#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি
(৫)
নিস্তব্ধ রাত্রি। পক্ষীকূলের সমস্ত যাত্রী ঘুমিয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকারাও আজ নিশ্চুপ। শিকদার বাড়ির শোকে তারাও যেন সামিল, ব্যথিত। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উপস্থিত চাঁদ মামা। থেকে থেকে মেঘের তলে হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাস নেই, উড়ছে না একটি গাছের পাতাও! সবকিছু কেমন থমধরা,স্তব্ধ! ঠিক তেমনই স্তব্ধ কুসুম। তার এখনো মাথায় খেলছে না, কী ঘটে গেল! নেহালকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে সেই বিকেলেই। হাসপাতাল যথেষ্ট কাছে হওয়ায় সময় মতো পাকস্থলী থেকে সব বিষ বের করতে সক্ষম হয়েছে ডাক্তারগণ। যদিও নেহালের এখনো হুশ ফেরেনি। ঘুমের কড়া ওষুধ দিয়ে তাকে গভীর ঘুমে রাখা হয়েছে। আগামীকাল সকালে সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠবে,আশা করা যাচ্ছে।
তবুও কুসুমের চিন্তা এতটুকু কমছে না। না কমছে ছটফটানি। ইচ্ছে হচ্ছে এক দৌড়ে হাসপাতালে চলে যেতে। কিন্তু হাবিব শিকদারের কড়া বারণ,কুসুম বা বাড়ির কোনো মহিলা সেখানে যেতে পারবে না। আর এমনিতেও আগামীকাল নেহালকে নিয়ে আসা হবে। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। যাওয়ারও দরকার নেই।
হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কুসুম। তার চোখে পানি নেই। চেহারায় মলিনতার ছাপ। হিসেব কষছে, কোথা থেকে কী হয়ে গেল! দু’দিন আগেও যাদের দিবস সূচনা, রজনীর সমাপ্তি হাসি,ঠাট্টা আর প্রাণ চঞ্চলতায় কাটতো, আজ তারা কতটা দূরত্বে! একজন বিষ অবধি খেয়েছে! আচ্ছা, মারা যাওয়া এতই সহজ? নেহাল না ওয়াদা করেছিল, কখনো কুসুমকে একা করার কথা ভাববে না। তাহলে সেই ওয়াদা কেন ভঙ্গ করল? অবশ্য নেহাল তো এও ওয়াদা করেছিল, কুসুমের ভরসা, বিশ্বাস আজীবন অটুট থাকবে। কই? সেই ওয়াদাও তো রইলো না। জীবন টা এমনই। ওয়াদা দেওয়া সহজ, সেই ওয়াদা রক্ষা করা কঠিন! কুসুম মৃদু শ্বাস ফেলল। একটা জট পাঁকানো মস্তিষ্ক নিয়ে ফিরে এলো ভাবনার জগত থেকে। দরজায় মিতু এসে দাঁড়িয়েছে। কুসুম মিতুর দিকে তাকাল।
“খাবি আয়।”
ডাকলো মিতু। কুসুম জবাব দিলো না, ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো।
“কী বললাম? খেতে আয়..”
“ও তো না খেয়ে আছে আপা। আমি কীভাবে…”
কুসুম কেঁদে ফেলল। দীর্ঘক্ষণ পর সে কাঁদছে। তার আঁটকে যাওয়া সমস্ত জলধর জলপ্রপাতের ন্যায় ঝরতে শুরু করল। মিতু নিরবে ঘর ত্যাগ করল। কুসুমকে কাঁদার জন্য বিন্দুমাত্র বারণ করল না। যার স্বামী হাসপাতালে অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে তার কাঁদাই উচিত। কান্না কখনো কখনো জীবনের সকল পাপ,তাপ ধুঁয়ে সম্পর্ককে পরিষ্কার করে দেয়। মিতু নিজেদের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, নয়ন তখন তার দিকেই এগিয়ে আসলো। মিতুকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লে মিতুও দাঁড়াল।
“কোথায় গেছিলা?”
