#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি
(৩)
নয়ন হতভম্বের ন্যায় বসে রয়েছে। তার চোখের সামনে শিমুল। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এত আলাভোলা দেখতে মেয়েটার মনে মনে এই ছিল! তার উপর লোকে শুনলে হাসবে যে, নয়ন আর শিমুলের প্রেমের বিয়ে ছিল। মাত্র মাস দুয়েক আগেই নয়ন শিমুলকে ‘হ্যাঁ’ জানায়। শিমুল অনেক আগে থেকেই নয়নের পেছনে লেগেছিল। নয়নকে রাজী করানোর জন্য কতকিছুই না করেছে সে! শেষতক শিমুলের মিথ্যে ভালোবাসার তীব্রতা নয়নের কাছে সত্যি মনে হওয়ায়, সে রাজী হয়। তার দুই মাস পরই দুই পরিবারের আলোচনায় বিয়ে করে ফেলে। তাহলে কী এসব নাটক ছিল? শুধুমাত্র এই বাড়িতে ঢোকার জন্য তাকে একটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল? আর নেহাল? বিয়ের আদ্যোপান্ত সবকিছুতেই সেই ছিল। শিমুলকে দেখার পরও কেন কিছু বলেনি? উল্টো এমন ভাব করেছে যেন কেউ কাউকে চিনেই না! আর শিমুলের পরিবারই বা নেহালকে দেখার পর কোনো রিয়েক্ট করেনি?এই রহস্যের শেষ কোথায়! কোথায় গিয়ে খুলবে সব জট? নয়নের মাথা ধরে গেল। সে এমনিতে খুবই নরম মনের ছেলে। শান্ত স্বভাবের… আর তার জীবনেই এমনকিছু ঘটলো যা ভুলে যাওয়ার মতো না… একদিকে নিজের স্ত্রী, যাকে সে মন থেকে ভালোবেসেছিল, অপরদিকে তার বড় ভাই! সেও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয় নয়নের জীবনে। নয়নের কান্না পেয়ে গেল। না জানি কোন পাপের কারণে তার জীবনে এরকম ধ্বস নেমে এলো! নয়ন উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে টের পেল শিমুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নয়ন থমকে পেছন ঘুরে তাকাল। তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কাঁদো কেন? যা করছ খুব গৌরবের কাজ করছ। তোমার তো হাসার কথা। যেটা চাইছো, সেটাই পেতে যাচ্ছো।”
শিমুল নাক টেনে বলল,
“আমি তোমাকেই চাই নয়ন। বিশ্বাস করো, আমি তোমার ভাইয়ের সাথে কিছুই করিনি। সে আমার রুমে এসেছিল। আমার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। আমি..আমি নিজেকে রক্ষা করেছি।”
“কী বললে, ভাইয়া তোমার সুযোগ নিতে চাইছিল মানে?”
শিমুল কান্না কান্না ভাব করে মাথা দোলালো। নয়ন দুই সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আক্রোশ সমেত শিমুলের মুখোমুখি হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“মিথ্যা কথা একটু কম বলো, বুঝলে! একটা পুরুষ কখনোই তোমার কাছে আসবে না যদি না তুমি তাকে সুযোগ দাও। বা ইশারা করো। নিজের দোষ ঢেকে সব দোষ আমার ভাইয়ের উপর চাপিয়ে দিও না। এমন ভাব করছ যেন তুমি দুধের ধোঁয়া… শোনো, পাপ তুমিও করেছো, ভাইও করেছে। তাই আব্বা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই হবে। ভালোবাসা? ওটা ভুলতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।”
নয়নের কণ্ঠ ব্যথাতুর। বড় মুখ করে বললেও সে জানে, শিমুলকে সে মনের মনিকোঠার যেই জায়গায় রেখেছিল, সেখান থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে সময় প্রয়োজন। সেই সময়ের দীর্ঘতা কতটুকু, কে জানে! নয়ন চলে যাওয়ার জন্য ফের পা বাড়ালে শিমুল ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলো,
“আব্বা কী সিদ্ধান্ত নিছে?”
নয়ন পুনরায় থমকে দাঁড়াল,পেছন ঘুরে শিমুলের মায়াভরা মুখপানে তাকাল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই শেষ। আর কখনো তোমার মুখে ভালোবাসার অর্থ খুঁজতে যাবো না। ওই মুখ আমার কাছে বিরক্তিকর এবং আমার জীবন ধ্বংসকারী…
“তোমাকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত।”
বলে চপল পায়ে ঘর ত্যাগ করল নয়ন। শিমুলের ঠোঁটে ক্রুর হাসি। এইতো চেয়েছিল সে। নয়নকে ছেড়ে নেহালের হওয়া… নেহাল তাকে ভুলে যেতে পারলেও সে নেহালকে এত সহজে ভুলতে পারেনি,পারবেও না….
.
