শুকতারা পর্ব-১০

0
1316

#শুকতারা (পর্ব-১০)
#হালিমা রহমান

পরনের লুঙ্গিটা গুটিয়ে গভীর মনোযোগে কাজ করছে রনি।মনির ঘরের সামনে ফেলে রাখা নারিকেল গাছের গুড়ির উপর বসে পলিথিনে আরশোলা ভরছে। ময়লা পলিথিনে উল্টো হয়ে পা ছোঁড়াছুড়ি করছে ছয়-সাতটা আরশোলা।খুবই বিশ্রি দৃশ্য। সূচির গা ঘিনঘিন করে।ভুরভুর করে বমি করে রনিকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।অকারণেই নাকে ওড়নার আঁচল চেপে ধরে সূচি। রনির থেকে একটু দূরেই দাঁড়ায়।ছেলেটা খুবই বেয়াদব।ওকে বিশ্বাস নেই।দেখা যাবে খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে সূচির দিকে আরশোলা ছুঁড়ে মারবে। ছেলেটা একটা বেয়াদব। এ হলো মানুষের মাঝের এক বিরল প্রজাতি।আরশোলা ভয় পায় না সূচি।তবে এটা দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। রনির থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় সূচি।উৎসুক গলায় প্রশ্ন করেঃ” কী করবি এগুলো দিয়ে?”

বিরক্ত চোখে তাকায় রনি।কাজের সময় প্রশ্ন-ট্রশ্ন ভালো লাগে না তার।সূচির দিকে একবার তাকিয়ে আবারো কাজে মনোযোগ দেয়।বাড়তি কথা বলার সময় নেই এখন।

“কী রে? কী জিজ্ঞেস করলাম?”

” তেলাপোকার জাদুঘর দিমু।নাম হইব, রনি তেলাপোকা হাউজ।সুন্দর না? পাঁচ টাকা টিকেট। তুমি ক্যাশিয়ার হইবা।আড়াই টাকা আমার, আড়াই টাকা তোমার।ভালো না?”

” থাপড়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদব। ব্রিটিশ একটা।ইংরেজরা চলে গেছে,একটা বংশধর রেখে গেছে ভোলায়।”

খুটখুট করে হাসে রনি।ডান হাতের মুঠোয় আরেকটা আরশোলা নিয়ে ছুঁড়ে মারলো পলিথিনে।

” ঘেড়ের পুকুরে মাছ ধরমু। বরশিতে তেলাপোকা গাথলে মাছ বেশি আসে।ঘেড়ের পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ।একদম তোমার মতো বড়।”

সূচি একটু ভাবে।রনির কাছে এসেছে একটা দরকারে।ওকে দিয়ে একটা কাজ করাবে।কিন্তু ছেলেটা এখন করবে নাকি সন্দেহ।সূচি গলার স্বর নরম করে নেয়।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলেঃ” রনি, মুন্সী বাড়ি থেকে আমাকে কয়েকটা কচুপাতা এনে দিবি?”

” পারুম না।কাম করতাছি।”– রনির কাঠখোট্টা উত্তর।

সূচি বিরক্ত হলেও কিছু বললো না।আরেকবার অনুরোধের সুরে বললোঃ” দে না।তোদের ঘরের পিছনের কচু পাতাগুলো ভালো না।তাই বলছি।মা এখন আমাকেও যেতে দেবে না।এনে দে না ভাই।তুই যা চাইবি তাই দেব।”

” এহ দরকার পরলেই রনি।মুখ দিয়া মধু বাইরাইতাছে।হা কইরা থাকো সূচি আপা।আমি একটা ডিব্বায় তোমার মুখের মধু ভরি।এমনে তো করল্লার রস বাইরায়।”

” দে না রনি।আমি তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করি?”

” না, তুমি সাধু।কী করবা কচুপাতা দিয়া?”

” ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে ভর্তা বানাব।বেশি করে ঝাল দিয়ে।তুই খাবি? যা তোকেও একটু দেব।মা কচুর মুখির টক রান্না করছে।তোকে ওখান থেকেও দেব।”

” ঘুষ দিতাছো? রনি ঘুষ খায় না।”

” এনে দে না রনি।বউচি খেলার সময় তোকে রাজা বানাব।লিলির কালো গরুটার দুধ খেয়েছিস তুই? অনেক মজা।খাবি? আমাকে কচু পাতা এনে দিলে আজকে বিকালেই লিলির কাছ থেকে এক গ্লাস দুধ এনে খাওয়াবো।কাজটা করে দে না ভাই।”

লোভ সামলাতে পারে না রনি। লিলির বাবা একটা নতুন গরু এনেছে।গরুটার প্রতি খুব লোভ রনির।কিন্তু লিলির সাথে ঝগড়া হয়েছে পনেরো দিন। ঝগড়ার জের ধরে রনিও কথা বলে না,লিলিও কথা বলে না। তাই গরুটার কাছেও যায় রনি।দূর থেকেই দেখে।মেয়েটা ছোট হলে কী হবে,রাগ অনেক।

” সত্যি কইতাছো?”

” হ্যাঁ। ”

পলিথিনের মুখ বন্ধ করে লুঙ্গি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায় রনি।ডান হাতে পলিথিনের মুখ ধরে বাম হাত মেলে ধরে সূচির সামনে।আঙুল গুনে গুনে এক এক করে বলেঃ” কচু পাতার ভর্তা,কচুর মুখির টক,লিলির গরুর দুধ আর বৌচি খেলার সময় রাজা।মনে থাকব তো?”

” হ্যাঁ। ”

” আচ্ছা, আইনা দিতাছি। সবসময় বিরক্ত করো।ভাল্লাগে না ঘোড়ার ডিম।”

হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে উঠোন পেরোলো রনি।মনির ঘরের বাইরের চুলা দুটোর পাশেই দাড়িয়াবান্ধার কোর্ট আঁকা। আলেয়া বানুর লাল মুরগীটা বাচ্চাসহ কোর্টের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছে।সূচি হুস হুস করে তাড়িয়ে দিলো।পা দিয়ে মাটি তুলে তুলে দাগগুলো মুছে দিচ্ছিলো মুরগীটা।লাউয়ের মাচার সাথে হালকা করে গা ঠেকিয়ে ছক কষে সূচি।বাবা বাড়িতে নেই।কৃষি অফিস থেকে কি এক আলোচনা সভা ডেকেছে,সেখানেই গেছে।এসব সভায় গেলে বাবার ফিরতে দেরি হয়।কখনো কখনো বিকাল হয়ে যায়।ভূমির বাসায় যাওয়ার এই সুযোগ।আজকে না যেতে পারলে সহজে আবার যেতে পারবে না।সূচি একটু ভাবে।তিনটা বাজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।এক ঘন্টা ভূমির বাড়িতে কাটিয়ে চারটা বাজেই চলে আসবে। আসার সময় রত্নার বাড়িতেও একটু ঢুঁ মারা যাবে।অনেকদিন যাওয়া হয় না।সেই মেলার ঘটনার পর থেকে খুব বেশি বাড়ির বাইরে পা রাখে না সূচি। হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা।হাওয়া বদল বলতেও তো একটা কথা আছে।

” আম্মা,তুমি কী করো?”

দুপুরের খাবার শেষে কলতলায় ভাতের পাতিলা
ধোয়ার জন্য পিঁড়ি পেতে বসেছেন সাহিদা বেগম। মেয়ের কথার বিপরীতে একবার তাকালেন মাত্র।তারপর আবার ছাই-সাবান দিয়ে পাতিল ধোয়ার কাজে লেগে গেলেন।

” ও,আম্মা ”

” তুই দেখছ না কী করি?”

” মুখে বললে কী হয়?”

” তোর মতো সারাদিন ভটভট করতে পারি না আমি।”

সূচি অধৈর্য্য হয়।কামিজে গুটিয়ে মায়ের পাশে পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে।আহ্লাদী সুরে বলেঃ” আম্মা,একটা কথা বলি?”

