#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫৫
মানুষের জীবনে অনেক ভাবে সুখ আসে,আবার কিছু কিছু সময় কষ্ট আসে। সুখ আসে আবার কিছু সময়ের জন্যেও। সুখের সময়টা বেশ তাড়াতাড়ি চলে যায় হাসি খুশি ভাবে কিন্তু দুঃখের সময়টা যেনো পেরুতেই চায়না। মানুষ কখনই চায়না তাদের জীবনে দুঃখ আসুক কিন্তু না চাইতেও চলে আসে দুঃখ। মানুষ হিসেবে দুঃখ আমাদের জীবনের চরম ও পরম সত্য। যে কোন জীবের কষ্টের অনুভূতি থাকলেও তাদের ভাষা নেই বলে প্রকাশ নেই। প্রকাশ করার ক্ষমতা মানুষকে অন্য জীবের চেয়ে আলাদা করে তার জীবন ধারায়, যাপনে, সম্পর্কে। জীবন অনেক সময় কঠিন হয়ে দাড়ায়। বিলন করে দেয় সমস্ত পিছু দিনের সুখ।
হসপিটালে ভগ্নহৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছে দুটি পরিবার। সবার ভিতরেই করছে হাহাকার। কিন্তু সবার মাঝেই রয়েছে নিরাবতা। কারো চোখে জলে পরিপূর্ণ। কেউ আবার থম মেরে বসে বছে। কেউ আবার নিরবে দপড়ে দপড়ে হাহাকার করছে। মিসেস শাহনাজ আর আশরাফ খান বাকরুদ্ধ হয়ে হসপিটালের বেঞ্চে বসে আছেন। তার সুখের সংসারে এমন কষ্টের দিন আসবে তারা বুঝতে পারেন নি। সাদিয়া আতিককে ধরে কাঁদছে। ওর খুবেই কষ্ট হচ্ছে। যে মানুষটা ওর এত কাছের ছিলো সবসময় ওর ভালো চাইতো সে মানুষটা আজ আই সি ইউ তে। রোকেয়া রহমান মাঝে মাঝেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন আবার কিছুক্ষণ নিঃশ্চুপে কাঁদছেন। আমিনুর রহমান দিশেহারা। মনের মাঝে কাঁপছে। এত সাহসী ধৌর্যবান মানুষটাও আজ অসহায়। তিন বছর ধরে তিনি তার প্রানপ্রিয় মেয়ের সাথে কথা বলেন না। রাগ, ইগো, অভিমান এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে এর মাঝে তিন বছর কি করে কেটে গেল তিনি বুঝতে পারেননি। এই তিন বছর আঁখির সাথে একবারও কথা বলেননি। গত নয় মাস আগে শুনেছিলেন তিনি নানা হতে যাচ্ছেন। খুব খুশি হয়েছিলেন কিন্তু মাঝখানে এত গ্যাপ থাকার কারনে ইতস্তত করে কথা বলা হয়নি তার। কে জানতো আর হয়তো তার মেয়ের সাথে কথা বলা হবে না। আজ তার মেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, ফিরবে বলে কোনো আশা নেই। তিনি ছটফট করে ছুটে এসেছেন হসপিটালে। কিন্তু লাভ কি হলো? মেয়েটার সাথে তো কথা বলতে পারছে না। নিজের উপর তার খুব ঘৃণা হচ্ছে। কেনো এত অভিমান করলেন?
পিতামাতার জন্য সন্তান হারাবার চাইতে বড় কষ্ট আর হতে পারে না। মৃত্যু! জগতের সব চাইতে নিশ্চিত ব্যাপার। মৃত্যু আসবেই, ঠেকবে না কোনও কিছুতে। পৃথিবীর কোনও জীবিত প্রাণীর সাধ্য নেই একে এড়িয়ে যাবার। জন্ম নিলে একটা না একটা সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবেই- জগতের অবধারিত নিয়ম! তবুও কোনও বাবা মা সন্তানের মৃত্যু ভাবনাকে মনে স্থান দেন না, কখনো চিন্তাও করেন না এই একটি ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু সন্তানেরা হারায়, আমাদের ঘর-জীবন আলোকিত করে রাখা প্রজাপতিরা জীবনের কোনও এক নিষ্ঠুর পরিহাসে সব ছেড়ে চলে যায় মৃত্যুলোকের ওপারে। চলে যায় আপনজনদের শোকের অন্ধকারে হারিয়ে রেখে। সন্তানহারা পিতামাতা ব্যতীত আর কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না যে কি অসহনীয় এই শোক, কি প্রবল-প্রচণ্ড এই ব্যথা। এক জীবনে ভোলা যায়না যে কষ্ট, এটা ঠিক তাই। অন্য মৃত্যুশোক গুলি হয়তো এক সময় সয়ে আসে প্রকৃতির নিয়মেই, কিন্তু সন্তান হারাবার শোক নয়। সন্তানকে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেন কত মা বাবা। দোষ তাদের দেয়া যায় না কিছুতেই। মানব জীবনের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ তো এই সন্তানই। অনেক সাধনায় মেলা সেই সম্পদ অকালে হারাবার ব্যথা সইবার ক্ষমতা না থাকাটাই খুব স্বাভাবিক।
