শরতের বৃষ্টি পর্ব-৪৬

0
2107

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৪৬

তীব্র সূর্যের আলো চোখে পরতেই ঘুম ভাঙলো আঁখির। কপাল কুচকে অন্য দিকে ঘুরতেই মাথায় আঘাত পেলো। মাথা ধরে হালকা পিটপিট করে তাকাতেই সাদা রংয়ের টাইলস্ চোখে পরলো। আখি হতবাক হয়ে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠলো। ও ফ্লোরে ঘুমিয়ে ছিলো? আখির ঘুম উড়ে গেলো। সাজ্জাদের উপর ভিষন রাগ হলো। ও এখানে শুয়ে ছিলো তবুও ওকে নিতে এলো না? আঁখির মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেলো। হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে রইলো। পরক্ষনেই ভাবলো সকালের নাস্তা বানাতে হবে তো! মন খারাপ বলে শ্বশুর বাড়ি কাজ না করে বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। শ্বশুর বাড়ি অনেক কাজ করে। সবার ভালো খারাপ সব কিছু লক্ষ করে খাটতে খাটতে মরে গেলেও রাজরানী হওয়া যায় না। বাবার বাড়ি বসে খেলেও বাবার রাজকন্যা হয়েই থাকে। মন খারাপ থাকলেও কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করবে না কি হয়েছে? ভালো কাজ করলে তুমি প্রশংসা শুনতে পাবে না শ্বশুরবাড়ি! যদি একটু দোষ করো তবেই শুনবে যত কথা।

আঁখি হাজার ভাবনা ভেবে আলসেমি ঝেড়ে চুলটা ভালো করে বেধে নিলো। অগত্যা উঠে রুমের দিকে উকি দিলো। দেখলো সাজ্জাদ রুমে নেই বেড কালকের মতোই গুছানো। তাহলে কি রুমে ঘুমায়নি? নাকি ঘুম থেকে উঠে গুছিয়ে রেখে গেছে? আখির মনের ভিতর ধপ করে উঠলো। ক’টা বেজেছে কে জানে। এত বেলা ঘুমিয়েছে সবাই কি কানাঘুষো শুরু করেছে আল্লাহ জানে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো ৮টা বাজে! আঁখি তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুম থেকে এসে ভয়ে ভয়ে ড্রইংরুমে উকি দিলো। দেখলো কেউ নেই! সাদিয়ার রুম থেকে পড়ার শব্দ আসছে। আর সাতদিন পর ওর পরীক্ষা! আঁখি হালকা পা ফেলে রান্না ঘরে গেলো। দেখলো মিসেস শাহনাজ রান্না ঘরে থমথমে মুখে কাজ করছেন। এটা দেখেই আঁখির ভিতরে আঁকুপাঁকু করতে লাগলো।মনে মনে ভাবলো আজ দেরি করে উঠেছে বলে কি ওর শ্বাশুড়ি রেগে আছে? বাসায় বসে তো কখনও রান্না ঘরে যায়েইনি কই ওর মা তো কখনও এমন করেনি! আঁখির মায়ের প্রতি ওর একরাশ ভালোবাসা জমালো। আঁখি এসব ভাবনা ছেড়ে আস্তে করে রুটি ভাজতে খুন্তি হাতে নিতেই মিসেস শাহনাজ থমথমে গলায় বললেন।

“তোমায় কাজ করতে হবে না! যাও ড্রইংরুমে গিয়ে বসো!”

মিসেস শাহনাজের কথায় আঁখির খুব খারাপ লাগলো। আঁখি মনের ভিতরে খুব আঘাত পেলো। কষ্টে চোখ দিয়ে পানি আসতে চাইলো। কিন্তু আঁখি তা জোর করে হজম করে নিলো। যদিও উনি খারাপ কিছু বলেন নি। রেগেও কথা কথা বলেননি। ওর মা তো এর থেকেও বেশি কিছু বলে তাতে তো কিছুই মনে করে না ও। হেসে উড়িয়ে দেয় কিন্তু এখন শ্বাশুড়ির কথায় এত খারাপ লাগছে কেনো? শ্বাশুড়ি বলে? আসলেই শ্বাশুড়ির দোষ সবসময় বৌয়ের কাছে থাকবে আর বৌয়ের দোষ শ্বাশুড়ির কাছে থাকবেই এটাই জগৎ ভরে চলে আসছে। আঁখি এসব আর বেশি ভাবলো না। জোরপূর্বক ঠোঁট প্রসারিত করে বললো।

