিকার দিকে তাকিয়ে বললো।

“অর্নব ভাইয়া ভালোই। অনেক তো ঘোরালি। আমার মনে হয় এবার রাজি হওয়াটাই ঠিক হবে।”

আনিকা আবারও লজ্জা মাখা হাসি দিলো। আঁখি নিজেও হাসলো। তবে কৃত্রিম হাসি। ওর মন কেনো জানি হতাশ থাকে। একদিকে সাদিয়া আবার সাজ্জাদ সব মিলিয়ে একটুও ভালো লাগছেনা। আনিকা আজও কলেজে গিয়ে এদিক ওদিক খুঁজলো। ও জানে অর্নবকে দেখবেনা তবুও মন কেনো জানি শুনতে চায় না। আনিকা একটু অপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকে গেলো। ও যেতেই অর্নব আড়াল থেকে তৃপ্তির হাসি দিয়ে চলে গেলো। ও তো আনিকার চোখে এই আকাঙ্ক্ষাটাই দেখতে চাইতো।

—————————

পড়ার টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে আখি। সামনে মোটা বই খোলা। বাহিরে মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। হয় তো বৃষ্টি আসবে। আজ ওর মন খারাপ বলে আকাশটাও মেঘ করেছে। পড়তে বসলেও ওর মন একেবারেই বইতে নেই৷ আজ কলেজে যাওয়ার পর অনেক কথাই শুনেছে। কেউ কেউ তো বলেছে সাজ্জাদের বাবার টাকা দেখে আখি ওকে ফাসাইছে। আবার কেউ কেউ বলেছে ওর সৌন্দর্যে আঁখি পাগল হয়ে ওর পিছনে পিছনে ঘুরছে। আঁখি কারও কথার উওর দেয়নি নিশ্চুপ ছিলো। যদিও ওর খারাপ লেগেছে তবুও কিছু করার ছিলো না। উওর দিলে ঝামেলা আরও বাড়তো। আঁখি এটা সেটা ভাবছে এর মাঝেই হলকা বাতাস শুরু হয়েছে। ঝিরঝির বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। পরিবেশ একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। আঁখি টেবিল ছেড়ে উঠে বেলকনিতে গেলো৷ হালকা বাতাসে বৃষ্টির কনাগুলো আঁখির গায়ে আছড়ে পরছে আঁখি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অনুভব করলো। ওর হঠাৎ করেই এই বৃষ্টিতে নাচতে মন চাইলো।

বৃষ্টির মাঝে বাসায় ফিরছে সাজ্জাদ। শরীর অনেকটাই ভিজে গেছে। আশরাফ খানও আজ বাড়িতে। সাজ্জাদ মিষ্টি হাতে ভিজে ভিজে বাসায় প্রবেশ করলো। সাজ্জাদ ভিতরে ঢুকে মিষ্টির পেকেটটা ওর মায়ের হাতে দিয়ে চুল গুলো ঝাড়তে লাগলো। সবাই ওর হাতে মিষ্টি দেখে অবাক হয়েছে। আবার ভাবছে হয়তো বিয়ে করেছে তাই এনেছে। সাজ্জাদ চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললো।

“আমার চাকরি হয়েছে আম্মু! কম্পানিটা খুবেই ভালো। সেলারিও মোটামুটি ভালো। অন্তত আমার এতে সংসার ভালোভাবেই চলে যাবে।”

সবাই চমকে তাকালো। ভুল শুনছে নাতো ওরা? সাজ্জাদ আড্ডা ছেড়ে চাকরি করবে? আশরাফ খান ভাবছেন ও মজা করছে। মিসেস শাহনাজ মিষ্টিটা রেখে বললেন।

“মজা করছিস কেনো বাবা?”

সাজ্জাদ ওর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বললো।

“আমি মজা করছি না আম্মু! সত্যি আমার চাকরি হয়েছে। নিজে এতকাল বাবার টাকায় খেয়েছি। বৌকে তো আর তার টাকায় খাওয়াতে পারি না তাইনা?”

ওর কথায় মিসেস শাহনাজ আকাশসম খুশি হলেন। খুশিতে কেঁদেই দিলেন। তার ছেলেটা বোধহয় এবার ঠিক হবে। আশরাফ খান এখনও বাকরুদ্ধ। বুঝতে পারেননি সাজ্জাদ এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে। তিনিও খুব খুশি হয়েছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন।

“শাহনা! মিষ্টি এনে দেও! খেয়ে নেই। এই খুশিতে চুপ থাকা যায় না। তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো!”

