#শুকতারা (পর্ব-১২)
#হালিমা রহমান
সকাল থেকেই বাড়িটা সরগরম। মামা শ্বশুর, খালু শ্বশুর এসেছে বাড়িতে। হুমায়রার আনন্দের শেষ নেই।মানুষ দুটো খুব ভালোবাসেন হুমায়রাকে।সালাম দিলেই হাসিমুখে সালামের উত্তর নেন। স্নেহপূর্ণ গলায় প্রশ্ন করেনঃ” ভালো আছো, মা? অনেকদিন তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না। এক কাপ ঘন দুধের চা বানাও তাড়াতাড়ি। ”
হুমায়য়ার চোখ ভিজে আসে।এখন আর এভাবে কেউ প্রশ্ন করে না।মায়া ভেজা গলায় আবদার করে না।ঝটপট করে মাটির চুলায় গরুর দুধ বসায় হুমায়রা।চিনি,চা-পাতি সব নিয়ম করে দুধে মেশায়।পারলে ভিতরের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাটুকুও ঢেলে দিতো।কিন্তু পারে না। ধরনীর মতো সব অনুভূতি লুকিয়ে রাখে ভিতরে।
মেহমান খুব পছন্দ হুমায়রার। অনেক মানুষ দেখলে ভিতরের আনন্দেরা বাঁধনহারা হয়ে উঠে। বাচ্চাদের মতো হৈ-হল্লা করতে ইচ্ছা করে। এ বাড়িতে সব আছে শুধু মানুষেরই অভাব। বিয়ের আগে বিশাল এক যৌথ পরিবারের সদস্য ছিল।বাবা-মা,কাকা-কাকি,দাদা-দাদি,চাচাতো ভাই-বোন মিলে একপাল মানুষ। সকাল কাটতো এক ঘরে,দুপুর কাটতো এক ঘরে,বিকাল-রাত আরেক ঘরে।মিশুক হওয়ায় পরিবারে কদরও ছিল অনেক।দুঃখ-কষ্ট, মন খারাপ, হতাশা, অসহায়ত্ব– এসব বাজে অনুভূতিদের দেখা পায়নি বিয়ের আগে।দশ জোড়া হাত মাথা উপরে ছিল। চোখের পানি মুছে দেওয়ার মতো মানুষের অভাব ছিল না।অন্যায় করে মায়ের কাছে মার খেয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদার মতো আশ্রয় ছিল। বিয়ের আগে হুমায়রার জীবনটা বড্ড রঙিন ছিল।
বহু মনের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকতে শিখেছে হুমায়রা। তাই অনেক মানুষের মাঝে কষ্ট হয় না বরং ওটাই শান্তি লাগে।অনেক মানুষের অনেক সুবিধা। মন খুলে কথা বলার মানুষের অভাব হয় না। কিন্তু এ বাড়িতে এসব কিছুই নেই।বিশাল বাড়ি,বিলাসিতা,প্রাচুর্য, এসব আকর্ষণ করে না হুমায়রাকে।তার সব লোভ মানুষের প্রতি।প্রতিদিন কথা বলার মতো,পাতিলের খাবার ভাগ করে খাওয়ার মতো,অলস বিকালে মাথায় বিলি দেওয়ার মতো যদি একজন মানুষ থাকতো! একটু সঙ্গ দেওয়ার মতো,ঝামেলার দিনে হাতে হাতে কাজ করে দেওয়ার মতো,কথা বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে লুটিয়ে পড়ার মতো, পাটিতে লেপ্টে বসে এক ঝুড়ি গল্প মেলে ধরার মতো যদি একজন মানুষ থাকতো! বেশ হতো তবে।
হুমায়রার এতো বছরের জীবনে একটাই ব্যর্থতা।রোমেলা বানুর সাথে এক ঘরে থাকতে পারেনি।বাড়িতে ফয়সাল বাদে কথা বলার সঙ্গী শুধু একজন।এই একজনের সাথেই মিলেমিশে থাকতে পারলো না। হাঁড়ি আলাদা হলো,ঘর আলাদা হলো,সংসার আলাদা হলো।অবশ্য একে ব্যর্থতা বলতে নারাজ হুমায়রা।এমনি এমনি তো কিছু হয় না।এমনি এমনি কি শান্ত-শিষ্ট মিশুক মেয়েটার একা থাকতে হয়? উঁহু,কারণ আছে।
