শরতের বৃষ্টি পর্ব-৩৮

0
1985

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৩৮

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে!”

মুচকি হেসে কথাটা বললো সাদিয়া। নিরব বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো। একটু শান্তি খুজতে ছাদে এসেছিলো কিন্তু শান্তির বদলে অশান্তি পেয়েছে ভাগে। ঘরের বাইরে কোথাও গিয়ে নিরব শান্তি পায়না। সব জায়গায় সাদিয়ার জালাতন। ও যেখানে যাবে সাদিয়া সেখানে গিয়েই ওর সাথে কথা বলা শুরু করে দিবে। এতবার নিষেধ করা সত্বেও ও সাদিয়াকে শোনাতে পারেনা। ওইদিন বিকালে নদীর পাড়ে গিয়েছিলো সাদিয়া সেখানে গিয়েও ওকে বিরক্ত করে আসছে। জোর করে সেলফি তুলে আসছে। নিরব বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারেনি ওকে বলার সুযোগ দেয়নি। সকতদিন বুঝিয়েছে সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা ওকে মন দিয়ে পড়তে তবুও ও নিরবকে বিরক্ত করে চলে। কোনো দিন তো কতা বলার আগে বলেনা কথা আছে, আজ হঠাৎ একথা বলছে কেনো? নিরব সজাগ দৃষ্টিতে তাকালো। রাগি চোখে তাকিয়ে বললো।

“সামনে না তোমার এইচএসসি পরীক্ষা? এখানে কি করো? যাও গিয়ে পড়তে বসো!”

“আগে কথাটা শুনে নিন! তারপরেই যাবো।”

নিরব এবার অন্য দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিলো। ও জানে সাদিয়া কথা না বলে যাবেও না। ভারি জেদি মেয়েটা। যেটা বলবে তা করেই ছাড়বে। ছোট হওয়ায় কিছু বলতেও পারছে না। নিরব আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“আচ্ছা কি বলবে বলো! বলে তাড়াতাড়ি বিদায় হও!”

সাদিয়া অবাক হয়ে বললো।

“আপনি আমাকে যাওয়ার জন্য এমন তাড়া দিচ্ছেন কেনো? আমি মোটেও যাবো না তাহলে। এখানেই থাকবো।”

“ওকে তাহলে তুমি থেকো আমি চলে যাবো!”

“আপনার মন এত খারাপ থাকে কেনো? আগের মতো হাসতে পারেন না? হাসলে আপনাকে অনেক ভালো লাগে।”

সাদিয়া লজ্জা জনক হাসি দিয়ে কথাগুলো বললো। এই কথাটা বলতেই নিরবের মন আরও খারাপ হয়ে গেলো। হুট করেই আঁখির কথা মনে পড়লো। আঁখিকে হারিয়ে যেনো ও ভিতর থেকে মরে গেছে। ওর হাসি খুশি সবেই তো আঁখির জন্য ছিলো। নিরব সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে রেগে বললো।

“এই কথাটা বলার ছিলো তোমার? বলা হয়েছে তো? এবার যাও এখান থেকে!”

সাদিয়া বুঝতে পারলো নিরব রেগে গেছে। ও তাড়াহুড়ো করে বললো।

“না না! এটা বলতে চাইনি। বলছি বলছি!”

নিরব রেগে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। সাদিয়া আমতা আমতা করে বললো।

“আপনাকে প্রথম দেখেই আমার খুব ভালো লাগে। আপনার হাসি কথা সবেই আমার মনে গেঁথে যায়। আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাই। আখি আপুর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে জেনে অনেক কেঁদেছি। বারবার চেয়েছি বিয়েটা যাতে ভেঙে যায়। আমি সত্যি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”

নিরবের এবার প্রচন্ড মাথা গরম হলো। ও আগেই সাদিয়ার হাবভাব দেখে এমন কিছু হবে বুঝতে পেরেছে। সাদিয়া চাইতো আঁখির সাথে ওর বিয়ে না হোক! এতে নিরবের খুব মেজাজ খারাপ হলো। তবুও নিরব মাথা ঠান্ডা করলো। এখন মাথা গরম করলে সাদিয়া রেগে উল্টা পাল্টা কিছু কারতে পারে। যেহেতু রাগি তার উপর বয়স কম। যদি সাদিয়া কিছু করে বসে তবে ওরেই মানসম্মান যাবে। নিরব জোরপূর্বক হেসে বললো।

“দেখো সাদিয়া! তুমি বয়সে ছোট একটা মেয়ে। সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ো। সামনে তোমার এইচএসসি পরীক্ষা। এখন তোমার এসব মাথায় আনাও ঠিক না। আরও বড় হও! মন দিয়ে পড়ালেখা করো। এসব ভাবার বয়স সামনে অনেক পড়ে আছে।”

সাদিয়া কথাটায় খুশি হতে পারলো না। ও হালকা কপাল কুচকে বললো।

“আমি মোটেও ছোট না। আমার বয়স কদিন পরেই১৮হবে।”