সাদিয়া তো আরও অবাক। আঁখি কি ওর ভাইকে কিছু বলেছে? আবার ভাবলো তাহলে তো ওর ভাই ওকে জিজ্ঞাসা করতো। ও গালে হাত দিয়ে বললো।

“বাড়িতে বৌ আসতে না আসতেই এত চেঞ্জ? আর বাবা মা এত বছর ধরেও চেঞ্জ করতে পারলো না? বাহ বা!”

সাজ্জাদ রেগে ওর দিকে তাকালো। কেনো জানি ওর কথাটা ভালো লাগছে না। ওর বোন এভাবে কথা বলতে পারে ওর জানা ছিলো না। সাজ্জাদ কিছু না বলে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ওর রুমের দিকে চলে গেলো। সবাই আনন্দে মিষ্টি মুখ করতে লাগলো।

“Cham cham cham…Cham cham cham…

Zulfon se baandh leya dil,
Seene pe se udne laga aaya aanchal,
Mujhse naina mila ke,
Mausam hone lage paagal,

Sabse hoke befikar nachun main aaj,

Cham cham cham…..Cham cham cham,
Cham cham cham cham cham,

Main nachun aaj

Cham cham cham…..Cham cham cham,
Cham cham cham cham cham

সাজ্জাদ রুমে ঢুকে আঁখিকে দেখতে পেলো না। বেলকনিতে থেকে শব্দ পেয়ে ও ওখানে গেলো। দেখলো আঁখি কোমরে ওড়না বেঁধে বৃষ্টির তালে তালে গান গেয়ে নাচছে। নাচছে বললে ভুল হবে। নাচছে কম লাফাচ্ছে বেশি। সাজ্জাদের খুব হাসি পেলো ওর কান্ড দেখে। একদম ছোট বাচ্চাদের মতো করছে। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ও দরজায় হেলান দিয়ে দেখতে লাগলো। আঁখি নাচতে নাচতে হঠাৎ সাজ্জাদের উপর চোখ পড়লো। ও থমকে দাড়িয়ে গেলো। থতমত খেয়ে ওড়নাটা খুলে ঠিক করে গায়ে দিলো। সাজ্জাদ চুপচাপ তাকিয়ে আছে। আঁখি এক কোষ পানি ওর গায়ে মেরে রেগে ফোসফাস করে বললো।

“রুমে ঢোকার আগে যে অনুমতি নিতে হয় সেটা জানেন না? কেউ শিখায় নি আপনাকে? রুমে তো অনুমতি ছাড়া ঢুকছেনেই বেলকনিতেও চলে এসেছেন। এটা কোন অভ্যাস?”

সাজ্জাদ ওর কথায় অবাক হলো। শেষে কিনা নিজের রুমে অনুমতি নিয়ে ঢোকা লাগবো? এই মেয়েটার মতিগতি কিছুই বোঝেনা ও। কোন সময় কোন মুডে থাকে কে জানে? সাজ্জাদ কপাল কুচকে বললো।

“এই! তুমি কি বলো এগুলো? আমার রুমে আমি অনুমতি নিয়ে ঢুকবো কেনো? আমি অনুমতি নিতে পারবো না।”

“অবশ্যই নিতে হবে। আলবাত নিতে হবে। ইসলামে বলেছে মায়ের ঘরে ঢুকতেও অনুমতি লাগে। এখানে তো আমি থাকি তো অনুমতি নিতেই হবে। আমি এখানে কেমন থাকি না থাকি আর আপনি চুপচাপ ঢুকে পড়েন। আপনার চোখ তো ভালো না দেখছি।”

আঁখি কোমরে হাত দিয়ে সাজ্জাদের দিকে একটু এগিয়ে কথাগুলো বললো। সাজ্জাদ আঁখির দিকে এগিয়ে ওর দিকে একটু ঝুকে আস্তে করে বললো।

“মায়ের ঘরে ঢুকতে অনুমতি লাগে। বৌয়ের রুমে ঢুকতে কখনও অনুমতি লাগেনা বুঝেছেন?”

কথাটা বলেই আঁখির নাকটা হালকা টান দিয়ে সাজ্জাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমের ভিতরে চলে গেলো। আঁখি ওখানেই থম মেরে হা করে তাকিয়ে রইলো। এটা কি বলে গেলো সাজ্জাদ? ওকে কি সাজ্জাদ বৌ বলে গেলো?

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here