শরতের বৃষ্টি পর্ব-৪৯

0
2234

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৪৯

রাত ১১টা। বাসায় ফিরছে আঁখি সাজ্জাদ আর সাদিয়া। ওরা সাজ্জাদের বাইকেই আসছে। আঁখি তখন থেকে একটা কথাও বলেনি কেমন যেনো নিরব হয়ে আছে। ওর মন কেমন যেনো করছে। বারবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। নিরবের জন্য কতকিছু হলো, সাজ্জাদ যদি আবার এবার এটা জানতে পারে তো কি করবে সেটা ভেবেই ওর চুপচাপ। ব্যাপারটা সাজ্জাদ খেয়াল করেছে কিন্তু সাদিয়া আছে বিধায় জিজ্ঞাসা করেনি। সাজ্জাদ বাসার নিচে এসে ওদের নামিয়ে দিলো। ও বাইক গ্যারেজে রাখতে গেলো। আঁখি ওখানে না দাড়িয়ে আস্তে আস্তে হেটে রুমে চলে গেলো। সাদিয়া ওখানেই দাড়ানো ছিলো। সাজ্জাদ বাইক রেখে এসে সাদিয়াকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো।

“কিরে? এখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো? চল উপরে চল!”

“ভাইয়া! তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে।”

তাড়াতাড়ি করে কথাটা বলে দিলো সাদিয়া। সাজ্জাদ অবাক হয়ে তাকালো। সাদিয়ার দিকে ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বললো।

“কি কথা বলতো? যে বাসায় না গিয়ে এখানেই বলতে হবে?”

সাদিয়ার একটু কেমন যেনো লাগছে তবুও না বলেও পাড়ছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর হাত কঁচলাতে লাগলো। সাজ্জাদ ওকে চুপ থাকতে দেখে ধমকে বলে উঠলো।

“কিরে? বলবি বলে চুপ করে আছোছ কেনো? তাড়াতাড়ি বল আমার ঘুম আসছে।”

সাজ্জাদের ধমকে সাদিয়া চমকে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো।

“ভাইয়া! তোকে আগেও বলেছি ভাবিকে সাবধানে রাখতে। আমি নিরব ভাইয়ার সাথে ভাবিকে অনেক দিন কথা বলতে দেখেছি। আজও…”

“চুপ..!”

সাদিয়া পুরো কথাটা বলতে পারলো না, তার আগেই সাজ্জাদের ধমকে ভয় পেয়ে থেমে গেলো। সাজ্জাদ প্রচন্ড রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। সাদিয়া ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো। সাজ্জাদের ইচ্ছা করছে সাদিয়ার গালে ঠাস করে একটা থাপপ্পড় মারতে। যদি জানতো সাদিয়া এসব বলবে তাহলে ও দাড়াতোই না। যতই ও আঁখিকে নিয়ে কিছু শুনতে না চায় ততই ওর কানে এসব আসে। ও চায় সব কিছু নতুন করে শুরু করতে কিন্তু সবাই শুধু বাধাই দিচ্ছে। সাজ্জাদ রেগে সাদিয়ার দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো।

“আঁখির সাথে তোর কি শত্রুতা? ওর পিছনে লেগে থাকোছ কেনো? কারো সাথে কথা বললে কি হয়? তুই বলোছ না? এখানে দোষের কি আছে?”

সাজ্জাদের কথায় সাদিয়া খুবেই কষ্ট পেলো। ও ওর ভাইয়ের জন্য এসব করছে আর ওকেই ধমক দিচ্ছে? ও চায় নিরব ওকে ভালোবাসুক কিন্তু আঁখির নামে মিথ্যা বলে নয়। ও চায় ওর ভাই ভালো থাকুক! এ তো ভালো করতে গিয়ে খারাপ হয়ে গেলো। যার জন্য চুরি করে সেও বলে চোর! অন্য মেয়ের জন্য আজ ওর ভাই ওকেই বিশ্বাস করছে না। আসলেই বিয়ের পর ছেলেরা একটু বদলে যায়। আগে ওর ভাইয়ের জীবনে কেউ ছিলোনা তাই সব ভালোবাসা ওর জন্যই ছিলো৷ কিন্তু এখন একজন এসেছে ভালোবাসা তো ভাগ হবেই স্বাভাবিক। সাদিয়া ভেজা চোখে আস্তে করে বললো।

