শরতের বৃষ্টি পর্ব-৫০

0
2198

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫০

ফুলে ভরা বিছানায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে আনিকা। চারদিক থেকে বেলী আর গোলাপের সুভাস আসছে। তবুও ওর খুবেই বিরক্ত লাগছে। ভারি লাল লেহেঙ্গায় ও ভাবসিয়ে উঠেছে৷ ওর মনে হচ্ছে গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ এ বাড়িতে আসার পর থেকে বসে আছে। বসে থাকতে থাকতে ওর কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে। সেই একঘন্টা আগে থেকে এই পর্যন্ত বসে আছে। কিন্তু অর্নব এখনও আসছে না। হয় তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আনিকার খুব মেজাজ খারাপ হলো। একটুও ভালো লাগছে না বসে থাকতে। হঠাৎ করেই দরজা খোলার শব্দ এলো। কে এসেছে দেখতে আনিকা চুপিচুপি ঘোমটা উঠাতেই অর্নবকে দেখতে পেলো৷ অর্নবও ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো আনিকা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ঘোমটা নামিয়ে ফেললো। অর্নবকে দেখে আজ খুব লজ্জা লাগছে ওর। অর্নব গোল্ডেন কালার পান্জাবী পড়ে আছে গলায় লাল ওড়নার মতো ঝোলানো। ওর পোশাক এখনও চেঞ্জ করেনি। আনিকার ড্রেসও চেঞ্জ করায় নি। আনিকা ঘোমটা টেনে চুপ করে বসে রইলো। অর্নবের পায়ের গতি যতই খাটের কাছে আসছে ওর ভিতরে ততই ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে। অর্নব ওর ঠিক সামনে খাটে পা উঠিয়ে বসে ওকে সালাম দিলো। আনিকা জিহ্বায় কামড় দিলো। ওতো লজ্জায় ভুলেই গেছে সালাম দিতে। তাড়াতাড়ি অর্নবের পা ধরে কেনো মতে নামের সালাম করলো। অর্নব ওর কাছে মুচকি হাসলো। অগত্যা হাত বাড়িয়ে ঘোমটা উঠালো।

আনিকা চোখ বন্ধ করে আছে। অর্নব মুচকি হেসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো৷ মনে মনে ভাবলো মেয়েটাকে লজ্জা পেলে খুবেই ভালো লাগে। একদম মায়াবতী লাগে। আজ ওই বৌ সাজে ওকে আরও দারুন লাগছে। প্রথম দেখে তো ও চিনতেই পারেনি। ওর আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে দীর্ঘ তিন বছরের সাধনার পর পেয়ে গেলো ওর ভালোবাসাকে। আনিকা লজ্জায় চোখ খুলছেই না। অর্নব ঠোঁটে দুষ্ট হাসি নিয়ে বললো।

“কি? ছুঁতে না ছুঁতেই সব বাহাদুরি শেষ? আগে তো আমায় বলতে ভয় পাও না। উল্টো আমায় ভয় দেখাতে। সারাদিন ফটফট করতে আর আজ লজ্জায় লজ্জাবতীর মতো নুইয়ে পড়েছো কেনো? চোখটা খোলো! আমি একটু দেখি। নাহয় আমায় দেখো!”

আনিকা ওর কথায় আরও লজ্জা পেলো। পিটপিট করে চোখ খুলে নিচে তাকিয়ে রইলো। কেনো জানি অর্নবের চোখের দিকে তাকাতেও ওর লজ্জা লাগছে। অর্নব ওর হাতে হাত রেখে সিরিয়াস হয়ে বললো।

“জানো! আজ আমি অনেক খুশি। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তুমি এত তাড়াতাড়ি রাজি হবে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে! কথা দিচ্ছি কখনও তোমায় কষ্ট দিবো না। যতদিব বাঁচি যতন করে আগলে রাখবো। যদি ভুল করি তবে সুধরে দিও কিন্তু ছেড়ে যেওনা। সবসময় পাশে থেকো!”

আনিকা কিছুই বললো না। শুধু মুচকি হাসলো। অর্নব ওর উওর পেয়ে গেছে। ও কিছু না বলেই আনিকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। এ যেনো মহা তৃপ্তি জায়গা। অর্নব শান্তিতে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো।

“তৃপ্তির মাঝে ডুবে গেছি আমি
জড়িয়ে ধরেছে তৃপ্তি আমাকে
বলতেও বাঁধা নেই তো আমার
তৃপ্তির স্বাদ ছাড়ে না আমাকে! — সুবির সেনগুপ্ত”

অর্নবের কবিতা শুনে আনিকা লজ্জা পেলো। ও নড়েচড়ে বসে জোরে শ্বাস ছাড়লো। এ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস!