“সমস্যা নাই মা, আপনি যান! আপনি তো এতক্ষণ অনেক কাজ করছেন এবার বাকিটা আমি করে দিচ্ছি।”

কথাটা শুনে মিসেস শাহনাজ রাগি চোখে আখির দিকে তাকালেন। ওর কথাটা যেনো মিসেস শাহনাজের পছন্দ হলো না। উল্টো মাথায় আগুন ধরে গেলো। চোখে মুখে রাগ নিয়ে থমথমে গয়াল বলে উঠলেন।

“এখানে এসে আমাকে এত দরদ দেখাতে হবে না। এই দরদ টুকু আমার ছেলের জন্য রাখে দয়া করে। আমার ছেলে কোথায় সেটা বলো?”

আখি কথাটা শুনে অবাক চোখে তাকালো। এমন ভাষায় কথা বলছে কেনো সেটাও বুঝতে পারছে না। সাজ্জাদের কথাই ওকে জিজ্ঞাসা করছে কেনো? ও কি করেছে? কোথায় মানে? কোথায় গেছে ওকি করে জানবে? ও তো ঘুম থেকে এই মাত্র উঠলো৷ ওর অগোচরে কিছু কি হয়েছে বাসায়? আঁখি আকাশ কুসুম ভাবলে লাগলো। মিসেস শাহনাজ আবারও ধমকে বলে উঠলেন।

“এখন চুপ করে আছো কেনো? আমাদের সাথে সাধু সাজো আর আমার ছেলের সাথে সারাদিন গেইগেই খেইখেই করেই চলো।সারাদিন অফিস করে বাসায় আসলে এক মিনিটের জন্যও শান্তি দাও না আমার ছেলেটাকে। যখন এতই সমস্যা তখন আমার ছেলেকে বিয়ে করেছিলে কেনো? তাও একা একা পালিয়ে গিয়ে!”

মিসেস শাহনাজের কথাটা আঁখি খুব গায়ে লাগলো। আঁখি মাথা নিচু করে ফেললো। মনের অজান্তেই ওর চোখে পানি চলে এলো। ও তো ইচ্ছা করে বিয়ে করতে চাইনি কিন্তু হয়ে গেছে। তাই বলে আজ এসব শুনতে হবে? ও একাই কি সাজ্জাদের সাথে ঝগড়া করে? সাজ্জাদ করে না? এক হাতে কখনও তালি বাজে? আজ নিজের ছেলে বলে তার দোষ দেখছেনা। অন্যের মেয়রটা ঠিকই দেখছে। মানুষ এমনেই নিজেদের দোষ লুকিয়ে রাখে আর অন্যের দোষ পেলে তা সার্কুলার দিয়ে বেড়ায়। আঁখির চোখ থেকে নিরবে টপটপ করে পানি পরছে। আঁখির চোখের পানিতে মিসেস শাহনাজের কোনো খারাপ লাগলো না। উল্টো বিরক্ত ভঙিতে বললো।

“আমি কি খারাপ কিছু বলেছি যে কাদছো? তোমার জন্য আমার ছেলেটা কাল মাঝ রাতে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। এখনও বাসায় ফেরেনি, ফোনটাও অফ! কোথায় গেছে কি করছে কিছুই জানি না। তোমার কাছে তো সেই খবর নেই। আমি তো মা! আমার কষ্ট লাগে, তোমরা বউরা তো চিনো শুধু টাকা! ভেবেছিলাম আমার ছেলে বিয়ে করেছে এবার ভালো হয়ে যাবে। ভালো তো হয়েছে, আড্ডা ছেড়ে চাকরি নিয়েছে কিন্তু ওর মনে তো শান্তি নেই৷ তোমার জন্য আমার ছেলের মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। যদি ওকে ভালোই না লাগে তো চলে যাচ্ছো না কেনো? এত ঝামেলার চেয়ে চলে যাওয়াই তো ভালো।”