“ভাবির সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আমি তোর ভালোর জন্য বলছি আর তুই আমাকেই বকছিস? আমি চাইনি যে পরে তুই কষ্ট পাছ। কথা বললে কিছু না। আমি তোকে এসব বলি যে তুই যাতে সাবধানে থাকোছ! পরে পস্তাতে না হয়। আজ ভাবি নিরব ভাইয়ার থেকে শাড়ি নিয়েছে সেটাই বলতে চাইছি। বিশ্বাস না হলে ভাবির ব্যাগ দেখিস! ওকে তুই যখন চাসনা তখন আমি তোকে আর কিছু বলবো না।”

কথাটা বলে সাদিয়া চোখ মুছতে মুছতে সাজ্জাদকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি করে সিড়ি বেয়ে চলে গেলো। সাজ্জাদ এখনও হ্যাং হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। কি বলে গেলো এগুলো সাদিয়া? ওর মস্তিষ্ক জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। আশেপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সব কেমন যেনো ধোঁয়াশা লাগছে। সাজ্জাদের মন বারবার এটাই বলছে নাহ এসব হতে পারে না। আঁখি কেনো নিরবের শাড়ি নিবে? সাজ্জাদের মন কিছুতেই এটা বিশ্বাস করছেনা। ওর মনে হচ্ছে সাদিয়া মিথ্যা কথা বলছে। আঁখি ওর বারন অমান্য করে কথা বলবে? সাদিয়াও মিথ্যা বলতে পারে না। সাদিয়া ওর বোন! ওকে অনেক বছর ধরেই চিনে আঁখির সাথে ওর কোনো শত্রুতা নেই। কেনো শুধু শুধু ওর নামে মিথ্যা অপবাদ দিবে? সত্যটা যাচাই না করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সাজ্জাদ রেগে পা দিয়ে শব্দ করে উপরে উঠতে লাগলো।

আখি অনেক ক্লান্ত। রুমে এসে তাড়াতাড়ি ড্রেসটা খুলেই বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। এত ক্লান্ত ছিলো যে শাড়িটা আলমারিতে লুকাতে ভুলে গেলো। শাড়িটা ভুলবশত ওর হ্যান্ড ব্যাগেই রয়ে গেলো। আঁখি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হঠাৎ করেই সাজ্জাদ রেগে হনহন করে রুমে ঢুকলো। সাজ্জাদের রাগের কারন আঁখি বুঝতে পারলো না একটু আগেও তো ঠিক ছিলো। আঁখি একটু অবাক হলেও পাত্তা দিলো না। সাজ্জাদ রুমে এসেই বাইকের চাবিটা ছুরে ফেললো। অগত্যা রেগে ওর কাছে গিয়ে ওর বাহু ধরে টেনে দাড় কড়ালো। আঁখি যেনো অবাকের চরম পর্যায়! আজ আবার কি হলো? ও কি করেছে? হঠাৎ করেই আঁখির শাড়িটার কথা মনে পড়লো। ওর অন্তর আত্না তুমুল ভাবে কেঁপে উঠলো। সাজ্জাদ কি কেনো ভাবে জেনে গেলো? আঁখির ভাবনার মাঝেই সাজ্জাদ রাগান্বিত চেহারায় গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলো।

“নিরব তোমায় শাড়ি দিয়েছে?”

