শর্বরী অলিন্দ্রিয়া রুহি (৪)

#শর্বরী
অলিন্দ্রিয়া রুহি

(৪)

“অবশেষে তোমার স্বপ্নটাই পূরণ হতে যাচ্ছে। খুশি?”

ধরা গলায় প্রশ্নটা করল নয়ন। শিমুল কান্না কান্না ভাব করল। এগিয়ে এসে নয়নের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমার সাথে এই অবিচার করিও না প্লিজ। আমি সরি। সত্যি সরি।”

নয়ন হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি,

“নাটক, নাটক হচ্ছে আমার সাথে তাই না? একবার গাধা বানাতে পেরেছো দেখে বারবার গাধা বানাতে পারবে তা তো হবে না। আমি ভুলে যাবো না তোমার কর্মকাণ্ড। আব্বা বিকেলে কাজী আনাচ্ছেন। আমি তোমাকে জনসম্মুখে তালাক দিবো আর জনসম্মুখেই তোমার বিয়ে হবে। যাও, খুশি থাকো। যেটা চেয়েছো, সেটাই তো পাচ্ছো।”

শিমুল কিছু না বলে চুপ চাপ কেঁদে গেল। নয়ন ঝটকা মেরে নিজেকে সরিয়ে নিলো। তার বুকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কলিজা পুড়ে ছাঁই। কেন তার জীবনে এরকম কিছু হলো! কেন, কেন, কেন! কার কী ক্ষতি করেছিল সে? নয়ন গটগট আওয়াজ তুলে ঘর ত্যাগ করলে চোখের জল মুছে বিছানায় উঠে বসল শিমুল। আনন্দে তার উড়তে ইচ্ছে করছে। যাক, অবশেষে সব নাটকের ইতি ঘটবে। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলে হয়। তারপর নেহাল তাকে ছেড়ে কই যায়, তাও দেখে নেবে সে। এখন শুধু বিকেলের অপেক্ষা। দেয়াল ঘড়িটা ঠিক তখনি ঢং ঢং আওয়াজে বেলা দুইটা বাজার জানান দিল। শিমুল সেদিকে চেয়ে অস্থির চিত্তে বলল,

“কখন বিকেল হবে!”

.

তমল, হাবিব শিকদার এক রুমে বসে রয়েছেন। তমল বাবাকে ভাত খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করছে। কিন্তু হাবিব শিকদার এই সমস্যা সমাধান না করে কিছু মুখে তোলার জন্য সাফ নাকোচ করেছেন। তমল বুঝে গেল, বাবাকে এখন শত বললেও খাবে না। তাই সে ঘুরে দাঁড়াল যাওয়ার জন্য, তখনি নেহাল ঘরে ঢুকল। একসঙ্গে দুই জোড়া চোখ নেহালের উপরে এসে পড়ল।

নেহাল একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি করুণ। চোখের ভাষায় বারংবার ক্ষমা চাইছে বাপ,ভাইয়ের কাছে। কিন্তু মুখে বলতে পারছে না। অজানা জড়তা তাকে লজ্জার দিকে ঠেলে দেয়।

নতমস্তকে দাঁড়ানো নেহালকে দেখে হাবিব শিকদার গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“কী চাই?”

নেহাল ভেজা বেড়াল ছানার মতো মিনমিনিয়ে জবাব দিলো,

“কিছু বলতে চাই আব্বা।”

“কী বলতে চাও?”

“আমাকে ফাঁসিতে চড়ান দরকার পড়লে। তবুও এই বিয়েটা দিবেন না। আমি স্বীকার করছি, আমার পাপ হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি মন থেকে অনুতপ্ত হয়, তাহলে তাকে ক্ষমা করে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত। একটা ভুলের জন্য আজীবন তড়পাতে পারব না। আমি মরে যাব,তাও এই বিয়ে করব না।”

“কী করে বুঝব তুমি অনুতপ্ত? দু’দিন পর যে আবার এরকম কোনো কাহিনী ঘটাবা না তার বিশ্বাস কী?”

“এর আগে কখনো কিছু হইছে আব্বা? কখনো মেয়েলি বিষয়ে কোনো বিচার পাইছেন আমার ব্যাপারে?”

“ভুইলা যাইয়ো না, আগে না পাইলেও এখন পাইছি। এমনকি হাতে নাতে ধরছি। আচ্ছা, আজকে কুসুম যদি এরকম কিছু করতো, তারপর শত অনুনয় করলেও তুমি কী তারে ক্ষমা কইরা দিতা? সব ভুইলা যাইতে পারতা?”