রোমেলা বানু শাসন করতে পছন্দ করেন।সবকিছুতে নিজের সিদ্ধান্ত ফলাতে ভালোবাসেন।কর্তৃত্বের প্রতি লোভ তার সর্বাঙ্গে মেশানো।ছোট বয়সে পা রেখেছিলেন এ বাড়িতে।বারো বছরের মেয়েটা আর কতটুকুই জানতো? এ বাড়িতে পা রাখার দিন থেকেই ভয়ে থাকতেন। কাজ-কর্মে আনাড়ি রোমেলা বানু বকা-ঝকা কম শোনেননি।কৌশলী আমিরা বেগম পিঠের উপর খুন্তির দাগও দিয়েছেন মাঝে মাঝে। অপটু রোমেলা বানুকে মাঝে মাঝে গোয়াল ঘরের খুঁটির সাথেও গরুর মতো বেঁধে রেখেছেন।ঝাড়ু,খুন্তি,জুতো,কিল,চড় — ছোট্ট রোমেলা কোনোটা থেকেই বাদ যায়নি। স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তখন। কলেরায় যখন গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হলো,রোমেলা বানুর বাবা তখন পটল তুললেন।ছোট ভাই রমিজ ও মায়ের কষ্ট দেখেছেন রোমেলা বানু।একটা সাদা শাড়িতে মাকে বছর কাটাতে দেখেছেন,ক্ষুধার জ্বালায় ছোট ভাইকে কলমি শাক সিদ্ধ করে খেতে দেখেছেন। তাই শ্বাশুড়ির অত্যাচারে মুখ ফুলিয়ে অভিমান করে বাবার বাড়ি যাওয়ার সাহস ছিল না।বাবার বাড়ি যাওয়া মানে আরেকটা বাড়তি পেট, মায়ের চিন্তিত মুখ, ক্ষুধায় কাতর ভাইয়ের চিৎকার। তারচেয়ে লাথি ঝাটা খেয়ে এ বাড়িতে থাকাই ভালো।শ্বাশুড়ি যাই করুক,খেতে তো দেয়।
আগুনে পুড়ে পুড়ে আজ এ প্রান্তে পৌঁছেছেন। ভিতরের খবর সৃষ্টিকর্তা জানেন।তবে উপরের অবয়বটা দেখলেই বুঝা যায় পোড় খাওয়া রোমেলা বানু এখন খুব খিটখিটে, স্বেচ্ছাচারী,কর্তৃত্ববাদী। শ্বাশুড়ি মরার পর প্রথমবারের মতো হাঁফ ছাড়লেন।এতে যে কতখানি স্বস্তি লুকানো ছিল তা স্বয়ং অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানেন না।শ্বাশুড়ির মৃত্যুতে রোমেলা বানু খুশি হলেন। একা সংসারে একা কর্তৃত্ব।ভাঙা-চোরা মাটির ঘরের সম্রাজ্ঞী তিনি।তার নাগাল পাওয়া মুশকিল।স্বামীসহ দুই ছেলে নিয়ে তার ছোট্ট রাজ্য।সেখানে তিনিই সর্বেসর্বা। ছোট সংসারটা এক হাতে সামলান। কাজী আকরাম বউকে ভালোবাসতেন।ছোট বয়সে বউয়ের কষ্ট নিজের চোখে দেখলেও কিছু করার ছিল না।তিনি বউকেও ভালোবাসতেন,মাকেও ভালোবাসতেন।মায়ের মুখের উপর কিছু বলার সাহস তার কোনো কালেই ছিল না।তাই বউ যখ ঘরের রানী,কাজী আকরাম তখন তার মন্ত্রী।বউ যা বলছে তাই ঠিক।মেয়েটারও তো শখ আছে।চলুক ইচ্ছামতো।
স্বামীর প্রশ্রয়ে খুব কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠলেন রোমেলা বানু।সবকিছুতে তার কথাই শেষ কথা।বছর সাত-আট পরে আকরাম মরলো।রোমেলা বানু দু-চারদিন শোক পালন করে শক্ত হয়ে বসলেন। ছেলেদেরকে উড়তে দিলে চলবে না শক্ত হাতে ধরতে হবে।উচ্ছৃঙ্খলতায় ভেসে যাওয়ার আগে খপ করে ধরতে হবে,যথাযথ শাসন করতে হবে।
তার শাসনে কাজ হলো।আফজাল ও ফয়সালের মতো মা ভক্ত, বাধ্য ছেলে সারা গ্রামে আর নেই।কি সুন্দর তাদের আচার ব্যবহার! কি সুন্দর তাদের চাল-চলন! আহা! দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আফজালকে বিয়ে করিয়ে হুমায়রাকে শিষ্যের আসন দিলেন রোমেলা বানু।তার নিয়ম বড় কঠিন।অপটু হুমায়রাকে যোগ্য করে তোলাই তার মূলমন্ত্র। শ্বাশুড়িকে পছন্দ না করলেও তার পথই ধরলেন রোমেলা বানু।তিনি সহ্য করতে পারলে হুমায়রা সহ্য করতে পারবে না কেন? হাজারবার হোঁচট খেয়ে তিনি আজ এখানে এসেছেন,হুমায়রার পথটা সহজ হবে? উঁহু, তা কী করে হয়? ভালোমতো শিক্ষা না দিলে হুমায়রার ধৈর্য্য হবে কী করে?