মিতুর তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে নয়ন একটু হকচকিয়ে গেল প্রথমে। পরক্ষণেই জবাবে বলল,
“শিমুলের বড় ভাইয়ের খোঁজে।”
“তার খোঁজ করা এতটাই জরুরি? এদিকে নিজের ভাই যে মরতে বসছিল।”
“শুনছি ভাবী। হাসপাতাল থেকে ভাইকে দেখে আসলাম। আসলে শিমুলের বড় ভাই লোকটা ভালো। সে বোধহয় তার বোনের কান্ডকারখানা সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানলে পানি এতদূর গড়াতো না। বাবা-মা’কে শিমুল ভয় না পেলেও ভাইকে যমের মতো ভয় পায়। তাই তাকে জানাতে গিয়েছিলাম তার বোনের কীর্তিকাহিনী।”
“জানানো হয়েছে?”
“হ্যাঁ ভাবী। আসবে আগামীকাল।”
“আর তখন ওই ডাইনীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলো। আজ রাতটাই এই বাড়িতে ওর শেষ রাত। এরপর থেকে ওর ছায়াটাও যেন এই বাড়িতে না পড়ে নয়ন।”
নয়ন প্রত্যুত্তর করল না। শিমুলকে ডাইনী উপাধী দেওয়ায় তার খারাপ লাগতো, কিন্তু সত্যি কথা বলতে খারাপ লাগছে না। কেননা সে মন থেকে শিমুলকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে এবং পারছেও। নয়ন ভারী নরম মনের- এই কথা সত্য, কিন্তু তাই বলে আবেগী না এবং দুনিয়াটাকে আবেগের জায়গা ভাবে না। সে সবসময় তার লক্ষ্যে স্থির ছিল এবং এই সিদ্ধান্তেও স্থিরই থাকবে। আগামীকাল শিমুলের বড় ভাই এলে শিমুলকে মুখে মুখে তালাক দিয়ে এই বাড়ি থেকে বিদেয় করবে। আর তারপর কাগজপত্রে তালাকের কার্য শেষ করে তার জীবন থেকে চিরজীবনের মতো বিদায় করবে- এমনটাই সিদ্ধান্ত নয়নের। মিতু নিজের রুমে চলে এলো। নয়নটার উপর রাগ জন্মে তার। এতকিছু ঘটে গেল অথচ কেমন ম্যাদা হয়ে আছে! নয়নের জায়গায় সে থাকলে শিমুলের হাড়গোড় চিবিয়ে খেতো। অথচ নয়ন শিমুলকে একটা কড়া কথা পর্যন্ত বলছে না। শিমুল এই বাড়ি থেকে আউট হবে,এটা নিশ্চিত মিতু,কিন্তু এত ঠান্ডা ভাবে না… তাকে ধড়াম ধড়াম কয়টা দিয়ে আউট করতে পারলে খুশি হতো। মিতুর হাত-পা নিশপিশ করছে। এখনি গিয়ে মেয়েটার গাল থ্যাতা করে দিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো…
মিতু আক্রোশে নিজের হাত ঝাড়া মারল।
.
রাত বাড়ছে। সময় থেমে নেই। কুসুমের মাথা ধরেছে। সে চোখ মুছে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হুট করে এই রাত্রিবেলা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো সে। শাওয়ারের ঠান্ডা পানি গা কাঁপিয়ে তুলছে, অথচ সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কুসুমের। নিচে বসে সে চোখজোড়া মুদলো। চলে গেল পেছনে… সেইদিনটায়, যেদিন নেহাল তাকে দেখতে এসেছিল!
