শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ২
তাদের দু’বোনের জন্মলগ্ন এক হলে কি হবে, ব্যক্তি হিসেবে দু’জন দু’মেরুর… অরিত্রী মনে মনে ভাবলো, আজ বোন এলে ঠিক ঠিক কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে সে। এ মেয়েটার জন্য শান্তিতে একটা রাত ঘুমোতে পারে না অরিত্রী, অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয় তাকেও। আজকাল তো আবার মাঝে মাঝে নেশাও করে, মাঝরাতে বাবা-মা কে লুকিয়ে তো তখন তাকেই সবটা সামলাতে হয়।
ঘরের দরজায় টোকা দিতেই আতিকুর রহমান মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলেন অরিত্রীকে। ও কাছে যেতেই ওর একটা হাত দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বললেন,
-“অতসীটা তোর মতো সাধারণ হলো না কোনো রে অরিত্রী? মেয়েটার এতো গুণ কেনো হলো?”
বাবার কথায় ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো অরিত্রীর, অতসীকে নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়েও তিনি তার গুণের সুনাম করতে ভুললেন না। তবে মনে মনে খারাপও লাগলো, যখন বাবা-মা অতসীর সুনাম করেন, তার মেধা এবং মননের প্রশংসা করেন তখন অরিত্রীর মনে হয় তার কোনো গুণ নেই, সে অতি সাধারণ। তাকে নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই… ঠিক সে মুহূর্তে তার মনে কিছু করার ইচ্ছে জাগে, এমন কিছু যা করলে তার বাবা-মা গর্ব করে বলবে, “আমাদের অরিত্রীর মতো সোনার টুকরো মেয়েই হয় না!” কবে বলবেন তারা এ কথা, কবে, কবে, কবে…
ওরা দু’বোন জমজ হলেও বাবা-মা দু’জনেরই ছোটবেলা থেকে অতসীর প্রতি দুর্বলতা বেশি। তবে অনেক ভেবে এই বেশি ভালোবাসার পেছনে একটা কট্টর যুক্তি দাঁড় করিয়েছে অরিত্রী। একবার গ্রামে বেড়াতে যাবার পর খেলার সময় অতসী পা পিছলে বাড়ির পেছনের পুকুরটায় পড়ে যায়। যতোক্ষণে ওকে পানি থেকে তোলা হলো ততোক্ষণে ওর অবস্থা গুরুতর, মুমূর্ষু অবস্থ… পরিচিত সবাই ধরে নিলো ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কিন্তু সে যাত্রায় সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও বেঁচে গেলো। এরপর থেকে বাবা-মা ওকে চোখের আড়াল হতে দিতো না, ও একবার কিছু চাইলে মুখ ফুটে দ্বিতীয়বার চাইতে হতো না।
ওদের দু’জনের জন্মক্ষণে পাঁচ মিনিটের তফাত কিন্তু জন্মলগ্ন এক, চেহারা এক, তাই জন্ম থেকে বেশি-কম ভালোবাসার কোনো কারন অরিত্রী পায় নি। তার ধারনা তারা অতসীকে হারাতে হারাতে আবার পেয়েছে বলেই তার প্রতি তাদের আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। এ আকর্ষণ মৃতপ্রায় সন্তানকে ফিরে পাবার মাধ্যমে সৃষ্টি… বাবা-মাকে অরিত্রী কখনোই অতসীকে অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য দোষারোপ করে নি, আজও করে না। যে সন্তানকে তারা প্রায় হারাতে বসেছিলো সে সন্তানের জন্য আলাদা টান থাকাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? তবুও মানব মন তো, কষ্ট হতো, আজও হয়। তার শিশুসুলভ মনটা অতসীর মতো বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটু বেশি মনোযোগ পেতে চায়। একটা সময় ছিলো, যখন অরিত্রীর মনে হতো, সেদিন দূর্ঘটনাটা অতসীর সঙ্গে না ঘটে তার সঙ্গে ঘটলে হয়তো ভালো হতো। আপনজনের অতিরিক্ত ভালোবাসা কে’ই বা পেতে না চায়! সময় কেটে গেছে, শিশুসুলভ মন পরিপক্ক হয়েছে, তবুও থেকে থেকে অরিত্রীর মনে হয়, যদি বাবা-মায়ের তার জন্য গর্ব হয় এমন কিছু করতে পারতো! বাবার ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটলো অরিত্রীর, আতিকুর রহমান হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
-“তোর মা সম্ভবত অমিতের ঘরে আছে, একটু ডেকে দে তো।”