আঁখি চমকে উঠলো। ওর হাত পা সব কেঁপে উঠলো। এবার কি উত্তর দিবে ও? মিথ্যা বলবে? নাহ! তাহলে আরও ধরা খেয়ে যাবে৷ সাজ্জাদ না জেনে ওকে জিজ্ঞাসা করেনি। কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই জেনেছে। ভয়ের দরুন আঁখির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সাজ্জাদ আজ কি করবে ওর সাথে? মারবে? আঁখি মুখ দিয়ে কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। কেমন যেনো বাঁধা আসছে। আঁখি মাথানত করে নিঃশ্চুপ হয়ে রইলো। সাজ্জাদ ওর নিরবতায় সব বুঝে গেলো। কিন্তু আঁখি কিছু তো বলবে? সাজ্জাদ ওর নিরবতায় আরও ক্ষিপ্ত হলো। ক্রোধান্বিত হয়ে আঁখির বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে চিল্লিয়ে বললো।

“কি হলো? চুপ করে আছো কেনো? চুপ থাকলেই সত্যটা মিথ্যা হয়ে যাবে?”

আঁখি এবারও নিরব। নিরবতা যেনো ওর হাত পা এমনকি সারা শরীরে বিরাজ করছে। আঁখি অনুভূতিহীন! কি হবে আজ? ওকি বেশি ভুল করেছে? সাজ্জাদ ওকে ধাক্কা মেরে ছেড়ে ওর ব্যাগ হাতে নিলো। আঁখি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। আজ যেনো শান্ত ওকে ঘিরে ধরেছে। সাজ্জাদ টেনেটুনে ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে আখির কাছে গেলো। শাড়িটা ওর সামনে ধরে ক্ষিপ্ত গলায় বললো।

“কি এটা? এবার কি বলবে? এবারও চুপ থাকবে?”

“আসলে…!”

“কি? আসলে নকলে কি বোঝাবে আমায়? তুমি শাড়িটা নিতে চাওনি তাইতো? নিরব জোর করে দিয়েছে? আমায় বোঝাও কেউ কাউকে জোর করে দেয় কিভাবে? যদি এমনি নিয়ে থাকো তাহলে আমার থেকে লুকালে কেনো? তোমার মনে খারাপ কিছু না থাকলে লুকালে কেনো? ভালো মনে আমায় তো বলতে পারতে একবার?”

আঁখি এবার কি করবে? ভালো ভেবে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে খারাপ হয়ে গেলো? সাজ্জাদ রাগ করবে বলে লুকিয়ে রাখলো আর আজ সেটাই হলো? আসলে সত্য কখনও লুকিয়ে রাখা যায়না। তা যতই লুকাবে ততই আরো খোলাসা হয়ে যাবে৷ সত্য একদিন না একদিন উন্মোচিত হয়েই যায়।
আঁখি বাবলো এবার চুপ থাকলে হবে না সবটা বুঝিয়ে বলা উচিত। ও বলতে যাবে তার আগেই সাজ্জাদ বলে উঠলো।

“তোমার শাড়ি লাগলে আমায় বলতে। তোমার রযে কয়টা শাড়ি লাগতো আমি এনে দিতাম। তুমি নিরবের থেকে কেনো নিয়েছো? আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ওর সাথেই কথা বলো, ওর থেকেই শাড়ি নেও! আমার কথার একটুও দাম নেই? ওই নিরবের থেকে আমার মূল্য এত কম? আমায় বুঝো না কেনো তুমি? আমার অনুভুতিকে কেনো বুঝো না? ও হো! বুঝতে পেরেছি তোমার মনে নিরব আছে, আমার থেকে ওর সাথে কথা বলা জরুরি। সব মায়া ওর জন্য তাহলে আমার অনুভূতি বুঝবে কি করে?”

আঁখি অবাক হয়ে গেলো। সাজ্জাদ এসব বলবে ও কখনও ধারনা করতে পারেনি। কষ্টে আঁখির চোখে পানি চলে এলো। সাজ্জাদ রাগে যেনো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। ওর মাথা ঠিক নাই। ওর বারবার মনে হচ্ছে আঁখি নিরবকে ভালোবাসে তাই ওর অনুভুতি বোঝে না। ওর কথার গুরুত্ব দেয়না। আঁখির কাছে নিরবেই সব! এটা ভাবতেই ওর মাথা আরও গরম হয়ে গেলো। শাড়িটা ফ্লোরে ছুরে ফেলে আঁখির হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আঁখি সাজ্জাদের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছাড়ুন! হাতে ব্যাথা পাচ্ছি। ঠান্ডা হবে বসে আগে আমার কথাটা তো শুনুন!”