কোঁচকানো ভ্রু আর এক ঝাঁক বর্ষা নিয়ে নেহাল এসেছিল সেদিন। বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি। সবাই ভেবেছিল পাত্রপক্ষ বুঝি এই বৃষ্টিতে আসবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, কাঁকভেজা হয়ে কুসুমদের বাড়িতে পৌঁছে ছিল একেকজন। নেহাল, নেহালের বড় ভাই তমল, আর শ্বশুর মশাই হাবিব শিকদার, সঙ্গে আরও জনা দুয়েক মাতব্বর গোছের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে মেয়ে দেখতে এসেছিলেন তারা। কুসুমের এক বান্ধবী তো রীতিমতো হৈচৈ করে বলছিল,
“বর আসছে, বর আসছে। আমগো কুসুমের বর আসছে।”
কুসুম তখন লজ্জায় লাল-নীল-সবুজ! পরনে শাড়ি নেই। চেহারায় সাজ নেই। আসলে ভাবতেই পারেনি এই বৃষ্টিতে তারা আসবে। তাই আর প্রস্তুতি নেয়নি কোনো। আম্মার অস্থিরতা আর বান্ধবীর তাড়াহুড়োর মাঝ দিয়ে কুসুম দ্রুত তৈরি হয়েছিল। একটা জাম রঙের সুতির শাড়ি। আব্বা আনিয়ে রেখেছিলেন আগে থাকতে। শাড়িটা এত সুন্দর মানিয়েছিল ওর গায়ে! আম্মা আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলেন! এক রত্তি মুখটায় কিছু মাখানোর আগেই বরপক্ষ থেকে মেয়ে দেখার তাড়া শোনা গেল। শেষে বড় ঘোমটা মাথায় টেনেই যাওয়া হলো তাদের সামনে। কুসুমের মনে পড়ছে, কী অসম্ভব ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল,এই বুঝি মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ল সে…!
ঘোমটার আঁচল শক্ত করে ধরে রেখে সে বসল একেবারে নেহালের মুখোমুখি। নেহালের চোখেমুখে তখন রাজ্যের বিরক্তি। সেই বিরক্তির কারণ কী, কুসুম জানত না। তাকে যখন চোখ তুলে তাকানোর কথা বলা হলো, সেই প্রথম নেহালের চোখে তার চোখ আঁটকে গেল। হা হয়ে গেল কুসুম। এই রাজপুত্র তার বর হবে! ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো তার। কিছু মানুষ আছে,যাদের দেখলেই আপন আপন লাগে… নেহালকে দেখামাত্রই তাকে বেশ আপন লেগেছিল কুসুমের কাছে। এরপরের গল্পটা গতানুগতিক ধারার। কুসুমকে দেখা শেষে হাজার টাকার পাঁচটি নোট দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কুসুম মিনতি করল বিধাতার কাছে, বর হলে এই লোকটিই যেন হয়। একে তার মনে ধরেছে। বিধাতা শুনেছিল। যাওয়ার সময়ই ‘মেয়ে আমাদের দারুণ লেগেছে’ বলেছিল হাবিব শিকদার, মুখে তার চওড়া হাসি। বাড়িতে খুশির রোল পড়ে গিয়েছিল…
কুসুম চোখ খুলল। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথা, অনেক ওয়াদা, অনেক প্রতিজ্ঞা! সবকিছু এত সহজে ভেস্তে দেওয়া যাবে না। নেহালকে ভালো হতেই হবে, তার জন্য, তার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্য! কুসুম উঠে পড়ল। শাওয়ার অফ করে জামাকাপড় পাল্টে ওজু করে এলো। সেজদায় লুটিয়ে পড়ে জানালো নিজের মনের প্রার্থনা। নেহালের সুস্থতা কামনা করল খোদার কাছে। তারপর টেবিলে গিয়ে বসল। এই টেবিলে নেহাল লেখালেখি করে, কাজ করে। একটা নোটপ্যাড টেনে নিলো। নীল কলমে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতে শুরু করল,
শুনুন,
ক্ষমা করিনি, কিন্তু ক্ষমা করতে চাই। ক্ষমা পেতে হলে।কিছু মূল্য আপনাকে দিতে হবে। এই মূল্য টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, এই মূল্য কোনো সোনা,রূপা,তামা দিয়ে পরিমাণ করা যায় না। এই মূল্য ভালোবাসার! নতুন প্রেমের! একটি নতুন জীবনের- যেখানে ছড়াছড়ি থাকবে অনুভূতির। বিয়ের পর এখন অবধি কোথাও হানিমুনে নিয়ে যাননি। এবার যেতে চাই। নিয়ে যাবেন কোথাও? যেখানে আকাশ নীল,মাটি নীল,প্রকৃতি নীল… নরম পানিতে গা মিশিয়ে জীবনের সব পাপ,তাপ ধোঁয়া যাবে? অপেক্ষায় থাকব!