বাবার চেহারাটা বড্ড বেশি শুকনো মনে হলো অরিত্রীর, মানুষটাকে কি ভেতর ভেতর কোনো রোগে ধরলো! অথচ এ শুকনো মুখেও বরাবরের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি লেপ্টে আছে। অরিত্রীর মন চাইছিলো না এ রুগ্ন মানুষটার পাশ ছেড়ে উঠতে তবুও পিতৃআদেশ পালনে উঠে দাঁড়ালো। অমিতের ঘরে গিয়ে দেখলো, মা ওকে পড়াচ্ছেন। অরিত্রী বুঝে না, এতো বড় ছেলেটার পাশে বসে না থাকলে সে পড়তে পারে না কেনো! অরিত্রীকে দেখে মা বললেন,
-“তুই এসেছিস, যাক ভালো হলো। অমিতটাকে একটু পড়া তো। আমি তোর বাবার বুকে-পিঠে রসুন আর সরিষার তেল গরম করে মালিশ করে দেই। আজকাল যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় অসুস্থ হলে তো অতসীটাকে সমস্যায় পড়তে হবে। কাল তো বললো, আজকাল অনেক কাজের চাপ। বাড়ি ফিরতেই কষ্ট হয়ে যায়। এতো কাজের ফাঁকে হাসপাতালে দৌঁড়াতে হলে তো মেয়েটা বিছানায় পড়বে।”
অরিত্রী বেশ বিরক্ত হলো, অতসীকে নিয়ে মায়ের বাড়াবাড়িটা চোখে পড়ার মতো। তবুও নিজেকে সংযত রেখে, ঠোঁটের কোনে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,
-“আপুকে করতে হবে কেনো মা? ও ওর কাজ করুক না। তেমন কোনো প্রয়োজন হলে আমি আর অমিত সবটা সামলে নেব।”
মায়ের মুখটা মলিন হলো, নিরাশ ভঙ্গিতে বললেন,
-“তুই আর কি’ই বা করবি? ওইতো স্কুলে চাকরি করে ক’টা টাকা বেতন পাস, বিপদে-আপদে তো অতসীটাকেই দু’হাতে টাকা ঢালতে হয়। তোর বাবার পেনশনে আর কতোই বা পায়… কতো করে বললাম, ব্যাংকের চাকরিটা কর। কিন্তু না, তোকে তো সমাজ সেবার ভুতে ধরেছে। এমন বোকা হলে সমাজে টিকে থাকবি কি করে আল্লাহ মাবুদ জানেন। হায় খোদা, এ মেয়েকে বুদ্ধি দাও।”
বিলাপ করতে করতে মিনতি রহমান বেরিয়ে গেলেন, অমিত অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“ছোটপু, কেমন লাগে বলতো? বড়পুর টাকায় চলি আমরা? বাড়িটা তো আমাদেরই, তাও দাদুর বানানো। বাড়ি ভাড়া লাগে না, বাজার খরচ আর আমার পড়ার খরচ তো বাবার পেনশনেই হয়ে যায়, তোর খরচ তো তুইই চালাস। আপুর টাকা তো খুব প্রয়োজন ছাড়া লাগেও না। মানে, আমাদের চাইতে হয় না কখনো। আপুই আমাদের জন্য খরচ করে। তবুও মা তোর সঙ্গে এমন করেন কেনো? কি হয় একটা বড় চাকরি না করলে? তুই জানিস, সেদিন আমার বন্ধু রাকিব বলছিলো, ওর মা নাকি তোর অনেক সুনাম করেছে। তুই নাকি খুব ভালো পড়াস, ওর ছোটভাই তো তোর ছাত্র। জানিস আমার বোন ভালো শিক্ষক, এ কথা ভেবে তখন আমার কতো গর্ব হচ্ছিলো?”
একটু থেমে দম নিলো অমিত, তারপর আবার বললো,
-“এতো টাকা দিয়ে কি হবে? মায়ের এতো কিসের আক্ষেপ বুঝি না। আমার আর এসব ভালো লাগে না, মনে হয় বনবাসে চলে যাই।”
ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসলো অরিত্রী, তারপর বললো,
-“এভাবে বলতে হয় না ভাই… মা তো আমার খারাপ চায় না। মা হয়তো ভাবেন যে, আপু এতো বড় বড় লোকজনের সঙ্গে উঠাবসা করছে, যদি আমাদের ভুলে যায়! তাই ওর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলার জন্য আমাকে বড় চাকরি করতে বলে। কিন্তু কি করবো বল, আমার যে এ চাকরিটা বড্ড প্রিয়…”
অমিত মুখ গোমরা করে বললো,
-“মা সবসময় বড়পুর টাকার গর্ব করে, একসময় আমিও অনেক টাকা উপার্জন করবো, তখন তুই আমাকে নিয়ে গর্ব করবি?”
মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায় অরিত্রী। অমিত আবার বলে,
-” জানিস, এখানে বসে বসে কি বলছিলো মা?বলছিলো বড়পুর কেনা ফ্লাটটায় উঠলেই তো বাবার এতো চিন্তা করতে হয় না। গরিবী এলাকাতে থাকে বলেইতো আপুর ফেরা নিয়ে বাবার এতো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। রাত করে ফেরা নাকি অতো বড় ব্যাপার না, এ বাড়িটাই নাকি সব সমস্যার মূল। বাবা নাকি বেকার বাড়াবাড়ি করছে। তুই বল, এসবের কোনো মানে হয়? আমরা কেনো আপুর সুবিধার জন্য এ বাড়িটা ছাড়বো? এ বাড়িটায় আমাদের সবার কতো স্মৃতি!”