নিরব অনেক বিরক্ত হলো। একটু রেগেই বললো।

“ফালতু কথা বলো না। এখন তোমার পড়ালেখা করার বয়স এসব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দাও৷ তোমার ১৮ও হয়নি আর আমার বয়স ২৮বুঝেছো? আর কখনও আমাকে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলতে আসবে না।”

কতাটা বলেই নিরব রেগে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো। সাদিয়া এসবের জন্যও আখিকে দায়ী ভাবছে। ও রেগে ছাদ থেকে নামতে নামতে বলতে লাগলো।

“ওই আঁখির জন্য সব কিছু তাইনা? ওকে তো আমি দেখে নিবো। ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলে আর আমার বেলাতেই মুখ ভার? আমিও এত সহজে পিছু ছাড়ছি না।”

———————————-

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। সাদিয়া সাজ্জাদ কে বিচার দিবে বলে কি মনে করে যেনো বিচার দিলো না। সাজ্জাদ একন নিয়মিতভাবে অফিসে যায়। অর্নবও অফিস নিয়ে ব্যস্ত। সবাই মোটামুটি আড্ডা ছেড়ে স্যাটেল হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন পার হলেও এখনও আমিনুর রহমান রেগে আছেন। আঁখির সাথে কথা বলেন না। ওর দিকে তাকানও না। মিসেস রোকেয়া রহমান মেয়ের সাথে দেখে না করে থাকতে পারেন না। তিনি স্বামীর অগোচরে মেয়ের সাথে দেখা করেন। আতিকও আঁখির কাছে প্রায় প্রতিদিনেই আসে। শ্বশুরবাড়িতে আঁখির মন না টিকলেও থাকতে হচ্ছে। এটাই নিয়ম। প্রত্যেক মেয়েকে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতেই থাকতে হয়। আঁখির এখন রুটিন হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন সকালে উঠে ওর শ্বাশুড়ির সাথে মিলে কাজ করে। দুপুরে কলেজে যায়। যেদিন কলেজ বন্ধ থাকে ওইদিন দুপুরের রান্নাও করে। বুঝে শুনে সবটা সামলানোর চেষ্টা করে। তবুও যেনো দোষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে খারাপ লাগলে শুয়ে থাকে কিন্তু তা নিয়ে মেয়ে আর মায়ের ভিতরে কিছু কানাঘুষোও হয়। এতে আঁখির খারাপ লাগলেও ও কান দেয়না। ওর মা হলে এই দোষ ধরতো না। যেমন মিসেস শাহনাজ সাদিয়ার দোষ চোখে দেখেন না। শ্বাশুড়ির কাছে সবসময় বৌয়ের কিছু দোষ আছেই আর বৌয়ের কাছে শ্বাশুড়ির দোষ আছেই। এটা চিরকালেই থাকবে। মা মায়েই হয়। শ্বাশুড়ি কখনও মায়ের মতো হতে পারবে না। বিয়ের পর হয়তো সাদিয়াও একদিন এটা বুঝবে।

আঁখির নিজের রুমটা পরিষ্কার করে সুন্দর করে গুছিয়ে পড়তে বসেছে। ওর সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা কিছুদিন পরেই। টেবিলে পড়তে বসতে ভালো লাগেনা তাই বিছায়নায় খাটের সাথে হেলান দিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসছে। সাজ্জাদ অফিস থেকে এখনও ফিরেনি ফিরলে হয়তো আঁখির মুখে পরা নয় ঝগড়া থাকতো। অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও ওদের ঝগড়া কমেনি। মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান সব সময়েই ওদের নিয়ে চিন্তা করেন ওরা এমন করলে কিভাবে সংসার করবে? যদিও বৃষ্টির মৌসুম নয় তবুও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আঁখি ঠান্ডা পরিবেশে মন দিয়ে পড়ছে। এর মাঝেই সাজ্জাদ রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকেই হাতের শপিংব্যাগ গুলো সোফায় ফেলে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। আখি আড় চোখে এক পলক সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আবার সোফার দিকে তাকালো। অগত্যা রেগে বইটা বন্ধ করে বিরক্ত নিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকালো। সাজ্জাদের কোনো খবর নাই। ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। আঁখি রেগে অনেক জোরে বইটা বিছানার উপর ফেলে বললো।

“আপনি কোন আক্কেলে এই ভিজা শরীরে বিছানায় শুইছেন? বিছানাটা ভিজে যাচ্ছে না? আর এগুলো কোন স্বভাব? অফিস থেকে এসেই এটা সেটা ওখানে ফেলে রাখার কি অভ্যাস? ঠিক মতো রাখতে পারেন না?”

আঁখির বই ফেলার শব্দে সাজ্জাদ চমকে উঠলো। বিছানা থেকে উঠে ওর কথা শুনে রেগে বললো।

“এত গ্যাজগ্যাজ করো কেনো? একটু চুপ থাকতে পারো না? ঘুম ছাড়া মনে হয় তোমার কথার মেশিন বন্ধ হয় না তাইনা?”

আঁখি হা করে বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে গেলো। অবাক হয়ে সাজ্জাদের মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো।

“এই! আপনি কি আমায় ইনডাইরেক্টলি বাঁচাল বললেন?”