সাজ্জাদ হসপিটালের দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। ফ্লোরের দিকে ওর নিঃশ্চুপ দৃষ্টি৷ যেনো অনুভুতি শূন্য। কেনো অনুভূতি কাজ করছে না ওর। চারপাশে কি ঘটছে না ঘটেছে তার কোনো খবর নাই ওর। ওর কোন রাগ লাগছে না, রাগ নেই, অভিমান নেই। আনন্দ, তৃপ্তি, সুখ, আশা কোন কিছুর অনুভুতি নেই। খুব প্রশ্ন জাগছে মনে ? ওর অনুভূতির দরজা বন্ধ কি তবে বন্ধ হয়ে গেছে? ওর মাথায় শুধু আঁখি ঘুরছে। এই তিনটা বছর কত সুখে ছিলো ও। আঁখির সাথে দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়ায় কেটেছে ওর তিনটা বছর। যখন শুনেছিলো ও বাবা হতে চলেছে তখন কি যে খুশি হয়েছিলো ও। মনে হয়েছিলো ওর মতো সুখি আর কেউ নেই। বাবা হওয়ার আনন্দ টা আসলেই খুব গভীর। এই আট মাস আঁখির অনেক যত্ন করেছে ও। আর আঁখির পাগলামো তো আছেই৷ কিন্তু মা পেগনেন্সির সময়টাতে ওর পাগলামি যেনো খুব বেড়ে গিয়েছিলো। সাজ্জাদকে ঠিক মত ঘুমাতেও দেয়নি ও। কখনও রাত একটায় উঠে বলতো বিরিয়ানি খাবো তো কখনও বলতো গোসল করবো। যদি সাজ্জাদ বাধা দিতো তো সাজ্জাদকেই গোসল করতে হতো। এই আটমাসে ওকে চার বার গোসল করাইছে। কখনও রান্না করিয়েছে। সাজ্জাদ মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছে। নিজেকে সুখীই মনে হতো। কে জানতো এই সুখ বেশি দিনের নয়?
আজ সকালে অফিসে যাওয়ার পর হঠাৎ সাদিয়ার ফোন এলো। ফোনটা ধরেই সাজ্জাদের দুনিয়া ঘুরে এলো। ও যেনো স্তব্ধ। পায়ের নিচটাও ওর শূন্য মনে হচ্ছিলো। আঁখি ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছে, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে। সাজ্জাদ দিক দিশা না পেয়ে কেনো মতে কষ্ট করে হসপিটালে এসেছে। এসেই শুনলো আঁখি আই সি ইউ তে, জরুরি অপারেশন করতে হবে। ডক্টর এসে সাজ্জাদ কে বললো সাইন করতে। সাজ্জাদ অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলো। ডক্টর বলেছে যে কোনো একজনকে বাঁচাতে পারবে। সাজ্জাদ অনুভুতি হীন হয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলো। কি করবে ও? কাকে চাইবে? বাবা হওয়ার আনন্দ কি পাবে না? এই কটা মাস ভেবেছে ওর সন্তান আসবে ওকে বাবা বলে ডাকবে আজ কি হলো এটা? ওর পাখি? তাহলে ওর পাখির কি হবে? ও কাকে বাঁচাবে? আঁখির জন্য ওর সন্তানের প্রান নিবে? সাইন করা মানে হত্যা করা একেই। সাজ্জাদ নিষ্ঠুর হতে পারলো না। ও দুজনকে বাঁচানোর কথা বলেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। কেউ ওঁকে দিয়ে এর সাইন করাতে পারলো না।
————————–
আঁখির পাশে বসে আছে পুরো পরিবার। বাচ্চা নিয়ে যেনো কাড়াকাড়ি চলছে। কেউ কাউকেই দিচ্ছে না। দুটো পরিবারে একটি বাচ্চা কাড়াকাড়ি তো হবেই। আঁখি আর বাচ্চা দুজনেই সুস্থ। এটা মহান আল্লাহ এক অশেষ নেয়ামত। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আঁখি সুস্থ হতে পেরেছে। যখন শুনেছিলো আঁখি আর বাচ্চা দুজনেই জীবিত। সাজ্জাদ যেনো আকাশের চাঁদ পেয়ে গিয়েছিল। ও কারো সাথে কথা না বলে দৌড়ে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে এসেছে। পরে আখির জ্ঞান ফেরা অব্দি ওর হাত শক্ত করে ধরে বসে ছিলো৷ যেনো ছেড়ে দিলেই আবার হারিয়ে যাবে। যেই ভালোবাসা ও পেয়েছে সেটা হারাতে চায়না ও।
সাজ্জাদের মেয়ে হয়েছে। এখন সুস্থ আছে৷ ওর মেয়ে হয়েছে শুনে রনি, আশিক, অর্নব আর আনিকা এসেছে হসপিটালে। বিভিন্ন উপহার সমগ্রী নিয়ে এসেছক ওরা। আনিকা তো ভিষণ খুশি আঁখির মেয়ে হওয়ায়। আনিকার দু বছরের একটা ছেলে আছে। আদনান অনিক। সবাই অনিক বলেই ডাকে। বিষণ দুষ্ট একটা ছেলে। দেখতেও খুবেই সুন্দর। অর্নব আগে থেকেই বলে রেখেছে ওর ছেলের সাথে সাজ্জাদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে বেয়াই হয়ে যাবে দুজনে। রনি দুজনের মাঝে থেকে ফোস করে বলে উঠলো।
“বাহ! দুজনে মিলে ঠিক করে নিলে? আমি আর আশিক কি বানের জলে ভেসে আসছি?”