শেষ কথাগুলো বলার সময় অমিতের চোখ ছলছল করছিলো, ছেলেটা বাইরে থেকে যতোই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেনো, অরিত্রী জানে তার ভাইটার মন কতো নরম। সে অমিতের চুলগুলো হাত দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,
-“আসলে আপু হলো মায়ের প্রিয় সন্তান। লোকমুখে কতো সুনাম ওর দেখিস না? আমি আর তুই তো খুব সাধারণ, আমাদের নিয়ে তো গর্ব করার কিছু নেই। তাই মা ওকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি করে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তো তার সবচেয়ে দামী জিনিসটাই অন্যকে দেখাতে পছন্দ করে বল, কমদামী জিনিসগুলো তো চার দেয়ালের আড়ালেই থেকে যায় তাই না?”
অমিতকে এক পলকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিত্রী আবার বললো,
-“আরেকটু সহজভাবে বলি, তুই যখন কোনো অনুষ্ঠানে যাস তখন তুই কি করিস? তোর সবচেয়ে ভালো জামাটা বের করে ইস্ত্রী করে তারপর পরে যাস। শুধু তুই না, সব মানুষই এমনটা করে। মায়ের ব্যাপারটাও তেমন, আমাদের তিন ভাই-বোনের মধ্যে আপু সবচেয়ে বেশি সফল। তাই মা আপুকে নিয়ে সবসময় কথা বলেন, গর্ব করেন, মাতামাতি করেন। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, বুঝলি?”
অমিত কি বুঝলো কে জানে, অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“কিন্তু আমার কাছে তুই সেরা ছোটপু, তুই আমার বেস্ট আপু। দেখ, বড়পু আমাকে অনেক কিছু কিনে দেয় ঠিক কিন্তু তোর মতো চুল আঁচড়ে দেয়? কলেজে যাবার সময় শার্টের পকেটে ভাড়া গুঁজে দেয়? রাত জেগে পড়ার সময় আমার পাশে বসে থাকে? আমার মাথা ব্যাথা করবে বলে চা করে দেয়? আমার কখন কি লাগবে তার খেয়াল রাখে? আমার অসুখ হলে একটু পরপর দেখতে আসে? এসবের কিছুই বড়পু করে না, তুই করিস।”
একটু থামে অমিত, তারপর আবার বলে,
-“কে কি ভাবে জানি না, তবে আমার জন্য তুই সেরা… ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার জন্য যে কাজটা মায়ের করা উচিত ছিলো, অনেক সময় তাও তুই করেছিস। বড়পুর মতো হয়তো অনেক গুণ নেই তোর, অনেক টাকা উপার্জনও করিস না, তবে তোর মাঝে যে মমতা আছে তা বড়পুর মধ্যে নেই। আমি হলপ করে বলতে পারি তোর মতো করে বড় আপু কখনো আমায় ভালোবাসে নি, বাবা-মাকে ভালোবাসে নি, আর কখনো ভালোবাসতে পারবেও না…”
অমিতটা বরাবরই অরিত্রীর জন্য পাগল, অরিত্রী আর অতসী যখন কলেজে পড়তো তখন মিনতি রহমানের কোল আলো করে অমিতের জন্ম হয়। অতসী তখন সবে কয়েকটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য ফটোশুটের অফার পেয়েছে, সে দিনরাত নিজের ক্যারিয়ার গড়ায় ব্যস্ত। আর অরিত্রী, সারাদিন পড়াশুনা আর ছোট্ট অমিতকে নিয়ে কেটে যেতো তার দিন। সেদিনের সেই ছোট্ট বাবুটা এখন এইচ.এস.সি. পরিক্ষার্থী, ভাবা যায়! অরিত্রী ভাবে, সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়… এখনো ভাবলে মনে হয়, এইতো কিছুদিন আগে অমিত তার হাত ধরে হাঁটতে শিখছে, আদো আদো বুলিতে তাকে আপ…পু বলে ডাকছে। আহা, কতো মধুর ছিলো সময়টা… আল্লাহ তাকে অমিতের রূপে এতো সুন্দর একজন মানুষ উপহার দিয়েছেন যার জন্য সে সৃষ্টিকর্তার নিকট চিরকৃতজ্ঞ। অরিত্রীর চোখের কোণে নোনা জলরা ভিড় জমায়, চোখের জল লুকাতে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আহা, তার ভাইটা তাকে কতো বোঝে, কতো ভালোবাসে! মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তার ভাইটা যেনো জীবনে মানুষের মতো মানুষ হয়।
চলবে…