ঢেঁকিতে চাল পিষলে চালের দশা যেমন হয়,হুমায়রার অবস্থা ঠিক তেমন হলো।ছোট একটা সংসার, চারজন মাত্র মানুষ।তবুও কাজ যেন শেষ হয় না।ফজরের আগে উঠতে হয়।পুব আকাশে একলা শুকতারা যখন নিজ মহিমায় জ্বলজ্বল করে,চোখে এক রাজ্য ঘুম নিয়ে হুমায়রা তখন উঠে পড়ে। শ্বাশুড়ি উঠোনের ময়লা দেখতে পারেন না।ঘুম থেকে উঠেই ময়লায় পা রাখতে পারেন না।হুমায়রা তাই সবাই উঠার আগে উঠোন ঝাট দেয়।গরুগুলোর ক্ষুধা লাগে ভোরে।ক্ষুধা লাগলেই এরা ডাকা শুরু করে।হুমায়রা রাতের শেষেই গোয়ালঘরে ঢুকে।শত শত মশার মাঝে উবু হয়ে ভুসি গোলায়,ভাতের মাড় খেতে দেয়।ঘুমে হাত-পা ভেঙে আসতো।হুমায়রা পশ্চিমের পুকুরের ভাঙা ঘাটে বসে চোখে-মুখে পানি দিয়ে আবার কাজে চলে যেতো।কত কাজ বাকি।রান্না বাকি,সকালের নাস্তা বানানো বাকি,শ্বাশুড়ির জন্য পানি গরম করতে হয়,ক্ষেতে দিনমজুরেরা কাজ করে,তাদের জন্য ভাত রাঁধতে হয়,ভর্তা বানাতে হয়,শরবত করে রাখতে হয়,বাড়ির সবার বাসি কাপড়গুলো প্রতিদিন সাবান দিয়ে ধুতে হয়।সাড়ে সাতটায় হালকা নাস্তা,নয়টায় সকালের ভাত।কাজ করতে করতে হুমায়রার জীবন যায়।
হুমায়রাও মানুষ।কত আর সহ্য হয়? বদ্ধ ঘরে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদেন।এ যেন আরেক রোমেলা।আফজালের কিছু বলার ছিল না।বাবা মরার পর পড়াশোনা হয়নি বেশি।গ্রামের শেষ মাথায় যে বড় কাপড়ের গার্মেন্টসটা আছে, সেখানে সুপারভাইজারের পদে চাকরি করতো।মাসের শেষে বেতনগুলো গুনে গুনে মায়ের হাতে তুলে দিতে হয়।বউটা কষ্ট করে সংসারের জন্য,তাই তার একটু যত্ন নেওয়া উচিত।এ কথা ভাবতে ভাবতে আফজাল দিনদিন শুকিয়ে যায়,কিন্তু এ কথা মাকে বুঝিয়ে বলার সাধ্য নেই।মায়ের কড়া শাসনে বেড়ে উঠা ছেলে চোখ থাকতেও অন্ধ।বউয়ের কষ্টে বুক ফেটে যায়,কিন্তু মুখ ফুটে মাকে কিছু বলার সাহস নেই।হুমায়রারও কষ্ট হয় এই কথা মাকে বুঝিয়ে বলার সাহস নেই।
এভাবেই দিন চলছিলো।হুমায়রা এক হাতে চোখ মুছে আরেক হাতে কাজ করে।একজন সহযোগী,একজন ভালো প্রশিক্ষক, একটু ভালো ব্যবহার — এসব কিছুই ছিল না।স্বামী, সংসারের উপর একদম বিতৃষ্ণা চলে এলো।হুমায়রাও মানুষ।সে উপন্যাসের নায়িকা নয়,সিরিয়ালের কষ্ট সওয়া সুন্দরী বউ নয়। সারাদিন গরুর মতো খাটার পরেও মূল্যায়ন নেই।সারাদিন বকা-ঝকা,তিরস্কার, তাচ্ছিল্য–সব সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না হুমায়রার। স্বামী, সংসারের উপর থেকে ভক্তি উঠে গেল পুরোপুরি। শরীরটাও ভালো যায় না ইদানীং।বেশি কাজ করলেই হাত-পা ভেঙে আসে।মাথা ঘুরায়,তিনবেলা খেতেও পারে না ঠিকমতো।বউয়ের এই দশা চোখে পড়লো রোমেলা বানুর।তিনি নাক-মুখ কুঁচকে বলতেনঃ” সব ফাঁকিবাজি,কাজ না করার ধান্দা।”