.
নয়নের ঘরেই শিমুল থাকছে যেহেতু, তাই নয়ন আজ রাতটা খালি ঘরে কাটানোর কথা ভাবল। শিমুলের সঙ্গে এক ঘরে আর এক মুহূর্তও না। শিমুলের ন্যাকা কান্নাকাটি দেখে যদি মন গলে যায়! অসম্ভব এটা…
নয়ন লুঙ্গি আনার জন্য নিজের ঘরে গেল। একটা বালিশ নিয়ে খালি ঘরে চলে আসবে- এমনটাই চিন্তাভাবনা। শিমুল নয়নকে দেখামাত্র তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। শিমুলের প্ল্যান বদলেছে। নেহালের বিষ খাওয়ার খবর শোনামাত্র সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যে করেই হোক নয়নকে হাতছাড়া করা যাবে না। নয়ন যদি সাপোর্ট না দেয়,তাহলে এই বাড়িতে আর কোনো জায়গা হবে না তার। আর এই বাড়িতে জায়গা না হলে নেহালের জীবনেও ফিরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু কী করবে, ভাবতে গিয়ে বেরিয়ে এলো পেছনের এক চরম সত্য! যা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি,তাই বাস্তব হলো। প্রথমে শিমুলের মাথায় বাজ পড়লেও পরক্ষণেই মুখে এলো হাসি। সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস সামনে এসেছে। এবার কেউই নয়নের জীবন থেকে তাকে তাড়াতে পারবে না। তারপর ধীরেসুস্থে নেহালকে নিজের করে পাওয়ার বুদ্ধি আঁটা যাবে।
নয়ন শিমুলের দিকে ফিরেও তাকাল না। সে তার মতো কাবার্ড থেকে একটা লুঙ্গি, ফতুয়া বের করল। বিছানা থেকে বালিশ নেওয়ার সময় শিমুলের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“নয়ন..”
নয়ন তাকাল না,জবাবও দিল না। নিজের মতো কাজ চালিয়ে গেল। শিমুল এসে তার সামনে দাঁড়ালে সে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। শিমুল আবার তার সামনে গেলে নয়ন বজ্র কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কী সমস্যা?”
“আমি কিছু বলতে চাই নয়ন।”
“কিন্তু আমি কিছু শুনতে চাই না। সরো সামনে থেকে।”
“নয়ন, তোমাকে শুনতেই হবে। তোমার অনাগত সন্তানের কথা তুমি জানবে না তো কে জানবে?”
নয়নের মনে হলো, তার মাথার উপর আকাশ,পাহাড়,জমিন সবকিছু একে একে ভেঙে পড়ছে। বললো কী এই মেয়ে! কার অনাগত সন্তান? তার! নয়নের চোখজোড়া এতবড় হলো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। শিমুলের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক, যেন নয়নের সন্তানের মা হতে পেরে সে খুশিতে মরে যাচ্ছে… নয়ন হাত থেকে বালিশটা ছুঁড়ে মেরে হন্যপায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে শিমুলের খুশিটুকু প্রদীপের ন্যায় দপ করে নিভে গেল। তবে কী কোনোভাবেই নয়নকে আঁটকে রাখা যাবে না!
(চলবে)
আগের পর্ব- https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/397620825293029/