শরতের বৃষ্টি পর্ব-৪৩

0
1897

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৪৩

সময় সে চির বহমান অন্তত মহাকালের পথে। ছোট্ট জীবনে কিছু সময় আসে ভীষণ সুখের। হাসি-আড্ডায় ভরে থাকা সুসময় গুলো আটকে রাখার কত চেষ্টা আমাদের। কিন্তু মৃত্যুর প্রয়োজনে রোজ বড় হই আমরা। সময়কে আটকে রাখার কোন ক্ষমতা নশ্বর মানু্ষের নেই৷ আমরা যা পারি, তা হলো স্মৃতির পাতায় একেকটি সময়কে স্থিরচিত্রের আদলে গেঁথে রাখতে। সময় কখন পেরিয়ে যায় বলা যায় না। দেখতে দেখতে অনেক দিন পেরিয়ে গেলো। আজ আনিকার গায়ে হলুদ। এতদিন আঁখি অনেক উৎসুক ছিলো। কি পড়বে কিভাবে সাজবে তা নিয়ে সারাদিন ভেবেছে। অর্নবের পরিবার চেয়েছিলো ওদের গায়ে হলুদ কমিউনিটি সেন্টারে হোক কিন্তু আনিকার বাবা মা তাতে দ্বিমত পোষন করেছেন। শেষে অর্নবরা রাজি হয়েছে ওদের বাড়িতেই গায়ে হলুদ করতে। আজ সন্ধ্যায় আনিকার গায়ে হলুদ। ওদের ছাদে হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠান হবে। অর্নবরাও এখানে আসবে। সাজ্জাদ, রনি আর আশিক খুবেই উৎসুক! ওরা তো বিয়ে নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আঁখি ওর মায়ের থেকে একটা হলুদ শাড়ি এনেছে পরবে বলে। আঁখি ভেবেছিলো শাড়ি পড়েই আনিকাদের বাসায় যাবে কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো ওকে এত সাজদে দেখলে ওর শ্বাশুড়ি যদি কিছু বলে? এই ভয়েই শাড়ি নিয়ে আনিকার বাসায় চলে গেলো। ওখানে যেতেই দেখলো বাসা ভর্তি মেহমান। আঁখি এদিক ওদিক তাকিয়ে আনিকার রুমে চলে গেলো। ওখানেও মানুষের ভীড়! সবাই সাজগাজ নিয়ে ব্যস্ত। আনিকাকে পার্লারের মহিলা সাজাচ্ছে। আঁখিকে দেখেই আনিকা মুচকি হেসে ওকে ডাক দিলো। আঁখি হেসে ওর কাছে যেতেই বললো।

“কিরে? এখনও তৈরি হছনি? অনুষ্ঠানে কখন যাবি?”

আঁখি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললো।

“এই তো এখনেই রেডি হয়ে সব গুছাতে যাচ্ছি। মাশাল্লাহ তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। আজকে অর্নব ভাইয়া তো তোর থেকে চোখ ফিরাতেই পারবে না।”

আনিকা লজ্জা রাঙা হাসি দিয়ে বললো।

“যাহ কি যে বলিস্ না? যা শাড়ি পরে আয়!”

আঁখি শব্দ করে হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আনিকা আবারও হাসলো। আঁখি নিজে নিজেই কুঁচি দিয়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে নিলো। পার্লারের মহিলাদের সাজের জিনিস থেকেই হালকা সেজে নিলো। যদিও সাজতে ওর ভালোই লাগে কিন্তু এখন সাজা যাবে না। আনিকার কাজিনদের নিয়ে হলুদের সব কিছু রেডি করতে গেলো। সাজ্জাদ আর ওর বন্ধুরা সবাই ছাদে টুকটাক সাজাচ্ছে। অর্নবরাও এসে পড়েছে। ছাঁদের দু প্রান্তে দুটো স্টেজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন রকমের বেলুন, লাইটিং, হলুদ সাদা কাপর আর গাঁদা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে স্টেজ! সাজ্জাদ এসব কিছুর প্রধান প্রকৌশলী। ওরা চার বন্ধু একেই রকম ড্রেস পরেছে। অর্নব সাদা পান্জাবীর উপর হলুদ কালারে লাল সুতোর কাজের কোটি পড়েছে। সাজ্জাদ, রনি আর আশিক সাদা পায়জামা আর হলুদ পান্জাবী পড়েছে৷ অর্নব স্টেজে বসে আছে, ওর বন্ধুরা ওকে ঘিরে বসে আছে। একেকজন হাসি মজা করছে। অর্নব ওদের কথার মাঝেও বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রনি ওর পিঠে চাপড় মেরে বললো।

“কিরে? বিয়ে করতে যাইতাছোছ তাও চোখ ঠিক হয়নি তোর? এখনও এদিক ওদিক তাকাছ? আরে এখন মাইয়া মানুষ খুঁজবো আমি আর তা না তুই খুঁজছিস?”