হুমায়রা মাথাচারা দিয়ে উঠলো।তার ভিতর-বাহিরে বিদ্রোহী গান।এতো অত্যাচারে আর একদিনও নয়।হুমায়রা ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার আগেই পা আঁটকে গেল একটা খবর শুনে।সে মা হতে যাচ্ছে,ছোট্ট একটা প্রাণ গড়ে উঠছে তার মাঝে।হুমায়রা ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে বসে পড়লো।একদিকে হতাশা,একদিকে আনন্দ। আফজালকে খুব ভালোবাসে মেয়েটা। তাকে ছেড়ে একা একা এই স্বর্গীয় আনন্দ ভোগ করার অধিকার তার নেই,হুমায়রা এমনটাই ভাবতো।
বাবা হওয়ার অনুভূতি বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর।অদৃশ্য একদলা মাংস পিন্ড আগাগোড়া বদলে দিল আফজালকে। নরম শয্যায় শুয়ে থাকা সেই অপূর্ণ বিড়ালছানাকে কল্পনা করতে করতে আফজালের দিন যায়। হুমায়রা ভালো থাকলে বাচ্চাটাও ভালো থাকবে।আফজাল হুমায়রার ছোট-খাটো যত্ন নিতে ভুলে না। আগের মতো ভোর চারটায় উঠতে দেয় না,কাজে যাওয়ার আগে নিজেই পুরো উঠোনটা ঝাট দেয়,ভোরবেলায় গরুর খাবারটা নিজেই দেয়, গোসলের সময় মা-ভাই-বউয়ের কাপড়গুলো নিজেই ধুয়ে দেয়।সংসারের খরচটা মায়ের হাতে দিয়ে কিছু টাকা নিজের কাছেও রেখে দেয়।বাড়ি ফেরার পথে মা-ভাইয়ের জন্য এক কেজি আপেল আনলে বউয়ের জন্য আধা কেজি আনে।ঘুমের আগে মা-ভাইকে দুটো ডিম সিদ্ধ করে দিলে, বউকেও একটা ডিম সিদ্ধ করে দেয়।আফজাল যেন পুরোপুরি আদর্শ স্বামী।
রোমেলা বানুর চোখ টাটায়।এতো আদিখ্যেতা, এতো যত্ন সহ্য হলো না। বউ মানুষের এতো বিলাসিতা থাকবে কেন? হুমায়রা দিনদিন মোটা হচ্ছে,আফজালের যত্নগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো তার চোখে।ছেলের আচরনের কাছে প্রথম বংশধরের আনন্দ হেরে গেল।এক সন্ধ্যায় মায়ের ঘরে ডাক পড়লো আফজালের।মা-ছেলে মুখোমুখি বসা।রোমেলা বানু গোপনীয়তা পছন্দ করেন না।ছেলের সামনে বসে শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেনঃ” তুমি এগুলা কী শুরু করছো?”
” কী করেছি, আম্মা?”
” আশেপাশের মানুষ তোমারে বউ ভাউরা কয়।তুমি কি আমার মান-ইজ্জত রাখবা না?”
” হুমায়রা অসুস্থ আম্মা।ওর কিছু কাজ আমি করে দিলে ক্ষতি কী?”
” চাইর জনের সংসারে কীয়ের কাম?”
” কাজ না থাকলে কি কেউ শখ করে ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে?”
আফজালের চটাং-চটাং উত্তর।যতই মায়ের কড়া শাসনের ছেলে হোক,শরীরে তো পূর্বপুরুষের সাহসী রক্ত বইছে। এগুলো কোথায় যাবে? রোমেলা বানু অবাক হয়ে যান।
” আমি কি তোমার বউরে সাহায্য করি না?”
