#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৪২
রেস্টুরেন্টের এক টেবিলে গোল হয়ে বসে আছে বন্ধু মহলের সেরা চার বন্ধু। যদিও স্কুল কলেজ লাইফে অনেক বন্ধু ছিলো কিন্তু ভারসিটিতে উঠার পর থেকেই বন্ধুদের সংখ্যা কমতে লাগলো। পড়া লেখা শেষে সবাই সবার নিজ গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। কেউ জাকরির খোজে কেউবা সংসার নিয়ে বিজি৷ কিন্তু পরে থাকলো ওরা চার বন্ধু। সাজ্জাদ, অর্নব, রনি আর আশিক। রেস্টুরেন্টে বসে ওরা আড্ডা দিচ্ছে আর এটা ওটা খাচ্ছে। আজ অনেক দিন পর ওরা একসাথে হলো। এখন ওরাও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। সাজ্জাদ একাই জব করে বাকি তিনজন নিজের বাবার বিজনেস সামলাচ্ছে। অর্নব কফি হাতে মুচকি হেসে বললো।
“আজ আমি খুব খুশি। আমার লাইফে সবচেয়ে বেশি খুশির দিন। তোদের জন্য ট্রিট আছে। আজকের বিলটা আমি দিবো। ওকে?
ওরা তিন জনেই কফি খাচ্ছিলো। অর্নবের কথার মানে বুঝতে পারলো না। তিন জনেই ভ্রু কুচকে উৎসুক চোখে অর্নবের দিকে তাকালো। কি এমন হয়েছে যে ও অনেক খুশি? রনি কফির মগটা টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসতে হাসতে বললো।
“আমি ১০০% সিওর আনিকা রাজি হয়েছে? কি? আমি কি ঠিক বলেছি মামা?”
কথাটা শুনে অর্নব একটু হাসলো। সাজ্জাদ, আশিক রনির কথায় অতটা পাত্তা দিলো না। ওরা জানে সব সময় রনি মজা করে। আর বুঝে না বুঝে মনে যেটা আসে সেটাই বলে। রনি ওর হাতের সাথে অন্য হাতে তালি মেরে সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“দেখ! ওর মুখ দেখে তেরা! এর হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমি ঠিক কথা বলেছি। কি মামা!”
কথাটা বলেই অর্নবের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। অর্নব ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।
“রনি অনেকটাই ঠিক বলেছে। তবে ও যা বলেছে তার থেকে বেশি কিছু হয়েছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
ওর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো। রনি হুর রে বলে লাফিয়ে উঠলো। পরক্ষনেই মনে হলো ও রেস্টুরেন্টে! সাথে সাথে সরি বলে বসে পড়লো। সবাই অর্নবকে কংগ্রাজুলেশন জানাচ্ছে। রনি কফি খেতে খেতে বললো।
“যাক বাবা! অনেক দিন হয়েছে বিয়ে খাইনা। এবার অন্তত পেট পুরে একটা বিয়ে খেতে পারবো। সাজ্জাদ যে বিয়ে করলো ও তো খাওয়ালোই না।”
রনির কথায় ওরা সবাই সায় দিলো। সাজ্জাদ ওদের কাহিনী দেখে জোরে শ্বাস ছেড়ে আলসামী ঝেড়ে বললো।
“আমার ওটা কোনো বিয়ে? গিনেস বুকে নাম উঠানোর মতো বিয়ে। মানুষ বউয়ের থেকে কত কি পায়। আর আমি ঝগড়া ছাড়া কিছুই পাইনা। সকাল শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে আর রাত শেষ হয় ঝগড়া দিয়ে। ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
ওর কথায় সবাই হেসে উঠলো। রনি হাসতে হাসতে বললো।
“তোরাই ঠিক আছোছ! তোদের ভালোবাসা ঝগড়ার মাঝে। তোদের মাঝেও খুব ভালোবাসা আছে তবে তা শুধু ঝগড়ার জন্য দেখা যাচ্ছে না।”
ভালোবাসার কথা মনে হতেই সাজ্জাদের সকালের কথা মনে উঠলো। ওর মনের কোনায় উকি দিলো হালকা ভালোবাসার আলো। ও কি সত্যি আঁখি কে ভালোবাসে? তা না হলে মাঝে মাঝে এমন মনে হয় কেনো? আজ সকালে নিরবের সাতে কতা বলতে দেখে ওর এত মাখা গরম হচ্ছিলো কেনো? তাহলে কি? পরক্ষনেই নিজে নিজেকেই বকলো। এটা এটা শুধু এমনিতেই। ও আঁখি কে ভালোবাসে না। রনি অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো।
“তোর বিয়ে হবে আর তুই এই হালকা খাবারের ট্রিট দিবি? এত কিপ্টা কেনো তুই? মোটেও হবে না। এই কটা টাকা বিল তো আমি এমনি এমনি দিতে পারি।”
“তাহলে বিলটা তুই দে!”