” কী?”

” একটু রত্নাদের বাসায় যাই? ”

রত্নার নাম শুনতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সাহিদা বেগমের।কপাল কুঁচকে ফেলেন মুহূর্তেই। ধাম করে হাতের পাতিল নিচে ফেলেন।শক্ত গলায় বলেনঃ” রত্নার লগে মিশবি না।খবরদার।”

” এমন করো কেন, আম্মা? একটু যাই? শুধু আজকে যাব।”

” এইখান থেকা যা সূচি।মেজাজ খারাপ করবি না।”

সূচি যায় না। কাজ আদায়ের কৌশল বেশ ভালী জানে সে। মায়ের গা ঘেষে বসে সূচি।সাহিদা বেগমের শাড়ির আঁচল মাটিতে পড়ে ভিজে যাচ্ছিলো,যত্ন করে নিজের হাতে তুলে নেয় সূচি।মায়ের সম্মতি আদায়ের জন্য মনে মনে প্রস্তুত কিরে নিজেকে।

” রত্নার অনেক জ্বর আসছে, আম্মা।”

” তাতে তোর কী? গেরামে ডাক্তার নাই?”

” এটা কোনো কথা? আমি ওর বান্ধবী না? আমি দেখতে না গেলে কে যাবে?”

” মেজাজ খারাপ করবি না সূচি।যা এইখান থেকা।”

” ও আম্মা,একটু যাই? দেড় ঘন্টা থেকেই চলে আসব। আল্লাহর কসম।”

গা ঝাড়া দেন সাহিদা বেগম। বিরক্ত গলায় বলেনঃ” কানের কাছে প্যানপ্যান করবি না। মেলার ঘটনা মনে নাই? রত্নার লগে ড্যাং ড্যাং করার লেগা ওই বাসায় যাবি?”

” ওর জ্বর আসছে, আম্মা।খাট থেকে উঠতেই পারে না।”

” আমি জানি না কিছু।তোর আব্বায় জানে।আমারে আর কিছু জিগাবি না।”— সাহিদা বেগম চরম বিরক্ত।এই মেয়ে কথা শোনার মেয়ে না।এ শাসন-বারণ,ভয়-ডর কিছুই বোঝে না।জলজ্যান্ত বেয়াদব একটা মেয়ে।

” আম্মা,যাই তাহলে। আব্বা আসার আগেই চলে আসব।রত্নার কাছে আমার দুইটা লিপস্টিকও আছে।ওইগুলাও আনা লাগব।যাই? ”

সাহিদা বেগম কোনো কথা বললেন না।বালতি থেকে মগ ভরে পানি নিয়ে ঝমঝম করে পাতিলে উপর ফেললেন।পানি ছিটকে পড়ল সাহিদা বেগমের শাড়িতে,সূচির গায়ে।তিনি যে রেগে আছেন তা বেশ বুঝতে পারছে সূচি।মায়ের রাগকে খুব বেশি একটা পাত্তা দিলো না।ভূমির বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে, তার মানে সূচি যাবে।মিনিট দুয়েক নীরবতা পালন করলো সূচি।
সাহিদা বেগম মেয়ের নীরবতায় খুশি হলেন।মেয়ে বোধহয় মায়ের রাগ বুঝে চুপ মেরে গেছে।ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটার আগেই সূচির কথা শুনে কপালের রগ ফুলে উঠলো তার।

সূচি নীরবতার শেষে মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়লো।প্রসন্ন গলায় বললোঃ” চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ।অনুমতি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,আম্মা।আল্লাহ তোমাকে আমার চুলের পরিমাণ আয়ু দেক।আল্লাহর কসম রত্নাদের বাসায় আজকেই যাব,আর কখনো যাব না।”

মায়ের রাগের পারদটাকে ইচ্ছা করে শত ডিগ্রি বাড়িয়ে দিলো সূচি।মনে মনে হাসতে হাসতে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।