মিসেস শাহনাজ কথাগুলো বলে শব্দ করে এটা ওটা করতে লাগলেন। বোঝাই যাচ্ছে তিনি খুব রেগে আছেন। রাগ গুলো জিনিসপত্রের উপর ঢালছেন। আঁখি চুপ করে ওখান থেকে চলে গেলো। তাড়াতাড়ি করে নিজের রুমে চলে গেলো। দরজা আটকে বালিশে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সব দোষেই এখন ওর? সাজ্জাদ কিছুই করেনি? ও তো কখনও সাজ্জাদের কাছে টাকা চায়নি তবে আজ কেনো টাকার কথা উঠলো? কেনো ওকে চলে যেতে বলছে? ও এখন কোথায় যাবে? আজ তার নিজের মেয়ে হলে এটা বলতে পারতো? উল্টো জামাইর দোষ ধরতো আজ ছেলে বলে সে নির্দোষ। ছেলের জন্য বৌকে ভালোবাসে। ছেলের কিছু হলেই বৌয়ের দোষ। কেনো ওর সাথেই এমন হতে হলো? ও ননদের চোখের বিষ তারপর হলো জামাইর চোখের বিষ এখন আবার শ্বাশুড়ি! যদি সবাই ওকে পর করে দেয় তো কিভাবে থাকবে ও? ও তো মানসিক যন্ত্রণায় মরে যাবে।

সাজ্জাদ দরজা ঢেলে ভিতরে ডুকলো। সারারাত ছাঁদে ছিলো। আঁখির সাথে যেনো শুইতে না হয় তাই ছাঁদে চলে গিয়েছিলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো আঁখি উপুর হয়ে শুয়ে আছে। কান্নার ফোসফাস শব্দ আসছে। আঁখি কে কাদতে দেখে সাজ্জাদের খুব খারাপ লাগছে। ওর মনে হলো সামান্য ব্যাপারে আঁখির সাথে ওমন করা ঠিক হয়নি। ও হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে। ওকে সরি বলা উচিত! পরক্ষনেই সাজ্জাদের মনে হলো আঁখি তো এত আবেগি মেয়ে না যে কাল রাতের জন্য এখনও কাদবে? সাজ্জাদ বুঝতে পারছেনা আঁখি কেনো কাঁদছে? কাল রাতের জন্য কি কাঁদছে? কিন্তু নাহ! কালকের জন্য আঁখি এভাবে কাঁদবে না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে৷ তাহলে কি সাদিয়া আবার কিছু বলেছে? নিশ্চয়ই সাদিয়াই কিছু বলেছে। সাজ্জাদ রেগে ড্রইং রুমে গিয়ে চিল্লিয়ে বললো।

“সাদিয়া!”

সাজ্জাদের শব্দ শুনে মিসেস শাহনাজ দৌড়ে এসে আবেগি হয়ে বললো।

“বাবা এসেছিস? কোথায় গিয়েছিলি? ফোন করেও পাইনি!”

সাজ্জাদ ওর আর আঁখির বিষয়টা ওর মাকে জানতে দিলো না। বললো অর্নবের বাড়িতে গিয়েছিলো জরুরি কাজে। অথচ সাজ্জাদ জানে না ওর মা আগে থেকেই সব জানে। এর মাঝেই সাদিয়া ওখানে আসলো। সাজ্জাদ রেগে ওর কাছে গিয়ে বললো।

“আঁখিকে কি বলেছিস?”

সাদিয়া কপাল কুচকে তাকালো। অগত্যা বলে উঠলো।

“আমি আবার কি বললাম? আমি কিছুই বলিনি। দেখো আম্মু! ভাবি আবার মিথ্যা মিথ্যা নালিশ করেছে।”

সাদিয়ার কথাটা শুনে সাজ্জাদ আরও রেগে গেলো। সাদিয়ার দিকে এগিয়ে ধমক দিয়ে বললো।

“একদম বেশি কথা বলবি না। ও তোর ভাবি হয় ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি! আঁখি কোনো নালিশ করেনি!”