” তা তো আপনি ভালো জানেন আম্মা।”
” তুমি আর এইসব করবা না।পুকুর ঘাটে বইসা মাইয়া মানুষের কাপড় ধোও,কালি-ঝালির হাঁড়ি-পাতিল ধোও,মাইনষে হাসাহাসি করে।আমরা সমাজ নিয়া বাস করি।এরকম বেহায়াপানা চলব না এইখানে।”
সমাজের কথা শুনে হাসে আফজাল।স্নিগ্ধ গলায় বলেঃ” তাহলে একটা কাজের মানুষ রেখে দেই আম্মা? হুমায়রার কাজ কমবে,আপনিও ঘরে বসে আল্লাহকে ডাকতে পারবেন।”
” কয় টাকার মুরদ তোমার? আবার কাজের বুয়া রাখবা!”
” আমার বেতন কম কিন্তু চাষের টাকাগুলোও আছে।সেগুলো যদি সংসারেই কাজে না লাগে তবে জমি বর্গা দিয়ে লাভ কী? মাস শেষে কত আসে, আম্মা?আপনি চাইলে সংসার চালানোর ভারটা আমাকে দিতে পারেন।দায়িত্বের অমর্যাদা করব না।”
রোমেলা বানু রাগে দিশেহারা হয়ে যান। আফজালের কথায় যেন কর্তৃত্বের রশিতে টান পড়লো।ছেলের এতো সাহস! মুখে মুখে কথা বলার সাহস কোথায় পেল?রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ান রোমেলা বানু।আঙুল নেড়ে আদেশ দেনঃ” তুমি এক্ষন আমার ঘর থেকা বাইরায়া যাইবা।তোমার বউ নিয়া আর একটা রাইতও থাকতে পারবা না এইখানে।”
” আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না আম্মা। আপনিও আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, হুমায়রাও। দুজনকেই আমার লাগবে।হুমায়রার হাত ধরে কেন বেড়িয়ে যাব? হুমায়রা কি আমার সাথে পালিয়ে এসেছিল? আপনিই তো হাতে ধরে এনেছেন।”
” চুপ কর জানোয়ার। আমার ঘর থেকা বাইরায়া যা। তোর লেগা মুখ দেখাইতে পারি না বাইরে। এক্ষন যাবি।”
আফজাল যায় না।ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।মাকে এটা-ওটা বলে বুঝায়।রোমেলা বানু বুঝতে চান না।রাগে দিশেহারা হয়ে পাশের ঘরে ছুটে যান।অসুস্থ হুমায়রার হাত ধরে টেনে উঠোনে আনেন। আফজালও ততোক্ষণে বাইরে বেড়িয়েছে।
” তুই আমার পোলারে তাবিজ করছোছ,আমার কোল খালি হইছে তোর জন্য। আল্লাহ যেন তোর কোলও খালি করে।যেই জানোয়ারের বাচ্চার লেগা আমার পোলায় আমার মুখের উপরে কথা কইছে, ওই জানোয়ারেরে যেন আল্লায় তুইল্লা নেয়।মায়ের অভিশাপ বিফলে যায় না।”
হুমায়রা আঁতকে উঠলেও আফজাল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখ জ্বলে ধিকধিক করে।খোলা আকাশের নিচে বলিষ্ঠ দেহের মাঝে যে কী চলছিল তা বোঝা গেল পরেরদিন।
হুমায়রাকে দু-দিনের জন্য তার বাবার বাড়িতে রেখে এলো।সকাল সকাল মিস্ত্রি নিয়ে এলো বাড়িতে।ঘরের পাশেই গোয়ালঘর ছিল।গরুগুলোকে বাইরের কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়ে পিটিয়ে গোয়ালঘরটাকে ভাঙলো।টিন পিটানোর আওয়াজে ঘুম পালিয়ে গেল রোমেলা বানুর।বাইরে এসে দাঁড়াতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। এ কে? আফজাল! চোখগুলো টকটকে লাল,কপালের রগ ফুলে মোটা হয়ে আছে। মায়ের দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। গোয়ালঘরের নরম চালাগুলো ভেঙে ফেললো একে একে।রোমেলা বানু হায় হায় করে উঠেন।শক্ত গলায় হুঙ্কার দেনঃ” কী করতাছোছ তুই? এতো সাহস!”