সবাই ওর কথায় হেসে উঠলো। অর্নব ওর পিঠ চাপড়ে বললো।
“তোদের কি ছেলে মেয়ে আছে হুম? বেশি কথা বলোছ কেনো? আগে হয়ে নেক তারপর তুই আশিক বেয়াই হয়ে যাইছ্! আরে তোরা বিয়ে করছোছ দেরি করে এতে আমাদের কি দোষ বল?”
রনি হালকা রেগে ঠোঁট উল্টে তাকালো। দেরিতে বিয়ে করছে বলে আজ এই দশা? খুব ভুল করে ফেলেছে। আগে জানলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতো। রনি আর আশিক দুজনেই বিয়ে করেছে একবছর হয়েছে। ওদের দুজনের কারোরই সন্তান নেই এখনও। আশিক সব ছেড়ে বললো।
“বাচ্চার নাম কি রাখবি সাজ্জাদ?”
সাজ্জাদ মুচকি হেসে আশিকের দিকে তাকালো। অগত্যা সাদিয়ার কোলে থাকা ওর মিষ্টি মেয়ের দিকে তাকালো। মেয়েটা দেখতে অনেকটাই ওর মতো। দেখলেই যে কেউ বুঝবে ওর মেয়ে। মিষ্টি লাল ঠোঁট দুটো নেড়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। সাজ্জাদ হাসি মুখে বললো।
“আমার মেয়ের নাম আমার সাথে মিলিয়ে রাখবো। সানজানা নিশি খান! অর্থ হলো- একত্রকারী রাত বা কোমল রাত। সুন্দর না নামট?”
“না”
নামটা সবারেই পছন্দ হয়েছিলো কিন্তু আঁখির না শুনে অবাক হলো। সবাই ওর দিকে তাকালো। আঁখি মুখ ভার করে বলে উঠলো।
“নাম আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখবো। ‘আদিবা আঁখিনুর’ হবে আমার মেয়ের নাম।”
সাজ্জাদ ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো।
“নাহ এ নামটা সুন্দর না। আমারটাই সুন্দর। আমার মেয়ের নাম আমার নামের সাথেই মিলিয়ে রাখবো এটাই ফাইনাল।”
“মেয়ে তোমার একার নাকি? আসছে! আমি এ নাম রাখবো না। আমি যেটা বলছি সেটাই।”
“আমি বলছি না!”
“আমি বলছি হ্যাঁ!”
বেঁজে গেলো দুজনের মাঝে ঝগড়া। এরা কখনও ঠিক হওয়ার নয়। কিছু হলেই ঝগড়ায় লেগে যায়। সবাই একবার আঁখির দিকে তো একবার সাজ্জাদের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনেই নাছোড়বান্দা! সবাই ওদের ঝগড়া দেখে ক্লান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু ওরা ক্লান্ত হচ্ছে না।
“স্টপ!”
সাদিয়া কোনো পথ না দেখে চিল্লিয়ে কথাটা বললো। ওরা দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। সাদিয়া দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো।
“ঝগড়া করলে মেয়ে কিন্তু আমি নিয়ে যাবো বলে দিলাম। নাম আমি বলছি। ওর নাম হবে– “সানজানা আঁখিনুর খান” বুঝেছো? মিষ্টি মামনির ডাক নাম ‘নুর’ হবে। নুর মানে আলো। ও আমাদের ঘরের আলো। হুম! এটাই হবে।”
সবাই এতে সায় দিলো। সাজ্জাদ আর আঁখি দুজনেই গাল ফুলিয়ে রেগে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
রি চেইক করিনি । ইনশাআল্লাহ গল্পটা শেষ হতে চলেছে। প্লীজ এবার অন্তত গঠন মুলক মন্তব্য করে একটু উৎসাহ তো দিন?”