————————–

সাজ্জাদ রুমে গিয়েই বেলকনিতে চলে গেলো। ওর রাগ যেনো কিছুতেই নামছে না। সামনে থাকা চেয়ারটা লাত্থি মেরে দূরে ফেলে দিলো। অগত্যা ঠাস করে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আঁখি কে ছাড়া রুমটা শূন্য শূন্য লাগছে। ওর বুকের মাঝেও হাহাকার করছে বারবার কিন্তু ও কি করবে? আঁখি তো ওকে চায় না ও চেয়ে কি করবে? ওর বারবার মনে হচ্ছে আঁখি নিরবকেই ভালোবাসে। ওকে আঁখি ভালোবাসে না তাহলে তো ওর মনের অনুভূতি বুঝতে পার তো। সাজ্জাদ নিজের চুল মুঠ করে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো।

“কেনো পাখি? একটুও আমায় বুঝলে না! কি নেই আমার মাঝে যা নিরবের থেকে পেয়েছো? যদি কিছু কমতি থাকতো তা বলতে আমি সংশোধন করতাম কিন্তু কেনো আমায় ঠকালে? আমার নিস্পাপ মনের ভালোবাসাকে এভাবে কু/পিয়ে হ/ত্যা করলে? বলো পাখি! উত্তর দিয়ে যাও!”

শেষের চিৎকার করে বলে উঠলো কথাটা সাজ্জাদ। ও যেনো দিশেহারা হয়ে গেলো। পাগলের মতো বেলকনিতে যা পেলো সবেই ভেঙে ফেললো। সবশেষে ক্লান্ত হয়ে রেলিং ধরে আস্তে আস্তে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠলো।

“যদি ভালোই না বাসবে তবে কেনো এসেছিলে? দূরেই থাকতে। এভাবে ভালোবাসাটা জাগালে কেনো? কেনো এভাবে আমায় কষ্ট দিলে? একটা বার পাখি বলে ডাকারও সুযোগ দিলে না আমায়! যত্ন করে তোমায় পুষে ছিলাম পাখি কিন্তু তুমি বুঝলে না। আমি চাইলেই তোমায় আটকে রাখতে পারলাম কিন্তু রাখিনি। জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? আমি চাইছি তুমি ইচ্ছা করেই আমায় মেনে নাও! কিন্তু তুমি নিরবের মাঝে সুখ পেলে। আচ্ছা তোমায় মুক্ত করে দিলাম। তুমি ওর সাথে ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। তোমায় তো পেলাম না, তোমার স্মৃতি নিয়েই আমি থাকতে পারবো। কিন্তু তোমার সাথে ঝগড়া না করে কি করে থাকবো আমি? কি করে থাকবো? একটা বার আমায় বুঝলে কি ভুল হতো পাখি? এত কষ্ট পেতে হতো না আমায়। কেনো আমায় বুঝলে না পাখি? কেনো?”

সাজ্জাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের মাঝেও যন্ত্রনা হচ্ছে৷ চারপাশে শুধু হাহাকার করছে ওর। রেলিংয়ে মাথায় আঘাত করে কথাগুলো বলতে লাগলো ও। সাজ্জাদ যেনো দিশেহারা। যদিও রাগের বসে বের করে দিয়েছে কিন্তু ওকে ছাড়া থাকতে পারছে না। ও চায়নি আঁখিকে জোর করে রাখতে। ওর মন বলে আঁখি নিরবকে ভালোবাসে ওর কাছেই সুখে থাকবে। আঁখির সুখেই ওর সুখ! কিন্তু কিভাবে কাটবে ওর রাতদিন! আঁখি তো সুখেই আছে এখন।

সাদিয়ার ঘুম আসছেনা এপাশ ওপাশ করছে। সাজ্জাদের ধমক খেয়ে চলে এসেছে ঠিকই কিন্তু আঁখির জন্য খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা এত রাতে কোথায় যাবে? ও হিংসা করতো। আঁখি কে সহ্য হতো না। আঁখি কে দেখলেই নিরবকে না পাওয়ার যন্ত্রনার কথা মনে হতো তাই ভালো লাগতো না। তাই বলে ওর ক্ষতি চায়নি ও। সাদিয়া আস্তে করে উঠে বাইরে বের হলো। দরজা খুলে এদিক ওদিক খুঁজেও আঁখিকে পেলো না৷ ওর মনে ভয় হলো, কোথায় গেলো এত রাতে? পরক্ষনেই ভাবলো হয়তো ওদের বাসায় গেছে এ ছাড়া কোথায় যাবে? এসব ভেবেই সাদিয়া আবার রুমে চলে গেলো।