দুপুর যত বাড়ছে, রোদের তীব্রতাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। টুকুর গলা শুকিয়ে গেছে। সে গিয়ে মিতুর আঁচল ধরে ফিসফিস করে পানি খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। মিতু তাকে নিয়ে রান্নাঘরে এলো। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির সহিত সাধারণ পানি মিশিয়ে এক গ্লাসে দিলো। টুকু পানি খাওয়া শেষ করে প্রশ্নের মেলা নিয়ে বসল।
“মা, রান্না করবা না আজকে?”
“না। ডিম ভাজা আর ডাল দিয়ে খেতে হবে। পারবে না?”
“আম্মু, ঘরে কী হইছে? সবাই এরকম মুখ করে আছে কেন? ছোট চাচাকে দেখলাম লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। কী হইছে আম্মু?”
মিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিচু হয়ে টুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হয়নি আম্মু। একটা খারাপ লোক আমাদের সংসার উচ্ছিষ্ট করতে চাইছে। আমরা আজ তাকে শাস্তি দিবো। এমন শাস্তি, যা তার কাছে সুখ মনে হলেও পরবর্তীতে বুঝবে কী হলো জীবনে..”
“খারাপ লোকটা কে আম্মু?”
“এত কথা বলে না মা। তুমি গিয়ে খেলো। ক্ষিদে পেয়েছে?”
“না আম্মু। পাপা একটা রুটি কিনে দিছিলো। আমি খাইছি।”
“আচ্ছা। তাহলে খেলো গিয়ে..”
“একা একা খেলতে ভালো লাগে না আম্মু। তুমিও আমার সাথে খেলো না..”
মিতু শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুঁজে খুঁজে তমলকে বের করে বলল,
“টুকুকে তানিয়াদের বাসায় দিয়ে আসো। ওর মা’কে বলবে, আমি বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসবো। ঘরের যে পরিস্থিতি, এর ভেতর ওর না থাকাই ভালো।”
তমল মিতুর হাত জোড়া চেপে ধরল।
“তুমিও দেখি ভেঙে পড়ছো মিতু।”
“কই? আমি ঠিক আছে। ঠিক থাকতে হবে। কুসুমটাকে শক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে। ওর পাশে থাকতে হবে।”
“জানো,আমার ইচ্ছে করতেছে নেহালকে ধরে মাটির তলায় পুঁতে রেখে আসি। ও কীভাবে এরকম একটা কাজ করতে পারল! আমাদের বাসায় ছেলেদের বলো বা মেয়েদের, সবার হয় এক বিয়ে। আর আজ, শুধুমাত্র নেহালের এই ভুলের কারণে, নয়নটার জীবন শেষ হয়ে গেল। নেহালকেও দ্বিতীয় বিয়ে করতে হবে। কুসুমের কী হবে, আল্লাহ জানেন।”
এক মণ সমান ভারী নিশ্বাস ফেলে স্ত্রীর দিকে তাকাল তমল। তার বুকটা কাঁপে বারংবার। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, তার খেই এখনো ধরতে পারছে না সে।
মিতু বলল,
“খালি নেহালের দোষ দিলে, আর ওই মেয়ে। ও কী কম নাকি? যাক, ও যেই ইচ্ছা পূরণে এই বাসায় এসেছে সেটা তো আব্বা পূরণ করেই দিবে। তারপর দেখা যাক, কী হয়।”
“এটা কেমন শাস্তি হলো মিতু? নেহাল আর শিমুলের যদি বিয়ে হয়, তাহলে কুসুম? আর ওর বাচ্চা?”
“এটা শাস্তি না,একটা পরীক্ষা বলতে পারো। নেহালের পরীক্ষা। শিমুলের কাছে যাওয়ার জন্য, শিমুলকে নিজের করার জন্য সবধরনের বৈধতা ওকে করে দেওয়া হবে। এরপর যদি ও কুসুমকে ভুলে শিমুলকে নিয়েই থাকে,তার মানে কুসুমের জন্য সঠিক লোক ও নয়। এবং যে সঠিক নয়,সে যত দ্রুত জীবন থেকে চলে যাবে, ততই ভালো হয়। আর যদি কুসুমকে সত্যি নেহাল ভালোবেসে থাকে। তাহলে শিমুলকে জীবনেও কাছে টানবে না। সব ছেড়ে কুসুমের কাছেই ফিরে আসবে এবং জন্মের মতো একটা শিক্ষা পেয়ে যাবে। নেক্সট টাইম কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দুইবার ভাববে.. আর কুসুম বা ওর বাচ্চার জন্য আমরা সবাই আছি তো। তুমি চিন্তা করো না। নেহালের জন্য এই পরীক্ষাটা দরকার। এটা ওকে শুধু শাস্তিই দিবে না, ওকে বোঝাবেও, কে তার জন্য সঠিক আর কে না…”
“মাঝখান দিয়ে শিমুলের কী শাস্তি হবে?”
