#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–৫৭ (অন্তিম পর্ব)
কালের ধারায় প্রকৃতি জগতে প্রাণের সজীবতা, রং, রূপ ও স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছে ঋতুরানী শরৎ। শরৎ হলো বষার্র পরবর্তী ঋতু। বষার্র অতি বষর্ণ ও অবিরাম মেঘবালিকার গুরুগুরু গজর্ন থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছে এক অপরূপ দৃশ্য। ঝকঝকে নীল আকাশের বুকে ধবধবে সাদা মেঘের ভেলা। নানাবিধ ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতা। ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস মিলেমিশে শরৎ ঋতু। শরৎ মানেই নদীর তীরে কাশফুল, গাছে গাছে শিউলি, বেলি, জুঁই, শেফালি, মালতি, টগর, হাসনাহেনা আর বিলে-ঝিলে শাপলা ফুলের সমারোহ। শরৎ ঋতুর সৌন্দযর্ বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময় ও মোহনীয়। ফুটন্ত শিউলির প্রাণ জুড়ানো ঘ্রাণ। আর নদীর তীরে শুভ্র সাদা কাশফুলের খিলখিল হাসিতে যেন তার সবটুকু সৌন্দযর্ ঢেলে পড়ার উপক্রম। শরতের আকাশের মতো স্বচ্ছ আকাশ আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। যদিও এখন আর সেই দিন নেই। এখন শরতের সময় হুট করেই বৃষ্টি আসে। প্রাকৃতিকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় ভালোবাসার পরশে।
সন্ধ্যেবেলা দিনের শেষে থেমে গেছে চারপাশের কমের্কালাহল। প্রকৃতিতে নেমে আশে এক অন্যরকম আবহ। টগবগে লাল রক্তের রূপ ধারণ করে দিনের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। সূযের্র রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজিয়েছে। আজ আকাশটা অনেকটাই মেঘলা। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। যদিও বর্ষা চলে গিয়েছে তবুও বৃষ্টি আসার কোনো শেষ নেই। এখন হেমন্ত কালেও বৃষ্টি আসে। সাদিয়ার পরিক্ষা শেষ হয়েছে। এখন ও অনেকটাই ফ্রি। বেলকনিতে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করছে ও। আজ মনটা কেমন যেনো ফুরফুরা লাগছে ওর। হয়তো ভালো কিছু ঘটবে কিন্তু ওর জীবনে তো ভালো কিছুই আসেনা। হুট করেই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
সাদিয়া রেলিং ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে নিচে গেইটের দিকে চোখ পরতেই থমকে গেলো ও। বুকের মাঝে ধুকবুক ধুকবুক করে উঠলো। গোধুলীর মেঘলা লাল আলোয় গেইটের কাছে নিরবকে দেখা যাচ্ছে। সাদিয়া ভাবলো ওর মনের ভুল হয় তো অন্য কেউ৷ যে মানুষটা তিন বছর ধরে আসে না সে আজ আসবে? কিন্তু যে মানুষটাকে এত ভালো করে চিনে তাকে চিনতে ভুল হবে? ভালো করে তাকাতেই দেখলো সত্যিই নিরব। সাদিয়া চোখ নোনা জলে ভিজে উঠলো। নিরব ওকে দেখে মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে। এই সেই আগের হাসি। যে হাসিতে পাগল হয়েছিলো ও। তিন বছরে একটু চেঞ্জ হয়নি নিরব। সেই আগের মতোই সুন্দর সুদর্শন আছে। সাদিয়া আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। গাল যুগল গড়িয়ে চিবুকে পড়লো নোলা জল। হৃদয়ের মাঝে কেমন যেনো হাহাকার করছে। নিরবের ফিরে আসায় তো ওর খুশি হওয়ার কথা কিন্তু ওর কেমন লাগছে বুঝতে পারছে না। হয়তো বেশি খুশি হয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেছে। সাদিয়া কিছুক্ষণ অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলো। নিরব সাদিয়া চোখের জল দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ওর যেনো কেমন খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে আসলেই খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। এতটা না করলেও পারলো। সাদিয়ার খুব অভিমান হলো নিরবের উপর। ও চোখটা মুছে রুমে চলে গেলো। নিরব মলিন হেসে আনমনে সাদিয়া শূন্য বেলকনির দিকে তাকিয়ে বললো।
“যতটা কষ্ট দিয়েছি সবটা পুষিয়ে দিবো কথা দিচ্ছি। হয় তো রাগ ভাঙানো টা একটু বেশি কঠিন হবে। ভুল যখন করেছি তখন কষ্ট তো করতেই হবে। কোনো জিনিস সহজে পেয়ে গেলে তার মূল্যও কম থাকে। ভালোই হলো!”