মেয়ের অবাধ্যতায় কেঁপে উঠলো সাহিদা বেগমের ভারী শরীরটা।মেয়েকে কিছুই বললেন না,কারণ বললেও শুনবে না এই মেয়ে।হাত নিশপিশ করছে।মেয়ের গাল দুটোতে সাধ মিটিয়ে ঠাটিয়ে তিন-চারটে চড় মারতে পারলে ভাল হতো। সূচি এতো গোয়ার কেন? এতো বেপরোয়া মানুষ হয়? মেয়েটার রক্তে রক্তে যেন বেয়াদবি বইছে।মনে মনে গালাগালি করেন সাহিদা বেগম।তার মতো অনুগত, বাধ্য মানুষের থেকে এই মেয়ে বেড়িয়েছে,একথা ভাবতেও গা শিরশির করে সাহিদা বেগমের।মমিন শেখ আসুক আজ।সূচির একদিন কি তার একদিন।

_________________________

আনন্দময়ী হাই স্কুলের ক্লাস টেনের দেওয়াল গুলোতে কোনো রুচিবান শৌখিন মানুষ তাকাতে পারবে না। সেই পনেরো-বিশ বছর আগ থেকে এ বছর পর্যন্ত যতগুলো ব্যাচ এসেছে, তাদের প্রেম কাহিনীর নিরব সাক্ষী হয়ে আছে ক্লাসের দেওয়াল গুলো। দেওয়ালের সাদা রঙটা ময়লা হয়ে অদ্ভূত এক রঙে পরিণত হয়েছে।কাঠের দরজাগুলোর রঙ বদলে কাঠ রঙ ও কালো রঙের মিশ্রণে এক বিশ্রি রঙ ধরেছে।দেওয়ালের এমাথা-ওমাথা স্ব-ঘোষিত কবিদের কবিতা ও অনুগল্পের ভার বইছে সেই আদিকাল থেকে।দেওয়াল জুড়ে পেন্সিলে লেখা ছেলে-মেয়েদের নাম,প্রেমের কবিতা,অমুক প্লাস তমুক,ওয়ান ফোর ত্রি,আই লাভ ইউ,ভালবাসি,ত্রিকোনমিতির সূত্র,পিথাগোরাসের সূত্র,ইংরেজির ম্যাচিং,রিয়ারেঞ্জ,কবিগুরু,বিদ্রোহী কবি,পল্লিকবিসহ বাংলা বইয়ের গোটা বিশেক কবিদের জন্মসাল,মৃত্যুসালের ছড়াছড়ি।কখনো কখনো চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মও দেখা যায়।মোট কথা এই ক্লাসের দেওয়াল গুলো কখনো প্রেমপত্র,কখনো নকলের ক্ষেত্র আবার কখনো ড্রয়িং খাতা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।বেঞ্চগুলো ঘষে-মেজে পরিষ্কার করার আগে তাদের অবস্থাও ঠিক দেওয়াল গুলোর মতোই ছিল। স্যারদের বকাবকি,প্রিন্সিপালের ধমক-হুমকি এমনকি টিসির ভয় দেখানোর পরেও ছেলে-মেয়েরা ভালো হয় না। তাদের শত শত সুপ্ত প্রতিভা,কুবুদ্ধির সাক্ষী এই ক্লাসের দেওয়ালগুলো।

এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় এই হিমশীতল ডিসেম্বরেও ক্লাস করতে হচ্ছে। দুপুরের টিফিনের পরে ক্লাসগুলো আর করতেই ইচ্ছা করে না।বসে থাকতে থাকতে ঘুম নেমে আসে দুচোখে।স্যার-ম্যাডামদের লেকচারকে অতি সহজেই মশার ভনভনের সাথে তুলনা করা যায়। হিসাববিজ্ঞানের রমজান স্যার আসছে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মিতালী। কাঠখোট্টা বুড়ো স্যারের ক্লাস করতে ভালো লাগে না একদম।কথায় কথায় ধমক দেয় আর ক্লাস থেকে বের করে দেয়।কখনো কখনো জালিবেত দিয়ে কারুকার্জও করে হাতে।বজ্রকন্ঠের অধিকারী হওয়ায় স্কুল জুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এই রমজান স্যার ” ঠাডা রমজান ” হিসেবে পরিচিত।