” কাজী বাড়ির ছেলে বউ নিয়ে বাইরে থাকবে কেন?এতো জায়গা-জমি দিয়ে কী হবে? আমি কাজী এনায়েতউল্লাহর নাতি।এই জায়গা-জমি সব আমার দাদার।সেখান থেকে বাবা পেয়েছে।এখন বাবা নেই,বংশের মেজ ছেলে হিসেবে এখানে আমারো প্রাপ্য আছে।আমি এখানেই ঘর করব।”
” বাড়াবাড়ি করবি না আফজাল।আল্লাহর গজব পড়ব।”
” আমি ভেবেছিলাম গজবটা কাল রাতে পড়বে।অসুস্থ মেয়েটাকে এই রাতের বেলা কী করে বের করে দিলেন আম্মা? আপনার কলিজায় একটুও টান পড়লো না? যাকে জানোয়ারের বাচ্চা বলেছেন সে আপনার ছেলের সন্তান। মা হয়ে ছেলের কোল খালি হওয়ার অভিশাপ দিলেন কী করে? রুচিতে বাঁধলো না একবারও? আপনার রুচিতে হাজার সালাম।”
আফজাল না এ যেন অন্য কেউ।গলার স্বরে তীব্র বিদ্রোহ। শ্বশুরকে দেখেননি রোমেলা বানু তবে তার কথা শুনেছেন অনেক।অনেক জেদী মানুষ ছিলেন।মুখ দিয়ে একবার যা বেরোতো তাই করতেন। আফজালের অগ্নিমূর্তি মৃত এনায়েতউল্লাহকে মনে করিয়ে দিলো। ভীষণ জেদী এক বলিষ্ঠ পুরুষ।একে থামানোর সাধ্য কার?
পানি এতোটা ঘোলা হবে তা কল্পনাও করতে পারেননি রোমেলা বানু।ছেলের আয়-রোজগার কম,বউ অসুস্থ। এই বাড়ি ছাড়া গতি নেই।ভেবেছিলেন বউকে নিয়ে চার-পাঁচদিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে আবার ঠিকই মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে আসবে। ছেলের মাথা নিচু,বউয়ের মাথা নিচু— প্রতিযোগিতার যুগে এর চাইতে বড় জিত আর কী হতে পারে?
কিন্তু আফজাল এতোটা এলোমেলো করে ফেলবে তা মোটেও বুঝতে পারেননি রোমেলা বানু।ভিতরের ফুলে-ফেঁপে উঠা ক্রোধকে বহু কষ্টে দমিয়ে রাখলেন। আফজালকে থামানো সম্ভব না এখন।ও ন্যায়-অন্যায় বুঝবে না এখন।তাই আর মুখ নাড়লেন না রোমেলা বানু।
দুই দিনের মাঝে ঘর করলো আফজাল।টিন-টুন দিয়ে দুই রুমের ঘর।ছোট্ট একটা বাথরুম, ছোট্ট একটা রান্নাঘর।আফজালের নতুন ঘর দেখে রাগ আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না রোমেলা বানু।সকাল-সন্ধ্যা অভিশাপ দিতেন ছেলে,ছেলের বউ ও অনাগত বংশধরকে।
দিন আসে, দিন যায়।হুমায়রার স্বাস্থ্য দিনদিন আরো খারাপ হয়।আফজাল শুকিয়ে কাঠ।গ্রামে ভালো হাসপাতাল নেই।একটা সরকারি হাসপাতাল আছে নামমাত্র। সেখানে ভালো ডাক্তার বসে না।অপারেশন করতে হলে সেই ভোলা সদরে নিতে হবে।প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টার রাস্তা। আফজালের মাথা খারাপ হয়ে যায় চিন্তায়।চোখের সামনে মা আছে, কিন্তু মা দেখে না।ফয়সালটারও এদিক-ওদিক দৌঁড়ানোর মতো বয়স হয়নি।বড় ভাই শান্ত সস্ত্রীক সিলেট থাকে।বাকি থাকে অন্তু।তার সাথেই রাত-দিন বিস্তর পরামর্শ করে আফজাল।অন্তু অভয় দেয়।শান্ত গলায় বলেঃ” তুমি ভয় পেয়ো না ভাই,সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সব ঠিক হলো না। সেদিন ছিল কালবৈশাখী। দুপুরের দিকে একচোট বাতাস হয়েছে।বিদ্যুতের তার পড়ে রাস্তা বন্ধ।দিন-রাত ঝমঝম বৃষ্টি। প্রকৃতির অশান্ত রূপের চেয়ে আফজালের ঘর আরো অশান্ত। হুমায়রা বিছানার এ মাথা-ও মাথা গড়াচ্ছে।যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে বারবার।