সাজ্জাদের কথা শুনে রনি অবাক চোখে তাকালো। বুঝে পেলেছে ভুল জায়গায় ভুল কিছু বলে ফেলেছে। অর্নব আর আশিকও ওর সাথে তাল দিলো। রনি ওদের দিকে আহত চোখে তাকালো। মানে সবাইকে ছেড়ে ওকেই কেনো দিতে হবে? টাকা ইনকাম করলে বন্ধুদের থেকেও রেহাই নেই। রনি বাধ্য হয়ে বিল দিতে রাজি হলো। রনি বিলের কার্ড দেখেই অবাক হলো বললো।
“একি? এতো সোজা এ্যাটেম্প টু ছিনতাই! দেখছোছ দিনে দুপুরে ডাকাতি করছে। এই কটা বিলের দাম এত হয়?”
ওয়েটার ওর কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলোনা। বোকার মতো তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো। “সরি স্যার!”
রনির কাহিনী দেখে সাজ্জাদ ওরা সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। রনি গাল ফুলিয়ে মানি ব্যাগ বের করলো। ভেবেছিলো অর্নবের থেকে বেশি করে খাবে, কিন্তু এখন সবাই ওকেই খেয়ে ফেলছে।
“মানি ব্যাগ চিনতাই হয়ে গেলো রে আমার!” রনি বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে ওয়েটারকে বিল দিয়ে দিলো। ওর কাহিনী দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। রনি সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
“এত হাইসো না মামা রা! আমারও দিন আসবে বুঝেছো? শুধু বিয়েটা করতে পারছিনা বলে! তোরা দুজন তো বিয়ে করে সাবার করেছিস্ এখন আমি আর আশিকেই থাকবো সিঙ্গেল? আমিও মেয়ে খুঁজে নিবো!”
ওর কথা শুনে অর্নব মুচকি হেসে বললো।
“আরে দোস্ত আমাদের মাঝে তুই একাই সিঙ্গেল! আশিকও ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। ওদের অফিসের একটা মেয়ের জন্য চোখের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।”
রনি অবাক হয়ে তাকালো সাথে সাজ্জাদও! ওরা দুজনেই এই বিষয়ে জানতো না। আশিক কাচুমাচু করে ওদের দিকে তাকালো। আশিক একজন কে পছন্দ করে আর ও জানে না? ওকেই বলা হয়নি? কথাটা ভেবেই রনি রেগে আশিকের পিঠে জোরে কিল মেরে বললো।
“তুই একটা মাইয়ারে পছন্দ করোছ আর আমি জানি না?”
আশিক নিজের পিট ডলতে ডলতে আহত গলায় বললো।
“আরে আমি তো আজ বলতেই আসছি। তার আগেই অর্নব বলে দিলো। আসার সময় শুধু ওকে হালকা পাতলা বলছি এখন তোকে আর সাজ্জাদ কেউ বলতাম!”
রনি আশিকের পিটে আরেকটা কিল বসালো। আশিক “উঃ” বলে লাফিয়ে উঠে বললো।
“আবার মারলি কেনো? কি হয়েছে?”
“আগের মাইরটা আমি জানি না বলে। এখন শুনলাম সাজ্জাদও জানেনা। তাই এই মাইরটা ওর পক্ষ থেকে আমিই দিয়ে দিলাম। আমি থাকতে ও কষ্ট করবে কেনো?”
মুচকি হেসে কথাটা বললো রনি। আশিক অসহায় চোখে ওর দিকে তাকালো। সাজ্জাদ আর অর্নব ঠোঁট চেঁপে হাসলো।
—————————
আজকে খুশির দিনে..