ওর কথা হয়তো সাজ্জাদের কানে পৌছালো না। রাগে ওর মাথা ঠিক নাই৷ কি করছে সেটা নিজেও জানে না। ও উল্টো রেগে বলে উঠলো।

“কি শুনবো হুম? ওই নিরবের কাছে যেতে চাস তাই তো? ওর জন্য সব মায়া? ওর কাছে যাওয়ার জন্য আমায় ধোঁকা দিবি? তা পারবি না। চরিত্রহীন বাজে মেয়ে! তুই কি আমায় ঠকাবি? আমি নিজে তোকে বের করে দিবো। দয়া করে ঘরে থাকতে দিয়েছিলা। তুই দয়ার যোগ্য না। নিরবের কাছে যাবি তাইনা? যাহ!”

কথাগুলো বলতে বলতে সাজ্জাদ আঁখিকে ড্রইংরুমে নিয়ে আসলো। আঁখি যেনো কাঁদতেও ভুলে গেলো। অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কথায় আছে মানুষ বেশি শোক পেলে নিথর হয়ে যায়। ওরও হয় তাই হয়েছে। আজ ওর চরিত্র নিয়েও কথা হচ্ছে? সাজ্জাদ ওকে এসব বলছে? এগুলো শোনার আগে ওর ম/রে যাওয়াও তো ভালো ছিলো। মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান ঘুমিয়ে আছেন তাই এসব আলাপ পাননি৷ সাদিয়া চিল্লাচিল্লি শুনে দৌড়ে রুম থেকে এলো। দেখলো সাজ্জাদ আঁখি কে বের করে দিচ্ছে। সাদিয়া অবাক হয়ে গেলো? শেষ পর্যন্ত ওর ভাবিকে বের করে দিচ্ছে? ও চাইতো আঁখি নিরবের থেকে দূরে থাকুক! আঁখিকে ওর ভালো লাগতো না তাই বলে এসব চায়নি। ও তো ওর ভাইকে সাবধান করেছে। আর আজ ওর জন্য সংসার ভাংতে চলেছে? সাদিয়া দৌড়ে দিয়ে সাজ্জাদের থেকে আঁখি ছাড়াতে ছাড়াতে বললো।

“ভাইয়া ছাড়! কি করছিস এসব? ভাবিকে ছাড়!”

সাজ্জাদ সাদিয়ার কথা শুনলো না। সাদিয়াকে ঝাড়া মে/রে ফেলে আঁখি কে দরজার বাইরে রেখে দরজা আটকে দিলো। আঁখি যেনো অনুভূতি শূন্য হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে সাজ্জাদের ব্যবহার দেখছে। কি বা করার আছে ওর? সাদিয়া উঠে সাজ্জাদের কাছে গিয়ে আহত গলায় বললো।

“এটা কি করলি ভাইয়া? ধরলাম ভাবি ভুল করেছে তাই বলে বাসা থেকে বের করে দিবি? ভাবি এত রাতে এখন কোথায় যাবে? কাজটা মোটেও ঠিক হলো না!”

“নিরবের কাছে যাবে। ঠিক বেঠিক আমাকে বোঝাতে আসিছ না। যা! নিজের রুমে যাহ! ছোটো মানুষ ছোটোর মতো থাক! আমায় জ্ঞান দিতে আসবি না।”

সাজ্জাদ চোখমুখ গরম করে কথাটা বললো। মনে হচ্ছে ওর চোখমুখ দিয়ে আগুনপর ফুলকি ছুটছে। সাদিয়া মন খারাপ করে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে গেলো। সাজ্জাদ রেগে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। রাগ যেনো ওর কিছুতেই কমছে না। ওর পাখি নিরবকে চায় এটা ও মানতেই পারছে না৷ রাগ মানুষের ভালো খারাপ বোঝার হিতাহিত জ্ঞান নষ্ট করে ফেলে।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

(রি চেইক করিনি। ভুলত্রুটি মাফ করবেন। সবাইকে পবিত্র শবে বরাতের শুভেচ্ছা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here