“যদি নেহাল ওর সাথেই সংসার বেঁধে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আব্বা নেহালকে ত্যাজ্য করবেন। যদিও এটা গোপনীয়। আব্বা এখনো কাউকে জানায়নি, আমি আর আম্মা বাদে। নেহালের নিজের কী যোগ্যতা আছে, তা তো তুমি ভালোই জানো। শিমুল খুবই ধূর্ত প্রকৃতির আর লোভী। যখন নেহালের কিছু থাকবে না তখন শিমুলও থাকবে না। এভাবেই আজ এই লোক,কাল ওই লোক করে করে জীবন যাবে। আর পরকালের বিচার তো আছেই। আর যদি নেহাল ওকে বাদ দিয়ে কুসুমকে বেছে নেয়, তাহলে আব্বা ওকে ক্ষমা করে দিবেন, শিমুলকে তাড়িয়ে দিবেন। আর এই সমাজে এক মেয়ের দুই দুটো বিয়ে, তার উপর একটা জায়গায়ও সংসার করতে না পারা… কতবড় ব্যাপার! একবার ভাবো। শিমুল তার শাস্তি আপনাতেই পাবে। তুমি চিন্তা করো না। প্রকৃতি কাউকেই ছেড়ে দেয় না। যে যেটা করবে, তার বিনিময়ে সেটাই পাবে… ভালো করলে ভালো,খারাপ করলে খারাপ।”
তমলের মাথায় হঠাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। সে মিতুর গলা জড়িয়ে ধরে ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
“আচ্ছা মিতু, আমাকেও আরেকটা বিয়ে করা উচিত। কী বলো? তাহলে আমারও একটা পরীক্ষা হয়ে গেল আর বুঝবেও পারব কে সঠিক কে না..”
“কী..কী বললে তুমি!?”
মিতু চোখ রাঙালো, এমনভাবে যেন খেয়েই ফেলবে তমলকে। তমল হালকা হেসে মিতুকে ছেড়ে দিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, কিছু না।”
“ভালো হয়ে যাও মাসুদ। ভালো হতে টাকা লাগে না।”
“এই, মাসুদ কে?”
তমলের ভ্রু কোঁচকানো, মিতু মিটিমিটি হাসছে। ভণিতা করে বলল,
“খুঁজে বের করো মাসুদ কে। আমি চললাম।”
“শুনে যাও। কে মাসুদ? মিতু… এই মিতু…”
তমলকে কপট রাগ নিয়ে ডাকতে লাগল। মিতু শুনল না। সে ততক্ষণে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে। তমল কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো।
.
“এইটুকুর জন্য এভাবে শাস্তি দিও না কুসুম!”
নেহালের কণ্ঠ করুণ শোনালো। কুসুম তৎক্ষনাৎ কটাক্ষ করে উত্তরে বলল,
“এইটুকু? আচ্ছা, আমি যদি রাতের বেলা কোনো পুরুষের ঘরে যেতাম। তখনও ব্যাপারটা এইটুকু হতো?”
নেহাল জবাব দিতে পারল না।
“দোষ আপনার না। দোষ তো সমাজের প্রথার। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সব অত্যাচার, অনাচার, ধোঁকাবাজি শুধু মেয়েদের জন্য। মেয়েরা মুখে তালা দিয়ে চুপচাপ সহ্য করে যাবে শুধু!”
“আচ্ছা বাবা সরি। আমি অন্য মিনিং করিনি। ওসব বাদ দাও। তুমি বাবাকে বোঝাও। আমি কিন্তু ঘর ছেড়ে চলে যাব।”
“যাও। আব্বার সাথে আমি একমত। ভুল ক্ষমা করা যায়, অপরাধ না। অপরাধী নইলে পার পেয়ে যাবে। ভাববে, সে যাই করুক, তার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আপনি কোনো ভুল করেননি। আপনি অপরাধ করেছেন। তাও একবার দুইবার না… আপনাকে তো ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। আব্বার শর্ত মেনে নিন যদি সৎ সাহস থাকে।”
নেহাল বুঝল, যতই বোঝানো হোক না কেন,কুসুমকে টলানো যাবে না। সে যদি হাবিব শিকদারের সঙ্গে একমত হয়, তবে তাই করে ছাড়বে। নেহাল কুসুমের পায়ের কাছটায় হাটু গেড়ে বসল। চোখে পানি চলে এলো কুসুমের। মুখ ঘুরিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি সরালো সে।
নেহাল প্রশ্ন করল,
“ভয় লাগছে না? যদি শিমুল আমাকে সত্যি জিতে নেয়? ও তো জিততেই এসেছে আমাকে।”
কুসুম তাকাল,তার স্পষ্ট দীঘি জোড়া পানিতে টইটম্বুর। ধরা গলায় জবাবে বলল সে,
“তাহলে ভুলে যাব আপনাকে। ভুল মানুষকে স্মৃতির পাতায়ও রাখতে চাই না।”
(চলবে)
[আগে আগেই হাইপার না হওয়ার জন্য অনুরোধ রইলো]
আগের পর্ব- https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/395439412177837/