কথাটা বলেই হেসে বাসার ভিতরে চলে গেলো নিরব। সাদিয়া পর্দার আড়াল থেকে সবেই দেখলো। নিরবের হাসি মুখ দেখে একটু অবাকেই হলো। তবে কি নিরবের মেসেজটা সত্যি ছিলো? ওর এত বছরের অনিশ্চিত অপেক্ষার অবসান ঘটবে? নিরব কি আসলেই ওর কষ্টে ঘেরা জীবনে শরতের বৃষ্টি হয়ে নামবে? শরতের বৃষ্টি এসে যেমন পরিবেশ থেকে সব ধুলোবালি ধুয়ে দূর করে দেয়, তেমনি নিরবও কি ওর জীবন থেকে সব কষ্ট দূর করে দিবে?
সাদিয়ার মনের কোনো আশার আলো উঁকি দিচ্ছে।
——————————
সন্ধ্যা হতে হতেই সাজ্জাদ বাসায় ফিরে আসলো। ও এখন সন্ধ্যার পরপরেই বাসায় ফিরে। মাঝে মাঝে কাজ থাকলে দেরি করে আসে। আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না। আজ হয় তো তুমুল বৃষ্টি নামবে। বাসায় ফরতেই দেখলো ড্রইংরুমের সোফায় সবাই বসে আছে। ওর মা বাবা, আঁখির মা বাবা, আতিক সাদিয়া সবাই আছে। সবার মুখেই লেগে আছে সুন্দর হাসি। তাদের আড্ডার মধ্যমনি হচ্ছে নুর! ছয় মাসের মেয়েটা যেনো পুরো পরিবারকে মাতিয়ে রাখছে। সুন্দর হাসির জন্য সবার কাছেই প্রিয় নুর! সাজ্জাদ বাসায় এসে হাত বাড়াতেই আতিকের কোল থেকে লাফিয়ে পড়লো সাজ্জাদের কোলে। ওর কোলে গিয়ে সাজ্জাদের চুল টেনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। সাজ্জাদ নিজেও হাসছে। নুরকে কোলে নিয়ে যেনো ও সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলো। সন্তান কতটা রহমত এটা কেউ বাবা হওয়ার আগে বুঝতে পারবে না। সাদিয়া হাসতে হাসতে বললো।
“নুর ভারি পাকনা হয়ে গেছে। বিষণ মিষ্টি মেয়ে হয়েছে তোর ভাইয়া। এখনেই সবাইকে নাচিয়ে ছাড়ে মেয়েটা। নুর আরেকটু বড় হলে কতনা দুষ্টামি করবে ভাবতেই আমার অনেক ভালো লাগছে।”
“দেখতে হবে না মেয়েটা কার!”
নুরের গালে চুমু দিয়ে ভাব নিয়ে কথাটা বললো সাজ্জাদ।
“ঠিকই তো। আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। মাশাল্লাহ কি সুন্দর করে হাসে।”
সাজ্জাদের কথার পিষ্টে মুখ বাকিয়ে কথাটা বলে উঠলো আঁখি। সবাই হেসে আঁখির দিকে তাকালো। সাজ্জাদ কপাল কুচকে ওর দিকে তাকালো। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো।
“নুর তোমার মতো না বুঝলে। আমার মতো হয়েছে বুঝলা? তুমি তো কথায় কথায় গাল ফুলিয়ে থাকো।”
“ইস! বললেই হলো? আমার মতো হয়েছে।”
“হ্যাঁ এখন হাসছে বলে তোমার মতো হয়েছে। আর কাঁদলেই আমার মতো হয়েছে তাইনা? যত দোষ নন্দঘোষের তাইনা?”
“জীঁ!”