” হিস,হিস,হিস, এই মিতালী।এই পল্লবের মিতালী।”

ছেলেদের দিক থেকে সাপের মতো হিস হিস ও পল্লবের নাম কানে আসতেই ফুঁসে উঠলো মিতালী।চোখ পাকিয়ে গলা উঁচিয়ে ছেলেদের সারির দিকে চেয়ে বললোঃ” ওই কে রে? কার এতো সাহস?”

চতুর্থ বেঞ্চে বসা অমল দাঁত বের করে হাসলো।হাতের ইশারায় পল্লবকে দেখিয়ে দিয়ে বললোঃ” আমি মিতা।ভুল বলছি? তোর পাশের দেওয়ালে তাকা। দেখ কি লেখা ওইখানে। ”

মিতালীর পাশেই বসেছিল রুমকি। অমলের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে মিতালীর কাঁধের উপর দিয়ে দেওয়ালে চোখ দেয়।ওই তো দেখা যাচ্ছে লেখাগুলো।কয়েকটা লাইন জোড়ে জোড়ে পড়ে রুমকি।

” রাজার তিন মেয়ে
প্রথমজন গীতালি
পরের জন বর্নালী,
তার পরের জন
পল্লবের বউ মিতালী।”

তার নিচেই বড় বড় অক্ষরে লেখা আরেকটা লাইন।

” বউ হও মিতালী,তোমায় নিয়ে ঘুরে আসব ইতালি।”

জোরে জোরে পড়ছিলো রুমকি।বিশাল রুমে মাত্র বিশজন ছাত্র-ছাত্রী।রুমকির কথার দিকে সবার ধ্যান ছিল। কথার শেষেই হাসির রোল পড়ে গেল পুরো ক্লাসে।হাসলো না শুধু মিতালী।রাগে, উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো।দূর থেকেই পল্লবের দিকে আঙুল তুলে বললোঃ” তোর টেঙরি কাইটা পানিতে ভিজামু বেদ্দপ।তোর বিয়ার বয়স হইছে? কত সাহস! নাক টিপ দিলে দুধ পড়ে আবার ভং-চং করতে আসে আমার সাথে।তোর নামে হেড স্যারের কাছে বিচার দিমু হারামজাদা।”