শীঘ্রই হাসপাতালে নেওয়া দরকার,অথচ এই দরকারি কাজটাই বন্ধ হয়ে গেল দুর্যোগে।এই দুর্যোগের দিনে বাইরে যাওয়া সম্ভব না। হুমায়রার আর্তচিৎকার রোমেলা বানুর কানে লাগে।শত হলেও রক্ত-মাংসের মানুষ তিনি।সব অহংকার পায়ে মাড়িয়ে ছেলের ঘরে ছুটে এলেন। চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন মেয়েটার জন্য।আনাড়ি ধাত্রীর মতো প্রথম বংশধরকে পৃথিবীর আলো দেখানোর ব্যবস্থা করলেন।
আধা ঘন্টা কাটা মুরগীর মতো দাপাদাপি করার পর এক মৃত ছেলের জন্ম দিলো হুমায়রা। নাড়ী ছেঁড়া ধনকে একপলক দেখার সৌভাগ্য হলো না হুমায়রার।একটুখানিই তো শরীর, এতো ধকল সহ্য হয় না।
” সোনা, আমার সোনা মানিক। আমার আয়ু আমার ছেলেরে দাও, খোদা।আমার মানিকের বদলে আমারে নেও। একটু রক্ষা করো খোদা। আমি মহাপাপী।আমার শাস্তি আমারে দেও,আমার মানিকরে দিও না।আমার সোনা মানিক”–আদরের ধনের মৃতদেহ কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলো আফজাল।রোমেলা বানু দৌঁড়ে আসেন।ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে মৃত নাতিকে কাপড়ে পেঁচিয়ে নেন।
” এমন কইরো না আব্বা।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
আফজাল মায়ের পা জড়িয়ে বসে পড়ে। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো দুই হাতে।
” তোমার অভিশাপ ফিরিয়ে নাও আম্মা। আমার কোলটা সত্যি খালি হয়ে গেল। আমার মানিক, আমার সোনা মানিক..—- দম আঁটকে আসে আফজালের।কথা জড়িয়ে যায়।বহুদিনের স্বপ্নরা আজ মৃত। ওই তো মৃতপ্রায় হুমায়রার পাশেই চোখ বুজে শুয়ে আছে। নিষ্প্রাণ, নিষ্পাপ একটা মানিক; আফজালের সাধের রত্ন।
_______________
চা হয়ে গেছে।হুমায়রা ছাকনিতে চা ছেকে নেয়।রান্নাঘরে বসলে পুকুরের পাশের সারি সারি আম গাছ দেখা যায়।দাদা শ্বশুরের কবরের পাশেই বুকের মানিকটা লুকানো।এক হাত কবরে একটুখানি শরীর।সেই কবে শুইয়ে রেখেছিল সেখানে! প্রথম সন্তান,ভুলতে পারে না হুমায়রা।প্রতিদিন সকালে পরিষ্কার করে।কবরের উপরে একটাও ঝরা পাতা নেই,শেষ ঠিকানাটাও একদম ছিমছাম, সাজানো-গোছানো।সাজানো হবে না কেন? সে হুমায়রার মানিক-রতন,কলিজার টুকরা।মানিকের স্মৃতি ভুলে যাওয়া সহজ নয়।সন্তান হারানোর পর থেকেই হুমায়রা একদম মুষরে গেছে। শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলতো না,ধারে-কাছেও যেতো না। শ্বাশুড়ির অভিশাপগুলো মনে আছে।হুমায়রা কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়।তবুও মায়ের মন।মনের মাঝে তীব্র ব্যাথা হয়,একটা বাজে কাঁটা খচখচ করে।মায়ের অভিশাপ কখনো বিফলে যায়? আম্মা এরকম অভিশাপ না দিলেও পারতো।
চা নিয়ে মৃদু পায়ে শ্বাশুড়ির ঘরে ঢুকে হুমায়রা।মামা শ্বশুর কথা বলতে বলতে হো হো করে হাসছেন।বড়ই রসিক মানুষ তিনি।কথা বলার আগেই হাসেন।হুমায়রাকে দেখে আহ্লাদী গলায় বলেনঃ” বাহ,এতো তাড়াতাড়ি চা হয়ে গেল? তোমার গুণ আছে মা।”
হুমায়রা মৃদু হেসে দুজনকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়।
” গোসল করে সেজেগুজে রেডি হও।দেবরের হবু বউ দেখতে যাবে না?”