———————–

সুখ দুঃখ কখন কার জীবনে বিরাজ করে কেউ বলতে পারেনা। জীবন কারো কাছে ছোট। কারো কাছ বড়। কারো কাছে আনন্দের। কারো কাছে বেদনার। একজন ধনী সুখী মানুষকে প্রশ্ন করলে বলবে, সুখ আনুভব করার সময় কই? বাঁচবোই বা কতদিন? একজন অভাবী অসুখী মানুষকে প্রশ্ন করলে বলবে, আর বাঁচতে চাইনা। দিন আর শেষ হয় না। মরতে পারলেই এখন বাঁচি। জীবনের প্রতি কখনো মায়া হয়। কখনো ঘৃণা হয়। আমাদের সবার জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে রচিত হয় অন্তহীন কাহিনি। দুঃখহীন সুখ বা সুখহীন দুঃখ কোথাও নেই। প্রকৃতি যেমন সহসা অবয়ব বদলায়, মানুষের জীবনও তেমন এক রকম থাকে না। যে সকালে আকাশ ঝলমলে পরিস্কার, ঝকঝকে রোদে পরিপূর্ণ; তার আগের বা পরের রাতে যে ঝড় আসেনি বা আসবে না- কে বলতে পারে নিশ্চিত করে! অর্থাৎ আমাদের জীবনে এমন কোনো সুখ, দুঃখ, আনন্দ বা বেদনা নেই, যা চিরস্থায়ী। দুঃখহীন সুখ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা, লোককাহিনি, গুণীজন কথা- সর্বত্র যে প্রবহমান সংলাপ সেখানেও সুখ ও দুঃখ পাশাপাশি বহমান। আজকের পৃথিবীতে আমরা উৎকর্ষের খোঁজে ছুটছি। আমাদের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আবিস্কার নিয়ে গর্ব করার প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ কেউ চিরস্থায়ী সুখের খোঁজে দিনরাত কষ্ট করছেন, কেউবা চেষ্টাবিহীন ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ সন্ধানে রয়েছেন। নৈতিকতার চেয়ে স্বার্থপরতা, নিজেকে সংশোধনের পরিবর্তে অপরকে আক্রমণ করার প্রবণতায় সৌন্দর্য ও নির্ভরশীলতা হারাচ্ছে আধুনিক সভ্যতা।

আখি ছাদের কর্নারে হাটুতে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদছে। এতক্ষণ দরজার সামনে ছিলো কিন্তু সাজ্জাদ আসেনি। ভেবেছিলো সাজ্জাদ আসবে কিন্তু আসেনি। আঁখির শরীরে যেনো শক্তির লেশ মাত্র নেই। ওর ভিতর থেকে ভেঙেচুরে আসছে। বারবার মন চাচ্ছে ম/রে যেতে। ইচ্ছে করছে ছাঁদ থেকে লাফ দিতে কিন্তু গুনাহর কথা ভেবে আবার কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলো। কেনো ওর সাথেই এমন হতে হলো? কেনো একটু সুখ পায় না ও? এবার কোথায় যাবে ও? বাবার বাড়িতে নিজের অধিকার হারিয়েছে এবার স্বামীর বাড়ি থেকেও। এটাই লেখা ছিলো ওর ভাঙে? এসব ভেবেই আঁখি ঠুকরে কেঁদে উঠলো। এমন দিন আসলো আজ ও বড়ই একা। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যও ওর পাশে কেউ নেই। আসলে বিপদ যখন আসে তখন দুঃখও আসে। পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে যাদের সুখের অভাব নেই আবার অনেকে আছে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খায় সারাদিন। আঁখির কান্না যেনো থামছেই না৷ মুখে হাত দিয়ে কাঁদছে যেনো শব্দ না হয়। সাজ্জাদ ওকে ভুল বুঝলো? চরিত্রহীন বললো? এটাই কিছুতেই মানতে পারছে না। ও তো নিরবের থেকে বন্ধু ভেবে নিয়েছিলো। নিরবের কষ্টটা ও কিছুটা হলে বুঝে তাই আর কষ্ট দিতে চায়নি। সাজ্জাদ নিজে কি বন্ধুদের থেকে কিছু নেয়না? এসব কে বোঝাবে ওকে? আঁখি রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। হয়তো সাজ্জাদ ওকে বের করে দিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে৷ ও তো ওকে বিরক্ত করতো। ঝগড়া করতো। একটুও সুখি করতে পারেনি সাজ্জাদকে।

দুই প্রান্তে দুজন মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। ভালোবাসা হারানোর ব্যথায় হাহাকার করছে। কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে দুটি মন। কিন্তু কারও খবর করো কাছেই নেই!

ইনশাআল্লাহ চলবে….

রি চেইক করিনি….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here