প্রেয়সীর হুমকির বিপরীতে কিছুই বললো না পল্লব।তবে অমল চুপ থাকলো না।সে পল্লবের বেস্ট ফ্রেন্ড। চুপ করে থাকবে কেন? মিতালীর মতোন অমলও দাঁড়িয়ে পড়লো। গলা উঁচিয়ে বললোঃ” তুই যখন অন্তু স্যাররে আন্টির বাবু ডাকোছ,আমরা কিছু বলি? আমরা কী স্যারের কাছে বিচার দেই? পল্লবের নামে বিচার দিলে আমিও অন্তু স্যাররে বইলা দিমু,তুই স্যারেরে পছন্দ করোছ। স্যারের পিছনে স্যাররে আন্টির বাবু ডাকোছ।বলুম? স্যারের মা তোর আন্টি লাগে? বলদা।”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তুর মুখটা থমথমে হয়ে উঠলো রাগে।এতোক্ষণের সব কথাই কানে গেছে তার।রমজান স্যার আসেননি বলে হিসাববিজ্ঞান ক্লাসটা অন্তুর ভাগ্যে পড়েছিল আজ।দোতলার টিচার্স রুম থেকে টেনের ছেলে-মেয়ের উচ্চস্বর কানে আসতেই দৌড়ে ক্লাসে এসেছিল অন্তু।কিন্তু ছেলে-মেয়েদের তর্কাতর্কি শুনে অন্তুর আর ভিতরে যেতে ইচ্ছা করলো না।কত বড় বেয়াদব এরা! স্যারদের নিয়ে এসব ভাবে? শিক্ষকেরা শ্রদ্ধার বিষয়।কিন্তু এরা তো স্যারদের নিয়ে প্রেম কাহিনী লেখা শুরু করে দিয়েছে। মিতালীকে চেনে অন্তু।অন্তুর হাঁটুর বয়সী মিতালী।অথচ কিসব চিন্তা-ভাবনা! অন্তুর গা ঘিনঘিন করে।মেয়েটাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে।কী শাস্তি দেওয়া যায়? ভাবে অন্তু।জালিবেত দিয়ে দু-হাতে মারবে? নাকি কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে? অথবা আরেকটা কাজ করা যায়।একদম শেষের লো বেঞ্চের উপর দাঁড় করালে কেমন হয়? এটা বেশ ভালো শাস্তি। মেয়েটাও অন্তুর উপর রেগে থাকবে,দূরেও থাকবে।ক্লাসের দিকে পা বাড়ানোর আগেই পা থেমে যায় অন্তুর।ফোন বাজছে।পকেট থেকে ফোন বের করে নজর বুলায় অন্তু।চাচিমা কল করেছে।অন্তু অবাক হয়।এই সময়ে চাচিমা? ক্লাসের ভিতর থেকে ছেলে-মেয়েদের শব্দ ভেসে আসছে।অন্তু তবুও ক্লাসে ঢুকে না। একটু দূরে দাঁড়ায় কথা বলার জন্য।

” আসসালামু আলাইকুম, চাচিমা।”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।ভালো আছো অন্তু?”

” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?”

” হ।কই আছো?”

” স্কুলে চাচি।ক্লাস হয়।”

” ওহ, তাইলে শর্ট-কার্টে কথা শেষ করি।আগামী সোমবারে ফয়সাল আংটি পরাইতে যাইব।তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবা।”

চাচির কথা বুঝলো না অন্তু।অবাক হয়ে প্রশ্ন করলোঃ” আংটি পরাবে মানে?”

” ফয়সালের বিয়া ঠিক হইছে।ওইখানেই।”

” ফয়সালের বিয়ে! ছোট ভাই ফয়সাল!”
ক্লাস থেকে ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে এলো।ফয়সাল চিন্তিত মুখে একবার ক্লাসের দিকে তাকাল।এরা মারামারি করছে নাকি?

” আমি আপনাকে ফ্রি হয়ে কল করছি, চাচিমা। আমার ক্লাস চলছে।”

” আইচ্ছা।”

কল কেটে দিলেও অবাকের রেশ কাটে না অন্তুর।ফয়সাল বিয়ে করছে? কি আশ্চর্য! কতটুকু বয়স ওর? এই তো সেদিন হাফপ্যান্ট পড়ে পশ্চিমের বিলে দৌড়াদৌড়ি করতো। বরিশাল থেক্র বাড়ি ফিরলে অন্তুর পিছু পিছু ঘুরতো হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য।ছোট ভাইয়ের জন্য হাওয়াই মিঠাই নিতে ভুলতো না অন্তু।এ আর কতদিন আগের কথা? অন্তুর কাছে ফয়সাল ছোট।কত আর বয়স? বড়জোর তেইশ-চব্বিশ।এই চব্বিশ বছরের ছেলে কতটুকু মেয়েকে বিয়ে করবে? দুটো পিচ্চি-পাচ্চার বিয়ে দেখতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! চোখের সামনে ছোট ভাইয়ের বিয়ে! দুঃখের বিষয়, ভয়াবহ দুঃখের বিষয়। এই দুঃখে একটানা দুই দিন দরজা-জানলা বন্ধ করে অষ্টপ্রহর শোক পালন করা উচিত। শোক সাগরে ডুবে যাওয়ার আগেই হুশ ফিরলো অন্তুর।ক্লাস টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে আসছে।অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এরা কি ভালো হবে না?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here