আমার বান্ধবীর বিয়ে দিনে..
নাচবো আমি উড়া ধুড়া রে…
হায় উড়াধুড়া…হায় উড়াধুড়া..
কি মজা ধীনাক ধীনাক…
আনিকা এইমাত্র ওকে কল করে বলেছে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তা শুনেই আঁখি উড়াধুড়া লাফিয়ে নাচ শুরু করে দিয়েছে। সাজ্জাদ রুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো। আঁখি কে এমন লাফাতে দেখে বোকা বনে গেলো। এগুলো কি নাচ, কি গান সেটাই বুঝতে ওর অনেকটা সময় লেগে গেলো। অবশ্য এটাকে আদৌও গান অথবা নাচ বলা যায় না। কিন্তু আঁখির এমন লাফানোর কারন সাজ্জাদ বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে বললো।
“কি হয়েছে? এভাবে পাগলের মতো লাফাচ্ছো কেনো?”
আঁখি কোনো হেলদোল হলো না। ওভাবেই লাফিয়ে নাচতে নাচতে বললো।
“লাফাচ্ছি কই? আমি তো নাচছি! দেখতে পাচ্ছেন না? আপনি কি চোখে কম দেখেন?”
“ওহ তাই বুঝি? কিন্তু কেনো নাচছো?
“আমার বন্ধবীর বিয়ে তাই!”
“বান্ধবীর বিয়েতে এমন অবস্থা। নাজানি নিজের বিয়েতে এ কি করতো। আল্লাহ বাচাইছে ওসব দেখতে হয়নি।”
সাজ্জাদ বিড়বিড় করে কথাটা বলে ওর উপরে জ্যাকেটটা খুলে বিছানায় বসলো। কিন্তু কথাটা আঁখির কান ফাঁকি দিতে পারলো না। আঁখি ওর কথাটা শুনে থেমে গেলো। রেগে কোমড়ে হাত দিয়ে সাজ্জাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো।
“এই আপনি কি পাগল? নিজের বিয়েতে কেউ নাচে কখনও শুনেছেন? আমার বিয়েতে আমার বান্ধবীরা নাচবে আর ওদের বিয়েতে আমি নাচবো বুঝেছেন? আপনার বিয়েতে মনে হয় আপনি নাচতেন তাই আমাকেও তেমন মনে হচ্ছে।”
সাজ্জাদ আঁখির কথাকে গ্রাহ্যই করলো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো৷ আঁখি অবাক হয়ে হা করে তাকালো। কি? এত বড় সাহস যে ওকে পাত্তা দিচ্ছে না? এটা তো হতেই পারেনা যে করে হোক পাত্তা পেতেই হবে। কি করবে এবার? পরক্ষনেই ওর সকালের কথা মনে হলো। বিছানায় বসে বললো।
“সকালে ওভাবে জোর করে নিয়ে গেলেন কেনো? কি আঁকুপাঁকু করছে আপনার মনে? সামথিং সামথিং তাইনা?”
সাজ্জাদ তবুও কিছুই বললো না। ও চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। ও আজ কথাই বলবে না। আঁখির সাথে আজ ঝগড়া না করে দেখবে কেমন লাগে। আঁখি রেগে ফোসফোস করতে লাগলো। সাজ্জাদ মনে মনে হেসে চুপ করে রইলো। আঁখি রেগে কথা না বলে শব্দ করে পা ফেলে বেলকনিতে চলে গেলো। ও যেতেই সাজ্জাদ চোখ খুলে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো৷ পরক্ষনেই বিছা ছেড়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। আঁখি বেলকনিতে গিয়েও ফোসফাস করতে লাগলো। সাজ্জাদ ওর সাথে এই প্রথম ঝগড়া করলো না। ওর কথাকে গ্রাহ্য করলো না। আঁখি ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কি হলো হটাৎ ওই সাজ্জাদের? ওর সাথে এমন করছে কেনো? পরক্ষনেই ভাবলো সাজ্জাদ ওকে গ্রাহ্য করেনি। ওর সাথে ঝগড়া করেনি তাতে ওর কি? ও এত রাগ করছে কেনো? তাহলে কি ওর মনের কোনো সাজ্জাদ আছে? ঝগড়ার মাঝেই কি ওদের ভালোবাসা লুকানো?
ইনশাআল্লাহ চলবে….