ওর কথায় সাজ্জাদ আর আশিক হেসে ফেললো। অর্নব রনির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

“এই শা/লা! আমার চোখ কি তোর মতো খারাপ নাকি যে মেয়ে খুঁজবো? আমি একজনের দিকে তাকাইছি আর এখন তাকেই খুঁজছি। তোর মতো হাজারটা খুঁজি?”

রনি গাল পুলিয়ে আফসোসের স্বরে বললো।

“এটাই তো দুঃখ দোস্ত! আমার তো পোড়া কপাল। তুই তো একজনকে পেয়ে গেছোছ তাই কাউকে খুঁজছিস না। আমি তো ওই একজনকেই খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না।”

ওর আফসোসের স্বরে বলা কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। অর্নব তখন থেকে অপেক্ষা করছে কখন আনিকাকে দেখবে। কেমন লাগবে আজকে সাজে ওকে? অর্নব দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। এর মাঝেই নিরব ওদের কাছে আসলো। ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বললো।

“সবাইকে খুবেই সুন্দর লাগছে।”

নিরবের কথা শুনে সাজ্জাদ বিরক্ত নিয়ে অন্য দিকে তাকালো। ওকে দেখে সাজ্জাদের সকালের কথা মনে হলো। কিজন্য জানি নিরব আর ওর কথাকে সাজ্জাদের বিরক্ত লাগছে। রনি নিরবের কথায় বেশ উৎসুক হয়ে বললো।

“তাই? আমাকেও সুন্দর লাগছে? তাহলে একটা মেয়েও বললো না কেনো এ কথা?

ওর কথায় সবাই মুখ চেপে হাসলো। নিরব সাজ্জাদের বিরক্ত মাখা মুখটা দেখেছে কিন্তু কিছু না বলে পাশের চেয়ারে বসলো। এর মাঝেই সাদিয়া ওখানে আসলো। ওকে দেখেই নিরব বিরক্ত নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সাদিয়া মুখে উৎফুল্ল হাসি নিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“ভাইয়া! আমাকে কেমন লাগছে রে?”

কথাটা বলে সাদিয়া আড় চোখে নিরবের দিকে তাকালো। নিরবও কথাটা শুনে সাদিয়ার দিকে তাকালো। ঠোঁটে ঝুলছে উৎসুকের অমায়িক হাসি। গালকা গোলাপি ঠোঁটে হাসিটা সত্যি অমায়িক। সাদিয়া হলুদ আর লাল রংয়ের মিশ্রনের একটা শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো ছেড়ে মাঝে সিথির ভাঁজে একটি টিকলি দিয়েছে। সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস্ তো আছেই। খুব সুন্দর করে সেজেছে ও। অনেক সুন্দরও লাগছে ওকে। সাদিয়া নিরবের থেকে প্রশংসা শোনার অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। নিরব ওর চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছে। নিরব ওর মনটা খারাপ করতে চায়নি তাই মুচকি হাসলো। যদিও নিরব মন থেকে বলেনি তবুও সাদিয়া খুশি হয়ে গেলো। সাজ্জাদ ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো।

“পেত্নীর মতো লাগছে তোকে!”

সাদিয়া রাগি চোখে তাকিয়ে বললো।

“ভাইয়া! মিথ্যা বলবি না একে বারে। আম্মু বলছে খুব সুন্দর লাগছে। তুই মিথ্যা বলছিস!”