মিসেস শাহনাজ এতক্ষণ চুপ ছিলেন। কিন্তু সাদিয়াকে এত কিছু বলতে দেখে তার খারাপ লাগলো। তিনি সাজ্জাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন।

“ওই মেয়ের জন্য নিজের বোনকে ধমকাচ্ছিস্? কি রে তুই?সাদিয়া কিছুই বলেনি যা বলার আমি বলছি।”

সাজ্জাদ অবাক হয়ে ওর মায়ের দিকে তাকালো। কপাল কুচকে বললো।

“মানে? কি বলছো আম্মু?”

“তোর সাথে সারাদিন ঝগড়া করে৷ কাল সাথে ঝগড়া করে মাঝ রাতে বেড়িয়ে গিয়েছিলি। আমি মা হয়ে এগুলো কি করে দেখবো তাই বলছি ভালো না লাগলে চলে যেতে।”

সাজ্জাদ অবাক হয়ে গেলো ওর মায়ের কথায়। চলে যাবে মানে? আঁখি চলে গেলে ও কি করে থাকবে? সাজ্জাদের খুব রাগ হলো কিন্তু মা বলে তা নিজের ভিতরে রেখে আহত গলায় বললো।

“আম্মু তুমি না জেনে এসব বলতে গেলা কেনো? ও কি একা ঝগড়া করে? আমি করি না? দোষ তো আমারও আছে।আমরা তো মজা করে ঝগড়া করি। তুমি আমাদের মাঝে এসে না প্লিজ!”

মিসেস শাহনাজ সাজ্জাদের কথায় মন কারাপ করলেন। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন।

“বাহ! তোর জন্য বললাম আর তুইয়েই ওই মেয়ের পক্ষ নিচ্ছিস? মা বোনের থেকে ওই মেয়েই এখন আপন তাইনা?”

সাজ্জাদ পুরাই বোকা বনে গেলো। কি বলতে গেলো আর কি হয়ে গেলো। সাজ্জাদ ওর মায়ের কাছে এসে বললো।

“আম্মু! তুমি উল্টো বুঝছো। আমার কাছে সবাই আপন। আঁখি কাদছিলো তাই জিজ্ঞাসা করছি।”

“দেখছো আম্মু! ওই মেয়ের কান্নাও সহ্য হয়না আর আমরা সারাদিন কাদলেও খবর রাখে না।”

কথাটা বলেই সাদিয়া রুমে চলে গেলো। মিসেস শাহনাজও হনহন করে চলে গেলেন। সাজ্জাদ কি করবে বুঝতে পারছেনা। এ জন্যই ও বিয়ে করতে চায়নি। এখন বৌয়ের কাছে মায়ের পক্ষ নিয়ে বললে বৌয়ের কাছে ভালো না। আর মায়ের কাছে বৌয়ের পক্ষ নিয়ে বললে মায়ের কাছে ভালো না। কি করবে ও? সাজ্জাদ রেগে রুমে চলে গেলো। আস্তে করে বিছানার কাছে যেতেই দেখলো আঁখি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের পানি এখনও পিছিতে লেগে আছে। সাজ্জাদ চোখটা মুছে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো।

“সরি পাখি! আমি ওমন করতে চাইনি কিন্তু নিরবের সাথে তোমায় দেখে সহ্য করতে পারিনি। আর এমন হবে না।”

কথাগুলো করে সাজ্জাদ মুচকি হেসে আঁখির গালে হাত বুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এখন মার্কেটে যেতে হবে ওকে। আঁখি আর ওর জন্য ম্যাচিং করে ড্রেস আনবে আজ সন্ধ্যায় অর্নবের বিয়েতে পরার জন্য। কিন্তু কি আনবে আঁখির জন্য? শাড়ি নাকি অন্য কিছু? নাহ! শাড়ি আনা যাবে না। শাড়ি পড়লে আঁখি কে অনেক সুন্দর লাগে আর সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। সাজ্জাদের এটা কিছুতেই ভালো লাগে না।এসব ভেবে চিন্তে সাজ্জাদ ঠিক করলো গাউন আর হিজাব আনবে। গাউন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যও পারফেক্ট আবার শরীরও পুরো ঢাকা থাকবে। তাহলেই ও নিঃচিন্তায় অনুষ্ঠানে থাকতে পারবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here