নেহাল জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। হাবিব শিকদার তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

“তুমি যদি ক্ষমা না করতে পারো, তাইলে ওয় তোমারে ক্ষমা করব কেন? ওর মনে আঘাত লাগছে না? আর এই আঘাতের দাগ এত সহজে শুকাবে না নেহাল।”

“দরকার পড়লে কুসুমের পা ধরে মাফ চাইবো। ওকে সময় দিবো। আমার কৃতকর্মের জন্য আমি সব ধরনের শাস্তি ভোগ করতে রাজী। শুধু এইটা না। আমি শিমুলের চেহারাও দেখতে চাই না।”

হাবিব শিকদার হেসে ফেললেন।

“চেহারা দেখতে চাও না আবার রাতের আঁধারে বউ ফেলে তার ঘরে যাও। অথচ সে তোমার ছোটো ভাইয়ের বউ লাগে, এই কথাটাও তোমার মাথায় আসে নাই।”

নেহাল মাথাটা নিচু করে ফেলল। হালকা গলায় বিড়বিড় করে বলল,

“শয়তান ধরছিল আমারে আব্বা। আমি মাফ চাই। ক্ষমা করেন। আমি এই বিয়ে চাই না আব্বা। আমি বাঁচলে কুসুমকে নিয়ে বাঁচবো।”

“কুসুম যদি তোমার সাথে আর থাকতে না চায়? যার প্রতি বিশ্বাস ভেঙে যায়, তার সাথে থাকা যায় না নেহাল।”

নেহাল ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই কথাটা সে ভেবে দেখেনি। যদি কুসুমই তার সঙ্গে আর থাকতে রাজী না হয়? পরমুহূর্তেই নেহালের মন বলল, নিশ্চয়ই হবে। কেননা কুসুমের সন্তানের বাবা সে। কুসুম আর তার মধ্যিখানের সুতো সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায়নি। সেই সুতো আবার জোড়া লাগাতে পারবে একজনই, তাদের অনাগত সন্তান! নেহাল হঠাৎ জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল,

“কুসুম আমাকে এড়াতে পারবে না আব্বা। আমি জানি। ও একদিন না একদিন আমাকে ক্ষমা করবেই।”

“তাইলে আমার সাথে না, যার বুকে তুমি ছুরিকাঘাত করছো, তার কাছে যাও। গিয়ে দেখো, ক্ষমা করে কী-না..”

নেহাল তক্ষুনি ছুটলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, কুসুমের পা ধরে বসে থাকবে ততক্ষণে যতক্ষণ না সে মাফ করে দেয় নেহালকে। কিন্তু কুসুমের সঙ্গে দেখাই করতে পারল না নেহাল। কুসুম দরজা আঁটকে ভেতরে রয়েছে। নেহাল অনুরোধ করল, কুসুম দরজা খুলল না। নেহাল বিষাদময় কণ্ঠে বলল,

“কুসুম, কুসুম এমনটা করো না তুমি। ক্ষমা করো, নয়তো আমাকে পাবে না আর..”

কুসুমের তবুও কোনো জবাব এলো না। নেহাল দরজায় আঘাত করতে করতে ব্যথিত মন নিয়ে প্রস্থান করল শেষতক। কুসুম দ ভঙ্গিতে বসে কাঁদছে নিরবে। তার পিঠ কেঁপে উঠছে বারে বারে। মিতু উদ্বিগ্ন নিয়ে বলল,

“তারে ছাড়া থাকতে পারবি না যখন তাহলে ক্ষমা করে দেস না কেন?”

“জানি না।”

“কুসুম, নেহালকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে আয়। তুই ওকে ছাড়া ভালো থাকবি না,ও তোকে ছাড়া ভালো থাকবে না। মাঝ দিয়ে একটা শাঁকচুন্নিকে জিততে দিস না।”

জবাব দিলো না কুসুম। কেঁদে গেল নিরবে….

.

বিকেল হলো। হাবিব শিকদার একজন হুজুর ডেকে আনলেন। শিমুল কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে আলু করে ফেলেছে। কিন্তু এই কান্না তার জয়ের, খুশির! শিমুলের আব্বা এসেছেন, আম্মা বা অন্য কেউই আসেননি। উনার আব্বাও নির্লিপ্ত,নির্বিকার। যা হচ্ছে সব মাথা পেতে নিচ্ছে। তাহলে কী সেও শিমুলের সাথে জড়িত? এবং শিমুলের প্ল্যান সম্পর্কে জানতো? ভাবায় নয়ন কে। শিমুলের ভাই-ই বা কোথায়? তাকেও তো আসতে বলা হয়েছে। তবু আসলো না কেন? নয়ন ঘর ছাড়ল। দুঃখে না, কিছু তথ্য নিতে। শিমুলের একমাত্র বড় ভাই জয়নাল কোথায়- সেই খবর উদ্ধার করতে।

হাবিব শিকদার ও শিমুলের বাবার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শেষে উদ্বিগ্ন চেহারার হুজুর এবার নেহালকে ডাকতে বলল। হাবিব শিকদারের আদেশে তমল নেহালের ঘরে গেল তাকে ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে থাকা নেহালকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠল তার। তমল উদ্ভ্রান্তের ন্যায় নেহালের বুকে ধাক্কা মারলে অচেতন নেহালের হাত খসে একটা শিশি বেরিয়ে এলো। সেই শিশি যে কীসের শিশি,তা বুঝতে একটুও সময় লাগল না তমলের। তমল “নেহাল” বলে একটা গগণবিদারি চিৎকার দিয়ে উঠল।

(চলবে)
সবাই লাইক,কমেন্ট করে পাশে থাকবেন। আপনাদের উৎসাহ, আমাকেও উৎসাহিত করে। লেখার জন্য অনুপ্রেরণা জাগায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here