কথাটা বলেই আঁখি মুখ বাঁকালো। সাজ্জাদ চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকালো৷ ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি আছে বলে কথা বাড়ালো না। সবাই হতাশ হলো। এদের ঝগড়া বুড়ো হলেও কমবে না। সবাই মিলে অনেক সময় আড্ডা দিলো হাসি মজা করলো। পরিবারটায় যেনো খুশির শেষ নেই। হাসি আনন্দে কাটে সবার দিন। এর মাঝে নিরবের পরিবারও আসলো। নিরবের সাথে সাদিয়ার বিয়ের কথা বললো। সবাই জানে নিরব খুব ভালো ছেলে তাই অমত করেনি। নিরব এখন এই এলাকায় চলে এসেছে। এখন থেকে বাড়িতেই থাকবে। সাদিয়া যদিও খুব খুশি হয়েছে কিন্তু প্রকাশ না করে নিরবের সাথে রেগে আছে। সবাই মিলে হাসি আনন্দে খাওয়া দাওয়া করলো।
——————————-
রাত ১০টা। আঁখি নুরকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। সাজ্জাদ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আঁখির পাশে শুয়ে পড়লো। অগত্যা আঁখি কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আঁখি রেগে সাজ্জাদ কে কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো। সাজ্জাদ হেসে বেলকনিতে চলে গেলো। আঁখি নুরকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বেলকনিতে গেলো। হালকা মেঘ ডাকছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সাজ্জাদ বেলকনিতে চেয়ারে বসে আছে। আজ হয় তো রাত্র বিলাস করবে। আঁখি মুচকি হেসে ওর কোলে গিয়ে বসলো। সাজ্জাদ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। অগত্যা আঁখি কে পিছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলো। আঁখি ওর বুকের সাথে লেগে বসলো। সাজ্জাদ আঁখির ঘাড়ে মুখটা রেখে বললো।
“কখনও ভাবিনি যে মানুষটার সাথে এত ঝগড়া সে আমার বৌ হবে। কখনও ভাবিনি আমি এত সংসার প্রিয় হবো। আমি চাকরি করবো। কখনও ভাবিনি তোমায় এত ভালোবাসবো, তুমি আমার এত প্রিয় হবে। দেখতে দেখতে কি করে তিনটা শরৎ পেরিয়ে আরেকটা শরৎ এলো বুঝতেই পারিনি। তুমি আমার জীবনে শরতের বৃষ্টি হয়ে এসেছো। শরতের বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিতে এসে পরিবেশ কে সজীব করে দেয়, তেমনি তুমি আমার জীবনে এসে আমার অগোছালো জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছো। ভালোবাসি প্রিয়!”
“আমিও ভালোবাসি আমার মি. সাজগাজকে!
সাজ্জাদ মুচকি হাসলো। আঁখির মুখে মি. সাজগাজ শুনতে খুবেই ভালোলাগে ওর। যেনো আলাদা একটা তৃপ্তি পায় ও। সাজ্জাদের যেনো সুখের শেষ নেই। ভালোবাসায় এত সুখ ও কখনই বুঝেনি। আঁখি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সাজ্জাদের হাতে উপর হাত দিয়ে বলে উঠলো।
“গুছিয়ে নিয়েছি আমার সুখ!
মন চাইছে আজ বৃষ্টি নামুক!
তুমি আমি ভিজবো দুজনে খুব!
শরতের বৃষ্টি আমাদের সুখ!”
হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। আঁখি মুচকি হেসে সাজ্জাদকে টেনে নিয়ে গেলো ছাঁদে। এত রাতে সাজ্জাদ ভিজতে নারাজ! আঁখির ঠান্ডা লাগলে ওর মেয়েরও লাগবে কিন্তু আঁখি ওর কথা কানেও তুলেনি আজ ও ভিজবে। শরতের বৃষ্টিতে মন মজিয়ে ভিজবে। সাজ্জাদ শেষ মেনে নিয়েছে। ছাঁদে গিয়ে দুজনে খুব করে ভিজলো। শরতের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাজ্জাদ গান গাইছে আর আঁখি মনের আনন্দে নাচছে।
“রিমঝিম এ ধারাতে চায় মন হারাতে
এই ভালোবাসাতে আমাকে ভাঁসাতে
এলো মেঘ যে এলো ঘিরে বৃষ্টি
সুরে সুরে সোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী
আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এতো আশা ভালোবাসা এ মনে
সেই বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায় ফোটে কামিনী
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূণ্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী
শ্রাবণের বুকে প্রেম কবিতা যে লিখে যায়
হৃদয়ের মরু পথে জলছবি থেকে যায়
জানি সেই তো ছিল আগে ঘুমে
অনুভবে স্বপ্নচারিনী
আজ রাগে-অনুরাগে লেখে
বৃষ্টি দাগে প্রেমের কাহিনী”
———————-সমাপ্ত———————
(দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে গল্পটা শেষ হলো। জানি ভালো হয়নি আমি চেষ্টা করেছি হাসি আনন্দ আর বাস্তবতা মিলিয়ে লিখতে। তবে সবটা ফুটিয়ে তুলতে পারিনও। একটা সংসার গড়তে সবার স্যাক্রিফাইস দরকার। সব সময় দোষ নিয়ে বসে থাকলে চলে না। বৌ কখনও মেয়ে হয়না ঠিক। তাই বলে তার দোষ ধরা উচিত নয়। আগে শ্বাশুড়িদের ভাবা উচিত বৌ বয়সে তারা কেমন করতো। বৌদেরও উচিত বিবেকবান হওয়া। আমার লেখার হাত পরিপক্ব নয়। আমি এখনও শিখছি। ভুলত্রুটি মাফ করবেন। আমার গল্পতে রেসপন্স খুব কম। মাঝে মাঝে লেখার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলি কিন্তু নিজের শখ তো তাই কেউ না পড়লেও লিখি। সবাই দোয়া করবেন।)