হুমায়রা আঁড়চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়।রমিজ মিয়া বুঝতে পারলেন ঘটনা।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেনঃ” বুবু,হুমায়রা যাবে না?”
” মন চাইলে যাইব।”
” এটা আবার কেমন কথা? আমাকে এমন করে বললে আমিও আসতাম না।”
” আচ্ছা,যা যাইবনি। যাও গোসল কইরা রেডি হও।সন্ধ্যার আগে আইতে হইব আবার।রতন ভাই ফোন দিছিলো একটু আগে।”
হুমায়রা চলে গেল।রোমেলা বানু ভাইয়ের সাথে কথা বললেও, তার মনটা খচখচ করে। ফয়সাল এখনো এলো না কেন? ওকেই তো দরকার আজ।ছেলেটা বিয়েতে রাজি না তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।শুধুমাত্র মায়ের ভয়ে সব করছে।রোমেলা বানুর ভয়টা তাই বেশি।তীরে এসে আবার তরী না ডুবে।মান-সম্মান না ডুবিয়ে দেয় ছেলেটা।
ফয়সালের দেরি দেখে ফোন করেন রোমেলা বানু।দুইবার রিং হতেই ফোন ধরে ফয়সাল,রোমেলা বানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
” আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।”
” কই তুই?”
” খামারে।”
” এখনো খামারে কী? তোরে না বলছি বাড়িতে থাকতে।”
” আধা ঘন্টার মাঝেই আসছি।”
” দশ মিনিটের মাঝে আসবি।এক মিনিটও এদিক-ওদিক হইলে খবর আছে।”
খট করে লাইন কেটে দেন রোমেলা বানু।ফয়সাল ফোন পকেটে ঢুকায়।খামারের পুকুরের কাছে পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছে সে।পাশেই ছোট বেলার বন্ধু তপু বসা। নরম ঘাসের উপর লেপ্টে বসে আছে।
” খালাম্মা কী বললো?”
” বাড়ি যাওয়ার কথা।ভালো লাগছে না কিছু।”
” তুই বিয়েতে রাজি না কেন?”
” মেয়ে পছন্দ না।তুই ভূমির বোনকে দেখিসনি?”
” না।”
” বড় বড় দুটো চোখ,একটা বোঁচা নাক, পাতলা পাতলা ঠোঁট আর ময়লা গায়ের রঙ।চুল দেখিনি কখনো।এমন মেয়ে দেখে-শুনে তুই বিয়ে করতি?”
” মনেহয় না।”
” তাহলে বোঝ অবস্থা।”
” কি করবি এখন?”
” পালিয়ে যাব।”
তপু অবাক হয়ে যায়।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” কী করবি?”
” পালিয়ে যাব।আজকে নিশ্চয়ই আঙটি পরানোর পর বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।সব বুঝে-শুনে কাল-পরশু পালিয়ে যাব।আমার কাপড়-চোপড় খাটের নিচে ব্যাগে ভরে রাখা।শেষ রাতেই বেরিয়ে যাব।কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকব।”
” এতো তাড়াতাড়ি কেন?হলুদের দিন পালাতে পারিস।”
” না।বিয়ের দিন পালিয়ে গেলে মেয়েটার বদনাম হবে।আমি তা চাই না।দোষ সূচির নয়,দোষ আম্মার।শুধু শুধু আরেক মেয়ের গায়ে বিয়ে ভাঙার তকমা লাগানোর কোনো মানেই হয় না।”
” এতো তাড়াতাড়ি পালিয়ে কী করবি?”
” আমি না থাকলে তো আগে থেকেই সব বন্ধ থাকবে।মেয়েপক্ষ যখন জানতে পারবে,তখন আর মেয়ে দেবে না নিশ্চয়ই। খরচাপাতিও বেঁচে গেল,বিয়ের ঝামেলাও চুকে গেল। কয়েকদিন পরে আবার আসব। কেঁদে-কেটে আম্মার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব।আমি ছাড়া আম্মার গতি নেই,আম্মা ছাড়াও আমার গতি নেই।আম্মা আমাকে ক্ষমা করবেই।ওই সূচিও ঘাড় থেকে নেমে যাবে।পুরো ঝকঝকা প্ল্যান।বুঝলি?”
হায়রে! এতো ঘৃণা! অসীম ঘৃণার একটুও যদি সূচি জানতে পারতো,তবে হয়তো চিত্রটা আজ ভিন্নরকম হতো।
চলবে…..