“বুঝেছি বড় হয়ে গিয়েছিস্। এবার তোর বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে হবে।”

সাদিয়া গাল ফুলিয়ে চলে গেলো। সাদিয়া যেতেই সাজ্জাদের হঠাৎ করেই আঁখির কথা মনে হলো। অনেকক্ষণ হলো আঁখিকে দেখছে না। সাদিয়া তো আসলো কিন্তু আঁখি কোথায়? কে জানে কেমন সেজেছে আজ! হঠাৎ করেই মনে হলো ও তো আঁখি কে হলুদ কিছু কিনে দেয়নি। বিয়েতে কিছু লাগবে কিনা তা আঁখি কেও জিজ্ঞাসা করেনি। কি পরেছে ও? সাজ্জাদের এখন খুবেই অনুশোচনা হলো। ও চরমভাবে নিজেকেই নিজে বকলো। এত বড় ভুল কি করে হলো ওর? পরক্ষনেই ভাবলো থাক কাল বিয়ের জন্য একটা ড্রেস কিনে দিবে। আজ ভুল করেছে কাল শুধরে নিবে। এর মাঝেই আঁখি হলুদের জিনিস পত্র নিয়ে ছাদে প্রবেশ করলো। এদিক ওদিক তাকাতেই সাজ্জাদের দিকে চোখ পরলো। সাজ্জাদ ওর বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে গল্প করছে। ওর হাসিটা বরাবরই খুবেই সুন্দর। আঁখি মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাজ্জাদকে পান্জাবীতে অনেক সুন্দর লাগছে। ফর্সা শরীরে হলুদ পান্জাবীটা খুবেই মানিয়েছে। সাজ্জাদকে পান্জাবী পড়তে দেখেই না আঁখি। পান্জাবীতে ওকে অনেক সুন্দর লাগছে আজ। হঠাৎ আনিকার কাজিনদের ধাক্কায় আঁখির ধ্যান ফিরলো। ও মুচকি হেসে স্টেজের দিকে কাজে চলে গেলো।

সাজ্জাদ ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ আঁখির দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলো। ওর বুকের মধ্যে টিপটিপ আওয়াজ হতে লাগলো। আঁখি মুখে হাসি ঝুলিয়ে এটা ওটা করছে। হাসিতে চেহারার উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে। কাঁচা হলুদ আর লালের মিশ্রনের একটা শাড়ি পড়েছে আঁখি। হলুদ রংয়ে ওর চেহারাও হলদে ভাব ধরেছে। হালকা হলুদ ও লাল পাড়ের শাড়ির সঙ্গে লাল বস্নাউজ খুবেই মানাইছে। আঁখি গাঁদা আর গোলাপ ফুল দিয়ে সেজেছে। গলায় কাঁচা ফুলের মালা আর মাথার চুলগুলো বিনুনি করে কাঁচা ফুল দিয়ে রেখেছে। সাজ্জাদ খুটিয়ে খুটিয়ে আঁখি কে দেখছে। ও যেনো অবাক হয়ে গেছে। চেহারায় সাজের লেস নেই। কিন্তু অমায়িক সুন্দর লাগছে। একদম হলুদ পরীর মতো লাগছে। সাজ্জাদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে আঁখিকে দেখতে লাগলো। আসলেই শাড়িতে নারীর সৌন্দর্য বেড়ে যায়। এখনো তাই শাড়ির আবেদন সামাজিক উৎসবে, বিভিন্ন পার্বণে। রং বাহারি শাড়ির সঙ্গে বস্নাউজে নিত্যনতুন ডিজাইন সেই সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

নিরব এতক্ষণ ওদের সাথে কথায় ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ সামনের স্টেজে তাকাতেই ওর চোখ আটকে গেলো। শাড়িতে আঁখিকে সেই কলেজের অনুষ্ঠানের দিন দেখেছিলো। ওইদিনেই ওকে বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলো। আজ আবারও আঁখি শাড়ি পড়েছে। সৌন্দর্য আগের মতোই আছে কিন্তু আঁখি আজ অন্য কারও। সাজ্জাদ হঠাৎ পাশে নিরবের দিকে তাকাতেই ওর মাথা খারাপ হয়ে গেলো। নিরব আঁখির আঁখির দিকে তাকিয়ে আছে দেখেই ওর চেহারা লাল হয়ে এলো। ব্যাপারটা ওর বন্ধুরা বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসছে। সাজ্জাদ ওখান থেকে উঠে হনহন করে আঁখির কাছে চলে গেলো। ওখানে গিয়েই রেগে আঁখির হাত ধরলো। হঠাৎ কেউ ওর হাত ধরায় আঁখি চমকে গেলো। সাজ্জাদ কে দেখে আরও চমকে গেলো। ওর এত রেগে থাকার কারন আঁখি বুঝতে পারলো না। সাজ্জাদ ওর হাত ধরে টেনে ওখান থেকে নিয়ে যেতে লাগলো। ছাদের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আঁখি নিজেও অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হলো হঠাৎ? ওকে টেনে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here