“ইনডাইরেক্টলি বাঁচাল কোথায় বললাম? আমি তো ডাইরেক্টলি বাঁচাল বলছি তোমাকে।”

সাজ্জাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাটা বলে অন্য দিকে তাকালো। আঁখি প্রচন্ড রকম অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। কোমরে হাত দিয়ে রেগে কপাল কুঁচকে বললো।

“আমাকে বাচাল বলে তা আবার স্বীকার করছেন?”

“সত্যি বলতে ভয় কিসের?”

“ইস্! আসছে আমার সত্যবাদী রে! আমি মোটেও বাঁচাল নই বুঝেছেন? কথাবার্তা ঠিক করে বলেন হুহ!”

আঁখি মুখভার করে কথাটা বললো। সাজ্জাদ অবাক হয়ে আঁখির দিকে তাকালো। ওর রুমে থেকেই ওকে হুমকি দিচ্ছে? ওর কথাবার্তা কি খারাপ যে, ঠিক করতে বলতাছে? সাজ্জাদ আঁখির দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে বললো।

“এই আমার কথা একদম ঠিক আছে বুঝেছো? আর ঠিক করতে হবে না এবার নিজেরটা ঠিক করো!”

“একদম ফালতু কথা বলবেন না আমার কথা ঠিকই আছে। আপনার স্বভাব চরিত্র কিছুই ঠিক নাই। এই শপিংগুলো সোফায় রাখছেন কেনো? এই যে বিছানা ভিজাইছেন এগুলো কে শুকাতে দিবে? হুম? বদ অভ্যাস একটা!”

সাজ্জাদ এবার প্রচন্ড রেগে গেলো। সারাদিন অফিস করে এসে একটু শুয়েও শান্তি নাই। রুমে আসতে না আসতেই ক্যাচক্যাচ। সাজ্জাদ রেগে বললো।

“এমন করে কথা বলো কেনো তুমি? সারাদিন অফিস করে এসে তোমার রুমে জিনিস সাজিয়ে রাখবো হুম? ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছি এক গ্লাস পানিও তো দিলা না। সবাই অফিস থেকে বাসায় ফিরার পর দরজা খুলে হাতের জিনিসটা নেয়, জিজ্ঞাসা করে কিছু লাগবে কিনা? আর তুমি কি করো? হুম কি করো? আমি আসি না আসি তার ঠিক নাই। একদিন দরজাও খুলো না। রুমে আসতে না আসতেই ঝগড়া। আর বাসায় আসবোই না। কোথাও শান্তি নাই!”

কথাটা বলেই সাজ্জাদ রেগে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আঁখি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ও বুঝতেই পারেনি ওর এতটা ভুল হইছে। আঁখি নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। সত্যি ওর খুবেই খারাপ লাগছে। সারাদিন অফিস করে শরীর ক্লান্ত থাকে মাথা গরম থাকে। তখন কারই উচিত না এভাবে কথা বলা। তার কি লাগবে না লাগবে সেদিকে খেয়াল দেওয়া উচিত ছিলো। আঁখি মন খারাপ করে ভাবলেশহীন ভাবে বিছানায় বসে পড়লো। সাজ্জাদ কে বাসা বেড়িয়ে যেতে দেখেই মিসেস শাহনাজ মন খারাপ করে বললেন।

“বাসায় আসতে না আসতেই ঝগড়া, কি করবো আমি!”

সাদিয়া ওর মায়ের পাশেই ছিলো। ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে রেগে কপাল কুচকে বললো।

“কি আর করবা! আরও লাই দেও ওই মেয়েকে। তোমাদের লাই পেয়েই তো এমন করে। এখনও কিছু বলবা না তুমি? বাবার সাথে তুমি কখনও এমন করছো? ওই মেয়েরই যত দোষ। ভাইয়া অফিস করে এসেও শান্তি পেলনা।”

সাদিয়ার কথা শুনে মিসেস শাহনাজ রেগে গেলেন। একটা মায়ের রাগার জন্য এতটুকু কথাই যথেষ্ট। মিসেস শাহনাজ রেগে আঁখির কাছে গেলেন। দেখলেন আঁখি বিছানায় চুপ হয়ে বসে আছে। মিসেস শাহনাজ ওকে হাতের বাহু ধরে দাড় করিয়ে বললো।

“এবার শান্তি হয়েছে তোমার? ছেলেটার সাথে সারাদিন এমন করো। এখন বাসায় আসতে না আসতেই ঝগড়া করে বের করে দিলা। এবার শান্তি হয়েছে তাইনা? সারাদিন কত খাটনি করে এলো এক গ্লাস পানি না খেয়ে চলে গেলো। স্বামীর মানে জানো? যদি নাই জানো তবে বিয়ে করেছো কেনো? থাকতে না চাইলে চলে যাও তবুও আমার ছেলের সাথে এমন করো না দোহাই লাগে।”

কথাটা বলে মিসেস শাহনাজ চলে গেলেন। আঁখি এখনও ভাবলেশহীন ভাবে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। সাদিয়া তো বেজায় খুশি। ওর মতে একেবারে উচিত শিক্ষা হয়েছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here